বদলে যাচ্ছে by তৌফিক অপু
রাজন আহমেদ এবং রম্ননা আহমেদের দাম্পত্য জীবন পাঁচ বছরের। এরই মধ্যে তাঁদের ঘর আলো করে এসেছে এক কন্যা সনত্মান। সারার বয়স তিন বছর। বেশ সচ্ছল এবং সুখের সংসার বলা যায়।
সুখের বলতে ঝগড়াঝাটি কম হওয়াতে তাঁরা দু'জনই বেশ খুশি। তাঁদের মতে, ঝগড়া করার মতো সময় তাঁদের হাতে নেই। দু'জনই চাকরিজীবী। গ্রাম থেকে আসা এক ফুফু এবং একটি কাজের মেয়েই তাঁদের ঘরসংসার সামলানোর কাজ করে। কাজের চাপে সকাল থেকে রাত পর্যনত্ম দু'জনকেই ব্যসত্ম থাকতে হয়। তবে রাজন সাহেবের বাসা অফিস থেকে কাছে হওয়ায় দুপুরের খাবার খেতে তিনি বাসায় আসেন। এই ফাঁকে মেয়েকে সময় দেন ঘণ্টাখানেক। সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে মেয়ের এবং ঘরের যাবতীয় কাজ গুছিয়ে দ্রম্নত ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে যান দু'জন। রাজন সাহেব দুপুরে এসে আরেকটু গুছিয়ে রেখে যান। লাঞ্চের পর অফিস থেকে ফিরতে রাজন সাহেবের রাত হলেও রম্ননা বিকেলের মধ্যেই বাসায় চলে আসেন এবং সংসার সামলান। তাঁদের এমন রোবোটিক আচরণে বেশ ুব্ধ ফুফু। বিশেষ করে রাজন সাহেব যখন দুপুরে এসে মেয়েকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর কাজ করেন তখন ফুফু বেশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তাঁর ধারণা, এসব পুরম্নষের কাজ নয়। যেসব পুরম্নষ এ ধরনের কাজ করে তারা নাকি বউয়ের গোলাম হয়ে যায়। এছাড়া তাদের খাওয়া এবং চালচনে বেশ অসন্তুষ্ট ফুফু। সকালে পাউরম্নটি টোস্ট করে তাতে মাখন বা জেলি মেখে নাসত্মা করা, দুপুরে কোন রকমে লাঞ্চ করা_ এসব একদমই মেনে নিতে চান না ফুফু। রাজন সাহেব ঠা-া মাথায় ফুফুকে বোঝান, কাজের মধ্যে কোন নারী-পুরম্নষ নেই। এছাড়া সময় স্বল্পতার কারণেই এ ধরনের খাওয়াতে অভ্যসত্ম হয়ে গেছে তারা। তারপরও ফুফু পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। সহজে মেনে নেননি নতুন এ রীতি-নীতি। কাজ এবং জীবিকার তাগিদে অনবরত ছুটে চলছে মানুষ। ঘরে বসে দু'জনের অবসর নেয়ার সময় পর্যনত্ম নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই নগরীর অধিকাংশ মানুষ চাকরিজীবী। যার ফলে সকাল-সন্ধ্যা কাজের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে থাকতে হয়। ভরসা শুধু সাপ্তাহিক ছুটি। এরই মধ্যে সেরে ফেলতে হয় সংসারের টুকিটাকি কাজ। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মানুষ এখন অনেক হিসেবি। কেউই সময় নষ্ট করতে চায় না। যুগের আশীর্বাদ প্রযুক্তি মানুষকে আরও বেশি বেগবান করে তুলেছে। কি ঘরে কি বাইরে প্রতিটি জায়গায় প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ নিজেকে আরও কর্মচঞ্চল করে তুলছে। সকালের ব্রেকফাস্ট প্রযুক্তির কল্যাণে খুব সহজে এবং খুব দ্রম্নত সম্পন্ন করা সম্ভব। ওভেন, টোস্টার, স্যান্ডউইচ মেকার, টি মেকার ইত্যাদি খুব অল্প সময়ের মধ্যে ব্রেকফাস্ট প্রস্তুত করতে সম। যার ফলে সময় এবং শ্রম দুটোই বেঁচে যায়। ঠা-ার মৌসুমে সকালে গোসল করার েেত্র পানি গরম করার মতো ঝামেলা পোহাতে হয় না। আধুনিক বাথরম্নম ফিটিংসে ঠা-া এবং গরম উভয় ধরনের পানি প্রবাহের ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ফ্যাট নির্মাণের সময় যুগের আধুনিক সরঞ্জামাদির সনি্নবেশ ঘটিয়ে থাকে। যার ফলে মানুষ আবাসনের েেত্র আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া পাচ্ছে যা মানুষকে আরও বেশি স্মার্ট ও মডার্ন করে তুলছে। এক যুগ আগেও মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করত এখন তা কল্পনাতীত। একটু পেছনে তাকালে দেখা যায় কর্মতৎপরতা ছিল একটু ঢিলেঢালা এবং সময়সাপে। কিন্তুু খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাজ করা যায় বলে কাজের গতি বেড়েছে বহু গুণ। সেই সঙ্গে বেড়েছে কর্মতৎপরতা।অফিসে কাজের ফাঁকে চা বিরতির কথাই ধরা যাক। আগেকার দিনের অফিসগুলোতে চিত্র ছিল কয়েকজন একসঙ্গে অফিস থেকে বের হয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে চা পান করত। কিন্তু এখন খাবারদাবারে বৈচিত্র্য এসেছে। বেড়েছে প্যাকেট খাবারের প্রবণতা। এখন অনেক অফিস এক্সিকিউটিভ তাঁদের ডেস্কে পানি গরম করার মেশিন রাখেন। আর দুধ, চিনির প্যাকেট, চা-কফি তো পাওয়া যায়ই। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে চা-কফি প্রস্তুত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে অনেকে প্যাকেট স্ন্যাক্সও রাখেন। যার ফলে অফিসে বসেই চা-নাসত্মা দ্রম্নত সেরে ফেলা যায়। এতে সময় অপচয় কম হয়। এ সকল প্রযুক্তির আরও বড় সুফল হচ্ছে মানুষ স্বনির্ভর হয়ে উঠছে। এখন আর অফিসে বসে কেউ পিয়নের দেয়া চায়ের জন্য অপো করে না। এছাড়া ভারি রান্নাবান্নাও হয়েছে অনেক সহজ। প্রতিটি খাবারের রেডি মস্লা এবং কৌটাজাত মাছ-মাংসের কারণে রান্না করাটা এখন সত্যিই চড়ুইভাতির মতো হয়ে গেছে। যার ফলে আগেকার দিনের মতো অনেক আয়োজন করে সময় নিয়ে রান্নার প্রয়োজনই পড়ে না। নগরীর মানুষগুলো এখন সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে এ ধরনের খাবারেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বর্তমানে পৃথিবীর এত গতিশীলতা সম্ভব হয়েছে শুধু প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে। আর এ উৎকর্ষই মানুষকে কর্মতৎপর করে তুলেছে। এ কারণে বদলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা সংসার সামলাত এবং পুরম্নষরা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি করত। সময়ের বিবর্তনে আজ এ ধারণা পাল্টে গেছে। সংসারের কাজ নারী-পুরম্নষ উভয়েই ভাগ করে নিচ্ছে। বাচ্চাদের যত্ন নেয়ার কাজ শুধুই মেয়েদের_ এ ধারণা এখনকার দিনে অচল। ব্যসত্ম সময়ের মধ্যে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ সময় পেলেই গুছিয়ে রাখবেন সংসার_ এটা আজকাল শহুরে দম্পতিরা মেনেই নিয়েছেন। কারণ অর্থনৈতিক সচ্ছলতার চাকা সচল রাখতে হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই অর্থ উপার্জনের বিকল্প নেই। যার ফলে সাংসারিক কাজকর্মকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। যেমন রান্না করা, ঘর গোছানো, বাজার করা এমনি নিত্যনৈমিত্তিক জরম্নরী কাজ স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মিলে সম্পন্ন করাই শ্রেয়। কোন্টা নারীর কাজ কোন্টা পুরম্নষের_ এ নিয়ে ভাবনার অবকাশ নেই। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। এছাড়া এখনকার বেশির ভাগ শিতি দম্পতিই কর্মেেত্র নেমে পড়ছে। এেেত্র একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া পথ চলা মুশকিল। তবে কর্মেেত্র নারী-পুরম্নষের অবদানই পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সচল রাখতে। পারস্পরিক এই সুদৃষ্টি বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া দরকার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে রান্না করা তো এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন গঠনে ও চলার পথে কোন কাজই ছোট নয়; শুধু প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
বর্তমানে শহুরে দম্পতিরা যে সমস্যাটায় বেশি ভোগে তা হচ্ছে সনত্মানদের দেখাশোনা করা। স্বামী-স্ত্রী দু'জনই চাকরিতে চলে গেলে সনত্মান দেখাশোনা নিয়ে বেশ জটিলতার সৃষ্টি হয়। এখনও যাঁরা যৌথ পরিবারে বাস করেন তাঁরা হয়ত এই ঝামেলা কাটাতে সম। তবে এখন বেশ কিছু ভাল ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। পরিবর্তিত সমাজে ডে-কেয়ারের চাহিদাও এখন বেশ চড়া। এখন অনেকেই নিশ্চিনত্ম মনে ডে-কেয়ার সেন্টারে বাচ্চাদের রেখে যাচ্ছেন। সমাজের এ ধরনের পরিবর্তন অবশ্যই ইতিবাচক দিক।
দ্রম্নত চলমান এ যুগে আড্ডার েেত্রও ব্যাপক পরিবর্তন ল্য করা যায়। বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় যেমন এসেছে ভাষাগত পরিবর্তন, তেমনি এসেছে আড্ডার খাবারের পরিবর্তন। এখনকার উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের আড্ডায় প্রথম পছন্দ ফাস্টফুডের দোকানগুলো। রীতিমতো হুমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। সেই সঙ্গে আমাদের দেশীয় খাবারের সঙ্গে ফাস্টফুড আইটেমগুলো একটা বড় অংশ দখল করে আছে। আগে বন্ধুবান্ধবদের কোন উপল থাকলে সবাই মিলে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ত। অথচ এখন সিনেপেস্নক্সে গিয়ে সিনেমা দেখা আর ফাস্টফুড শপগুলোতে বসে টেবিল চাপড়ে গান গাওয়া যেন তারম্নণ্যের ফ্যাশন হয়ে গেছে। পরিবর্তন ল্য করা যায় পোশাক-পরিম্নছদেও। চিরাচরিত বাঙালী উৎসব ছাড়া বাঙালী পোশাক শহুরে মানুষদের পরতে দেখা যায় না বললেই চলে। পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় নায়ক-নায়িকা, মডেল_অভিনেত্রীদের পোশাকের অনুকরণ বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে চলে ফ্যাশন প্রতিযোগিতা। নিত্যনতুন ফ্যাশনেবল ড্রেসে ছেয়ে যায় মার্কেটগুলো। নিন্দুকেরা যাই বলুক, যুগের এ চাহিদা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। দিন বদলের পালাতে সমাজ- সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক।
মডেল : মেজবাহ ও ঋতু
ছবি : আরিফ আহমেদ
No comments