সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করে আওয়ামী লীগের নির্বাচন বিজয় by বদরুদ্দীন উমর

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করেছে! ৫ জানুয়ারি সংসদীয় নির্বাচনে তাদের জয়জয়কার হয়ে তারা এখন নতুন 'গণতান্ত্রিক' সরকার গঠনের পথে। আওয়ামী লীগের লোকজন ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতা-বিবৃতি, টক শোতে এই বিজয়ের বার্তা জনগণের কাছে ইতিমধ্যেই পেঁৗছে দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকভাবে পেঁৗছে দেবেন। অন্যদিকে বাস্তব ব্যাপার হলো এই যে, ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে তার থেকে বড় জালিয়াতি এ দেশে তো নয়ই, অন্য কোনো দেশে আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এ এমন নির্বাচন যাতে একটিও ব্যালট পেপার কোনো ভোটের বাক্সে না পড়া সত্ত্বেও ১৫৩টি আসনে ৫ জানুয়ারির আগেই আওয়ামী লীগ তাদের তথাকথিত জোটসঙ্গী দলকে নিয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে! ৫ জানুয়ারি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া যে নির্বাচন হয়েছে, তাতেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দুই-তৃতীয়াংশ আসন তারা অধিকার করেছে। অর্থাৎ সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা করে আরও নতুন সংশোধনী আনার মতো ক্ষমতা এখন তাদের হাতের মুঠোয়!
এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ্য করার মতো তা হলো, এই নির্বাচনে ১৪৭ আসনে যে ভোট পড়েছে তা মোট ভোটসংখ্যার ১৫/২০ শতাংশের বেশি হবে না। এখনও পর্যন্ত এই গণনা কাজ সম্পূর্ণ না হলেও ইতিমধ্যে যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ভোটের চিত্রটি এ রকমই। এখানে আরও কথা আছে। এভাবে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে বিরাট সংখ্যায় হচ্ছে জাল ভোট, যা নির্বাচন কমিশন কর্মচারীদের সহায়তায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা বহু ভোটকেন্দ্রে প্রদান করেছে। এক একজন এভাবে ২০টি পর্যন্ত ভোট দেওয়ার রিপোর্টও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে (ডেইলি স্টার, ৬.১.২০১৪)।
অন্যদিকে আবার যা লক্ষ্য করার বিষয় তা হলো, বিএনপি ও তার গুণ্ডাবাহিনী হিসেবে সক্রিয় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা জ্বালাও-পোড়াও এবং খুন-খারাবির মাধ্যমে চারদিকে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তার ফলে অনেক ভোটারই ইচ্ছা সত্ত্বেও ভোট দিতে পারেননি। বিএনপি কর্তৃক ভোট বর্জনের আহ্বান তাদের দিক থেকে ঠিক আছে। এর জন্য তারা রাজনৈতিক প্রচারও করতে পারে নিজেদের স্টাইল অনুযায়ী। কিন্তু যারা ভোট দিতে চান তাদের জোর করে ভোটদানে বিরত রাখার কোনো অধিকার তাদের নেই। কিন্তু সে অধিকার কোনোভাবেই না থাকা সত্ত্বেও বিএনপি ভোট বর্জনের কর্মসূচি হিসেবে শুধু নিজেরাই ভোট বর্জন করছে তাই নয়, যারা ভোট দিতে চায় তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এমনকি সরাসরি হামলা করে যে সামান্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে সেটাও নষ্ট করেছে। এ ক্ষেত্রে হিন্দুদের ওপর যে আক্রমণ তারা করেছে, এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেক জায়গাতেই তারা হিন্দুদের বাড়িঘর আক্রমণ করে। তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট করে তাদেরকে নির্বাচনের সময় শুধু ভোটদানে বিরত রেখেছে তাই নয়, তাদের মধ্যে নতুন করে এক নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে। ভারত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে যেভাবে সাহায্য-সমর্থন করছে তার সঙ্গে এখানকার হিন্দুদের তো কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে হিন্দুরা শান্তিতেই বসবাস করেন। বাংলাদেশে সবকিছু সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ভারতের থেকে অনেক ভালো। যদিও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অনেক প্রচার-প্রচারণা করে থাকেন। কেউ কেউ নানা ধরনের 'ডকুমেন্টারি' তৈরি করে ভারতে তার প্রদর্শনী করে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন! এসবের মাধ্যমে যে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধিতে তারা অবদান রাখেন, এ বিবেচনার কোনো প্রয়োজন তাদের নেই। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মুখে জামায়াত-শিবির যেভাবে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করছে, তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা বলতে যা বোঝায় তার কোনো সম্পর্ক নেই। এদের আক্রমণের মুখে হিন্দুরা অনেকে ভোটদানে বিরত থেকেছেন, এটা ঠিক। কিন্তু আবার অনেক হিন্দু ভোটার আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে অনীহার কারণে যে ভোটকেন্দ্রে যাননি, এটাও ঠিক। অতীতে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এ কারণেই আওয়ামী লীগের প্রতিও তাদের বিশেষ কোনো মোহ নেই (ডেইলি স্টার, ৬.১.২০১৪)। এ প্রসঙ্গে এটা লক্ষ্য করা দরকার যে, কক্সবাজারে বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণ থেকে নিয়ে অনেক জায়গায় হিন্দুদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তার কোনো ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সরকার কোনো তদন্ত করেনি। ঢালাওভাবে তারা বিরোধীদের ওপর দোষ চাপিয়ে বসে আছে। কিন্তু বাস্তবত এসব আক্রমণের বিষয়ে কোনো তদন্ত না করার কারণ আওয়ামী লীগের লোকজনও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, জমিজমা, সম্পত্তি লুটপাট ও দখলের উদ্দেশ্যে তাদের ওপর হামলা করেছে। সম্প্রতি পাবনায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এলাকায় আওয়ামী লীগের লোকদের প্রকাশ্যে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ এবং তারপর মন্ত্রীর নেতৃত্বে শান্তি মিছিলের অগ্রভাগে তাদের থাকার যে সচিত্র রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটাও এদিক দিয়ে চোখ খুলে দেওয়ার মতো ব্যাপার।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলা দরকার যে, এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীদের মুখপাত্ররা যা বলছেন ও করছেন, তার মধ্যে গণতান্ত্রিক অথবা প্রশংসার যোগ্য কিছু নেই। জামায়াত-শিবির দ্বারা সৃষ্ট আতঙ্ক এবং ঘন কুয়াশার কথা বলে নির্বাচনে সাধারণভাবে ভোটারদের অনুপস্থিতির যে ব্যাখ্যা তারা দিচ্ছেন এবং একই সঙ্গে 'ব্যাপকভাবে' ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে কথা তারা বলছেন, এর থেকে বড় মিথ্যাচার আর কী হতে পারে? এই প্রতিনিধিরা চোখ বড় বড় করে ও মারমুখী হয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে যেসব কথা বলছেন, তার মধ্যে তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্রের পরিবর্তে ফ্যাসিষ্ট চরিত্রেরই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। কীভাবে এ ধরনের কথা বলতে হয় সেটা হিটলার ও মুসোলিনি ভালোভাবে শিখিয়ে দিয়ে গেছে। এটা সবারই জানা যে, মিথ্যাচার ও চরম মিথ্যাচার ফ্যাসিস্ট আচরণের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আসলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন এবং তার আগে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ জোট যে সরকার গঠন করবে, সেটা যতই সাংবিধানিক আইনসম্মত হোক, এর দ্বারা গণতন্ত্রের কোনো বিজয় হয়নি। উপরন্তু সংবিধানের পবিত্রতা নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকেরা অহরহ অনেক গালভরা কথা কারণে-অকারণে বললেও সংবিধানকে জনস্বার্থের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করে তারা এর পবিত্রতা বলতে যা বোঝান, সেটা নিজেরাই নষ্ট করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যাই ঘটুক, এসব নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ ও মাথাব্যথা নেই। তারা ক্ষমতার নেশায় আচ্ছন্ন থেকে বেপরোয়াভাবে দেশে যে সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, এর পরিণতি কী দাঁড়াবে সেটাই এখন জনগণের এক গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়।
সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.