প্রবাসীদের চাকরির নিরাপত্তা by ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম, এমপি
জনশক্তি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান
সম্পদ। এই জনশক্তি রপ্তানির ফলে একদিকে বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশের
ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল হয়েছে, তেমনি তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশীয়
অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মূলত অভিবাসীদের পাঠানো অর্থই আমাদের দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টেকসই ও শক্তিশালী করতে সহায়তা করছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের দেশে মূল্যবান হলেও প্রবাসী শ্রমিকরা বরাবরই মূল্যহীন। এরা আমাদের কাছে শুধুই শ্রমিক হিসেবে গণ্য। প্রবাসীরা প্রতিবছর প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে পরিবারের সুখ-শান্তির আশায় প্রবাসজীবন কাটান লাখ লাখ বাংলাদেশি। তাদের ঘামের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। অথচ তাদের কোনো সম্মান নেই আমাদের দেশে। অনেকের পরিবার নিরাপত্তার অভাবে নিজের গ্রামের বাড়িতে বসবাস করতে ভয় পাচ্ছে। অনেকের জায়গাজমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রবাসীদের দুঃখকষ্ট দূর করা এবং তাদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারসহ আমাদের সবার মানবিক দায়িত্ব।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠানোর ফলে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ওপরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১০ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার কিনেছে। ১০ জুলাই ৭৭ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ডলার কিনেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট ৫ দশমিক ১১ বিলিয়ন (৫১১ কোটি ৪০ লাখ) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আকুর সদস্যভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ইরান ও মিয়ানমার। এই দেশগুলো থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার বিল একসঙ্গে আকুর মাধ্যমে দুই মাস পরপর পরিশোধ করে বাংলাদেশ। ৮ জুলাই সোমবার মে-জুন মেয়াদের ৭১ কোটি ৮০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেকর্ড পরিমাণ ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১২.৬ শতাংশ বেশি। আর বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে সর্বমোট ২৭ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের চেয়ে ১১.১৮ শতাংশ বেশি।
বিশ্বমন্দার প্রভাব সত্ত্বেও দেশে আপনজনরা যাতে আর্থিকভাবে নিরাপদে থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখছেন প্রবাসীরা। বিদেশি মুদ্রা আসার ফলে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ রেমিট্যান্স খাত। আত্মীয়স্বজন এবং দেশের জন্য যাঁরা এই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছেন, তাঁদেরও ন্যায্য প্রতিদান প্রাপ্য। অথচ অনেককে প্রবাসে চরম মানবেতর ও নিরাপত্তা হুমকিতে দিন কাটাতে হয়। অনেকটা মূল্যহীন, লক্ষহীন ও অবহেলিত হয়েই প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ উন্মুক্ত হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৪ হাজার শ্রমিক কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন। আর ওই বছর প্রবাসীদের আয় ছিল পাঁচ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে কালের পরিক্রমায় বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের ১৪০টি দেশে কাজ করছেন। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবাসী আয় বাংলাদেশে যে কেবল বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়াচ্ছে তা-ই নয়, দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ গেছেন অর্থ ঋণ নিয়ে, আর ৪১ শতাংশ গেছেন জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে অর্থ সংগ্রহ করে। এসব শ্রমিকের বড় অংশই অদক্ষ বা আধাদক্ষ। ফলে বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। প্রবাসীরা আয়ের বড় অংশই দেশে পাঠান। তাঁদের টাকায় অনেকের পরিবার চলে। তবে পরিবারের চেয়েও বেশি লাভবান হয় সরকার।
আমাদের দেশ থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সেখানে লাখো বাঙালি ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করছেন, যা চোখে না দেখলে অনেকের কাছে কাল্পনিক মনে হবে। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন তাঁরা। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় তাঁদের পারিশ্রমিকও অনেক কম। ফলে অনেকে স্ত্রী, পুত্র এবং মা-বাবার মায়া ছেড়ে তিন-চার বছর ছুটিতে আসতে পারেন না টাকার অভাবে। অনেকে একনাগাড়ে প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন।
কষ্ট স্বীকার করে ছুটিতে এলেও শান্তি নেই। বিমানবন্দর থেকে বাড়ি পৌঁছা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বিমানবন্দরে তাঁদের প্রতি সামান্য সম্মান ও সহানুভূতি দেখানো হয় না। তাঁদের সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মানুষ হিসেবে, একজন সম্মানিত যাত্রী হিসেবে যতটুকু সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের ভাগ্যে তা জোটে না। বাড়িতে পঁৗছার পরও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বসতভিটা, জায়গাজমি বেদখল হয়েছে। কোথাও প্রতিকারের জায়গা নেই। তাঁদের প্রতি সবার হায়েনার মতো দৃষ্টি। মাস্তানদের দৌরাত্ম্য তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। এ ধরনের হয়রানি, নির্যাতন ও অবিচার কি যুগ যুগ ধরে চলবে? সরকারের বা প্রশাসনের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
মধ্যপ্রাচ্যে ৪০ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। প্রয়োজনের তুলনায় তাদের কাউন্সিলর ও পাসপোর্ট নবায়নের সুযোগ-সুবিধা সীমিত। নাগরিক সুবিধা নেই বললেই চলে।
যেমন সৌদি আরবে বৈধ-অবৈধ মিলে ২২ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন। অনেককে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য এক হাজার কিলোমিটারের ওপর পথ পাড়ি দিতে হয়। একই অবস্থা সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও কুয়েতে বিরাজ করছে। কুয়েতে বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের জন্য কোনো স্কুল নেই। এ ছাড়া তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুলের সংখ্যাও সীমিত। কাতার ও বাহরাইনের স্কুলের অবস্থাও অনুরূপ। সুতরাং এ ব্যাপারে আমার অভিমত এই যে-
১. পাসপোর্ট নবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি এবং একাধিক স্থানে অফিস স্থাপন করা।
২. বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।
৩. মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের ছেলেমেয়েদের জন্য দেশের বিভিন্ন কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে কোটা সংরক্ষণ জরুরি। অন্যথায় প্রবাসীদের প্রতি অবিচার করা হবে।
৪. প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রায় বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়ার ভিসা। পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিদেশের সব শ্রমবাজার। কোথাও সীমিত হয়ে পড়েছে জনসংখ্যা রপ্তানি, আবার কোথাও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। জনসংখ্যা রপ্তানি ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের শ্রমবাজারের ৮০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবে, ২৫ শতাংশ আরব আমিরাতে, ৭ শতাংশ কুয়েতে, ৬ শতাংশ ওমানে, ৩ শতাংশ বাহরাইনে, ২ শতাংশ কাতারে, ১ শতাংশ লিবিয়ায়। অবশিষ্ট ২০ শতাংশের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৪ শতাংশ ও অন্যান্য দেশে ৬ শতাংশ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- এটা অনিবার্য। এর জন্য দায়ী শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা। নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ বর্তমান সরকার নেয়নি বললেও ভুল হবে না। বিদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তা ধরে রাখতে না পারায় এই ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে।
লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের দেশে মূল্যবান হলেও প্রবাসী শ্রমিকরা বরাবরই মূল্যহীন। এরা আমাদের কাছে শুধুই শ্রমিক হিসেবে গণ্য। প্রবাসীরা প্রতিবছর প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে পরিবারের সুখ-শান্তির আশায় প্রবাসজীবন কাটান লাখ লাখ বাংলাদেশি। তাদের ঘামের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। অথচ তাদের কোনো সম্মান নেই আমাদের দেশে। অনেকের পরিবার নিরাপত্তার অভাবে নিজের গ্রামের বাড়িতে বসবাস করতে ভয় পাচ্ছে। অনেকের জায়গাজমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রবাসীদের দুঃখকষ্ট দূর করা এবং তাদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারসহ আমাদের সবার মানবিক দায়িত্ব।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠানোর ফলে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ওপরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১০ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার কিনেছে। ১০ জুলাই ৭৭ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ডলার কিনেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট ৫ দশমিক ১১ বিলিয়ন (৫১১ কোটি ৪০ লাখ) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আকুর সদস্যভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ইরান ও মিয়ানমার। এই দেশগুলো থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার বিল একসঙ্গে আকুর মাধ্যমে দুই মাস পরপর পরিশোধ করে বাংলাদেশ। ৮ জুলাই সোমবার মে-জুন মেয়াদের ৭১ কোটি ৮০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেকর্ড পরিমাণ ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১২.৬ শতাংশ বেশি। আর বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে সর্বমোট ২৭ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের চেয়ে ১১.১৮ শতাংশ বেশি।
বিশ্বমন্দার প্রভাব সত্ত্বেও দেশে আপনজনরা যাতে আর্থিকভাবে নিরাপদে থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখছেন প্রবাসীরা। বিদেশি মুদ্রা আসার ফলে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ রেমিট্যান্স খাত। আত্মীয়স্বজন এবং দেশের জন্য যাঁরা এই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছেন, তাঁদেরও ন্যায্য প্রতিদান প্রাপ্য। অথচ অনেককে প্রবাসে চরম মানবেতর ও নিরাপত্তা হুমকিতে দিন কাটাতে হয়। অনেকটা মূল্যহীন, লক্ষহীন ও অবহেলিত হয়েই প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ উন্মুক্ত হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৪ হাজার শ্রমিক কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন। আর ওই বছর প্রবাসীদের আয় ছিল পাঁচ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে কালের পরিক্রমায় বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের ১৪০টি দেশে কাজ করছেন। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবাসী আয় বাংলাদেশে যে কেবল বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়াচ্ছে তা-ই নয়, দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ গেছেন অর্থ ঋণ নিয়ে, আর ৪১ শতাংশ গেছেন জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে অর্থ সংগ্রহ করে। এসব শ্রমিকের বড় অংশই অদক্ষ বা আধাদক্ষ। ফলে বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। প্রবাসীরা আয়ের বড় অংশই দেশে পাঠান। তাঁদের টাকায় অনেকের পরিবার চলে। তবে পরিবারের চেয়েও বেশি লাভবান হয় সরকার।
আমাদের দেশ থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সেখানে লাখো বাঙালি ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করছেন, যা চোখে না দেখলে অনেকের কাছে কাল্পনিক মনে হবে। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন তাঁরা। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় তাঁদের পারিশ্রমিকও অনেক কম। ফলে অনেকে স্ত্রী, পুত্র এবং মা-বাবার মায়া ছেড়ে তিন-চার বছর ছুটিতে আসতে পারেন না টাকার অভাবে। অনেকে একনাগাড়ে প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন।
কষ্ট স্বীকার করে ছুটিতে এলেও শান্তি নেই। বিমানবন্দর থেকে বাড়ি পৌঁছা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বিমানবন্দরে তাঁদের প্রতি সামান্য সম্মান ও সহানুভূতি দেখানো হয় না। তাঁদের সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মানুষ হিসেবে, একজন সম্মানিত যাত্রী হিসেবে যতটুকু সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের ভাগ্যে তা জোটে না। বাড়িতে পঁৗছার পরও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বসতভিটা, জায়গাজমি বেদখল হয়েছে। কোথাও প্রতিকারের জায়গা নেই। তাঁদের প্রতি সবার হায়েনার মতো দৃষ্টি। মাস্তানদের দৌরাত্ম্য তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। এ ধরনের হয়রানি, নির্যাতন ও অবিচার কি যুগ যুগ ধরে চলবে? সরকারের বা প্রশাসনের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
মধ্যপ্রাচ্যে ৪০ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। প্রয়োজনের তুলনায় তাদের কাউন্সিলর ও পাসপোর্ট নবায়নের সুযোগ-সুবিধা সীমিত। নাগরিক সুবিধা নেই বললেই চলে।
যেমন সৌদি আরবে বৈধ-অবৈধ মিলে ২২ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন। অনেককে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য এক হাজার কিলোমিটারের ওপর পথ পাড়ি দিতে হয়। একই অবস্থা সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও কুয়েতে বিরাজ করছে। কুয়েতে বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের জন্য কোনো স্কুল নেই। এ ছাড়া তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুলের সংখ্যাও সীমিত। কাতার ও বাহরাইনের স্কুলের অবস্থাও অনুরূপ। সুতরাং এ ব্যাপারে আমার অভিমত এই যে-
১. পাসপোর্ট নবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি এবং একাধিক স্থানে অফিস স্থাপন করা।
২. বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।
৩. মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের ছেলেমেয়েদের জন্য দেশের বিভিন্ন কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে কোটা সংরক্ষণ জরুরি। অন্যথায় প্রবাসীদের প্রতি অবিচার করা হবে।
৪. প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রায় বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়ার ভিসা। পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিদেশের সব শ্রমবাজার। কোথাও সীমিত হয়ে পড়েছে জনসংখ্যা রপ্তানি, আবার কোথাও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। জনসংখ্যা রপ্তানি ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের শ্রমবাজারের ৮০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবে, ২৫ শতাংশ আরব আমিরাতে, ৭ শতাংশ কুয়েতে, ৬ শতাংশ ওমানে, ৩ শতাংশ বাহরাইনে, ২ শতাংশ কাতারে, ১ শতাংশ লিবিয়ায়। অবশিষ্ট ২০ শতাংশের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৪ শতাংশ ও অন্যান্য দেশে ৬ শতাংশ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- এটা অনিবার্য। এর জন্য দায়ী শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা। নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ বর্তমান সরকার নেয়নি বললেও ভুল হবে না। বিদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তা ধরে রাখতে না পারায় এই ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে।
লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি
No comments