সাভারে ভবনধস তবু জীবনের পথে পা by গোলাম মর্তুজা
সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন
কেন্দ্রে (সিআরপি) দেখা মিলল সাদ্দাম হোসেনের (২৮)। ডান হাতটা কনুইয়ের
নিচে থেকে নেই। কাটা জায়গাটা শুকিয়ে গেছে। তবে ডান পায়ে এখনো ব্যান্ডেজ।
বালিশের ওপরে একটা বই খুলে রাখা। স্নাতকোত্তর পরীক্ষার
প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে বাড়ি সাদ্দামের। দরিদ্র
পরিবারের ছেলে হলেও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা ছিল।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করে টঙ্গী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগে স্নাতকে
(সম্মান) ভর্তি হন। স্নাতক শেষ করে একই কলেজে করছেন স্নাতকোত্তর। এর মাঝেই
পেয়ে যান একটি চাকরি। গত ১ এপ্রিল থেকে মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে একটি
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাভার এলাকায় বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন।
রানা প্লাজার পাশে তিনতলা ভবনে ছিল তাঁর অফিস। গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা
ধসে পড়লে তিনতলা এ ভবনটিও গুঁড়িয়ে যায়। সাদ্দাম চাপা পড়েন তার
নিচে।সাদ্দাম হোসেন বলেন, ২৪ এপ্রিল সকালে রোজকার মতো অফিসে হাজির হন।
সেখানে সব মিলিয়ে ২৩ জন ছিলেন। নয়টা বাজার কিছু আগে হঠাৎ ভবনটা কেঁপে
উঠল। তাঁরা ভাবলেন ভূমিকম্প। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ভবনটি ভেঙে পড়ে।
তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যান।সাদ্দাম জানান, তাঁর দুই পা ও ডান হাত
কংক্রিটের নিচ চাপা পড়ে। তিনি নিজে বাঁ পা’টা মুক্ত করেন, উদ্ধারকর্মীরা
ডান পা’টা বের করে আনেন। উদ্ধারকারীরা যখন তাঁকে টেনে বের করার চেষ্টা
করছেন, তখন ডান হাতটাও আটকে ছিল। উদ্ধার পাওয়ার পর সারা শরীরে প্রচণ্ড
যন্ত্রণার পরও বেঁচে থাকাটাকে ভাগ্য বলে মনে করেন সাদ্দাম হোসেন। কিন্তু
পঙ্গু হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর যখন প্রথমবারের মতো দেখলেন ডান হাতটা
নেই, তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলেন না। বললেন, ‘হাতের অবস্থা দেখে
একেবারেই ভেঙে পড়ি।’ কিন্তু আবার জীবনের পথে পা বাড়িয়েছেন সাদ্দাম। ২২
জুন থেকে শুরু হওয়া স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। একজন তাঁর হয়ে
খাতায় লিখেছেন, পাশে বসে বলেছেন সাদ্দাম। ইতিমধ্যে চারটি পরীক্ষা শেষ
হয়েছে। ৫ আগস্ট সর্বশেষ লিখিত পরীক্ষা। বন্ধুদের সহায়তায় সিআরপি থেকে
গিয়ে টঙ্গীতে থাকেন তিনি। সেখান থেকে গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম কলেজে
পরীক্ষা কেন্দ্রেও যান বন্ধুদের সহায়তায়।
সাদ্দামের মা শামসুন্নাহার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরেই থাকেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর তিন ছেলের মধ্যে সাদ্দাম দ্বিতীয়। গত বছর রোজার ঈদের পরে সাদ্দামের বাবা আবদুস সালাম মারা যান। এর পর থেকে তাঁদের পরিবার অর্থকষ্টে পড়ে। তিনি আশুলিয়া এলাকায় কর্মরত তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। শামসুন্নাহার জানান, সাদ্দাম পড়াশোনার মাঝখানে চাকরি খুঁজতে শুরু করেন। এপ্রিল মাসে তাঁর চাকরিটা হয়। এর পরই কেঁদে ফেলেন এই মা। বলেন, ‘সবাই যেন আমার পোলাডার জন্য দোয়া করে। আপনারা সবাই ওরে দেইখেন। ও একদম অসহায় হইয়া গেছে।’
প্রাপ্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখনো ৮০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে সিআরপিতে ভর্তি আছেন ৫৭ জন। ১৫ জন ভর্তি আছেন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্র পঙ্গু হাসপাতালে। বাকিরা বিভিন্ন হাসপাতালে আছেন।
রানা প্লাজা ধসে ৩৬ জন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন ও হাত-পা কাটা পড়েছে। তাঁদের মধ্যে ২২ জনের পা ও ১১ জনের হাত কাটা পড়েছে।
সিআরপিতে চিকিৎসাধীন ৫৭ জন রোগীর মধ্যে ১৫ জনের হাত-পা কাটা পড়েছে। ২৫ জন মেরুদণ্ডে আঘাত, ১২ জন হাত-পা ভাঙা ও আটজন বিভিন্ন ধরনের আঘাতজনিত সমস্যা নিয়ে এখানে ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের সবারই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন বলে জানান সিআরপির রেজিস্ট্রার হাসান মেহেদি।
সিআরপির গবেষণা সহযোগী মোরশেদুল কাদির বলেন, ৫৭ জন ভর্তি রোগী ছাড়াও সিআরপির ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন রানা প্লাজায় আহত আরও ৭৭ জন জন। হাত-পা কাটা ১৫ জন রোগীর সুস্থ হওয়া সাপেক্ষে কৃত্রিম অঙ্গ লাগানো হবে। এর পরে তাঁদের হাঁটার চর্চা করানো হবে। তার পরে তাঁদের ইচ্ছা ও অবস্থা অনুসারে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর পরে পুনর্বাসনের দায়িত্বটাও পালন করবে সিআরপি।
বর্তমানে সিআরপিতে প্রশিক্ষণরত ৭৭ জনের মধ্যে ৪৪ জন সেলাই (দরজির কাজ), পাঁচজন কম্পিউটার, ১৪ জন ইলেকট্রনিকস মেরামত ও ১৪ জন দোকান ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মার্ক্স অ্যান্ড স্পেন্সারের সহযোগিতায় তাঁদের শিল্পে ব্যবহূত সেলাই মেশিন চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যে আজিরন (৪০) নামের এক শ্রমিককে তাঁর ইচ্ছানুসারে গরু কিনে, ঘর তৈরি করে তাঁর গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডিমলায় পুনর্বাসিত করা হয়েছে। রজিব নামে আহত এক শ্রমিককে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে জানান মোরশেদুল কাদির।
আর পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক আবদুল আউয়াল রিজভী বলেন, বর্তমানে পঙ্গুতে ভর্তি রোগীদের মধ্যে একজনের অবস্থা একটু খারাপ। তাঁর দুটি পা কাটা পড়েছে। এক পায়ের ঘা শুকায়নি। তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যেই আহত, অঙ্গ হারানো ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে।
আবদুল আউয়াল রিজভী জানান, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশটির একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে এসে ১০০ রোগীর কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেবেন। হাত হারানো রোগীদের বায়োনিক (যান্ত্রিক) হাত লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভারতের একটি বিশেষজ্ঞ দলও আহত ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশে আসছেন। আহত (অঙ্গ হারানো) ২৪ জন রোগীকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার করে সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর কিছু শ্রমিককে বিজিএমইএর সহায়তায় চাকরিও দেওয়া হয়েছে।
সম্ভাবনা আছে, সমস্যাও অনেক: সিআরপির কর্মকর্তারা জানান, পঙ্গুত্ব জয় করা শ্রমিকদের অনেক পোশাক কারখানাই কাজ দিতে আগ্রহী। কিন্তু ভবনের কাঠামো ও কাজের আনুষঙ্গিক পরিবেশের কারণে তাঁরা কারখানাগুলোতে কাজ করতে পারছেন না। এই কর্মকর্তারা জানান, বেশির ভাগ কারখানাই বহুতল, সেগুলোতে হুইলচেয়ার নিয়ে ওঠার মতো র্যাম্প (ঢালু পথ) নেই। সাধারণ বাথরুম, প্রক্ষালন কক্ষ ইত্যাদি এই শ্রমিকেরা ব্যবহার করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে যাতায়াতটাও সমস্যা হয়।
তবে সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক ভ্যালেরি টেইলর বলেন, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত পঙ্গুত্বকে জয় করে যেসব শ্রমিক কাজ করছেন, তাঁরা অনেক বেশি মনোযোগী হন ও সময় মেনে চলেন। তাঁরা ছুটিও কম নেন।
সাদ্দামের মা শামসুন্নাহার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরেই থাকেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর তিন ছেলের মধ্যে সাদ্দাম দ্বিতীয়। গত বছর রোজার ঈদের পরে সাদ্দামের বাবা আবদুস সালাম মারা যান। এর পর থেকে তাঁদের পরিবার অর্থকষ্টে পড়ে। তিনি আশুলিয়া এলাকায় কর্মরত তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। শামসুন্নাহার জানান, সাদ্দাম পড়াশোনার মাঝখানে চাকরি খুঁজতে শুরু করেন। এপ্রিল মাসে তাঁর চাকরিটা হয়। এর পরই কেঁদে ফেলেন এই মা। বলেন, ‘সবাই যেন আমার পোলাডার জন্য দোয়া করে। আপনারা সবাই ওরে দেইখেন। ও একদম অসহায় হইয়া গেছে।’
প্রাপ্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখনো ৮০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে সিআরপিতে ভর্তি আছেন ৫৭ জন। ১৫ জন ভর্তি আছেন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্র পঙ্গু হাসপাতালে। বাকিরা বিভিন্ন হাসপাতালে আছেন।
রানা প্লাজা ধসে ৩৬ জন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন ও হাত-পা কাটা পড়েছে। তাঁদের মধ্যে ২২ জনের পা ও ১১ জনের হাত কাটা পড়েছে।
সিআরপিতে চিকিৎসাধীন ৫৭ জন রোগীর মধ্যে ১৫ জনের হাত-পা কাটা পড়েছে। ২৫ জন মেরুদণ্ডে আঘাত, ১২ জন হাত-পা ভাঙা ও আটজন বিভিন্ন ধরনের আঘাতজনিত সমস্যা নিয়ে এখানে ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের সবারই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন বলে জানান সিআরপির রেজিস্ট্রার হাসান মেহেদি।
সিআরপির গবেষণা সহযোগী মোরশেদুল কাদির বলেন, ৫৭ জন ভর্তি রোগী ছাড়াও সিআরপির ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন রানা প্লাজায় আহত আরও ৭৭ জন জন। হাত-পা কাটা ১৫ জন রোগীর সুস্থ হওয়া সাপেক্ষে কৃত্রিম অঙ্গ লাগানো হবে। এর পরে তাঁদের হাঁটার চর্চা করানো হবে। তার পরে তাঁদের ইচ্ছা ও অবস্থা অনুসারে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর পরে পুনর্বাসনের দায়িত্বটাও পালন করবে সিআরপি।
বর্তমানে সিআরপিতে প্রশিক্ষণরত ৭৭ জনের মধ্যে ৪৪ জন সেলাই (দরজির কাজ), পাঁচজন কম্পিউটার, ১৪ জন ইলেকট্রনিকস মেরামত ও ১৪ জন দোকান ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মার্ক্স অ্যান্ড স্পেন্সারের সহযোগিতায় তাঁদের শিল্পে ব্যবহূত সেলাই মেশিন চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যে আজিরন (৪০) নামের এক শ্রমিককে তাঁর ইচ্ছানুসারে গরু কিনে, ঘর তৈরি করে তাঁর গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডিমলায় পুনর্বাসিত করা হয়েছে। রজিব নামে আহত এক শ্রমিককে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া হয়েছে বলে জানান মোরশেদুল কাদির।
আর পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক আবদুল আউয়াল রিজভী বলেন, বর্তমানে পঙ্গুতে ভর্তি রোগীদের মধ্যে একজনের অবস্থা একটু খারাপ। তাঁর দুটি পা কাটা পড়েছে। এক পায়ের ঘা শুকায়নি। তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যেই আহত, অঙ্গ হারানো ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে।
আবদুল আউয়াল রিজভী জানান, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশটির একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে এসে ১০০ রোগীর কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেবেন। হাত হারানো রোগীদের বায়োনিক (যান্ত্রিক) হাত লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভারতের একটি বিশেষজ্ঞ দলও আহত ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশে আসছেন। আহত (অঙ্গ হারানো) ২৪ জন রোগীকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার করে সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর কিছু শ্রমিককে বিজিএমইএর সহায়তায় চাকরিও দেওয়া হয়েছে।
সম্ভাবনা আছে, সমস্যাও অনেক: সিআরপির কর্মকর্তারা জানান, পঙ্গুত্ব জয় করা শ্রমিকদের অনেক পোশাক কারখানাই কাজ দিতে আগ্রহী। কিন্তু ভবনের কাঠামো ও কাজের আনুষঙ্গিক পরিবেশের কারণে তাঁরা কারখানাগুলোতে কাজ করতে পারছেন না। এই কর্মকর্তারা জানান, বেশির ভাগ কারখানাই বহুতল, সেগুলোতে হুইলচেয়ার নিয়ে ওঠার মতো র্যাম্প (ঢালু পথ) নেই। সাধারণ বাথরুম, প্রক্ষালন কক্ষ ইত্যাদি এই শ্রমিকেরা ব্যবহার করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে যাতায়াতটাও সমস্যা হয়।
তবে সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক ভ্যালেরি টেইলর বলেন, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত পঙ্গুত্বকে জয় করে যেসব শ্রমিক কাজ করছেন, তাঁরা অনেক বেশি মনোযোগী হন ও সময় মেনে চলেন। তাঁরা ছুটিও কম নেন।
No comments