শাহরি রমজান-রোজার মূল উদ্দেশ্য by মাওলানা শোয়াইব ইজহার
মানুষ যে কাজই করে না কেন, তাতে দুটি
জিনিস অবশ্যই থাকে। একটি হলো উদ্দেশ্য অর্থাৎ যে জন্য সেই কাজ করা হয়।
দ্বিতীয়টি হলো সেই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গৃহীত পন্থা।
ধরুন,
আমাদের খাওয়া-দাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে দৈহিক শক্তি অর্জন করা এবং বেঁচে
থাকা। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য 'গ্রাস' বানাতে হয়, তা মুখে দিতে হয়, চিবাতে
হয় এবং গিলতে হয়। খাওয়ার উদ্দেশ্য সফল করতে সবচেয়ে কার্যকর ও
সামঞ্জস্যপূর্ণ পন্থা এটিই। খাওয়ার কাজ সমাধার জন্যই এটিকে গ্রহণ করা
হয়েছে। কিন্তু সবাই জানেন, এ ব্যাপারে আসল হচ্ছে এর উদ্দেশ্য অর্থাৎ যে
জন্য খাওয়া হয়। খাওয়ার এ পন্থাটি মুখ্য বিষয় নয়। কোনো ব্যক্তি যদি মাটি,
ছাই বা বালি মুঠি ভরে মুখে দেয় এবং চিবিয়ে গিলে ফেলে; তবে তাকে কী বলা
যাবে? বলতেই হবে, তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এ জন্য যে, ওপরে উল্লিখিত
খাওয়ার চারটি নিয়ম পালন করলেই খাওয়ার উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। তেমনি যে
ব্যক্তি ভাত খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি করে ফেলে, তার পরও সে যদি অভিযোগ করে
যে, ভাত খাওয়ার যে উপকারিতা বর্ণনা করা হয়, তা আমি মোটেই পাচ্ছি না। বরং
আমি ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, মৃত্যু আমার নিকটবর্তী। এ নির্বোধ ব্যক্তি
নিজের এই দুর্বলতার জন্য খাওয়াকে দোষারোপ করছে, আসলে এটি তারই
নির্বুদ্ধিতার ফল মাত্র। সে নির্বোধের মতো মনে করেছে; যে কয়টি নিয়ম পালনের
দ্বারা খাওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়, ব্যস, শুধু সে কয়টি সম্পন্ন হলেই জীবনীশক্তি
লাভ করা যাবে। এ জন্যই সে মনে করেছে, এখন পেটে ভাতের বোঝা রেখে লাভ কী, তা
বের করে ফেলাই উচিত। এভাবে পেট হালকা হয়ে যাবে। খাওয়ার বাহ্যিক নিয়ম তো
পালন করা হয়েছে। এই নির্বোধ ব্যক্তি এ ধরনের ভুল ধারণা পোষণ করেছে এবং
কার্যত তাই করেছে। সুতরাং তার দুর্ভোগ তাকেই ভুগতে হবে। তার এ কথা জানা
উচিত ছিল, ভাত পেটে গিয়ে হজম হয়ে রক্তে পরিণত হয় এবং সারা দেহে তা ছড়িয়ে
পড়লেই কেবল জীবনীশক্তি লাভ করা যায়। খাওয়ার কাজের বাহ্যিক নিয়মগুলো যদিও
অপরিহার্য, কারণ তা ছাড়া খাদ্য পেটেই প্রবেশ করতে পারে না। এ বাহ্যিক
অনুষ্ঠানে এমন কোনো জাদু নেই যে এগুলো সম্পন্ন হলেই ইন্দ্রজালিক উপায়ে তার
শিরায় শিরায় রক্ত প্রবাহিত হবে। রক্ত সৃষ্টির জন্য আল্লাহ তায়ালা যে নিয়ম
বানিয়ে দিয়েছেন, তা সেই নিয়ম অনুসারেই হতে পারে। সেই নিয়ম লঙ্ঘন করলে ধ্বংস
অনিবার্য।
ওপরে যে উদাহরণটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, তা একটু চিন্তা করলেই বর্তমানে মুসলমানদের ইবাদত নিষ্ফল হয়ে যাওয়ার কারণ সহজেই বোঝা যায়। আমরা নামাজ-রোজার আরকান (অভ্যন্তরীণ জরুরি কাজ) এবং এসবের বাহ্যিক অনুষ্ঠানকেই মূল ইবাদত বলে মনে করি। অথচ এটি অনেক বড় ভুল। আমাদের সেই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যে ভাতের মুঠি বানাল, মুখে রাখল, চিবালো এবং গিলে ফেলল। এ চারটি কাজ করাকেই খাওয়া এবং খাওয়ার উদ্দেশ্য এটি থেকেই অর্জন হলো বলে মনে করেছে। সে এভাবেই মাটি খেল কিংবা বালি খেল অথবা তা বমি করে ফেলল তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা যদি এমন ভুল ধারণায় বিশ্বাসী না হয়ে থাকি, তাহলে রোজা রেখে কেমন করে মিথ্যা কথা বলতে পারি? কেমন করে পরের 'গিবত' করতে পারি? কেমন করে অন্যায় ঝগড়া-বিবাদে যুক্ত হই? কিভাবে মুখ থেকে গালাগাল ও অশ্লীল কথা বের করি? পরের হক কিভাবে নষ্ট করি? হারাম খাওয়া ও অন্যকে হারাম খাওয়ানোর কাজ কেমন করে করতে পারি? বালি কিংবা মাটি খেয়ে যারা মনে করে, তারা খাওয়ার কাজ সম্পন্ন করছে, আমরা ঠিক তাদেরই মতো।
রমজান মাসজুড়ে আমরা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করি। শাওয়ালের প্রথম তারিখেই এ বিরাট ইবাদতের সব প্রভাব একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় কেন? বিধর্মীরা তাদের মেলা-উৎসবে যা কিছু করে, আমরাও ঈদের উৎসবে ঠিক তাই করি। এমনকি শহরাঞ্চলে ঈদের দিন ব্যভিচার, নাচ-গান, মদ পান আর জুয়া খেলার তুফান বইতে শুরু করে। অনেক লোককে এমনও দেখা যায়, দিনের বেলা রোজা রেখে সারা রাত মদ খায়, নানা অপকর্ম করে। সাধারণ মুসলমান আল্লাহর রহমতে এতটা পথভ্রষ্ট এখনো হয়নি। রমজান বিদায় হওয়ার পরই তাকওয়ার প্রভাব কতজন লোকের ওপর থাকে? আল্লাহর আইন লঙ্ঘন করতে কতজন লোক ভয় পায়? নেক কাজে কতজন লোক অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা করে? স্বার্থপরতা কতজনের দূর হয়?
এর একমাত্র কারণ হলো, আমাদের মনে ইবাদতের অর্থ এবং সে সম্পর্কে যে ধারণা রয়েছে, তা ভুলে ভরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার বর্জন করাকেই আমরা রোজা মনে করি। এটি সম্পন্ন করার নামই ইবাদত। এ জন্য দেখা যায়, আমরা রোজা ও রোজার মাস রমজানকে খুব সম্মান করি, আল্লাহর কথা বেশি বেশি স্মরণ করি, যেসব কাজে রোজা ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা, তা থেকে দূরে সরে থাকি, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিলেও রোজা ভাঙতে রাজি হই না। আমরা বুঝি না, এসব অনুষ্ঠান পালন করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা। এত দূর শক্তি জেগে ওঠা যে, বড় বড় লাভজনক কাজও কেবল আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে ভয় করে (নিজের মন শক্ত করে) তা পরিত্যাগ করতে হবে। কঠিন বিপদের কাজেও যেন কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিজের মন শক্ত করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ শক্তি আমাদের মধ্যে আসবে, যখন রোজার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারব এবং রমজানের পুরো মাস আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় নিজের মনকে নফসের খায়েশ থেকে ফিরিয়ে রাখব। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রস্তুত হব।
লেখক : ইমাম ও খতিব, হাতিরঝিল জামে মসজিদ, ঢাকা।
ওপরে যে উদাহরণটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, তা একটু চিন্তা করলেই বর্তমানে মুসলমানদের ইবাদত নিষ্ফল হয়ে যাওয়ার কারণ সহজেই বোঝা যায়। আমরা নামাজ-রোজার আরকান (অভ্যন্তরীণ জরুরি কাজ) এবং এসবের বাহ্যিক অনুষ্ঠানকেই মূল ইবাদত বলে মনে করি। অথচ এটি অনেক বড় ভুল। আমাদের সেই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যে ভাতের মুঠি বানাল, মুখে রাখল, চিবালো এবং গিলে ফেলল। এ চারটি কাজ করাকেই খাওয়া এবং খাওয়ার উদ্দেশ্য এটি থেকেই অর্জন হলো বলে মনে করেছে। সে এভাবেই মাটি খেল কিংবা বালি খেল অথবা তা বমি করে ফেলল তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা যদি এমন ভুল ধারণায় বিশ্বাসী না হয়ে থাকি, তাহলে রোজা রেখে কেমন করে মিথ্যা কথা বলতে পারি? কেমন করে পরের 'গিবত' করতে পারি? কেমন করে অন্যায় ঝগড়া-বিবাদে যুক্ত হই? কিভাবে মুখ থেকে গালাগাল ও অশ্লীল কথা বের করি? পরের হক কিভাবে নষ্ট করি? হারাম খাওয়া ও অন্যকে হারাম খাওয়ানোর কাজ কেমন করে করতে পারি? বালি কিংবা মাটি খেয়ে যারা মনে করে, তারা খাওয়ার কাজ সম্পন্ন করছে, আমরা ঠিক তাদেরই মতো।
রমজান মাসজুড়ে আমরা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করি। শাওয়ালের প্রথম তারিখেই এ বিরাট ইবাদতের সব প্রভাব একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় কেন? বিধর্মীরা তাদের মেলা-উৎসবে যা কিছু করে, আমরাও ঈদের উৎসবে ঠিক তাই করি। এমনকি শহরাঞ্চলে ঈদের দিন ব্যভিচার, নাচ-গান, মদ পান আর জুয়া খেলার তুফান বইতে শুরু করে। অনেক লোককে এমনও দেখা যায়, দিনের বেলা রোজা রেখে সারা রাত মদ খায়, নানা অপকর্ম করে। সাধারণ মুসলমান আল্লাহর রহমতে এতটা পথভ্রষ্ট এখনো হয়নি। রমজান বিদায় হওয়ার পরই তাকওয়ার প্রভাব কতজন লোকের ওপর থাকে? আল্লাহর আইন লঙ্ঘন করতে কতজন লোক ভয় পায়? নেক কাজে কতজন লোক অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা করে? স্বার্থপরতা কতজনের দূর হয়?
এর একমাত্র কারণ হলো, আমাদের মনে ইবাদতের অর্থ এবং সে সম্পর্কে যে ধারণা রয়েছে, তা ভুলে ভরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার বর্জন করাকেই আমরা রোজা মনে করি। এটি সম্পন্ন করার নামই ইবাদত। এ জন্য দেখা যায়, আমরা রোজা ও রোজার মাস রমজানকে খুব সম্মান করি, আল্লাহর কথা বেশি বেশি স্মরণ করি, যেসব কাজে রোজা ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা, তা থেকে দূরে সরে থাকি, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিলেও রোজা ভাঙতে রাজি হই না। আমরা বুঝি না, এসব অনুষ্ঠান পালন করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা। এত দূর শক্তি জেগে ওঠা যে, বড় বড় লাভজনক কাজও কেবল আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে ভয় করে (নিজের মন শক্ত করে) তা পরিত্যাগ করতে হবে। কঠিন বিপদের কাজেও যেন কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিজের মন শক্ত করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ শক্তি আমাদের মধ্যে আসবে, যখন রোজার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারব এবং রমজানের পুরো মাস আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় নিজের মনকে নফসের খায়েশ থেকে ফিরিয়ে রাখব। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রস্তুত হব।
লেখক : ইমাম ও খতিব, হাতিরঝিল জামে মসজিদ, ঢাকা।
No comments