এবার আক্রান্ত দিনাজপুরে সংখ্যালঘুর বাড়ি দোকান ও চট্টগ্রামে ছাত্রাবাস

(ঘরে ফিরেছেন অভয়নগরের নির্যাতিতরা) ভোট দিতে যাওয়ায় দিনাজপুরে একটি গ্রামাঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের অর্ধশতাধিক বাড়িঘর, দোকানপাটে অগি্নসংযোগ, ভাংচুর ও লোকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। এতে ওই এলাকাসহ আশপাশের সংখ্যালঘু পরিবারগুলো রয়েছে ভীষণ আতঙ্কে। অনেকেই নিরাপত্তার অভাবে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। এ ছাড়া চট্টগ্রাম কলেজে সংখ্যালঘু ছাত্রাবাসে হামলা ও ভাংচুর করেছে শিবির ক্যাডাররা। এ সময় ৮-১০ জন ছাত্রকে একটি কক্ষে আধঘণ্টা তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। এদিকে ভোট দিতে যাওয়ায় যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ায় বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডবে ঘরছাড়া পরিবারগুলো বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুর সদর উপজেলার ১নং চেহেলগাজী
ইউনিয়নের একটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রাম কর্ণাই। গত রোববার কর্ণাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গণনার পরপরই নির্বাচনবিরোধীরা ওই গ্রামের বৈদ্যনাথপাড়া, স্কুলপাড়া, তেলিপাড়া, হাজিপাড়া ও প্রিতমপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর আক্রমণ করে। এ সময় ৫/৬ শতাধিক লোক রাজকুমার রায়, দীপক রায়, শিবু রায়, রতন রায়সহ বিভিন্ন বাড়িতে অগি্নসংযোগ, কয়েকটি বাড়ি ও মন্দিরে হামলা, লুটপাট এবং গ্রামের পার্শ্ববর্তী দোকানপাটে হামলা, অগি্নসংযোগ ও লুটপাট করে। লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এ ৫টি পাড়ায় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সাড়ে ৩ ঘণ্টা তাণ্ডবলীলা চালায় তারা। সর্বস্ব হারিয়ে এসব পরিবারের আহাজারিতে গোটা এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঘটনার পর বিষয়টি স্থানীয় থানায় অবহিত করা হলেও কোনো পুলিশ সহযোগিতার জন্য আসেনি। পরে রাতে ঘটনাস্থলে বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা এলে দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে যায়। ওই এলাকার লোকজন নিরাপত্তার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে ভারত ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলে যাচ্ছে।
এলাকার রাজকুমার রায় জানান, এভাবে আমাদের ওপর হামলার ঘটনায় আমরা এখন আতঙ্কিত। তাই আমরা এখান থেকে ভারতে চলে যাচ্ছি। যেখানে আমাদের থাকার কোনো নিরাপত্তা নেই সেখানে আমরা স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে থাকব?
একই কথা বললেন এলাকার বৃদ্ধা ঊর্মিলা। তিনি জানান, ভোট দিয়ে আসার পথে বিকেলে আমাদের পথরোধ করে মারধর করা হয়েছে। এর চেয়ে আমাদের ভারত ভালো। ওই এলাকার দ্বিজেন্দ্রনাথ রায় জানান, '৭১ সালে আমরা ভারতে গিয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতি হয়ে গেছে যে এখানে এখন আর থাকা সম্ভব নয়।
কোতোয়ালি থানার ওসি আলতাফ হোসেন জানান, ঘটনার সময় আমরা নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তবে ঘটনা স্বীকার করে তিনি জানান, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম জানান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি, এটি বড়ই দুঃখজনক।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম কলেজে সংখ্যালঘু ছাত্রাবাসে হামলা ও মোটরসাইকেল ভাংচুর করেছে শিবির ক্যাডাররা। এ সময় ৮-১০ ছাত্রকে একটি কক্ষে আধাঘণ্টা তালাবদ্ধ করেও রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যান্টিনে রান্নাবান্নার কাজ। শিবিরের ক্রমাগত হুমকিতে বেশ কয়েকজন সংখ্যালঘু ছাত্র ছাত্রাবাস ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। গত রোববার রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে। শিবিরের ভয়ে জুয়েল বড়ূয়া, জ্যাকসন, সুমনসহ পাঁচ-ছয়জন ছাত্র ছাত্রাবাস ছেড়ে দিয়েছেন। জ্যাকসনের মোটরসাইকেল ভাংচুর করা হয়েছে বলে কলেজ সূত্রে জানা গেছে। ওই ছাত্রাবাসে ১৮ জন শিক্ষার্থী থাকেন।
গতকাল সোমবার সকালে চট্টগ্রাম কলেজ অধ্যক্ষ শেখর দস্তিদার সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। অধ্যক্ষ চলে আসার পর থেকে ফের রান্নার কাজ শুরু হয়। পরে কলেজ ছাত্রশিবির সভাপতি আবু বক্করসহ নেতাদের ডেকে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য সতর্ক করে দেন।
নওয়াপাড়া (যশোর) প্রতিনিধি জানান, এ যেন শরণার্থী শিবির থেকে বসতবাড়িতে ফেরা। বাড়িতে এসেই লণ্ডভণ্ড কিছু আসবাবপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। নিয়ে গেছে বেঁচে থাকার চালও। বাড়িতে এসেই নিজের সাজানো ঘর দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন দুলাল বিশ্বাসের স্ত্রী রণজিতা বিশ্বাস, তার ৩ মেয়ে ১ ছেলেসহ পরিবারের সবাই। ঘরের সবকিছু নিয়ে গেছে তাণ্ডবকারীরা। পুড়িয়ে দিয়েছে অবশিষ্ট আসবাবপত্র-লেপ-তোষক, জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন মাছ ধরার জালগুলোও। শোকে স্তব্ধ দুলাল বিশ্বাস অজানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত। এ অবস্থা শুধু দুলাল বিশ্বাসের নয়। গতকাল সোমবার সকালে মালোপাড়ায় গিয়ে দুলাল বিশ্বাসের মতো শতাধিক পরিবারে দেখা গেছে কান্নার রোল।
গত রোববার সকাল ১১টার দিকে চাঁপাতলা আলিম মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে ওই এলাকার নূর মোহাম্মদের ছেলে আবদুর রহিমের নেতৃত্বে বোমাবাজি ও ত্রাস সৃষ্টি করে মালোপাড়া এলাকার লোকদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়া হয়। তারপরও তারা ভোটকেন্দ্রে আসায় মালোপাড়া এলাকার বিশ্বনাথ সরকার (৪০), শ্যামল সরকার (৩৭), দেবব্রত সরকার (২৪), মুকুলকে (২৪) ব্যাপক মারধর করা হয়। তাদের অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
মহিলা পরিষদ ও আসকের নিন্দা
যশোরের অভয়নগর, দিনাজপুরসহ কয়েকটি স্থানে ভোট দেওয়ার দায়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের হামলা-ভাংচুরের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল পৃথক বিবৃতিতে সংগঠন দুটি দোষীদের গ্রেফতার ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়।

No comments

Powered by Blogger.