আলোচনার জন্য খালেদা প্রস্তুত

বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া গতরাতে বিবিসিকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আলোচনার জন্য তিনি প্রস্তুত। তিনি মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তার বক্তব্যের জবাবেই খালেদা জিয়া এই মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার শর্ত হিসেবে সহিংসতা পরিহার ও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার শর্ত দেন। এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি তাদের রাজনীতির বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে এবং কারও দ্বারা নির্দেশিত হবে না। খালেদা জিয়া বিবিসিকে বলেন, সরকারকে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দলের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। তাদের কার্যালয় খুলে দিতে হবে। তিনি বলেন, তিনি গৃহবন্দি। তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতে হবে। খালেদা জিয়া একই সঙ্গে বলেন, বিএনপি তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে। রোববারের নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচন বলে মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। কোন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন_ এ প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এ সরকারের মেয়াদ আছে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। বাতাসের সঙ্গে তো আর আলোচনা হয় না। কারও না কারও সঙ্গে তো আলোচনা করতে হবে। যারা জোর করে ক্ষমতা নিয়েছে, প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিবিসির প্রশ্ন ছিল, লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে তারেক জিয়া বলেছেন, এ নির্বাচন অবৈধ, অতএব এ সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়, আন্দোলন চলবে_ এ বিষয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা আলোচনা করতে চাই। তবে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দলের সিনিয়র নেতারা জেলে, সারাদেশের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে, আমি বন্দি, আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না, যেতে পারি না। তাহলে কীভাবে আলোচনা করব।
আলোচনা কীভাবে শুরু হতে পারে_ এ বিষয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আমার নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, যারা আত্মগোপনে আছে তাদের স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ করে দিতে হবে।
এ জন্য তো সময় লাগবে_ এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া বলেন, এ জন্য সময় লাগবে কেন। এ জন্য তো সময় লাগার কথা নয়।
বিএনপির কর্মসূচি চলবে কি-না_ এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া বলেন, তাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলছে এবং চলবে।
প্রধানমন্ত্রী আলোচনার জন্য বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলেছেন_ এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা কার সঙ্গে থাকব-না থাকব সেটা আমাদের বিষয়। তার (শেখ হাসিনা) নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কেন চলব।
সমঝোতার জন্য তিন শর্ত
এদিকে এর আগে সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তিন শর্তে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি অবিলম্বে 'প্রহসনের' নির্বাচন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতায় পেঁৗছার আহ্বান জানান। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের তিন ঘণ্টা পর এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। অবশ্য বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি তিনি। বিবৃতিতে বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিএনপিপ্রধান। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের বর্জনের মধ্যে রোববার দশম সংসদ নির্বাচনের পরের দিন খালেদা জিয়া এ বিবৃতি দেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারির কলঙ্কময় প্রহসনের নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা আবারও প্রমাণ হয়েছে। একই সঙ্গে প্রমাণ হয়েছে, নির্দলীয় সরকার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন ছাড়া বাংলাদেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। বিবৃতিতে নির্বাচন বর্জনের জন্য 'গণতন্ত্রপ্রিয়' মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। খালেদা জিয়া দাবি করেন, তাকে কার্যত গৃহবন্দি ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে বিরোধী দল ও জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে সমস্যা ও সংকটের কোনো সুরাহা হবে না। সন্ত্রাসের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা প্রলম্বিত করার অপচেষ্টাতেও শেষ রক্ষা হবে না; বরং তাতে সংকট আরও জটিল, গভীর ও সমাধানের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
একই সঙ্গে খালেদা জিয়া কেন্দ্র থেকে ঘোষিত কর্মসূচি পালন এবং স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমন্বয় করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে দল ও জোটের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। চলমান আন্দোলনকে বেগবান করতে সব রাজনৈতিক দল, শক্তি ও ব্যক্তির প্রতিও আহ্বান জানান বিরোধীদলীয় নেতা। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সব 'মিথ্যাচার ও কারসাজিকে' মোকাবেলা করে তাদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে অটল থাকার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, অবৈধ সরকার দীর্ঘায়িত হবে না ইনশাআল্লাহ।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ভোটারশূন্য এ নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সবার সামনে হাতে-কলমে প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারের প্রতি মানুষের ঘৃণা ও অনাস্থা কত তীব্র। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তাদের মুষ্টিমেয় দোসর ও আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের গণবিরোধী কুকর্মও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
সারাদিন ভোটকেন্দ্রগুলো শূন্য পড়েছিল দাবি করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, কেউ ভোট দিতে আসেনি। বহু ভোটকেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। কোথাও কোথাও দু'চারটা করে ভোট পড়লেও এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল জাল। অথচ ভোটগ্রহণের শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচন কমিশন অভিমুখে ছোটাছুটি ও তৎপরতার পর রাতে লাখ লাখ এবং হাজার হাজার ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়। এতে পুরো প্রহসনটির সামান্যতম বিশ্বাসযোগ্যতাও আর অবশিষ্ট থাকেনি।
খালেদা জিয়া বলেন, গায়ের জোর, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রশক্তির নিষ্ঠুর অপব্যবহার করে এই প্রহসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে পরাজিত এবং গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারকে কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের শাসনক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চাইছে। কতটা নির্লজ্জ হলে তারা এরপরও বলতে পারে যে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে এবং তারা দেশ পরিচালনায় জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে গেছে।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, মানুষের কোনো ভোট বা সম্মতি ছাড়াই আগেই জাতীয় সংসদের ১৫৩টি আসন আওয়ামী লীগ ভাগ-বাটোয়ারা করে সিলেকশন করেছে। বাকি ১৪৭ আসনেও ভোটারদের সমর্থন দূরে থাক, তারা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের হাজিরই করতে পারেনি। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ তাদের এই কারসাজির একতরফা অপপ্রয়াসকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই এ সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার আর কোনো নৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। জনগণের অনুমোদন ছাড়া দেশ পরিচালনার এখতিয়ার কারও থাকে না।
আওয়ামী লীগেরও বিপুলসংখ্যক লোক 'নির্বাচনী প্রহসনে' শরিক হয়নি দাবি করে তাদেরও ধন্যবাদ জানান বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি আশা করেন, তারাও জনগণের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের সঙ্গেই একাত্ম থাকবেন। একই সঙ্গে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি বেআইনি কার্যকলাপ ও হত্যা-নির্যাতন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করুন। জনগণের সঙ্গে থাকুন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দুর্বল জনগোষ্ঠীসহ সব নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
খালেদা জিয়া বলেন, এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতি আমার কিছু বলার আছে। আজ বাংলাদেশে জনগণের সব অধিকার ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম স্তব্ধ। সংবাদমাধ্যম শৃঙ্খলিত।
তিনি দাবি করেন, আগেরবারের আওয়ামী শাসনামলে সৃষ্ট যে জঙ্গিবাদকে আমরা ধর্মপ্রাণ মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কঠোর হাতে দমন করতে পেরেছিলাম, আজ আবারও স্বৈরশাসনের কারণে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। এই স্বৈরব্যবস্থা কেবল বাংলাদেশে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্বস্তি ও স্থিতিকে হুমকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই অবিলম্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবাধ অনুশীলনের পক্ষে বিশ্ববিবেককেও আরও বেশি সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.