চৈতন্যের মুক্তবাতায়ন-'বাংলার সার্বভৌমত্ব রাখতে যদি চাও' by যতীন সরকার
আজকের বাংলাদেশ অনেক সমস্যা-সংকটে জর্জরিত। লুটপাটতন্ত্রীদের কবলে পড়ে দেশের মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে নিপতিত। রাষ্ট্রনীতি-অর্থনীতির সব 'তন্ত্র' আজ এ দেশ থেকে নির্বাসিত, লুটপাটতন্ত্রই সর্বাধিনায়ক।
নানা নামের 'হায় হায় কম্পানি' দেশের অনেক মানুষকে সর্বস্বান্ত করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে, কিংবা শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতে বহু মানুষের মাথায় হাত পড়েছে- এমন সংবাদ ও সংবাদভাষ্যের ছড়াছড়ি সব সংবাদমাধ্যমে।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির খবরে দেশ-বিদেশে যখন তোলপাড় চলছে, তখন আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদই বলে দিয়েছেন, 'দেশে বিভিন্ন সেক্টরে যে পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে, তা দিয়ে প্রতিবছর একটি করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।' এ কথার পর দুর্নীতি নিয়ে আমাদের আর কোনো বাক্বিস্তার করার প্রয়োজনই পড়ে না। তবে বিশ্বব্যাংক আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাহায্য ছাড়া (অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক সাম্রাজ্যবাদের কাছে জোড়হাতে নতশির হয়ে থাকা ছাড়া) বাংলাদেশের বাঁচার কোনো উপায় নেই বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের জন্য ভাবনার খোরাক আছে স্পিকার সাহেবের বক্তব্যে।
তবে বাঁচার পথ যে ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছে, সে কথাও না বলে পারা যায় না। বিরামহীন মৃত্যুর মিছিলের দিকে তাকিয়ে বলতেই হয়, 'দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।' মৃত্যুর ফাঁদ পাতা সর্বত্র ও সর্বদা। পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু তো দেশে এখন নিত্যদিনের ঘটনা। আপন শয্যাগৃহেও কেউ নয় মৃত্যুর শঙ্কামুক্ত। দেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিযুক্ত বাহিনীর হেফাজতে অনেকে 'হৃদরোগে' আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে- এমন কথা বেশ কিছু দিন শুনলাম। তার কিছু দিন পর হঠাৎ এ রকম হৃদরোগ বন্ধ হয়ে গেল। তখন মৃত্যু হতে লাগল 'ক্রস ফায়ারে'। এখন বেশ কিছু দিন ধরে এমন ধারা মৃত্যুর কথা শুনি না, শুনি নানাজনের 'গুম' ও 'অপহৃত' হয়ে যাওয়ার খবর। আসলে মৃত্যুই এসবেরও গন্তব্য। কারো জন্যই নেই 'স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি'।
তাই 'স্বাধীন হলাম, মুক্তি পেলাম না'- গানের এ রকম কলির ভেতরই মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা প্রতিনিয়ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কখনো প্রত্যক্ষ এবং কখনো পরোক্ষ জঙ্গিশাসনে মানুষ বঞ্চিত থেকেছে সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে। জঙ্গি শাসকরাই বাংলাদেশের অসাধারণ সংবিধানটিকে কেটেছেঁটে এর ভেতরে পাকিস্তানের শাঁস ঢুকিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অধিকার বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে, বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশের পথ খুলে দিয়েছে। শুধু অনুপ্রবেশ নয়, সাম্রাজ্যবাদই যেন আজ আমাদের প্রভুর আসনে আসীন। আমাদের অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদের কবজায়, দেশটি পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর অবাধ শোষণের চারণভূমিতে। সাম্রাজ্যবাদের হুকুমে ও ধমকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ধরেছে মরণদশায়।
এমন ভূরি ভূরি সমস্যা ও সংকটের কথা লিখে পাতার পর পাতা ভরে দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। আসল প্রয়োজন সমস্যার সমাধানসূত্র ও সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা। এরই জন্য প্রয়োজন, যারা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলশক্তির ধারক, তাদের অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করা। শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয়, সব সমাজ-সংসারের মূলশক্তিরও ধারক তারাই। কবিগুরুর ভাষায়-
চাষি ক্ষেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল,-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারই 'পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।
চাষি-তাঁতি-জেলে- এরা সবাই মূলত বৃহত্তর কৃষকসমাজের অন্তর্ভুক্ত। এই কৃষকসমাজই, আগে তো বটেই, এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলশক্তি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সৈনিকদের গরিষ্ঠসংখ্যকই এই কৃষকসমাজের মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশেও এই সমাজটিই উৎপাদনের কর্ণধার। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ও ঘটছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্বই কৃষকসমাজের মানুষের। এক সময় গাঁয়ের কৃষকদের ছিল 'উঠান সমুদ্র'। অর্থাৎ নিজের উঠানের তথা একান্ত আপন ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যেই সীমিত ছিল তাদের অবস্থান ও বিচরণ। এমন কি নিজের গ্রাম কিংবা আশপাশের গ্রামের বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের সামান্য সংযোগও ছিল না। এখন সেই কৃষকের ছেলেরাই দূর বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, তাদের গায়ের রক্ত-জল করা শ্রমের অর্জনেই বাংলাদেশের অর্থভাণ্ডারের সমৃদ্ধি ঘটছে। শুধু ছেলেরা নয়, গাঁয়ের মেয়েরাও আজ ঘরের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে থাকছে না। দেশে পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের মূলশক্তি গাঁয়ের মেয়েরাই। তারা অবরোধের বাঁধন ছিঁড়ে গাঁয়ের সীমানা উল্লঙ্ঘন করে নগরবাসিনী হয়েছে। যে মেয়েরা ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করত, পাটের শিকা তৈরি করত কিংবা রুমালে ফুল তুলত, তাদের সেই শিল্পিত হাত আজ শিল্পশ্রমে নিয়োজিত। তাদের শ্রমই বাংলাদেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস। অর্থাৎ কৃষক ও কৃষকের ছেলেমেয়েরাই দেশের সিংহভাগ সম্পদের জোগানদার। এখনকার চেয়ে অর্ধেক লোকসংখ্যা ছিল যখন, তখনো এ দেশে ছিল খাদ্যঘাটতি, প্রায় প্রতিবছরই পড়তে হতো দুর্ভিক্ষের কবলে। অথচ সনাতন ধারার হাল-লাঙল ছেড়ে এবং উচ্চফলনশীল বীজ ও উৎপাদন সহায়ক নানা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসহ নবতন যন্ত্রশক্তিকে আশ্রয় করে বাংলার কৃষকই উৎপাদনশক্তিকে বহু বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের পুরোপুরি উৎসাদন ঘটাতে না পারলেও তার প্রতাপ খর্ব করতে সক্ষম হয়েছে। 'গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলা গান'-এর স্বপ্ন আমরা দেখে আসছি অনেক দিন, কিন্তু তার বাস্তব রূপ সৃষ্টি করতে পারিনি। সেই সৃষ্টিতেই নিয়োজিত রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকের লাখ লাখ হাত। কিন্তু সৃষ্টিকর্মে সনাতন পদ্ধতির বদলে নবতন যন্ত্রকৌশলের প্রয়োগ ঘটিয়েও জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি ঘটেনি তাদের। উৎপাদিত ধান তাদের গোলায় ওঠেনি, গলায় আনন্দের গানের সুর ধ্বনিত হয়নি। কারণ উৎপাদনের কর্ণধার হয়েও উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা তাদের হাতে নেই। উৎপাদনযন্ত্র তথা উৎপাদনের উপকরণের মালিকদের হাতে তারা শোষিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ হচ্ছে আগের মতোই। কিংবা আগের চেয়েও অনেক বেশি। এখনো 'মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ, মাটির মালিক তাহারাই হন' এবং 'সন্তানসম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়'। তবে এই শোষিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ কৃষকদের জীবনভাবনায় কিন্তু অনেক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে। জীবনযন্ত্রণাকে আজ আর তারা নীরবে সহ্য করে না, প্রতিকারের পথ খোঁজে। অদৃষ্ট-বিশ্বাসের হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে না পারলেও তারা আর সব কিছুকেই অদৃষ্টের মার বা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিতে রাজি নয়। প্রাপ্য ভাগ থেকে বঞ্চিত করে তাদের ভাগ্যহীন বানিয়েছে যারা, সেই বঞ্চক ও শোষকদের আজ তারা চিনে ফেলেছে। চিনে ফেলেই তাদের প্রতিরোধ করতে প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে। প্রতিরোধ করতে না পারলে প্রতিবাদ করছে। প্রতিবাদ করাও যখন সম্ভব হয় না, তখন অন্তত মনে মনে ঘৃণা করছে। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। উৎপাদনকর্মে যেমন তারা সনাতনের বদলে নবতন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, জীবনভাবনা ও ভাবনা প্রকাশেও তেমনই নবতনী হয়ে উঠেছে। আর এ ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে নারীরা। দুই দিন আগেও গ্রামের কৃষকসমাজের নারীরা ছিল অসূর্যম্পশ্যা। সেই নারীরা গ্রামীণজীবনের বৃত্তের বাইরে নগরে-বন্দরে গিয়ে মাথার ঘোমটা খুলে ফেলে জীবনসংগ্রামে নিরত হয়েছে, তাদের ভাবনার বৃত্তটিও হয়েছে নবায়িত ও প্রসারিত। গ্রামীণজীবনে এই নারীরা লোকসংস্কারজাত যেসব মানস প্রতিবন্ধে বাঁধা পড়ে ছিল, অন্যতর পরিবেশে সেসবের অনেক কিছুই দূর হয়ে যায়, পরম্পরাগত লোকসংস্কারের বদলে তাদের চিত্তে সঞ্চারিত হয় সংগ্রামী শ্রেণীচেতনা। তাদের এ রকম নবায়িত ও প্রসারিত শ্রেণীচেতনার বিশেষ প্রকাশ প্রত্যক্ষ করছি পোশাকশিল্পে নিয়োজিত নারীদের মধ্যে। লম্পটের লালসার আগুন তাদের অনেকের সম্ভ্রমহানি ঘটাচ্ছে, শিল্পমালিকের সীমাহীন লোভ ও অসভ্য অমানবিকতা তাদের জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ করে হত্যা করছে। কিন্তু নবজাগ্রত এই নারীশক্তির হৃদয়ে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, সেই ঘৃণা-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আগুন নিভিয়ে ফেলার সাধ্য কোনো অপশক্তিরই নেই। সেই আগুন অবশ্যই ছড়িয়ে যাবে সবখানে। ছড়িয়ে যাবে এক শিল্প থেকে আরেক শিল্পে। ছড়িয়ে যাবে শহর থেকে গ্রামে, শহরের কলকারখানা থেকে গ্রামের ক্ষেত-খামারে।
সে রকম ঘটার সূচনা এখনই ঘটে গেছে। বিগত ২০০৬ সালে পোশাকশিল্পের নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা যখন শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াকু অবস্থান গ্রহণ করেছিল, তখন প্রায় একই সময়ে কানসাটে ও ফুলবাড়ীতে পুরুষদের সঙ্গে গ্রামীণ নারীরাও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরুদ্ধে এখনো চলছে নারী-পুরুষের সম্মিলিত সংগ্রাম। একই ধারায় চলছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষার সংগ্রামও। এখানে-ওখানে এ রকম সংগ্রামের দৃষ্টান্ত প্রতিনিয়তই স্থাপিত হচ্ছে।
তবে বিভিন্ন রকমের পৃথক পৃথক সমস্যার মোকাবিলায় বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো এখনো সংহত জাতীয় রূপ ধারণ করছে না। এমন কি অতীতে টংকপ্রথাবিরোধী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন কিংবা নানকার আন্দোলনের মতো স্থানীয়ভাবে সংঘটিত কোনো শক্তিশালী কৃষক আন্দোলনও দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না। এ কারণেই অনেকে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করছেন। লুটপাটতন্ত্রের চক্করেই দেশটি ঘুরপাক খেতে থাকবে- এমন নেতিবাচক ভাবনাও অনেকের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সমাজের অগ্রগমনের দ্বান্দ্বিক নিয়ম সম্পর্কে অনবহিতি ও অসচেতনতাই এ রকম হতাশা ও নেতিবাচক ভাবনার জনয়িতা।
মনে রাখতে হবে, অতীতের কোনো ঘটনারই হুবহু অনুবর্তন কখনো ঘটে না। অনুবর্তন নয়, পরিবর্তনকে অঙ্গে ধারণ করেই ঘটে প্রতিটি ঘটনা। কাল ও দেশ (স্থান) উভয়ত্রই এই পরিবর্তন ঘটে। দেশকালের পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটার বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়ম আছে। সেই নিয়মে কালের প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনই পরিবর্তন ঘটে দেশের মানুষের মনোজগতেও। মনোজগতের সেই পরিবর্তনই আবার দেশের বাস্তব পরিবেশে এমন রূপান্তরমুখী নতুন ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেয়, যাতে পুরনো ঘটনার অনুবর্তন ঘটে না। তাই এখনকার কৃষকদের সংগ্রামও আগের চেয়ে অন্য রকম রূপ ধারণ করেছে ও করছে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ও হচ্ছে। সেই মাত্রা যোগ করেছে নারীরা। পূর্বেকার কৃষক আন্দোলনেও নারীদের যোগ ছিল বটে। নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে টংক আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন আদিবাসী নারী রাসিমণি, শঙ্খমণি ও রেবতি। তেভাগার সংগ্রামেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অংশগ্রহণ করেছিলেন দীপেশ্বরী, জয়মণি, রোহিনী, তাঞ্চানি, কুলেশ্বরী, বুধমণি, বুড়িমা, সরলা এবং এ রকম আরো অনেক কৃষক রমণী। তবে সেদিনকার এই সংগ্রামী নারীদের চৈতন্য ছিল গ্রামীণ কৃষকসমাজেরই বৃত্তাবদ্ধ। শিল্প শ্রমিকদের ভাবজগতের সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না। কিন্তু এখনকার গ্রামীণ নারীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শিল্প শ্রমিকে পরিণত, শিল্প মালিকদের শোষণ-প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত এবং সেই শোষণবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের চেতনাও রূপান্তরিত। পুরো রূপান্তর অবশ্যই ঘটেনি, তাদের শ্রেণীচেতনা সমাজের আমূল বদল ঘটানোর বিপ্লবী প্রত্যয় এখনো ধারণ করেনি। তবে ঘটনাধারা সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে, খণ্ড খণ্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে অখণ্ড বৈপ্লবিক চেতনার উদ্বোধন ঘটছে। শিল্প শ্রমিকদের শ্রেণীচেতনা কৃষকের ভেতরেও সঞ্চারিত হচ্ছে। এই চেতনা ধারণ করে দেশজুড়ে শ্রমিক-কৃষকদের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান যে ঘটবেই- এমন প্রত্যাশা মোটেই অসম্ভবের প্রত্যাশা নয়।
এমন প্রত্যাশার উপাদান জড়িত-মিশ্রিত হয়ে আছে আবহমান বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির পরতে পরতে। লোকায়ত সংস্কৃতি সর্বদাই বিদ্রোহী চৈতন্যের ধারক, সে সংস্কৃতি কোনোদিনই সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়নি। চর্যাপদ থেকে শুরু করে এ কালের বাউল গান পর্যন্ত সর্বত্রই তার প্রমাণ বিধৃত। এ কালের বাংলাদেশের লোকসমাজের কবি তো শুধু বিদ্রোহী নন, রীতিমতো বৈপ্লবিক ভাবনার বাহক ও প্রচারক। লোকসমাজের এ রকমই একজন কবি শাহ্ আবদুল করিম 'শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা'র প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলার লোকসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন- 'বাংলার সার্বভৌমত্ব রাখতে যদি চাও/শোষণের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে দাঁড়াও রে।' একান্ত স্পষ্ট ও নির্দ্বিধ বৈজ্ঞানিক প্রত্যয় তাঁর এই আহ্বানের পেছনে ক্রিয়াশীল। অত্যন্ত সঠিকভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু রূপে তিনটি শয়তানকে তিনি চিহ্নিত করেছেন-
বড় শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে
মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে
সামন্তবাদ জালিম বটে দয়া নাই তাহার মনে
তিন শয়তানের লীলাভূমি শ্যামল মাটি সোনার বাংলার
গরিবের বুকের রক্তে রঙিন হলো বারে বার
সোনার বাংলা করলো ছারখার সাম্রাজ্যবাদ শয়তানে
স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মজা মারলো শোষকে
এখন সবাই বুঝতে পারে চাবি ঘুরছে কোন পাকে
মধু হয় না বল্লার চাকে বাউল আবদুল করিম জানে
একা শাহ্ আবদুল করিমই নন, লোকসাধারণের সবাই এই শয়তানদের চিনে ও জেনে ফেলেছে। কিন্তু তাদের এই চেনা-জানাটাকে ভুলিয়ে দিতে চায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্তৃত্বশীল নানা জাতের লুটপাটতন্ত্রী। কর্তৃত্বের ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থাকলেও তারা সবাই মিলেই সাম্রাজ্যবাদকে ডেকে এনেছে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্রনীতিকে বিকৃত পুঁজিবাদের ঘোলাজলের ডোবায় ডুবিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের ভূতকে বাংলাদেশের ঘাড়ে বসিয়েছে, দেশটিকে সামন্তবাদী ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়েছে, অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়ে অপরাজনীতি কায়েম করে রেখেছে। না, আর অন্ধকারের কথা নয়। এর আগে যা যা বলেছি, সে সব কথা স্মরণ করেই বলি, অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, দেশের লোকসাধারণ নবচেতনায় জেগে উঠেছে। নবজাগ্রত লোকসাধারণই পাকিস্তানের ভূত তাড়াবে, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের উৎসাদন ঘটাবে, সাম্রাজ্যবাদের খবরদারির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবে, লোককবির আহ্বানে সাড়া দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে দাঁড়াবে, স্বাধীনতার মূল্যবোধের পূর্ণ ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাদানের মধ্য দিয়ে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি তারাই ঘটাবে। অতএব, মাভৈঃ!
লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির খবরে দেশ-বিদেশে যখন তোলপাড় চলছে, তখন আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদই বলে দিয়েছেন, 'দেশে বিভিন্ন সেক্টরে যে পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে, তা দিয়ে প্রতিবছর একটি করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।' এ কথার পর দুর্নীতি নিয়ে আমাদের আর কোনো বাক্বিস্তার করার প্রয়োজনই পড়ে না। তবে বিশ্বব্যাংক আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাহায্য ছাড়া (অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক সাম্রাজ্যবাদের কাছে জোড়হাতে নতশির হয়ে থাকা ছাড়া) বাংলাদেশের বাঁচার কোনো উপায় নেই বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের জন্য ভাবনার খোরাক আছে স্পিকার সাহেবের বক্তব্যে।
তবে বাঁচার পথ যে ক্রমেই দুর্গম হয়ে উঠছে, সে কথাও না বলে পারা যায় না। বিরামহীন মৃত্যুর মিছিলের দিকে তাকিয়ে বলতেই হয়, 'দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।' মৃত্যুর ফাঁদ পাতা সর্বত্র ও সর্বদা। পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু তো দেশে এখন নিত্যদিনের ঘটনা। আপন শয্যাগৃহেও কেউ নয় মৃত্যুর শঙ্কামুক্ত। দেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিযুক্ত বাহিনীর হেফাজতে অনেকে 'হৃদরোগে' আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে- এমন কথা বেশ কিছু দিন শুনলাম। তার কিছু দিন পর হঠাৎ এ রকম হৃদরোগ বন্ধ হয়ে গেল। তখন মৃত্যু হতে লাগল 'ক্রস ফায়ারে'। এখন বেশ কিছু দিন ধরে এমন ধারা মৃত্যুর কথা শুনি না, শুনি নানাজনের 'গুম' ও 'অপহৃত' হয়ে যাওয়ার খবর। আসলে মৃত্যুই এসবেরও গন্তব্য। কারো জন্যই নেই 'স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি'।
তাই 'স্বাধীন হলাম, মুক্তি পেলাম না'- গানের এ রকম কলির ভেতরই মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা প্রতিনিয়ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কখনো প্রত্যক্ষ এবং কখনো পরোক্ষ জঙ্গিশাসনে মানুষ বঞ্চিত থেকেছে সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে। জঙ্গি শাসকরাই বাংলাদেশের অসাধারণ সংবিধানটিকে কেটেছেঁটে এর ভেতরে পাকিস্তানের শাঁস ঢুকিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অধিকার বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে, বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশের পথ খুলে দিয়েছে। শুধু অনুপ্রবেশ নয়, সাম্রাজ্যবাদই যেন আজ আমাদের প্রভুর আসনে আসীন। আমাদের অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদের কবজায়, দেশটি পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর অবাধ শোষণের চারণভূমিতে। সাম্রাজ্যবাদের হুকুমে ও ধমকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ধরেছে মরণদশায়।
এমন ভূরি ভূরি সমস্যা ও সংকটের কথা লিখে পাতার পর পাতা ভরে দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। আসল প্রয়োজন সমস্যার সমাধানসূত্র ও সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা। এরই জন্য প্রয়োজন, যারা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলশক্তির ধারক, তাদের অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করা। শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয়, সব সমাজ-সংসারের মূলশক্তিরও ধারক তারাই। কবিগুরুর ভাষায়-
চাষি ক্ষেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল,-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারই 'পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।
চাষি-তাঁতি-জেলে- এরা সবাই মূলত বৃহত্তর কৃষকসমাজের অন্তর্ভুক্ত। এই কৃষকসমাজই, আগে তো বটেই, এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলশক্তি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সৈনিকদের গরিষ্ঠসংখ্যকই এই কৃষকসমাজের মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশেও এই সমাজটিই উৎপাদনের কর্ণধার। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ও ঘটছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্বই কৃষকসমাজের মানুষের। এক সময় গাঁয়ের কৃষকদের ছিল 'উঠান সমুদ্র'। অর্থাৎ নিজের উঠানের তথা একান্ত আপন ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যেই সীমিত ছিল তাদের অবস্থান ও বিচরণ। এমন কি নিজের গ্রাম কিংবা আশপাশের গ্রামের বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের সামান্য সংযোগও ছিল না। এখন সেই কৃষকের ছেলেরাই দূর বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, তাদের গায়ের রক্ত-জল করা শ্রমের অর্জনেই বাংলাদেশের অর্থভাণ্ডারের সমৃদ্ধি ঘটছে। শুধু ছেলেরা নয়, গাঁয়ের মেয়েরাও আজ ঘরের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে থাকছে না। দেশে পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের মূলশক্তি গাঁয়ের মেয়েরাই। তারা অবরোধের বাঁধন ছিঁড়ে গাঁয়ের সীমানা উল্লঙ্ঘন করে নগরবাসিনী হয়েছে। যে মেয়েরা ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করত, পাটের শিকা তৈরি করত কিংবা রুমালে ফুল তুলত, তাদের সেই শিল্পিত হাত আজ শিল্পশ্রমে নিয়োজিত। তাদের শ্রমই বাংলাদেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস। অর্থাৎ কৃষক ও কৃষকের ছেলেমেয়েরাই দেশের সিংহভাগ সম্পদের জোগানদার। এখনকার চেয়ে অর্ধেক লোকসংখ্যা ছিল যখন, তখনো এ দেশে ছিল খাদ্যঘাটতি, প্রায় প্রতিবছরই পড়তে হতো দুর্ভিক্ষের কবলে। অথচ সনাতন ধারার হাল-লাঙল ছেড়ে এবং উচ্চফলনশীল বীজ ও উৎপাদন সহায়ক নানা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসহ নবতন যন্ত্রশক্তিকে আশ্রয় করে বাংলার কৃষকই উৎপাদনশক্তিকে বহু বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের পুরোপুরি উৎসাদন ঘটাতে না পারলেও তার প্রতাপ খর্ব করতে সক্ষম হয়েছে। 'গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলা গান'-এর স্বপ্ন আমরা দেখে আসছি অনেক দিন, কিন্তু তার বাস্তব রূপ সৃষ্টি করতে পারিনি। সেই সৃষ্টিতেই নিয়োজিত রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকের লাখ লাখ হাত। কিন্তু সৃষ্টিকর্মে সনাতন পদ্ধতির বদলে নবতন যন্ত্রকৌশলের প্রয়োগ ঘটিয়েও জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি ঘটেনি তাদের। উৎপাদিত ধান তাদের গোলায় ওঠেনি, গলায় আনন্দের গানের সুর ধ্বনিত হয়নি। কারণ উৎপাদনের কর্ণধার হয়েও উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা তাদের হাতে নেই। উৎপাদনযন্ত্র তথা উৎপাদনের উপকরণের মালিকদের হাতে তারা শোষিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ হচ্ছে আগের মতোই। কিংবা আগের চেয়েও অনেক বেশি। এখনো 'মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ, মাটির মালিক তাহারাই হন' এবং 'সন্তানসম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়'। তবে এই শোষিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ কৃষকদের জীবনভাবনায় কিন্তু অনেক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে। জীবনযন্ত্রণাকে আজ আর তারা নীরবে সহ্য করে না, প্রতিকারের পথ খোঁজে। অদৃষ্ট-বিশ্বাসের হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে না পারলেও তারা আর সব কিছুকেই অদৃষ্টের মার বা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিতে রাজি নয়। প্রাপ্য ভাগ থেকে বঞ্চিত করে তাদের ভাগ্যহীন বানিয়েছে যারা, সেই বঞ্চক ও শোষকদের আজ তারা চিনে ফেলেছে। চিনে ফেলেই তাদের প্রতিরোধ করতে প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে। প্রতিরোধ করতে না পারলে প্রতিবাদ করছে। প্রতিবাদ করাও যখন সম্ভব হয় না, তখন অন্তত মনে মনে ঘৃণা করছে। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। উৎপাদনকর্মে যেমন তারা সনাতনের বদলে নবতন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, জীবনভাবনা ও ভাবনা প্রকাশেও তেমনই নবতনী হয়ে উঠেছে। আর এ ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে নারীরা। দুই দিন আগেও গ্রামের কৃষকসমাজের নারীরা ছিল অসূর্যম্পশ্যা। সেই নারীরা গ্রামীণজীবনের বৃত্তের বাইরে নগরে-বন্দরে গিয়ে মাথার ঘোমটা খুলে ফেলে জীবনসংগ্রামে নিরত হয়েছে, তাদের ভাবনার বৃত্তটিও হয়েছে নবায়িত ও প্রসারিত। গ্রামীণজীবনে এই নারীরা লোকসংস্কারজাত যেসব মানস প্রতিবন্ধে বাঁধা পড়ে ছিল, অন্যতর পরিবেশে সেসবের অনেক কিছুই দূর হয়ে যায়, পরম্পরাগত লোকসংস্কারের বদলে তাদের চিত্তে সঞ্চারিত হয় সংগ্রামী শ্রেণীচেতনা। তাদের এ রকম নবায়িত ও প্রসারিত শ্রেণীচেতনার বিশেষ প্রকাশ প্রত্যক্ষ করছি পোশাকশিল্পে নিয়োজিত নারীদের মধ্যে। লম্পটের লালসার আগুন তাদের অনেকের সম্ভ্রমহানি ঘটাচ্ছে, শিল্পমালিকের সীমাহীন লোভ ও অসভ্য অমানবিকতা তাদের জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ করে হত্যা করছে। কিন্তু নবজাগ্রত এই নারীশক্তির হৃদয়ে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, সেই ঘৃণা-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আগুন নিভিয়ে ফেলার সাধ্য কোনো অপশক্তিরই নেই। সেই আগুন অবশ্যই ছড়িয়ে যাবে সবখানে। ছড়িয়ে যাবে এক শিল্প থেকে আরেক শিল্পে। ছড়িয়ে যাবে শহর থেকে গ্রামে, শহরের কলকারখানা থেকে গ্রামের ক্ষেত-খামারে।
সে রকম ঘটার সূচনা এখনই ঘটে গেছে। বিগত ২০০৬ সালে পোশাকশিল্পের নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা যখন শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াকু অবস্থান গ্রহণ করেছিল, তখন প্রায় একই সময়ে কানসাটে ও ফুলবাড়ীতে পুরুষদের সঙ্গে গ্রামীণ নারীরাও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরুদ্ধে এখনো চলছে নারী-পুরুষের সম্মিলিত সংগ্রাম। একই ধারায় চলছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষার সংগ্রামও। এখানে-ওখানে এ রকম সংগ্রামের দৃষ্টান্ত প্রতিনিয়তই স্থাপিত হচ্ছে।
তবে বিভিন্ন রকমের পৃথক পৃথক সমস্যার মোকাবিলায় বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো এখনো সংহত জাতীয় রূপ ধারণ করছে না। এমন কি অতীতে টংকপ্রথাবিরোধী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন কিংবা নানকার আন্দোলনের মতো স্থানীয়ভাবে সংঘটিত কোনো শক্তিশালী কৃষক আন্দোলনও দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না। এ কারণেই অনেকে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করছেন। লুটপাটতন্ত্রের চক্করেই দেশটি ঘুরপাক খেতে থাকবে- এমন নেতিবাচক ভাবনাও অনেকের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সমাজের অগ্রগমনের দ্বান্দ্বিক নিয়ম সম্পর্কে অনবহিতি ও অসচেতনতাই এ রকম হতাশা ও নেতিবাচক ভাবনার জনয়িতা।
মনে রাখতে হবে, অতীতের কোনো ঘটনারই হুবহু অনুবর্তন কখনো ঘটে না। অনুবর্তন নয়, পরিবর্তনকে অঙ্গে ধারণ করেই ঘটে প্রতিটি ঘটনা। কাল ও দেশ (স্থান) উভয়ত্রই এই পরিবর্তন ঘটে। দেশকালের পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটার বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়ম আছে। সেই নিয়মে কালের প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনই পরিবর্তন ঘটে দেশের মানুষের মনোজগতেও। মনোজগতের সেই পরিবর্তনই আবার দেশের বাস্তব পরিবেশে এমন রূপান্তরমুখী নতুন ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেয়, যাতে পুরনো ঘটনার অনুবর্তন ঘটে না। তাই এখনকার কৃষকদের সংগ্রামও আগের চেয়ে অন্য রকম রূপ ধারণ করেছে ও করছে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ও হচ্ছে। সেই মাত্রা যোগ করেছে নারীরা। পূর্বেকার কৃষক আন্দোলনেও নারীদের যোগ ছিল বটে। নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে টংক আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন আদিবাসী নারী রাসিমণি, শঙ্খমণি ও রেবতি। তেভাগার সংগ্রামেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অংশগ্রহণ করেছিলেন দীপেশ্বরী, জয়মণি, রোহিনী, তাঞ্চানি, কুলেশ্বরী, বুধমণি, বুড়িমা, সরলা এবং এ রকম আরো অনেক কৃষক রমণী। তবে সেদিনকার এই সংগ্রামী নারীদের চৈতন্য ছিল গ্রামীণ কৃষকসমাজেরই বৃত্তাবদ্ধ। শিল্প শ্রমিকদের ভাবজগতের সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না। কিন্তু এখনকার গ্রামীণ নারীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শিল্প শ্রমিকে পরিণত, শিল্প মালিকদের শোষণ-প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত এবং সেই শোষণবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের চেতনাও রূপান্তরিত। পুরো রূপান্তর অবশ্যই ঘটেনি, তাদের শ্রেণীচেতনা সমাজের আমূল বদল ঘটানোর বিপ্লবী প্রত্যয় এখনো ধারণ করেনি। তবে ঘটনাধারা সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে, খণ্ড খণ্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে অখণ্ড বৈপ্লবিক চেতনার উদ্বোধন ঘটছে। শিল্প শ্রমিকদের শ্রেণীচেতনা কৃষকের ভেতরেও সঞ্চারিত হচ্ছে। এই চেতনা ধারণ করে দেশজুড়ে শ্রমিক-কৃষকদের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান যে ঘটবেই- এমন প্রত্যাশা মোটেই অসম্ভবের প্রত্যাশা নয়।
এমন প্রত্যাশার উপাদান জড়িত-মিশ্রিত হয়ে আছে আবহমান বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির পরতে পরতে। লোকায়ত সংস্কৃতি সর্বদাই বিদ্রোহী চৈতন্যের ধারক, সে সংস্কৃতি কোনোদিনই সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়নি। চর্যাপদ থেকে শুরু করে এ কালের বাউল গান পর্যন্ত সর্বত্রই তার প্রমাণ বিধৃত। এ কালের বাংলাদেশের লোকসমাজের কবি তো শুধু বিদ্রোহী নন, রীতিমতো বৈপ্লবিক ভাবনার বাহক ও প্রচারক। লোকসমাজের এ রকমই একজন কবি শাহ্ আবদুল করিম 'শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা'র প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলার লোকসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন- 'বাংলার সার্বভৌমত্ব রাখতে যদি চাও/শোষণের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে দাঁড়াও রে।' একান্ত স্পষ্ট ও নির্দ্বিধ বৈজ্ঞানিক প্রত্যয় তাঁর এই আহ্বানের পেছনে ক্রিয়াশীল। অত্যন্ত সঠিকভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু রূপে তিনটি শয়তানকে তিনি চিহ্নিত করেছেন-
বড় শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে
মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে
সামন্তবাদ জালিম বটে দয়া নাই তাহার মনে
তিন শয়তানের লীলাভূমি শ্যামল মাটি সোনার বাংলার
গরিবের বুকের রক্তে রঙিন হলো বারে বার
সোনার বাংলা করলো ছারখার সাম্রাজ্যবাদ শয়তানে
স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মজা মারলো শোষকে
এখন সবাই বুঝতে পারে চাবি ঘুরছে কোন পাকে
মধু হয় না বল্লার চাকে বাউল আবদুল করিম জানে
একা শাহ্ আবদুল করিমই নন, লোকসাধারণের সবাই এই শয়তানদের চিনে ও জেনে ফেলেছে। কিন্তু তাদের এই চেনা-জানাটাকে ভুলিয়ে দিতে চায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্তৃত্বশীল নানা জাতের লুটপাটতন্ত্রী। কর্তৃত্বের ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থাকলেও তারা সবাই মিলেই সাম্রাজ্যবাদকে ডেকে এনেছে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্রনীতিকে বিকৃত পুঁজিবাদের ঘোলাজলের ডোবায় ডুবিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের ভূতকে বাংলাদেশের ঘাড়ে বসিয়েছে, দেশটিকে সামন্তবাদী ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়েছে, অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়ে অপরাজনীতি কায়েম করে রেখেছে। না, আর অন্ধকারের কথা নয়। এর আগে যা যা বলেছি, সে সব কথা স্মরণ করেই বলি, অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, দেশের লোকসাধারণ নবচেতনায় জেগে উঠেছে। নবজাগ্রত লোকসাধারণই পাকিস্তানের ভূত তাড়াবে, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের উৎসাদন ঘটাবে, সাম্রাজ্যবাদের খবরদারির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবে, লোককবির আহ্বানে সাড়া দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে দাঁড়াবে, স্বাধীনতার মূল্যবোধের পূর্ণ ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাদানের মধ্য দিয়ে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি তারাই ঘটাবে। অতএব, মাভৈঃ!
লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ
No comments