এক কিশোরী যৌনকর্মীর আত্মকাহিনী
এটি কোন কাল্পনিক লেখা নয়। ‘The Life Of A
Child Prostitute নামে এই লেখাটি ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় মার্চ
২০০৯ সালে, Unicef Bangladesh পরিচালিত মাসিক পত্রিকা Newsletter এর ১১ তম
ইস্যুতে।
এই লেখাকে ‘১৮+’ ট্যাগ দিলাম না। দিলাম বাস্তবতার
ট্যাগ। কারণ এটি এমন এক কিশোরীর বলা কাহিনী, যার নিজেরই এখনো ১৮
পেরোয়নি।আমার বাবা যখন মারা গেলেন, আমার বয়স তখন ছয় কি সাত। তখন থেকেই
আমার মায়ের কাঁধে সংসার চালানোর সব দায়িত্ব বর্তায়। তিনি বরিশালেরই
দুই-তিনটা বাসায় ঝিয়ের কাজ নেন। মা যখন কাজে যেতেন, আমি ১১ মাস বয়সী
আমার ছোট বোনের দেখাশোনা করতাম। আমরা ছিলাম তিনবোন। মেজো বোনের বয়স ছিল আট
আর আমার তের।
আমরা চারজন একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। কিন্তু সেটার ভাড়া ছিল অনেক বেশি। বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে আমার মায়ের রোজগার খুব বেশি হত না। তাই প্রায়ই আমাদের তিনবেলা খাবার যোগাড় করতে এমনকি বাড়িভাড়া মেটাতেও হিমশিম খেতে হত। তখন থেকেই আমার মনে এই ভাবনার উদ্রেক ঘটল যে আমাকেও এগিয়ে আসতে হবে সংসার চালানোয় মাকে সাহায্য করতে। তাই আমি ঠিক করলাম আমিও একটা চাকরি করব। কিন্তু এত কমবয়সী একটা মেয়েকে কে চাকরি দেবে? আমি না জানি লেখাপড়া, আর না পারি ভারি কোন কাজ করতে। তারপরও আমি এক বাসায় কাজ নিলাম। কিন্তু ঠিকমত কাজ করতে না পারায় মালকিনের হাতে রোজই মাকে মার খেতে হত। তার অধীনে কাজ করে উপার্জনও খুব একটা হত না। সে শুধু আমাকে একবেলা খেতে দিত। কাজেই সংসার চালানোয় মাকে সাহায্য করা ওই কাজের মাধ্যমে আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তাই দুইমাস বাদেই ওই কাজ ছেড়ে আমি একজন যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করা আরম্ভ করলাম।
আমার মা জানতে পারল না আমি কোন পথে নেমেছি। খদ্দেরদের কাছে যখন ‘ঠেক’ খাটতে যেতাম, মাকে বলতাম যে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আর যখন মায়ের হাতে টাকা তুলে দিতাম, মা জানতে চাইত আমি কিভাবে এত টাকা পেলাম। মাকে বলতাম, আমি ইট ভাঙ্গার কাজ নিয়েছি। পাড়া-পড়শী সবাইকেই এই কথা বলে আসছিলাম।
একজন যৌনকর্মী হিসেবে আমার হাতে খড়ি হয় এক প্রতিবেশির মাধ্যমেই। উনাকে আমি ডাকতাম ‘কাকা’ বলে। সেই কাকাই একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন এক লোকের কাছে। তিনি আমাকে ওই লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আমার নতুন ‘কাকা’ হিসেবে। এই লোকটাকে সেদিনই আমি প্রথম দেখেছিলাম।
‘নতুন কাকা’ আমাকে বললেন উনার সাথে যেতে। আমিও গেলাম। এক হোটেলে। সেটাই ছিল আমার প্রথম। অনেক ব্যথা পেয়েছিলাম সেদিন। এরপর থেকে ফি হপ্তায় তিন-চারবার উনার সাথে যেতাম ওই হোটেলে। একদিন উনি আমাকে উনার সাথে উনার বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেদিন উনার বাড়িতে অন্য কেউ ছিল না। এরপর থেকে কখনো উনার সাথে হোটেলে যেতে লাগলাম, কখনো উনার বাড়িতে, যখন বাড়িতে তার বউ বা অন্য কেউ থাকত না।
এই ‘নতুন কাকা’ই আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন এক লোকের সাথে। সেই লোক একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন কুয়াকাটায়। বরিশাল থেকে বাসে কুয়াকাটা যেতে সময় লেগেছিল তিন ঘন্টা। ফেরার পথে সে আমাকে দেয় মাত্র ১০০টাকা। আমি সেদিন খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ হাজার টাকার কন্ট্রাক্টে তার সাথে আমি অতদুর গেছিলাম। আমাকে সে ব্যবহার করল ঠিকই কিন্তু শেষে তার বিশ্বাসঘাতকতারও শিকার হলাম। তাকে বাকি টাকা দেয়ার কথা বলতে আমাকে সে কষে একটা চড় মারল। আমি তারপর চুপ করে যাই। কিন্তু এই দুঃখের কথা কখনো কাউকে বলতে পারিনি।
আমি কনডম ব্যবহার করতাম না। আমি ভাবতাম, দেড়-দুই ঘন্টার নরক যন্ত্রনা ভোগ করে পাচ্ছিই তো মাত্র একশ টাকা। তার থেকে আবার ৫০ টাকা কনডমের পেছনে নষ্ট করলে আমার হাতে তো আর কিছুই থাকে না। আমার খদ্দেররাও কনডম ব্যবহারে খুব একটা সচেতন ছিল না।
সাধারণত বয়স্করাই আমাকে ভাড়া করত। তাদের বয়স থাকত ৪০-৪৫ এর মধ্যে। এদের কেউই খুব একটা বড়লোক ছিল না। আমার প্রতিবেশি কাকাই এদের সাথে আমার যোগাযোগে দালালের কাজ করতেন। মাঝেমধ্যে কাকাও আমাকে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এর বিনিময় তিনি আমাকে কিছু দিতেন না। তার কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে ভয় দেখিয়ে বলতেন যে বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমার মাকে বলে দেবেন আমি কি করি। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে মুখ বুজে এসব অত্যাচার সহ্য করতে হত। আবার দালালির বিনিময় মাস শেষে কাকা আমার কাছ থেকে মোটা টাকাও হাতিয়ে নিতেন। সেই একই ভয় দেখিয়ে!
আমার খুব কষ্ট হয়। এ কষ্ট যে শুধু শারীরিক, তা নয়। মানসিক কষ্টও বটে! মাসিকের (পিরিয়ড) সময়ও যখন ‘খেপ’ খাটতে হয়, তখন আমার খুবই রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু এ দেখে খদ্দেররা কিন্তু একটুও সহায় হয় না। তারা সবসময় ব্যস্ত থাকে তাদের পয়সা উসুল করতে। আরও মজার বিষয়, এই জঘন্য কাজ আরম্ভের আগে আমার মাত্র দুইবার মাসিক হয়েছিল। তাহলেই বুঝুন, কত কম বয়সে আমার জীবনটা নরকে পরিণত হয়েছে!
আমি চাই এই কাজ থেকে সরে আসতে। কিন্তু জানি, আমার এই ইচ্ছে পূরণ হবার নয়। প্রথমত, অর্থের খুব অভাব আমার। আর দ্বিতীয়ত, এ এমনই এক পেশা যাতে ঢোকা অনেক কঠিন। কিন্তু এ থেকে বেরোনো? সেটা প্রায় অসম্ভব।
আমরা চারজন একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। কিন্তু সেটার ভাড়া ছিল অনেক বেশি। বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে আমার মায়ের রোজগার খুব বেশি হত না। তাই প্রায়ই আমাদের তিনবেলা খাবার যোগাড় করতে এমনকি বাড়িভাড়া মেটাতেও হিমশিম খেতে হত। তখন থেকেই আমার মনে এই ভাবনার উদ্রেক ঘটল যে আমাকেও এগিয়ে আসতে হবে সংসার চালানোয় মাকে সাহায্য করতে। তাই আমি ঠিক করলাম আমিও একটা চাকরি করব। কিন্তু এত কমবয়সী একটা মেয়েকে কে চাকরি দেবে? আমি না জানি লেখাপড়া, আর না পারি ভারি কোন কাজ করতে। তারপরও আমি এক বাসায় কাজ নিলাম। কিন্তু ঠিকমত কাজ করতে না পারায় মালকিনের হাতে রোজই মাকে মার খেতে হত। তার অধীনে কাজ করে উপার্জনও খুব একটা হত না। সে শুধু আমাকে একবেলা খেতে দিত। কাজেই সংসার চালানোয় মাকে সাহায্য করা ওই কাজের মাধ্যমে আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তাই দুইমাস বাদেই ওই কাজ ছেড়ে আমি একজন যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করা আরম্ভ করলাম।
আমার মা জানতে পারল না আমি কোন পথে নেমেছি। খদ্দেরদের কাছে যখন ‘ঠেক’ খাটতে যেতাম, মাকে বলতাম যে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আর যখন মায়ের হাতে টাকা তুলে দিতাম, মা জানতে চাইত আমি কিভাবে এত টাকা পেলাম। মাকে বলতাম, আমি ইট ভাঙ্গার কাজ নিয়েছি। পাড়া-পড়শী সবাইকেই এই কথা বলে আসছিলাম।
একজন যৌনকর্মী হিসেবে আমার হাতে খড়ি হয় এক প্রতিবেশির মাধ্যমেই। উনাকে আমি ডাকতাম ‘কাকা’ বলে। সেই কাকাই একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন এক লোকের কাছে। তিনি আমাকে ওই লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আমার নতুন ‘কাকা’ হিসেবে। এই লোকটাকে সেদিনই আমি প্রথম দেখেছিলাম।
‘নতুন কাকা’ আমাকে বললেন উনার সাথে যেতে। আমিও গেলাম। এক হোটেলে। সেটাই ছিল আমার প্রথম। অনেক ব্যথা পেয়েছিলাম সেদিন। এরপর থেকে ফি হপ্তায় তিন-চারবার উনার সাথে যেতাম ওই হোটেলে। একদিন উনি আমাকে উনার সাথে উনার বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেদিন উনার বাড়িতে অন্য কেউ ছিল না। এরপর থেকে কখনো উনার সাথে হোটেলে যেতে লাগলাম, কখনো উনার বাড়িতে, যখন বাড়িতে তার বউ বা অন্য কেউ থাকত না।
এই ‘নতুন কাকা’ই আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন এক লোকের সাথে। সেই লোক একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন কুয়াকাটায়। বরিশাল থেকে বাসে কুয়াকাটা যেতে সময় লেগেছিল তিন ঘন্টা। ফেরার পথে সে আমাকে দেয় মাত্র ১০০টাকা। আমি সেদিন খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ হাজার টাকার কন্ট্রাক্টে তার সাথে আমি অতদুর গেছিলাম। আমাকে সে ব্যবহার করল ঠিকই কিন্তু শেষে তার বিশ্বাসঘাতকতারও শিকার হলাম। তাকে বাকি টাকা দেয়ার কথা বলতে আমাকে সে কষে একটা চড় মারল। আমি তারপর চুপ করে যাই। কিন্তু এই দুঃখের কথা কখনো কাউকে বলতে পারিনি।
আমি কনডম ব্যবহার করতাম না। আমি ভাবতাম, দেড়-দুই ঘন্টার নরক যন্ত্রনা ভোগ করে পাচ্ছিই তো মাত্র একশ টাকা। তার থেকে আবার ৫০ টাকা কনডমের পেছনে নষ্ট করলে আমার হাতে তো আর কিছুই থাকে না। আমার খদ্দেররাও কনডম ব্যবহারে খুব একটা সচেতন ছিল না।
সাধারণত বয়স্করাই আমাকে ভাড়া করত। তাদের বয়স থাকত ৪০-৪৫ এর মধ্যে। এদের কেউই খুব একটা বড়লোক ছিল না। আমার প্রতিবেশি কাকাই এদের সাথে আমার যোগাযোগে দালালের কাজ করতেন। মাঝেমধ্যে কাকাও আমাকে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এর বিনিময় তিনি আমাকে কিছু দিতেন না। তার কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে ভয় দেখিয়ে বলতেন যে বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমার মাকে বলে দেবেন আমি কি করি। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে মুখ বুজে এসব অত্যাচার সহ্য করতে হত। আবার দালালির বিনিময় মাস শেষে কাকা আমার কাছ থেকে মোটা টাকাও হাতিয়ে নিতেন। সেই একই ভয় দেখিয়ে!
আমার খুব কষ্ট হয়। এ কষ্ট যে শুধু শারীরিক, তা নয়। মানসিক কষ্টও বটে! মাসিকের (পিরিয়ড) সময়ও যখন ‘খেপ’ খাটতে হয়, তখন আমার খুবই রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু এ দেখে খদ্দেররা কিন্তু একটুও সহায় হয় না। তারা সবসময় ব্যস্ত থাকে তাদের পয়সা উসুল করতে। আরও মজার বিষয়, এই জঘন্য কাজ আরম্ভের আগে আমার মাত্র দুইবার মাসিক হয়েছিল। তাহলেই বুঝুন, কত কম বয়সে আমার জীবনটা নরকে পরিণত হয়েছে!
আমি চাই এই কাজ থেকে সরে আসতে। কিন্তু জানি, আমার এই ইচ্ছে পূরণ হবার নয়। প্রথমত, অর্থের খুব অভাব আমার। আর দ্বিতীয়ত, এ এমনই এক পেশা যাতে ঢোকা অনেক কঠিন। কিন্তু এ থেকে বেরোনো? সেটা প্রায় অসম্ভব।
No comments