হৃদয়নন্দন বনে-একটু পেছন ফিরে দেখি by আলী যাকের
সেদিন এক বন্ধু ফেসবুকে একটি ছবি দিয়েছিল।
ছবিটি হাতে আঁকা। ফাঁসির মঞ্চে, ফাঁসির দড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুদিরাম।
আমি নিশ্চিত যে, ক্ষুদিরাম সম্বন্ধে পাঠকের সম্যক ধারণা আছে।
তবুও
বলি, তার জন্ম ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর এবং মৃত্যু ১১ আগস্ট ১৯০৮-এ। কেবল ১৮
বছর ৭ মাস ১১ দিন বয়সে। ক্ষুদিরাম ছিলেন মেদিনীপুরের যুবক। ব্রিটিশবিরোধী
আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৬ বছর বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন ব্রিটিশ সরকারি
প্রতিষ্ঠানে বোমা নিক্ষেপ করতে থাকেন প্রতিবাদ হিসেবে। ১৯০৮ সালের ৩০
এপ্রিল বিহারের মোজাফ্ফরপুরের মতিঝিল নামক জায়গায় স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের
সামনে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিনি পিস্তল এবং বোমার সাহায্যে ব্রিটিশ অফিসার
কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়িটি উড়িয়ে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখন ওই গাড়িতে
কিংসফোর্ড ছিলেন না। গাড়ির অন্য তিনজন যাত্রী এই ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। এই
অপরাধে তাকে পরবর্র্তীকালে গ্রেফতার করা হয়, তার বিচার হয় এবং ফাঁসির দণ্ড
দেওয়া হয়। ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন ব্রিটিশরাজবিরোধী অন্যতম প্রধান তরুণ
বিপ্লবী। আমরা সবাই জানি যে, পরবর্তীকালে আরও অনেক বাঙালি বিপ্লবী সশস্ত্র
বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশরাজের উৎখাতের জন্য কাজ করেছেন। এদের মধ্যে
অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন সম্মুখ সমরে। আবার কেউবা গ্রেফতার হয়ে পরে
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত
মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা এবং আরও অনেক বিদ্রোহীর নাম আমরা জানি এবং
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের সক্রিয়
ভূমিকার জন্য শ্রদ্ধা করে থাকি।
ফিরে আসি প্রসঙ্গ কথায়। ফেসবুকে ক্ষুদিরাম বসুর এই ছবিটিতে অনেকেই নানারকম মন্তব্য করেন। বেশ কিছু মন্তব্য এমত ছিল যে, ক্ষুদিরাম বসু ব্রিটিশবিরোধী হয়েছিলেন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গকে ভঙ্গ করার প্রতিবাদী হয়ে এবং অতএব, ক্ষুদিরাম বসুকে নিয়ে বাংলাদেশিদের এত মাতামাতি করার কোনো কারণ নেই। অনেকেরই ধারণা যে, ১৯০৫ সালে বঙ্গকে না ভাঙতে পারলে '৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তারা বলেন, ভগ্ন বঙ্গই ছিল পরবর্তীকালে সৃষ্ট বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত রূপ। এসব মন্তব্য পড়ে আমি বিস্মিত হইনি, তবে যুক্তির সারবত্তাহীনতা দেখে হেসেছিলাম বৈকি। এখানে একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করা জরুরি। আমরা সবাই জানি যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন ভারতের মানুষ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা চোখে শর্ষে ফুল দেখতে শুরু করে, তখন থেকেই তারা নানা ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাততে শুরু করে এ দেশের মানুষকে তাদের ন্যায্য দাবি থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। এর সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্রটি ছিল 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল'। অর্থাৎ ভারতবাসীকে কখনোই এক হতে দেওয়া যাবে না। বিভক্ত করে শাসন করতে হবে। যেমন করেই হোক না কেন। তাহলে তাদের শক্তি কমে আসবে এবং তখন উপনিবেশবাদীদের পক্ষে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
এই যে বিভাজন, এর প্রথমটি ঘটেছিল ধর্ম দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে একটা বিরোধ বাধিয়ে দিয়ে ভারতবাসীদের ধর্মের ভিত্তিতে দুই সাম্প্রদায়িক শক্তিতে পরিণত করা। কাজও হয়েছিল বটে। ইতিহাস বলে, ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ অল্পদিনেই বুঝে গিয়েছিল যে, জীবন এবং জীবিকার জন্য ইংরেজদের ভাষা শিখে তাদের আনুকূল্যে নানা ধরনের পেশায় নিয়োজিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। সে সময় মুসলমান তার জাত্যভিমান নিয়ে এতই আত্মগরিমায় নিমজ্জিত ছিল যে, মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা ভারতে ব্রিটিশদের রাজত্ব তারা দু'চোখে দেখতে পারত না। যে কারণে যা কিছু ব্রিটিশ, যেমন ইংরেজি ভাষা, ইংরেজদের পোশাক, ইংরেজি খাদ্য, এসব কিছুই মুসলমানরা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অতএব, স্বভাবতই তারা জীবন-জীবিকার সব ক্ষেত্রে হিন্দুদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। ওইভাবে চলতে থাকলে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে ভারতে মুসলমানদের অবস্থা সত্যিকার অর্থেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত। ওই পরিস্থিতিতে কতিপয় মানুষ যেমন, স্যার সৈয়দ আহমেদ, সৈয়দ আমীর আলী, শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী, এসব আলোকপ্রাপ্ত মুসলমানরা প্রতীচ্যীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মুসলমানদের সেই শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হওয়ার জন্য একাগ্রভাবে কাজ করে চলেন এবং আমরা তৎকালীন মুসলমান যুবকদের ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত হতে দেখি। কেবল তা-ই নয়, ওই সময় অনেক মুসলমান যুবক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের উচ্চ পদেও আসীন হন। সারা ভারতবর্ষের জনগণ তখন অর্থনীতির মানদণ্ডে দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। আশরাফ এবং আতরাফ। যারা ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত হন এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেন, তারা সাধারণত আশরাফ শ্রেণী অর্থাৎ উচ্চ বংশ থেকেই আসতেন। আতরাফেরা ছিল খেটে খাওয়া মানুষ। এদের প্রায় সবাই কৃষিকার্যে নিয়োজিত ছিল। এই আশরাফ শ্রেণীর মুসলমানরা সাধারণত সামন্ত প্রভু গোষ্ঠী থেকে আসতেন এবং সর্বভারতীয় 'কৌলীন্য' বজায় রাখার জন্য বঙ্গে তারা উর্দু ভাষাভাষী ছিলেন। ব্রিটিশরাজ যখন বিভক্তিকরণের মাধ্যমে শাসনের প্রক্রিয়ায় হিন্দু-মুসলমানকে দু'ভাগে ভাগ করার জন্য বঙ্গকেও ভেঙে ফেলার দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তখন এই সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানায় সামন্তবাদী, উর্দু ভাষাভাষী আশরাফ মুসলমান শ্রেণী। বাংলার আপামর কৃষকরা, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তারা এ বিষয়ে আদৌ সচেতন ছিল না। তারা নির্যাতিত হতো সামন্ত প্রভুদের দ্বারা, যারা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতএব, বঙ্গভঙ্গের দ্বারা বাংলাদেশের জনসাধারণের, বিশেষ করে মুসলমান জনসাধারণের কোনো লাভ হয়েছিল এ কথাটি আদৌ সত্য নয়। স্বীকার করি যে, ক্ষুদিরাম বসু এবং তৎকালীন বিপ্লবীদের মধ্যে কেউ কেউ হিন্দুবাদী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গকে তাদের বিরোধিতা করার বড় কারণ ছিল এই যে, তারা তাদের নিজস্ব প্রদেশকে মায়ের মতো দেখতেন। মনে করতেন বঙ্গ একটি অবিকৃত সম্পূর্ণ দেহবিশেষ। এটিকে খণ্ডিত করলে নিজের দেহকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়ে যায়। এই ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার প্রধান নিয়ামক। বস্তুতপক্ষে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের সরব বিরোধিতা করেছিলেন। আজকে আমাদের যে জাতীয় সঙ্গীত, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি', এটিও রচিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিশ্বকবির অবস্থান বোঝানোর জন্য।
যে বঙ্গভঙ্গের আদলে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্ট হয়েছিল মুসলিম লীগের আশরাফ সদস্যদের চেষ্টায়, সেই পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমান কি টিকতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত? আমরা কি স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করতে বাধ্য হইনি? তখন কি ওই আশরাফ শ্রেণীর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জাতকরা এই পূর্ববঙ্গে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়নি? ভাবতে অবাক লাগে যে, আজকের বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে এখনও আমাদের দেশের ইতিহাস নিয়ে লেখাপড়া করার প্রবণতা এত কম। এ ধরনের মনোবৃত্তির সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের তিন বছরের মাথায়, যখন এ দেশের স্থপতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে একটি সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা পাকা করার চেষ্টা করা হয়। যে প্রচেষ্টাটি এখনও থেমে যায়নি।
অবশ্য আমি বিচলিত নই। কেননা, যে ধারণা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আজকের কলামটি লিখছি, আমি নিশ্চিত, সেটি আপামর তরুণ জনগোষ্ঠীর অভিমত নয়। কেননা সেই '৭১-এ যেমন, এখনও তেমনি বাংলাদেশের তরুণরা নিঃস্বার্থভাবে ও যুক্তি প্রয়োগ করে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। এহেন তরুণদের ওপর নিরাশ হওয়া সঙ্গত নয়।
আলী যাকের
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ফিরে আসি প্রসঙ্গ কথায়। ফেসবুকে ক্ষুদিরাম বসুর এই ছবিটিতে অনেকেই নানারকম মন্তব্য করেন। বেশ কিছু মন্তব্য এমত ছিল যে, ক্ষুদিরাম বসু ব্রিটিশবিরোধী হয়েছিলেন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গকে ভঙ্গ করার প্রতিবাদী হয়ে এবং অতএব, ক্ষুদিরাম বসুকে নিয়ে বাংলাদেশিদের এত মাতামাতি করার কোনো কারণ নেই। অনেকেরই ধারণা যে, ১৯০৫ সালে বঙ্গকে না ভাঙতে পারলে '৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তারা বলেন, ভগ্ন বঙ্গই ছিল পরবর্তীকালে সৃষ্ট বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত রূপ। এসব মন্তব্য পড়ে আমি বিস্মিত হইনি, তবে যুক্তির সারবত্তাহীনতা দেখে হেসেছিলাম বৈকি। এখানে একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করা জরুরি। আমরা সবাই জানি যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন ভারতের মানুষ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা চোখে শর্ষে ফুল দেখতে শুরু করে, তখন থেকেই তারা নানা ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাততে শুরু করে এ দেশের মানুষকে তাদের ন্যায্য দাবি থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। এর সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্রটি ছিল 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল'। অর্থাৎ ভারতবাসীকে কখনোই এক হতে দেওয়া যাবে না। বিভক্ত করে শাসন করতে হবে। যেমন করেই হোক না কেন। তাহলে তাদের শক্তি কমে আসবে এবং তখন উপনিবেশবাদীদের পক্ষে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
এই যে বিভাজন, এর প্রথমটি ঘটেছিল ধর্ম দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে একটা বিরোধ বাধিয়ে দিয়ে ভারতবাসীদের ধর্মের ভিত্তিতে দুই সাম্প্রদায়িক শক্তিতে পরিণত করা। কাজও হয়েছিল বটে। ইতিহাস বলে, ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ অল্পদিনেই বুঝে গিয়েছিল যে, জীবন এবং জীবিকার জন্য ইংরেজদের ভাষা শিখে তাদের আনুকূল্যে নানা ধরনের পেশায় নিয়োজিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। সে সময় মুসলমান তার জাত্যভিমান নিয়ে এতই আত্মগরিমায় নিমজ্জিত ছিল যে, মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা ভারতে ব্রিটিশদের রাজত্ব তারা দু'চোখে দেখতে পারত না। যে কারণে যা কিছু ব্রিটিশ, যেমন ইংরেজি ভাষা, ইংরেজদের পোশাক, ইংরেজি খাদ্য, এসব কিছুই মুসলমানরা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অতএব, স্বভাবতই তারা জীবন-জীবিকার সব ক্ষেত্রে হিন্দুদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। ওইভাবে চলতে থাকলে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে ভারতে মুসলমানদের অবস্থা সত্যিকার অর্থেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত। ওই পরিস্থিতিতে কতিপয় মানুষ যেমন, স্যার সৈয়দ আহমেদ, সৈয়দ আমীর আলী, শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী, এসব আলোকপ্রাপ্ত মুসলমানরা প্রতীচ্যীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মুসলমানদের সেই শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হওয়ার জন্য একাগ্রভাবে কাজ করে চলেন এবং আমরা তৎকালীন মুসলমান যুবকদের ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত হতে দেখি। কেবল তা-ই নয়, ওই সময় অনেক মুসলমান যুবক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের উচ্চ পদেও আসীন হন। সারা ভারতবর্ষের জনগণ তখন অর্থনীতির মানদণ্ডে দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। আশরাফ এবং আতরাফ। যারা ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত হন এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেন, তারা সাধারণত আশরাফ শ্রেণী অর্থাৎ উচ্চ বংশ থেকেই আসতেন। আতরাফেরা ছিল খেটে খাওয়া মানুষ। এদের প্রায় সবাই কৃষিকার্যে নিয়োজিত ছিল। এই আশরাফ শ্রেণীর মুসলমানরা সাধারণত সামন্ত প্রভু গোষ্ঠী থেকে আসতেন এবং সর্বভারতীয় 'কৌলীন্য' বজায় রাখার জন্য বঙ্গে তারা উর্দু ভাষাভাষী ছিলেন। ব্রিটিশরাজ যখন বিভক্তিকরণের মাধ্যমে শাসনের প্রক্রিয়ায় হিন্দু-মুসলমানকে দু'ভাগে ভাগ করার জন্য বঙ্গকেও ভেঙে ফেলার দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তখন এই সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানায় সামন্তবাদী, উর্দু ভাষাভাষী আশরাফ মুসলমান শ্রেণী। বাংলার আপামর কৃষকরা, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তারা এ বিষয়ে আদৌ সচেতন ছিল না। তারা নির্যাতিত হতো সামন্ত প্রভুদের দ্বারা, যারা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতএব, বঙ্গভঙ্গের দ্বারা বাংলাদেশের জনসাধারণের, বিশেষ করে মুসলমান জনসাধারণের কোনো লাভ হয়েছিল এ কথাটি আদৌ সত্য নয়। স্বীকার করি যে, ক্ষুদিরাম বসু এবং তৎকালীন বিপ্লবীদের মধ্যে কেউ কেউ হিন্দুবাদী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গকে তাদের বিরোধিতা করার বড় কারণ ছিল এই যে, তারা তাদের নিজস্ব প্রদেশকে মায়ের মতো দেখতেন। মনে করতেন বঙ্গ একটি অবিকৃত সম্পূর্ণ দেহবিশেষ। এটিকে খণ্ডিত করলে নিজের দেহকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়ে যায়। এই ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার প্রধান নিয়ামক। বস্তুতপক্ষে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের সরব বিরোধিতা করেছিলেন। আজকে আমাদের যে জাতীয় সঙ্গীত, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি', এটিও রচিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিশ্বকবির অবস্থান বোঝানোর জন্য।
যে বঙ্গভঙ্গের আদলে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্ট হয়েছিল মুসলিম লীগের আশরাফ সদস্যদের চেষ্টায়, সেই পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমান কি টিকতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত? আমরা কি স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করতে বাধ্য হইনি? তখন কি ওই আশরাফ শ্রেণীর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জাতকরা এই পূর্ববঙ্গে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়নি? ভাবতে অবাক লাগে যে, আজকের বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে এখনও আমাদের দেশের ইতিহাস নিয়ে লেখাপড়া করার প্রবণতা এত কম। এ ধরনের মনোবৃত্তির সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের তিন বছরের মাথায়, যখন এ দেশের স্থপতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে একটি সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা পাকা করার চেষ্টা করা হয়। যে প্রচেষ্টাটি এখনও থেমে যায়নি।
অবশ্য আমি বিচলিত নই। কেননা, যে ধারণা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আজকের কলামটি লিখছি, আমি নিশ্চিত, সেটি আপামর তরুণ জনগোষ্ঠীর অভিমত নয়। কেননা সেই '৭১-এ যেমন, এখনও তেমনি বাংলাদেশের তরুণরা নিঃস্বার্থভাবে ও যুক্তি প্রয়োগ করে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। এহেন তরুণদের ওপর নিরাশ হওয়া সঙ্গত নয়।
আলী যাকের
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments