শ্বাসনালি পোড়ার ঝুঁকি বেশি

শ্বাসনালি পোড়ার ঝুঁকি বেশি
ত্বক বা চামড়া মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেই সঙ্গে মুখ ও মুখগহ্বর, নাসিকা ও শ্বাসনালির গতিপথে যে মিউকাস মেমব্রেন আছে, তা-ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শরীর ও শরীরের চামড়ার সঙ্গে কলা ও কলার খোসার তুলনা করলে বোঝা যাবে যে একটি কলাকে তার খোসা খুলে ফেললে যে অবস্থা হয়, মানবদেহের চামড়া, এমনকি শ্বাসনালি পুড়ে গেলেও একই অবস্থা হয়। ত্বকের কারণে প্রতিকূল অবস্থায়ও মানবদেহের অভ্যন্তরীণ সব জৈবিক-রাসায়নিক ও বিপাক-প্রক্রিয়া প্রায় অক্ষুণ্ন থাকে এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রা ঠিক রাখে। যখন এই ত্বক বা শ্বাসনালির মিউকাস মেমব্রেন পুড়ে যায়, তখন দেহের সব প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক জৈবিক ও রাসায়নিক বিপাক-প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় গ্রন্থি, যেমন লিভার, কিডনি, এমনকি সব দেহকোষের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে বার্ন স্ট্রেচ শরীরের সব রাসায়নিক উত্তেজক গ্রন্থির সিক্রেশন আরও দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যায় এবং অতি অল্প সময়ে ওই পোড়া রোগীর সারা শরীর ফুলে-ফেঁপে যায়।
একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ইডিমা ফরমেশন বলে। ইডিমার কারণে বাতাসের মধ্যে থাকা অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহকোষে পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছাতে পারে না বিধায় পোড়া রোগী চিকিৎসায় ভালো বা আবার মন্দও হতে পারে। তার পরও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, স্মোক ইনহলেশন ইনজুরি সব সময়ই শ্বাসনালির চরম ক্ষতির কারণ নয়। রোগীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, পরিমাপ করতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত ওই ব্যক্তির মুখ, মুখগহ্বরের ওপর-নিচ ও শ্বাসনালি কতটুকু ফুলে-ফেঁপে গিয়েছে, ধোঁয়ার তীব্রতা কেমন ছিল, কী পরিমাণ গরম ছিল, তা কতক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বার্ন করেছে, শ্বাস-প্রশ্বাস কতটুকু সীমিত, দম নিতে বা ঢোক গিলতে কতটুকু কষ্ট, নাকের লোম, গলার স্বর পরিবর্তন কেমন, নাকে ঝুল বা কার্বনিয়াস স্পুটাম আছে কি না, এসবই অভিজ্ঞ নিবিড় পরিচর্যাকারী পরখ করতে পারেন। তবে ফাইবার অপটিক ন্যাসোফারেঙ্গোস্কপি করে উপরিউক্ত শ্বাসনালির গতিপথ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। অহেতুক বা অনভিজ্ঞতার কারণে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর জন্য শ্বাসনালিতে টিউব দিলে শ্বাসনালির অত্যন্ত ঢেলিকেট মিউকাস মেমব্রেন, ভোকাল কর্ড, এপিগ্লোটিস, সাবগ্লোটিক, সুপ্রাগ্লোটিক ইত্যাদি জায়গায় আঘাতের কারণে আরও বেশি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় Intubation induced injury ev Ventilator induced injury I Thermal induced injury বলা হয়। তাই পর্যাপ্ত কৃত্রিম শ্বাস প্রদানের প্রয়োজনীয় প্রমাণ ছাড়া শ্বাসনালিতে টিউব দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। শুধু অভিজ্ঞ নিবিড় পরিচর্যাকারী গভীর পর্যবেক্ষণ করে যদি বুঝতে পারেন, ওই শ্বাসনালি পোড়া রোগীর উল্লিখিত লক্ষণগুলো আছে এবং যদি ফাইবার অপটিক ন্যাসোফারেঙ্গোস্কপি করে দেখতে পারেন,
শ্বাসনালির গতিপথ গাঠনিক বিকৃত পরিবর্তন হয়ে রোগী রেসপিরেটর ফেইলরের দিকে যাচ্ছে, কেবল তখনই শ্বাসনালিতে টিউব দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের যান্ত্রিক সাপোর্ট দেওয়ার বিধান আছে। তাই অতীত গবেষণায় বিজ্ঞানী ক্লাক ইট অল প্রমাণ করেছেন, শ্বাসনালি পোড়া রোগীর শতকরা ৫১ ভাগের অধিক ক্ষেত্রে কৃত্রিম শ্বাসের জন্য শ্বাসনালিতে টিউব দেওয়ার দরকার হয় না। অন্যথায়, এই শ্বাসনালির কৃত্রিম শ্বাসের জন্য যান্ত্রিক সাপোর্ট রোগীর অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে। অধ্যাপক ডেমলিং ও চেন শ্বাসনালি পোড়া রোগীর মৃত্যুর বৈজ্ঞানিক রহস্য নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, শ্বাসনালি পোড়া রোগীর প্রথমত শ্বাসনালির গতিপথে অতিরিক্ত রক্তরস জমা হতে থাকে। একে বলে পালমোনারি কনজেশন। তারপর পালমোনারি হাইপার টেনশন, পরবর্তী সময়ে শ্বাসনালির সব গতিপথ সরু হয়ে যায়। এই গতিপথে ধীরে ধীরে ইপিথেলিয়াল স্লাফ, ইপিথেরিয়াল কাস্টস জমা হয়। এ কারণে শ্বাসনালির সিলিয়ারি মুভমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তখন শ্বাসনালির ভেতরের অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা বের হতে পারে না বিধায় জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন ফুসফুসে গিয়েও ইচেঞ্জ হতে পারে না। এ অবস্থায় রোগীর শ্বাসনালির চারপাশের ক্ষতিকারক জীবাণু শ্বাসনালিকে সংক্রমিত করে এবং রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও জটিল হয়ে যায়। এতে মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, প্রায় সব ধরনের ওষুধের কার্যকারিতা সীমিত হয়ে যায়। শরীরের সব স্বাভাবিক জৈবিক রাসায়নিক ও বিপাক-প্রক্রিয়া ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় গ্রন্থিগুলো, যেমন লিভার, কিডনি, এমনকি সব দেহকোষের কার্যকারিতা বিপন্ন হয়। তাই শ্বাসনালি পোড়া রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি শতভাগ বেড়ে যায়।
ডা. মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী: সহকারী অধ্যাপক (অ্যানেসথেসিয়া), বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

No comments

Powered by Blogger.