ভারতীয় আমলা-সাংসদদের হীনম্মন্যতা

আম আদমি পার্টির আন্দোলনের ফলে ভারতের রাজনীতিতে যে নৈতিক মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তা উপেক্ষা করে কংগ্রেসশাসিত দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকের ১৬ জন আইনপ্রণেতার একটি দল সরকারি খরচে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে বেড়াতে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছিল। কিন্তু জনগণের করের টাকায় তাদের এই আনন্দভ্রমণের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ভন্ডুল হয়েছে কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গান্ধীর হস্তক্ষেপে, যিনি রাজস্থান ও দিল্লির নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, যেসব আইনপ্রণেতা এই আনন্দভ্রমণের পেছনে সরকারি অর্থ নষ্ট করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তাঁরা রাজ্যের হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য। অথচ এই কমিটির দায়িত্বই হচ্ছে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ করা। প্রস্তাবিত ওই ভ্রমণে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় দল থেকেই প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁদের এই প্রমোদভ্রমণ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সমালোচনার মুখে বিজেপির সদস্যরা হঠাৎ করে পিছিয়ে যান। আর কংগ্রেসের সদস্যরা গর্তে ঢুকে গেলেন যখন রাহুল গান্ধী বললেন, রাজ্যটির ৬০টি জেলায় যখন খরা চলছে আর দুই শতাধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, তখন ১৬ কোটি রুপি খরচ করে বিদেশে প্রমোদভ্রমণে যাওয়া সরকারি অর্থের বিরাট অপচয়। নিয়মকানুনের দিক থেকে ওই ভ্রমণকে জায়েজ করা হয়েছিল এই বলে যে আইনপ্রণেতারা তাঁদের পাঁচ বছরের মেয়াদকালে সরকারি খরচে দুবার বিদেশভ্রমণে যেতে পারবেন।
অন্য অধিকাংশ রাজ্যের আইনপ্রণেতাদের জন্যও সম্ভবত একই বিধান রয়েছে। খবর বেরিয়েছে, অন্ধ্র প্রদেশের আইনপ্রণেতারা একটি বিদেশ সফরের আয়োজন করছেন। আর ঘরের কাছে আকালি দলের সরকার তাদের আইনপ্রণেতাদের স্কটল্যান্ড পাঠিয়েছে স্কচ হুইস্কি কীভাবে তৈরি করা হয়, তা দেখার জন্য। এ ধরনের সব বিদেশভ্রমণকে বিবেচনা করা হয় শিক্ষা সফর হিসেবে। সফর শেষে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না। আইনপ্রণেতারা কাগজে-কলমে আদৌ কিছু জমা দেন কি না, তা-ও অনুমানের বিষয়। আসলে এগুলো সবই আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য বেতনসহ ছুটি; সরকার মাঝেমধ্যে এসবের আয়োজন করে নিজ দলীয় ও বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে। আর এই সুবিধা দেওয়াটা শুধু আইনপ্রণেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কর্ণাটকের তফসিলি সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘুদের কমিটির সদস্যরাও ১৬ দিনের বিদেশভ্রমণ শেষে সদ্য দেশে ফিরেছেন। তাঁদের ভ্রমণসূচিতে দেখা যায়, সমুদ্রসৈকত, ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্ট, প্রমোদ রিসোর্ট ইত্যাদি জায়গা। বিদেশভ্রমণের প্রতি একই ধরনের তীব্র আকর্ষণ আমি লক্ষ করেছি সংসদ সদস্যদের মধ্যেও। আমি যেহেতু রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হয়েছিলাম, তাই এ ধরনের কোনো সফরে আমি কখনো অন্তর্ভুক্ত হইনি। গণমাধ্যমে লেখালেখির কারণে অপচয় বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি নৈতিকতা কমিটি গঠনের প্রচেষ্টা হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত নিজেদের লোকজনের মধ্যেই ‘শিক্ষাসফরে’ যাওয়ার সুযোগ বণ্টন করত। তাজ্জব বিষয় হলো, বহির্বিশ্বে হিন্দি ভাষার বিস্তার মূল্যায়ন করতে ভাষা কমিটির সদস্যরা প্রতিবছর ইংল্যান্ড ও আমেরিকা সফর করেন। তাঁদের মধ্যে এমন লোকজনও থাকেন, যাঁরা সংসদ সদস্য নন।
আসলে বিদেশভ্রমণের প্রতি আকর্ষণ ভারতের মতো পাকিস্তান আর বাংলাদেশেও প্রবল। ওই দুই দেশেও সংসদ সদস্যরা কোনো না কোনো অজুহাতে বিদেশভ্রমণে যান। এটা দেড় শ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের খোঁয়াড়ি, নাকি বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থহীন টাকা খরচের প্রবণতার অংশ, তা বলা কঠিন। সম্ভবত দুটি অনুমানই সঠিক। কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে নিখরচায় বিদেশভ্রমণ সরকারের তরফ থেকে সেরা ‘ঘুষ’। পশ্চিমা দেশগুলো এটা জানে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনগুলো এভাবে ঘুষ দিয়ে অনেক সুবিধাই আদায় করে থাকে। আমাদের শীর্ষস্থানীয় আমলাদের কাছে বিদেশ থেকে ‘আমন্ত্রণ’ আসে। সরকারের সচিবদের কতজন ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করে, তাঁদের কতজন বিদেশি বৃত্তি নিয়ে গেছে আর কতজন নিজেদের খরচে পড়তে গেছে—এসব তথ্য বের করা গেলে অনেক কিছু জানা যেত। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েদের টিকিট-ভিসা, ভ্রমণের সম্পূর্ণ খরচ, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে দেখভাল করে বিদেশি মিশনগুলো। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের আমলারা বিদেশি মিশনগুলোর যৎসামান্য আদর-আপ্যায়নের জন্যও লালায়িত থাকেন। বিনা মূল্যে অঢেল সুরার ব্যবস্থা থাকে বলে বিদেশি মিশনগুলোর নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের পার্টিতেও আমাদের শীর্ষ আমলাদের উপস্থিতি দেখা যায়। এই লোভ নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছর থেকেই এটা শুরু হয়েছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিদেশি মিশনগুলোর তৃতীয় সচিবদের দেওয়া পার্টিতে ভারত সরকারের সচিবদের যোগ দেওয়ার কথা জানতে খেপে গিয়ে এই মর্মে একটা নির্দেশনা জারি করেছিলেন, ভারত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা শুধু তাঁদের সমমর্যাদার বিদেশি কূটনীতিকদের আমন্ত্রণই গ্রহণ করবেন। যতই দিন গড়িয়েছে, নেহরুর সেই নির্দেশনা লঙ্ঘনের ঘটনা ততই বেড়েছে। আজ আর ওই নির্দেশনার কোনো কার্যকারিতাই নেই। এখন সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত বিদেশি কূটনীতিকদের আতিথ্য প্রার্থনা করেন। নেহরুর মতো প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়েরও একটা নির্দেশনা জারি করা উচিত।
কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের হাতে ভারত সরকার যেভাবে অপদস্ত হলো, তাতে আমি হতাশ। আমাদের কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়েকে হাতকড়া পরিয়ে ক্রিমিনালদের সঙ্গে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারপর জানা গেল, দেবযানীকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তাঁর সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সুরক্ষা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ ঘটনায় আমি অবাক হয়নি, কারণ আমেরিকার ক্ষমতার দম্ভ আমার জানা। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে শুরুতে অন্য রকম মনে হতো, কিন্তু তিনিও এখন আমেরিকান দাম্ভিক প্রশাসনের অংশে পরিণত হয়েছেন। তাঁর প্রতি আমার কোনো আশা বা ভরসা নেই। তাঁর উচিত ছিল অনুতপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে টেলিফোন করা। কারণ এই ঘটনায় ক্ষতি যা হয়েছে, তা আমেরিকার। ভারত অনুভব করতে শুরু করেছিল যে আমেরিকা পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আলাদা। কিন্তু এই ঘটনার পর তাদের সেই অনুভূতি মার খেয়েছে। ওয়াশিংটন ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে পারে আর নয়াদিল্লিও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটির সঙ্গে একই উচ্চতায় থেকে কথা বলতে পারে। কিন্তু এই সম্পর্ক থেকে যাবে নেহাতই সরকারি পর্যায়ে, আনুষ্ঠানিকভাবে। ভারতের জনগণ থেকে যাবে অনেক অনেক দূরে। তাদের কাছে দেবযানীর সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তার সঙ্গে কূটনৈতিক সৌজন্যের কোনো সম্পর্ক আছে বলে ভারতের জনগণ মনে করে না। তাদের কাছে এটা ওয়াশিংটনের দম্ভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, সামান্য সংক্ষেপিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.