দোহারে মান্নান সমর্থকদের হামলায় নিহত তিন
(নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা)
দোহারের হাজারবিঘা গ্রামের মোকসেদ খন্দকারের বাড়িতে ঢুকতেই মসজিদের পাশে
ছোপছোপ রক্তের দাগ। বাড়ির উঠানেও জমাটবাঁধা রক্ত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইটের
টুকরো। কয়েকটি ঘরে হামলার চিহ্ন। বাড়িতে আতঙ্কিত স্বজনদের আহাজারি। ওই
বাড়িটির একটু দূরে মকবুল হোসেন মুন্সীর বাড়িতেও একই মর্মান্তিক দৃশ্য।
বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় রক্তের চিহ্ন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী
সহিংসতায় গতকাল সোমবার সকালে ওই দুটি বাড়িতে নিহত হন মোকসেদ খন্দকার, তার
ছেলে মাসুদ খন্দকার ও মকবুল হোসেন মুন্সী। ওই সহিংসতায় নারীসহ আরও অন্তত ৮
জন আহত হন। আহতদের মধ্যে দু'জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহত ও আহতরা ঢাকা-১
আসনের (দোহার-নবাবগঞ্জ) বিজয়ী প্রার্থী সালমা ইসলামের লাঙ্গল প্রতীকের
সমর্থক। ওই আসনে আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল
মান্নান খানের সমর্থকরা দোহার উপজেলার হাজারবিঘা গ্রামের ওই দুটি বাড়ি
ছাড়াও কয়েকটি বাড়িতে হামলা-ভাংচুর চালায়। পুলিশ হামলাকারীদের মধ্যে তিনজনকে
আটক করেছে।
নিহতদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ, পুলিশের উপস্থিতিতে বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে ওই তিনজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ও আহতরা আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও নির্বাচনে মান্নান খানের বিরোধিতা করায় তাদের ওপর হামলা হয়। নিহত তিনজনের মধ্যে মকবুল হোসেন মুন্সী (৩২) দোহার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি। অন্য নিহত দু'জন হলেন মোকসেদ খন্দকার মুসা (৫৫) এবং তার ছেলে মাসুদ খন্দকার (৩০) কৃষিকাজ করতেন। নিহত মাসুদের ডান হাত, দুই পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। তার বাবা মুসার মাথা, বুক ও পেটে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। মকবুলের মাথা, পেট, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গতকাল দুপুরে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে দোহার থানায় নেওয়া হলে সেখানে স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। বিকেলে তিনজনের লাশ পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহ আলম খন্দকার, সালেহা বেগম, বছিরুননেছা, তার ছেলে মো. সুমন এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন রেজাউল হক মোল্লা, তার ভাই আসলাম মোল্লা, শাহজালাল সরদার ও আনোয়ার খন্দকার। তাদের মধ্যে রেজাউল ও আসলামের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও লাঠি দিয়ে পেটানোর চিহ্ন রয়েছে। ঘটনাস্থল হাজারবিঘা গ্রামসহ পুরো দোহার উপজেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিজয়ী প্রার্থী সালমা ইসলামের সমর্থক ও পরাজিত মান্নান খানের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা থাকায় ওই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাটহল বাড়ানো হয়েছে। বিকেল থেকে হাজারবিঘা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু করায় ওই গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
এদিকে হামলা ও তিনজনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দোহার থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছে সালমা ইসলামের সমর্থকরা। তারা থানার ওসি কামরুল ইসলাম মিঞার উপস্থিতিতে এ হামলা হয়েছে দাবি করে ওসির পদত্যাগ দাবি করে। দোহারের সহিংসতার ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে কয়েকটি টেলিভিশন ও অনলাইন গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে তিনজনের নিহত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
হামলার বিষয়ে পরাজিত প্রার্থী আবদুল মান্নান খান সমকালকে বলেন, মূলত বিলাসপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতির মধ্যকার দ্বন্দ্বের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত তিনজনই আওয়ামী লীগের সমর্থক। এখন অনেকেই তাতে রাজনৈতিক রঙ দিতে চাইছেন। ওই ঘটনার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে তা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। তিনি ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তিও দাবি করেন।
নিহত ও আহতরা লাঙ্গল প্রতীকের সমর্থক দাবি করলেও ওই আসনে লাঙ্গল প্রতীকে বিজয়ী প্রার্থী সালমা ইসলাম দোহারের ঘটনা সম্পর্কে গতকাল কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
যে কারণে হামলা :ঘটনাস্থল হাজারবিঘা গ্রাম ও দোহার উপজেলা সদর ঘুরে জানা গেছে, বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লা দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে নৌকা মার্কার প্রার্থী মান্নান খানের বিপক্ষে অবস্থান নেন। নির্বাচনে এর প্রভাব পড়লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মান্নান সমর্থকরা। নির্বাচনের দিন হাজারবিঘা গ্রামের একটি ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট ছিলেন নিহত মোকসেদ খন্দকার মুসার ছোট ভাই আনোয়ার খন্দকার। এর জের ধরে মান্নান খানের অনুসারী দোহার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বাশার চোকদারের সঙ্গে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি নিহত মকবুল মুন্সীর কথা কাটাকাটি হয়। ওই সময় বাশার চোকদার নির্বাচনের পর তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এছাড়া বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লার সঙ্গে ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হুকুম আলী চোকদারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল। জাতীয় নির্বাচনে ওই দু'জন দুই প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিলে এ দ্বন্দ্ব আরও চরম আকার ধারণ করে। এসব ঘটনার জের ধরেই গতকাল সকালে প্রথমে মকবুল মুন্সীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার বাড়ি ভাংচুর করে পরাজিত প্রার্থী মান্নান খানের অনুসারী বাশার চোকদার ও হুকুম আলী চোকদারের লোকজন। হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান মকবুল মুন্সী। এর পরই হামলা চালানো হয় মোকসেদ খন্দকারের বাড়িতে। লাঙ্গল প্রতীকের নির্বাচনী এজেন্ট আনোয়ার খন্দকারের ওপরও হামলা চালানো হয়।
যেভাবে হামলা :হামলার শিকার বাড়িগুলোর লোকজন ও আশপাশের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সকাল ৯টার দিকে সাবেক পূর্ত প্রতিমন্ত্রী ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল মান্নান খানের অনুসারী বাশার চোকদারের লোকজন ১০-১২টি মোটরসাইকেল নিয়ে হাজারবিঘা এলাকার তোতা মিয়ার বাড়িতে অবস্থান নেয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে রাশেদ চোকদার, বাদশা চোকদার, শের আলী মাতব্বর ও মনু শেখের নেতৃত্বে ওই এলাকায় মান্নান খানের দেড়-দুইশ' লোক রামদা, চাপাতি, ঢাল-সড়কি, হকিস্টিক ও লাঠি নিয়ে প্রথমে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মকবুল মুন্সীর বাড়ি আক্রমণ করে। তারা মকবুল মুন্সীর বাড়িতে ভাংচুর শুরু করলে এতে তিনি বাধা দেন। এ সময় তাকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় শেখ মজর আলী জানান, খবর পেয়ে থানার ওসিসহ ৫-৬ পুলিশ মকবুলের বাড়িতে অবস্থান নেন। ওই বাড়ির অদূরে পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলাকারীরা মোকসেদ খন্দকারের বাড়িতে হামলা চালায়। এর আগে পথে মোকসেদের ভাই আনোয়ার খন্দকারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আনোয়ারকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে। আনোয়ার সালমা ইসলামের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী নিহত মোকসেদের ছোট ভাই দেলোয়ার খন্দকার সমকালকে বলেন, মান্নান খানের সমর্থক দেড়-দুইশ' লোক তাদের পুরো বাড়ি ঘেরাও করে বাড়িতে ভাংচুর শুরু করে। হামলাকারীরা তার বড় ভাই মোকসেদ খন্দকারকে ঘর থেকে টেনে বের করে পেটাতে থাকে। বাঁচার জন্য তার ভাই দৌড়ে বাড়ির সামনে মসজিদের দিকে চলে গেলে সেখানেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ভাইয়ের নিস্তেজ দেহ পড়ে থাকলে তাতেও লাঠি দিয়ে পেটায় হামলাকারীরা। তিনি বলেন, ভাতিজা মাসুদ তার বাবাকে হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তাকেও কোপানো হয়। পুরো ঘটনার সময় দোহার থানা পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কেউ রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেনি।
নিহত মোকসেদ খন্দকারের ছোট ছেলে মানু খন্দকার সমকালকে বলেন, তারা সব সময় নৌকায় ভোট দেন। তবে গত পাঁচ বছরে মান্নান খান তাদের কোনো খোঁজ না নেওয়ায় এবার তারা আলাউদ্দিন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে লাঙ্গল মার্কায় ভোট দেন। এটাই তার বাবা ও ভাইয়ের জন্য কাল হয়েছে।
দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাঙ্গল সমর্থক আলাউদ্দিন মোল্লা সমকালকে জানান, দোহার থানার ওসি সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল মান্নান খানের নিজস্ব লোক। এ ধরনের হামলা হতে পারে বলে ওসিকে আগেই জানানো হয়েছিল। পুলিশের সামনে এমন ঘটনা ঘটলেও কেউ প্রতিরোধ করেনি। তিনি দাবি করেন, মান্নান খানের নিজস্ব লোক ওসির উস্কানিতেই এমন হামলা হয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য :দোহার থানার ওসি কামরুল ইসলাম মিঞা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার করে সমকালকে বলেন, হামলার খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছিলেন। তবে হামলাকারীরা সংখ্যায় বেশি থাকায় পুলিশ তাদের প্রতিহত করতে পারেনি। পরে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হয়। সেখান থেকে হামলায় অংশ নেওয়া আনোয়ার চোকদার, খোকন হোসেন ও তোতা মিয়াকে আটক করা হয়েছে। জড়িত অন্য হামলাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে ঢাকা জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান সমকালকে জানান, অপরাধীরা যত শক্তিশালীই হোক তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
স্বজনদের আহাজারি : দুপুরে দোহার থানায় লাশ নেওয়া হলে সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। মোকসেদ খন্দকারের লাশ জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন মাজেদা খন্দকার নামে এক নারী। তিনি জানান, নিহত মোকসেদ তার বড় ভাই। মাসুদ খন্দকার তার ভাতিজা। তারা সব সময় নৌকায় ভোট দিতেন। এবার লাঙ্গল মার্কায় ভোট দেওয়ায় তাদের হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে প্রতিমন্ত্রী (সাবেক) মান্নানের সমর্থকরা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার দাবি করেন। সেখানেই মোকসেদের ছোট মেয়ে চম্পার কান্নায় যেন চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। তখনও মকবুলের স্ত্রী শারমিনের শরীরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, ৭০-৮০ জন লোক বাড়িতে হামলা চালায়। তিনি দুই সন্তান নিয়ে পালাতে পারলেও স্বামীকে ধাওয়া করে হামলাকারীরা। দিশেহারা মকবুল দৌড়ে পুলিশের একটি গাড়ির সামনে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলেও সেখানেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। স্বামী হত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে শারমিন চিৎকার করে কাঁদছিলেন।
আহতরা যা বললেন : সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সুমন সমকালকে জানান, সকালে তিনি ঘরে বসেছিলেন। এ সময় হঠাৎ অনেক লোকের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পান। এরপরই কয়েকজন ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা হাতে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা সুমনকে কোপাতে ও পেটাতে শুরু করে।
তিনি জানান, স্থানীয় হুকুম আলী চোকদার ও তার লোকেরা এ হামলা চালায়। তারা সুমনের মা বছিরুন্নেসাকেও বেধড়ক পেটায়। মোর্শেদ খন্দকারকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন তার ভাতিজা শাহ আলমও। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি জানান, চাচার চিৎকার শুনে তিনি ঘর থেকে বের হন। হামলাকারীদের ঠেকাতে গেলে তাকেও পেটানো হয়।
তাজ মাহমুদ নামে আহতদের একজন স্বজন জানান, হামলাকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে পিটিয়ে-কুপিয়ে জখম করে। তিনি পরে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
নিহতদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ, পুলিশের উপস্থিতিতে বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে ওই তিনজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ও আহতরা আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও নির্বাচনে মান্নান খানের বিরোধিতা করায় তাদের ওপর হামলা হয়। নিহত তিনজনের মধ্যে মকবুল হোসেন মুন্সী (৩২) দোহার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি। অন্য নিহত দু'জন হলেন মোকসেদ খন্দকার মুসা (৫৫) এবং তার ছেলে মাসুদ খন্দকার (৩০) কৃষিকাজ করতেন। নিহত মাসুদের ডান হাত, দুই পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। তার বাবা মুসার মাথা, বুক ও পেটে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। মকবুলের মাথা, পেট, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গতকাল দুপুরে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে দোহার থানায় নেওয়া হলে সেখানে স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। বিকেলে তিনজনের লাশ পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহ আলম খন্দকার, সালেহা বেগম, বছিরুননেছা, তার ছেলে মো. সুমন এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন রেজাউল হক মোল্লা, তার ভাই আসলাম মোল্লা, শাহজালাল সরদার ও আনোয়ার খন্দকার। তাদের মধ্যে রেজাউল ও আসলামের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও লাঠি দিয়ে পেটানোর চিহ্ন রয়েছে। ঘটনাস্থল হাজারবিঘা গ্রামসহ পুরো দোহার উপজেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিজয়ী প্রার্থী সালমা ইসলামের সমর্থক ও পরাজিত মান্নান খানের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা থাকায় ওই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাটহল বাড়ানো হয়েছে। বিকেল থেকে হাজারবিঘা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু করায় ওই গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
এদিকে হামলা ও তিনজনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দোহার থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছে সালমা ইসলামের সমর্থকরা। তারা থানার ওসি কামরুল ইসলাম মিঞার উপস্থিতিতে এ হামলা হয়েছে দাবি করে ওসির পদত্যাগ দাবি করে। দোহারের সহিংসতার ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে কয়েকটি টেলিভিশন ও অনলাইন গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে তিনজনের নিহত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
হামলার বিষয়ে পরাজিত প্রার্থী আবদুল মান্নান খান সমকালকে বলেন, মূলত বিলাসপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতির মধ্যকার দ্বন্দ্বের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত তিনজনই আওয়ামী লীগের সমর্থক। এখন অনেকেই তাতে রাজনৈতিক রঙ দিতে চাইছেন। ওই ঘটনার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে তা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। তিনি ওই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তিও দাবি করেন।
নিহত ও আহতরা লাঙ্গল প্রতীকের সমর্থক দাবি করলেও ওই আসনে লাঙ্গল প্রতীকে বিজয়ী প্রার্থী সালমা ইসলাম দোহারের ঘটনা সম্পর্কে গতকাল কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
যে কারণে হামলা :ঘটনাস্থল হাজারবিঘা গ্রাম ও দোহার উপজেলা সদর ঘুরে জানা গেছে, বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লা দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে নৌকা মার্কার প্রার্থী মান্নান খানের বিপক্ষে অবস্থান নেন। নির্বাচনে এর প্রভাব পড়লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মান্নান সমর্থকরা। নির্বাচনের দিন হাজারবিঘা গ্রামের একটি ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট ছিলেন নিহত মোকসেদ খন্দকার মুসার ছোট ভাই আনোয়ার খন্দকার। এর জের ধরে মান্নান খানের অনুসারী দোহার উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বাশার চোকদারের সঙ্গে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি নিহত মকবুল মুন্সীর কথা কাটাকাটি হয়। ওই সময় বাশার চোকদার নির্বাচনের পর তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এছাড়া বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লার সঙ্গে ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হুকুম আলী চোকদারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল। জাতীয় নির্বাচনে ওই দু'জন দুই প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিলে এ দ্বন্দ্ব আরও চরম আকার ধারণ করে। এসব ঘটনার জের ধরেই গতকাল সকালে প্রথমে মকবুল মুন্সীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার বাড়ি ভাংচুর করে পরাজিত প্রার্থী মান্নান খানের অনুসারী বাশার চোকদার ও হুকুম আলী চোকদারের লোকজন। হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান মকবুল মুন্সী। এর পরই হামলা চালানো হয় মোকসেদ খন্দকারের বাড়িতে। লাঙ্গল প্রতীকের নির্বাচনী এজেন্ট আনোয়ার খন্দকারের ওপরও হামলা চালানো হয়।
যেভাবে হামলা :হামলার শিকার বাড়িগুলোর লোকজন ও আশপাশের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সকাল ৯টার দিকে সাবেক পূর্ত প্রতিমন্ত্রী ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল মান্নান খানের অনুসারী বাশার চোকদারের লোকজন ১০-১২টি মোটরসাইকেল নিয়ে হাজারবিঘা এলাকার তোতা মিয়ার বাড়িতে অবস্থান নেয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে রাশেদ চোকদার, বাদশা চোকদার, শের আলী মাতব্বর ও মনু শেখের নেতৃত্বে ওই এলাকায় মান্নান খানের দেড়-দুইশ' লোক রামদা, চাপাতি, ঢাল-সড়কি, হকিস্টিক ও লাঠি নিয়ে প্রথমে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মকবুল মুন্সীর বাড়ি আক্রমণ করে। তারা মকবুল মুন্সীর বাড়িতে ভাংচুর শুরু করলে এতে তিনি বাধা দেন। এ সময় তাকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় শেখ মজর আলী জানান, খবর পেয়ে থানার ওসিসহ ৫-৬ পুলিশ মকবুলের বাড়িতে অবস্থান নেন। ওই বাড়ির অদূরে পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলাকারীরা মোকসেদ খন্দকারের বাড়িতে হামলা চালায়। এর আগে পথে মোকসেদের ভাই আনোয়ার খন্দকারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আনোয়ারকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে। আনোয়ার সালমা ইসলামের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী নিহত মোকসেদের ছোট ভাই দেলোয়ার খন্দকার সমকালকে বলেন, মান্নান খানের সমর্থক দেড়-দুইশ' লোক তাদের পুরো বাড়ি ঘেরাও করে বাড়িতে ভাংচুর শুরু করে। হামলাকারীরা তার বড় ভাই মোকসেদ খন্দকারকে ঘর থেকে টেনে বের করে পেটাতে থাকে। বাঁচার জন্য তার ভাই দৌড়ে বাড়ির সামনে মসজিদের দিকে চলে গেলে সেখানেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ভাইয়ের নিস্তেজ দেহ পড়ে থাকলে তাতেও লাঠি দিয়ে পেটায় হামলাকারীরা। তিনি বলেন, ভাতিজা মাসুদ তার বাবাকে হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তাকেও কোপানো হয়। পুরো ঘটনার সময় দোহার থানা পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কেউ রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেনি।
নিহত মোকসেদ খন্দকারের ছোট ছেলে মানু খন্দকার সমকালকে বলেন, তারা সব সময় নৌকায় ভোট দেন। তবে গত পাঁচ বছরে মান্নান খান তাদের কোনো খোঁজ না নেওয়ায় এবার তারা আলাউদ্দিন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে লাঙ্গল মার্কায় ভোট দেন। এটাই তার বাবা ও ভাইয়ের জন্য কাল হয়েছে।
দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাঙ্গল সমর্থক আলাউদ্দিন মোল্লা সমকালকে জানান, দোহার থানার ওসি সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল মান্নান খানের নিজস্ব লোক। এ ধরনের হামলা হতে পারে বলে ওসিকে আগেই জানানো হয়েছিল। পুলিশের সামনে এমন ঘটনা ঘটলেও কেউ প্রতিরোধ করেনি। তিনি দাবি করেন, মান্নান খানের নিজস্ব লোক ওসির উস্কানিতেই এমন হামলা হয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য :দোহার থানার ওসি কামরুল ইসলাম মিঞা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার করে সমকালকে বলেন, হামলার খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছিলেন। তবে হামলাকারীরা সংখ্যায় বেশি থাকায় পুলিশ তাদের প্রতিহত করতে পারেনি। পরে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হয়। সেখান থেকে হামলায় অংশ নেওয়া আনোয়ার চোকদার, খোকন হোসেন ও তোতা মিয়াকে আটক করা হয়েছে। জড়িত অন্য হামলাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে ঢাকা জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান সমকালকে জানান, অপরাধীরা যত শক্তিশালীই হোক তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
স্বজনদের আহাজারি : দুপুরে দোহার থানায় লাশ নেওয়া হলে সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। মোকসেদ খন্দকারের লাশ জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন মাজেদা খন্দকার নামে এক নারী। তিনি জানান, নিহত মোকসেদ তার বড় ভাই। মাসুদ খন্দকার তার ভাতিজা। তারা সব সময় নৌকায় ভোট দিতেন। এবার লাঙ্গল মার্কায় ভোট দেওয়ায় তাদের হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে প্রতিমন্ত্রী (সাবেক) মান্নানের সমর্থকরা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার দাবি করেন। সেখানেই মোকসেদের ছোট মেয়ে চম্পার কান্নায় যেন চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। তখনও মকবুলের স্ত্রী শারমিনের শরীরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, ৭০-৮০ জন লোক বাড়িতে হামলা চালায়। তিনি দুই সন্তান নিয়ে পালাতে পারলেও স্বামীকে ধাওয়া করে হামলাকারীরা। দিশেহারা মকবুল দৌড়ে পুলিশের একটি গাড়ির সামনে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলেও সেখানেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। স্বামী হত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে শারমিন চিৎকার করে কাঁদছিলেন।
আহতরা যা বললেন : সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সুমন সমকালকে জানান, সকালে তিনি ঘরে বসেছিলেন। এ সময় হঠাৎ অনেক লোকের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পান। এরপরই কয়েকজন ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা হাতে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা সুমনকে কোপাতে ও পেটাতে শুরু করে।
তিনি জানান, স্থানীয় হুকুম আলী চোকদার ও তার লোকেরা এ হামলা চালায়। তারা সুমনের মা বছিরুন্নেসাকেও বেধড়ক পেটায়। মোর্শেদ খন্দকারকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন তার ভাতিজা শাহ আলমও। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি জানান, চাচার চিৎকার শুনে তিনি ঘর থেকে বের হন। হামলাকারীদের ঠেকাতে গেলে তাকেও পেটানো হয়।
তাজ মাহমুদ নামে আহতদের একজন স্বজন জানান, হামলাকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে পিটিয়ে-কুপিয়ে জখম করে। তিনি পরে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
No comments