বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি by মো. আবু সালেহ সেকেন্দার
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবারও অস্থির
হয়ে উঠছে। ওই অস্থিরতার পেছনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষকদের
আন্দোলনও কমবেশি দায়ী। আর শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত
করা যায়,
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির
ব্যাপারে উপাচার্যের উদাসীনতার বিষয়টি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় যার বড়
নজির। সেখানে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতি করে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ
উত্থাপিত হলেও উপাচার্য ওই বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, গণমাধ্যম
সূত্রে আমরা এমন অভিযোগ পেয়েছি। ওই অভিযুক্ত শিক্ষক বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও
ডিনের দায়িত্ব পালন করছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকদের সুদীর্ঘ
কর্মবিরতির অন্যতম কারণও উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত শিক্ষক নিয়োগে
অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি। একটি জাতীয় দৈনিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক নিয়োগ ও দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বর্তমান
উপাচার্য সম্প্রতি সিনেট সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছেন। এর আগেও মহাজোট
সরকারের বিদায়ী প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও একই
অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনিয়মের বিষয়টি শতভাগ সত্য, এমনটি সর্বদা নাও হতে পারে। কখনো-সখনো বিরোধীপক্ষ কোনো শিক্ষককে ফাঁসাতে গিয়ে অথবা উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন তৈরি করতে ওই ধরনের ইস্যু তৈরির ঘটনাও বিরল নয়। আমার জানা মতে, ওই ধরনের বহু নজির রয়েছে। এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনবার প্রমোশন নেওয়ার অভিযোগ শুনেছিলাম। বিষয়টি অনেকটা এই রকম : পরপর তিন বছরে, এমনকি কয়েক মাসের ব্যবধানে তিনি সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন। ওই সংবাদ অবগত হয়ে মর্মাহত হয়েছি। কিন্তু যখন ওই সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি, তখন বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি অধ্যাপক পদে আবেদন করার মতো সব ধরনের যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। পিএইচডি সম্পন্নও বিগত প্রতিষ্ঠানে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত ওই সহকর্মীর মতে, বিভাগে অধ্যাপক পদে কোনো বিজ্ঞপ্তি না থাকাতে বিজ্ঞপ্তি সাপেক্ষে তিনি একই সঙ্গে সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদন করেছিলেন। প্রথমে সহকারী অধ্যাপক পদে ভাইভা হওয়ায় তিনি ওই পদে নিয়োগ লাভ করেন। ওই নিয়োগ লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং সহযোগী অধ্যাপক পদেও নিয়োগ পান। এরই মধ্যে অধ্যাপক পদে বিজ্ঞপ্তি হওয়ায় তিনি ওই পদের জন্য আবেদন করেন এবং যথারীতি নিয়োগ পান। ওই ঘটনা নিঃসন্দেহে মিরাকল। আমার ওই সহকর্মী হয়তো ভাগ্যবান অথবা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে ওই রকম সুযোগ পেয়েছেন। তবে সর্বদা একই ধরনের ঘটনা ঘটে বিষয়টি এমন নয় অথবা ওই ধরনের উদাহরণ দিয়ে উপাচার্যরা দুর্নীতি ও অনিয়ম একেবারেই করেন না সে রকমটি বলারও কোনো সুযোগ নেই।
বরং দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতির ঘটনা অহরহ ঘটে। আবার যোগ্য প্রার্থীদের যেমন নিয়োগ দেওয়া হয় না, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীদের পদোন্নতি আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে; যেগুলো হয়তো সংবাদপত্রে সচরাচর প্রকাশিত হয় না। এমনকি কাউকে নিয়োগ বা পদোন্নতি দিতে অথবা আটকাতে আইন পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটে। তবে যাই হোক, ওই ধরনের ঘটনা ঘটে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক কারণে বা প্রতিহিংসাবশত; যদিও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে যা কখনোই কাম্য ছিল না। আরেকটি কথা না বললেই নয়, যাঁরা উপাচার্য পদে আসীন হন, তাঁরা একদা শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই ওই পদ লাভে সক্ষম হয়েছেন ধরে নেওয়া হয়। আর যখন শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা ছিল তখন তাঁরা শিক্ষকদের বিভিন্ন ফোরামে উপাচার্যের দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়ম, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান বন্ধ, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন প্রভৃতি বিষয়ে বেশ সোচ্চার থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্যাম্পাসে অস্থিরতা দেখা দেয় তার মূলে ওই নিয়োগ-বাণিজ্যই মূল কারণ। মাঝেমধ্যে ওই শিক্ষক নিয়োগের ধারাবাহিকতায় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও অনিয়মের বিস্তার ঘটে। ওই অনিয়মের বিষয়টি যখন সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন অবহিত হয়; তখন তারাও হালুয়া-রুটির ভাগ পেতে উপাচার্যের ওপর প্রভাব খাটাতে তৎপর হয়। যেসব উপাচার্যের পায়ের তলার মাটি শক্ত তাঁরা ওই বিষয়টি শক্তভাবে প্রতিকার করেন। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল উপাচার্যরা নিজের চেয়ার ঠিক রাখতেই ছাত্রসংগঠনগুলোকে ভাগ দেন। না হয়, নানা অজুহাতে ক্যাম্পাস অস্থির করার ঘটনা আমরা বহুবার দেখেছি। সম্প্রতি হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হাড়ে হাড়ে বিষয়টি টের পেয়েছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের স্ত্রীকে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ না দেওয়ায় তারা সাত শিক্ষককে বেধড়ক পিটিয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী নীল দলের কার্যকরী কমিটির অনেক শিক্ষকও নিয়োগকে কেন্দ্র করে বহুবার লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত ধরনের নোংরা ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি হয়, তার অন্যতম কারণ ওই নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি।
শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাসহ সব নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হওয়া জরুরি। মেধা ও যোগ্যতাই হোক নিয়োগের মাপকাঠি। উপাচার্যরা যেহেতু সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন; সেই কারণে ওই অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ভার সরকারের ওপরও বর্তায়। তাই সরকার ওই বিষয়ে নজর রাখবে বলে আমরা আশা করি। তবে বিরোধিতার খাতিরেই উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে মাসের পর মাস আন্দোলন করে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করার পক্ষপাতী, আমি নই। ঢালাওভাবে সব উপাচার্য অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন সচরাচর এমন অভিযোগ উত্থাপনেরও কোনো যৌক্তিকতা নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও এমন অনেকেই এখনো আছেন- যাঁরা মেধা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, উৎকর্ষ ও গবেষণা উপাচার্য বা শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি হলে, তাঁরাই হতেন ওই পদের সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী। তাই উপাচার্যের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ অথবা কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হলে, প্রমাণিত না হওয়ার আগে গণমাধ্যমে প্রকাশ থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ওই বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সর্বোত্তম পন্থা। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপসারণ নয়, বিচার সাপেক্ষে শাস্তিও হতে পারে। আর ওই বিষয়ে যদি ইউজিসির উদাসীনতা ও সরকারের গাফিলতি পরিলক্ষিত হয় এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়; তবে তখনই কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে উপাচার্যের অপসারণের বিষয়টি যৌক্তিক। ওই আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে সব শিক্ষকেরও অংশগ্রহণ কাম্য। আর সাধারণত ওই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কোনো রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় নয়, সচেতন সাধারণ শিক্ষকরা বিবেকের তাগিদেই ওই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন, তা অতীতে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই একদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া; অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযথা অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থির না করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা, একজন শিক্ষকের যথার্থ দায়িত্ব বলে মনে হয়।
লেখক : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@gmail.com
উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনিয়মের বিষয়টি শতভাগ সত্য, এমনটি সর্বদা নাও হতে পারে। কখনো-সখনো বিরোধীপক্ষ কোনো শিক্ষককে ফাঁসাতে গিয়ে অথবা উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন তৈরি করতে ওই ধরনের ইস্যু তৈরির ঘটনাও বিরল নয়। আমার জানা মতে, ওই ধরনের বহু নজির রয়েছে। এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনবার প্রমোশন নেওয়ার অভিযোগ শুনেছিলাম। বিষয়টি অনেকটা এই রকম : পরপর তিন বছরে, এমনকি কয়েক মাসের ব্যবধানে তিনি সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন। ওই সংবাদ অবগত হয়ে মর্মাহত হয়েছি। কিন্তু যখন ওই সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি, তখন বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি অধ্যাপক পদে আবেদন করার মতো সব ধরনের যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। পিএইচডি সম্পন্নও বিগত প্রতিষ্ঠানে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত ওই সহকর্মীর মতে, বিভাগে অধ্যাপক পদে কোনো বিজ্ঞপ্তি না থাকাতে বিজ্ঞপ্তি সাপেক্ষে তিনি একই সঙ্গে সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে আবেদন করেছিলেন। প্রথমে সহকারী অধ্যাপক পদে ভাইভা হওয়ায় তিনি ওই পদে নিয়োগ লাভ করেন। ওই নিয়োগ লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং সহযোগী অধ্যাপক পদেও নিয়োগ পান। এরই মধ্যে অধ্যাপক পদে বিজ্ঞপ্তি হওয়ায় তিনি ওই পদের জন্য আবেদন করেন এবং যথারীতি নিয়োগ পান। ওই ঘটনা নিঃসন্দেহে মিরাকল। আমার ওই সহকর্মী হয়তো ভাগ্যবান অথবা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে ওই রকম সুযোগ পেয়েছেন। তবে সর্বদা একই ধরনের ঘটনা ঘটে বিষয়টি এমন নয় অথবা ওই ধরনের উদাহরণ দিয়ে উপাচার্যরা দুর্নীতি ও অনিয়ম একেবারেই করেন না সে রকমটি বলারও কোনো সুযোগ নেই।
বরং দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতির ঘটনা অহরহ ঘটে। আবার যোগ্য প্রার্থীদের যেমন নিয়োগ দেওয়া হয় না, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীদের পদোন্নতি আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে; যেগুলো হয়তো সংবাদপত্রে সচরাচর প্রকাশিত হয় না। এমনকি কাউকে নিয়োগ বা পদোন্নতি দিতে অথবা আটকাতে আইন পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটে। তবে যাই হোক, ওই ধরনের ঘটনা ঘটে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক কারণে বা প্রতিহিংসাবশত; যদিও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে যা কখনোই কাম্য ছিল না। আরেকটি কথা না বললেই নয়, যাঁরা উপাচার্য পদে আসীন হন, তাঁরা একদা শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই ওই পদ লাভে সক্ষম হয়েছেন ধরে নেওয়া হয়। আর যখন শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা ছিল তখন তাঁরা শিক্ষকদের বিভিন্ন ফোরামে উপাচার্যের দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়ম, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান বন্ধ, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন প্রভৃতি বিষয়ে বেশ সোচ্চার থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্যাম্পাসে অস্থিরতা দেখা দেয় তার মূলে ওই নিয়োগ-বাণিজ্যই মূল কারণ। মাঝেমধ্যে ওই শিক্ষক নিয়োগের ধারাবাহিকতায় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও অনিয়মের বিস্তার ঘটে। ওই অনিয়মের বিষয়টি যখন সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন অবহিত হয়; তখন তারাও হালুয়া-রুটির ভাগ পেতে উপাচার্যের ওপর প্রভাব খাটাতে তৎপর হয়। যেসব উপাচার্যের পায়ের তলার মাটি শক্ত তাঁরা ওই বিষয়টি শক্তভাবে প্রতিকার করেন। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল উপাচার্যরা নিজের চেয়ার ঠিক রাখতেই ছাত্রসংগঠনগুলোকে ভাগ দেন। না হয়, নানা অজুহাতে ক্যাম্পাস অস্থির করার ঘটনা আমরা বহুবার দেখেছি। সম্প্রতি হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হাড়ে হাড়ে বিষয়টি টের পেয়েছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের স্ত্রীকে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ না দেওয়ায় তারা সাত শিক্ষককে বেধড়ক পিটিয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী নীল দলের কার্যকরী কমিটির অনেক শিক্ষকও নিয়োগকে কেন্দ্র করে বহুবার লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত ধরনের নোংরা ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি হয়, তার অন্যতম কারণ ওই নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি।
শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাসহ সব নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হওয়া জরুরি। মেধা ও যোগ্যতাই হোক নিয়োগের মাপকাঠি। উপাচার্যরা যেহেতু সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন; সেই কারণে ওই অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ভার সরকারের ওপরও বর্তায়। তাই সরকার ওই বিষয়ে নজর রাখবে বলে আমরা আশা করি। তবে বিরোধিতার খাতিরেই উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে মাসের পর মাস আন্দোলন করে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করার পক্ষপাতী, আমি নই। ঢালাওভাবে সব উপাচার্য অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন সচরাচর এমন অভিযোগ উত্থাপনেরও কোনো যৌক্তিকতা নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও এমন অনেকেই এখনো আছেন- যাঁরা মেধা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, উৎকর্ষ ও গবেষণা উপাচার্য বা শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি হলে, তাঁরাই হতেন ওই পদের সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী। তাই উপাচার্যের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ অথবা কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হলে, প্রমাণিত না হওয়ার আগে গণমাধ্যমে প্রকাশ থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ওই বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সর্বোত্তম পন্থা। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপসারণ নয়, বিচার সাপেক্ষে শাস্তিও হতে পারে। আর ওই বিষয়ে যদি ইউজিসির উদাসীনতা ও সরকারের গাফিলতি পরিলক্ষিত হয় এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়; তবে তখনই কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে উপাচার্যের অপসারণের বিষয়টি যৌক্তিক। ওই আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে সব শিক্ষকেরও অংশগ্রহণ কাম্য। আর সাধারণত ওই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কোনো রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় নয়, সচেতন সাধারণ শিক্ষকরা বিবেকের তাগিদেই ওই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন, তা অতীতে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই একদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া; অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযথা অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থির না করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা, একজন শিক্ষকের যথার্থ দায়িত্ব বলে মনে হয়।
লেখক : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@gmail.com
No comments