রাজনীতিবিদরাই আশার শেষ বাণীটি শোনাবেন by ড. মাহবুব উল্লাহ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট যে কত গভীর সেটি বোঝা গেছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে। নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় ২২ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাদের অনেকেই নিহত হয়েছে পুলিশের গুলিতে। দুই শতাধিক নির্বাচন কেন্দ্র ভস্মীভূত হয়েছে। ৫৩৯টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়েছে। এসব পরিসংখ্যান বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্নভাবে পরিবেশিত হয়েছে। তবে বড় ধরনের হেরফের নেই। কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আসেনি। ইইউ, কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। কিছু বিলম্বে হলেও রুশ রাষ্ট্রদূত জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার দেশও পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। নির্বাচনের দু'দিন আগে জানা গেল ভারত ও ভুটান চারজন পর্যবেক্ষক পাঠাবে। তারাও শেষ পর্যন্ত এসেছিলেন কি-না সেটিও সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়নি। আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জাতিসংঘের একটি সক্রিয় উদ্যোগ ছিল। সেই উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত কোনো ফল বয়ে আনেনি। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। ফলে নির্বাচন হয়েছে মূলত মহাজোটের অংশীদার দলগুলোর মধ্যে। এর মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করেছি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির অবস্থান নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি। দেশীয় পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে শোনা যায়নি। ফলে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হয়েছে সে ব্যাপারটি অন্ধকারেই থেকে গেল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হওয়ার আগেই ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়ে গেছে। অর্থাৎ এসব আসনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সংবিধানের স্পিরিট হলো নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ চালাবেন। সেই বিবেচনায় ৫২ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এক কথায়, নির্বাচনটি ছিল একতরফা এবং কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন।
দেশীয় সাংবাদিক, যারা বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্রে সংবাদ সংগ্রহের জন্য উপস্থিত ছিলেন তারা প্রায় একবাক্যে জানিয়েছেন, ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। হয়তো ৫ শতাংশের বেশি নয়। ভোটাররা কেন ব্যাপক সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে এলেন না তার নানাবিধ ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। কেউ বলছেন, শীত ও কুয়াশার কারণে ভোটাররা আসেননি। কেউ বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ভোটাররা উৎসাহিত বোধ করেননি। আবার কেউ বলছেন, নিরাপত্তার অভাববোধ করায় অনেকেই ভোটকেন্দ্রে আসেননি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেও স্বীকার করেছেন, ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছিল।
নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল যখন জানা গেল, তখন কত শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন তা ঠিকভাবে জানা গেল না। তবে বাস্তবতার সঙ্গে বেসরকারি ফলাফলের এই তফাতকে অনেকের দৃষ্টিতে তেলেসমাতি বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছিলেন কোন দল নির্বাচনে এলো বা এলো না সেটা বড় কথা নয়, বিবেচ্য বিষয় হলো কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। তাদের যুক্তি হলো, ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার যদি ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাহলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। তবে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের মাপকাঠি একটু ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিতে সর্বশেষ নির্বাচনে যে দলটি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয় সেই দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। শাসক দল এই মাপকাঠিকে গুরুত্ব দেয়নি। তাদের দৃষ্টি ছিল ভোটাধিকার প্রয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ানোর দিকে। সে কারণেই হয়তো জাল ভোট দেওয়ার অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। একটি প্রধান জাতীয় দৈনিকে প্রথম পাতায় ব্যালট পেপারে সিল মারার ছবিতে দেখা গেছে নির্বাচনী কর্মকর্তারা কতটা সক্রিয়। এসব ছবি যখন আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও প্রচারিত হবে তখন এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আরও তীক্ষষ্ট হবে।
সময় থাকতে নির্বাচন নিয়ে একটি সমঝোতা কেন হলো না, কেন এত প্রাণক্ষয়, কেন জাতীয় অর্থনীতির এত ক্ষতি, সেটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাবে। সংবাদপত্র পড়ে এবং টেলিভিশনে বিদেশি মিডিয়ার সংবাদ থেকে যতদূর বুঝতে পেরেছি তা হলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পাশ্চাত্য শক্তিগোষ্ঠী ও গণচীন সহমত পোষণ করেছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং যখন সংক্ষিপ্ত ঢাকা সফরে এলেন তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসাটাই যথেষ্ট। তিনি প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেননি। ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনকে তার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নিরিখেই বিবেচনা করে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বক্তব্য থেকে জানা গেছে, সুজাতা সিং তাকে জানিয়েছেন, ভারত আশঙ্কা করছে বাংলাদেশের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের এই একদেশদর্শী মনোভাবই শাসক দল আওয়ামী লীগকে বিরোধী জোটের সঙ্গে কোনো প্রকার সমঝোতায় পেঁৗছাতে নিবৃত্ত করেছে কি-না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ভারত বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার শক্তি, সামর্থ্য ও সুযোগের সঙ্গে অন্য কোনো রাষ্ট্রের তুলনা হয় না বললেই চলে। ভারত আওয়ামী লীগকে তার বন্ধু দল বিবেচনা করে। বিএনপি সম্পর্কে ভারত সন্দিগ্ধ। কিন্তু এই সন্দেহের ওপর ভর করে ভারত যে কূটনীতি করল সেটি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কতটা অনুকূল হয়েছে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দু এবং বিশিষ্ট বোদ্ধা সুব্রামানিয়াম সে প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে যে সংঘাত-সহিংসতা হলো তার ফলে বাংলাদেশ পরবর্তী দশটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। উন্নয়নের ধাঁধা হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোথায় পর্যবসিত হলো তা নিয়ে দেশে যাদের ক্ষমতা আছে তাদের মধ্যে দুর্ভাবনার লেশমাত্র আছে কি-না সন্দেহ। আসলে এই নির্বাচনটি নিয়ে কোনো রকম সমঝোতায় পেঁৗছাতে হলে সর্বোৎকৃষ্ট সময় ছিল জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকোর শেষ সফরের সময়। জাতিসংঘের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আপস-মীমাংসা হলে কোনো পক্ষই দাবি করতে পারত না তাদের জয় হয়েছে। কাজেই এ নিয়ে নির্বাচনী পুঁজি করারও সুযোগ থাকত না। এ ছাড়া সংসদ তো এখন জীবিত। নির্বাচনে বিরোধীপক্ষকে আনার জন্য কোনো সাংবিধানিক সংশোধনী করতে হলে সেটাও করা সম্ভব ছিল। এবারকার পরিস্থিতি ১৯৯৬ সালের মতো নয়। সুতরাং একতরফা, একপক্ষীয় নির্বাচনের কলঙ্ক এড়ানো যেত। এর জন্য শাসক দল আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও প্রশংসা পেতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ইগোর কাছে মহৎ চিন্তাগুলো পরাজিত হয়ে যায়।
যত প্রশ্নবিদ্ধই হোক নিয়তির লেখা হিসেবে দশম সংসদ নামের নির্বাচনটি হয়ে গেল। অচিরেই হয়তো নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল নবগঠিত সরকারের সঙ্গে কতটা সহযোগিতা করবে তা অনিশ্চিত থেকে গেল। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান কোনোক্রমেই বহির্বিশ্বের অসহযোগিতার ঝুঁকি ধারণ করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দলের কট্টরপন্থিরা হয়তো বোঝাতে চাইবেন, নির্বাচন যখন করা গেছে তখন সামনের ৫টি বছর এভাবেই চালিয়ে দেওয়া হোক না কেন। কিন্তু এরকম অবস্থান বাংলাদেশকে আরও বড় রকমের হুমকির মধ্যে ঠেলে দেবে। হয়তো দমনপীড়ন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন, দমনপীড়ন সহ্য করার জন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে না দিলে যে গুমোট ভাবের সৃষ্টি হবে তা যে কোনো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দেবে না তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে তিনি দুটি শর্ত দিয়েছেন। জামায়াত দল হিসেবে নিবন্ধন হারিয়েছে। সুতরাং তার নির্বাচন করার সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, সহিংসতা পরিহারের শর্ত তিনি দিয়েছেন। দেশের কোনো মানুষই সহিংসতা চায় না। তবুও অনেকের ঝাপসা স্মৃতিকে উজ্জ্বল করার জন্য বলতে হয়, ১৯৯৫ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল। সেই সমঝোতাকে কেন্দ্র করে তখনকার ক্ষমতাসীন দল বিএনপি দাবি করেছিল আওয়ামী লীগকে কথা দিতে হবে, তারা আর হরতাল-অবরোধ করবে না। কিন্তু সেদিনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা সেই শর্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, আমরা মুচলেকা দিয়ে রাজনীতি করি না এবং এই বলে তিনি তার দল ও মিত্রদের সংসদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে নেন। অতীতমুখী না হওয়াটাই শ্রেয়। এখনও যদি আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকে তাহলে পূর্বশর্তের কথা বলে আলোচনার টেবিলে না বসার অজুহাত সৃষ্টি করা শ্রেয় নয়। আমাদের মতো লোকেরা রাজনীতি করি না। দেশ শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে, এটাই আমাদের কামনা। আশা করি, অনেক হতাশার মধ্যেও রাজনীতিবিদরাই আশার শেষ বাণীটি শোনাবেন।
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.