সহিংসতা ও জামায়াত ছেড়ে আলোচনায় আসুন

সহিংসতা বর্জন ও জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আলোচনায় আসার জন্য বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সময় হলে আলোচনা করেই আগামী নির্বাচন দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতা একুল-ওকুল দু'কুলই হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী গতকাল সোমবার বিকেলে গণভবন প্রাঙ্গণে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এর পর তিনি সাংবাদিকদের বেশ কিছু প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেন। কোনো কোনো প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যে কোনো মূল্যে সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষাই তার সরকারের প্রথম কাজ হবে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বহাল থাকবে। স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারকাজ চলবে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে।
তিনি রোববারের নির্বাচনকে 'গণতন্ত্রের বিজয়' আখ্যা দিয়ে আরও বলেন, জনগণ সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও নাশকতার বিরুদ্ধে শান্তি, সাংবিধানিক ধারা এবং গণতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছে। এ নির্বাচনে বিজয় হয়েছে গণতন্ত্রের এবং পরাজয় হয়েছে গণতন্ত্রবিরোধী ও স্বাধীনতবিরোধী শক্তির।
এর আগে বিকেল ৪টায় গণভবনের একটি সম্মেলন কক্ষে বিদেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার আগ্রহ ব্যক্ত করলেও নিজে সমঝোতার আহ্বান জানাবেন কি-না তা স্পষ্ট করেননি। কী নিয়ে সংলাপ হবে_ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবকিছু নিয়েই আলোচনা হবে। জনগণ না মানলেও তারা তো হরতাল দিয়েই যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগেও বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। তবে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে দশম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার কতদিন থাকবে কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে কি-না_ এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের কথাই বলেছি। ওই নির্বাচন যখন হবে, তখনই এ নিয়ে আলোচনা হবে।
আগামী সরকার জাতীয় ঐকমত্যের তথা সর্বদলীয় সরকার হবে কি-না_ এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা হেসে বলেন, এটি জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করা হবে। সব দলের অংশগ্রহণে সরকার হলে তার আপত্তি নেই। তবে বিরোধী দলও তো লাগবে_ এটাও মনে রাখতে হবে। স্পষ্টতই তিনি জাতীয় পার্টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
'মানুষ শান্তি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চায়' : প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের পর আজ কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, সন্ত্রাস ও সহিংসতার বদলে শান্তি, নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তার বদলে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা, ধ্বংস ও নাশকতার বদলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চান তিনি।
তিনি বলেন, নিরীহ নাগরিকের রক্তে আজ গণতন্ত্র রক্তাক্ত, সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির শিকার বার্ন ইউনিটের অগি্নদগ্ধ মানুষের আর্তনাদ জাতির বিবেককে আজ দংশন করছে। জাতি আজ এর অবসান চায়।
'যতটুকু নির্বাচন হয়েছে, তাতেই খুশি' : বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত এবং সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যা, জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞ, অগি্নসংযোগ, উস্কানি, ত্রাস সৃষ্টি ও বোমাবাজির মাধ্যমে 'নির্বাচন বানচালের সব অপপ্রয়াস' প্রত্যাখ্যান করেই জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ১৮ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে কিছু কেন্দ্রে বিএনপি-জামায়াত সহিংসতা সৃষ্টি করে ভোট বন্ধ করতে পেরেছে। বিএনপি-জামায়াত পুরো নির্বাচনই বানচাল করতে চেয়েছিল। জনগণ যে ভোট দিয়েছে, যতটুকু দিয়েছে, তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। যতটুকু নির্বাচন হয়েছে তাতেই আমি খুশি।
'জঙ্গিবাদে বিশ্বাসীরা নির্বাচনে যায়নি' : শেখ হাসিনা বলেন, যারা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তারাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। যারা জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে তারা নির্বাচনে যায়নি। এ নির্বাচনের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত সোনার বাংলা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে নির্বাচন বর্জনকারী বামপন্থি দলও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কি-না_ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টির যেগুলো ছিল ভালো, পাকা পাকা বামপন্থিদের আমি নিয়ে নিয়েছি। বাকিরা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে করতেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে।
'তিনি দুই কুলই হারিয়েছেন' : সংলাপের জন্য আবার টেলিফোন করবেন কি-না এ মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। বারবার উদ্যোগ নিয়েছি, নিজে বিরোধীদলীয় নেতাকে টেলিফোন করেছি। এখন তার অবস্থা কী হলো? তিনি তো আগামী সংসদে যেতে পারছেন না, বিরোধীদলীয় নেতাও থাকতে পারছেন না। এর পরও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সবার সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি।'
তিনি বলেন, যতক্ষণ জঙ্গিবাদী জামায়াত তাদের ঘাড়ে চেপে থাকবে ততক্ষণ তারা সুষ্ঠু চিন্তা করতে পারবে না। আগে তাদের সঙ্গ ছাড়তে হবে।
জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি-না_ জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাইকোর্ট জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে রায় দিয়েছেন। এ বিষয়ে হাইকোর্টে আরেকটা রিটও বিচারাধীন রয়েছে। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
'এরশাদ তো ভালোই আছেন' : নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার কয়েকদিন পর সিএমএইচে 'আটক' জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি তো গলফ খেলছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন, ভালোই আছেন।
'এর চেয়েও খারাপ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে' : সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ হতে পারে_ এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কী অপরাধ করেছে যে, 'অবরোধ' আরোপ করতে হবে? এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হয়েছে। তার পরও তো সেসব নির্বাচন ও দেশগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশের ভালো চায় না, বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, তারাই চায় এমনটা হোক।
দুর্নীতিবাজরা রেহাই পাবেন না : নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় বেশকিছু মন্ত্রী-এমপির ফুলেফেঁপে ওঠা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, দুর্নীতিবাজরা তার কাছ থেকে রেহাই পাবেন না। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন। তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি বলেন, দেশের পাঁচ কোটি নিম্নবিত্ত মানুষ মধ্যবিত্ত হয়েছে। গড় মাথাপিছু আয় ৬০০ ডলার থেকে এক হাজার ৪৪ ডলার হয়েছে। সবারই আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এ অবস্থায় মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের পরিমাণ বাড়তে পারে।
নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতি কী হবে_ একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রসহ সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়_ এ নীতিতেই অটল থাকবেন।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বেশ কিছুদিন ধরে নিজ বাসভবনে 'অবরুদ্ধ'_ এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীকে কোনো প্রশ্ন করেননি।

No comments

Powered by Blogger.