আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ-ঘরে-বাইরে, সর্বত্র আরও অধিকার
প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন এখন পৃথিবীর বহু দেশের রেওয়াজ। শুরু থেকে যত দিন গেছে ততই এটি বর্ণাঢ্য ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। শুরুতে শুধু কর্মজীবী নারীদের অধিকার আদায়ে দিবস হিসেবে গণ্য হলেও কালক্রমে এটি সব নারীর অধিকারের দিনে পরিণত হয়েছে।
বছরের আর দশটি পালনীয় দিবসের চেয়ে এর তাৎপর্য ভিন্নভাবে অনুভূত হয়েছে। কালের আবর্তনের সঙ্গে দিনটি যতই জৌলুস পেয়েছে, বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে_ ততই নারী অধিকার ও আন্দোলনের মৌল নীতি থেকে সরে গিয়ে সাদামাটা একটি দিনে পরিণত হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও নারী দিবস বিশ্বের নানা প্রান্তের নারীদের কাছে মুক্তি, স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও অধিকারের বাণী কিছুটা হলেও যে পেঁৗছে দিতে পেরেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। তাৎপর্যপূর্ণ দিবসটি এবার শতবর্ষ অতিক্রম করতে চলেছে। ফলে গত এক বছর নানাভাবে দিবসটি উদযাপনের উদ্যোগ ছিল। সমাজের নানা অংশ, বিশেষত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, মিডিয়া, রাজনৈতিক সংগঠনের তৎপরতার কারণে আমাদের সমাজে এখন দিনটিকে অনেকেই চেনে; নারীর অধিকার আদায়ের পথে দিনটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে বিচার করা হয়। আমাদের মতো শিক্ষায়, যোগাযোগে, অগ্রগতিতে পিছিয়ে থাকা দেশে ঘটা করে নারী দিবস পালনের আলাদা তাৎপর্য আছে। আমাদের নারী আন্দোলনের বয়স পাশ্চাত্যের নারী আন্দোলনের সমসাময়িক হলেও সামাজিক নানা প্রভাব এখানে নারীকে পশ্চাৎপদ করে রেখেছে। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে নারী বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত থেকেছে তাদের সব ভূমিকা ও তৎপরতা সত্ত্বেও। শুধু যে সামাজিক কারণ তা নয়; নারীবাদীরা বলেন, অগ্রগতি বা আধুনিকতার মোড়কেও নারীকে নতুন নিপীড়ন ও শোষণের যাঁতাকলে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সমাজ, রাষ্ট্রের বহু সমস্যার পরও বাংলাদেশের নারীকে পুরনো কিছু সমস্যা এখনও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক ও গ্রগতিশীল দেশে সেগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত। অতিসম্প্রতি এ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোয় বখাটেদের দ্বারা নারীদের নির্যাতিত হওয়ার বহু সংবাদ আমরা জেনেছি। এ সমস্যা প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছিল। বখাটেদের নির্যাতনে বহু কোমলমতি নারীশিশুকে আত্মহত্যার শিকার হতে হয়েছে। অনেকেই আহত-নিহত হয়েছেন। অনেকের নিকটাত্মীয়রা আহত-নিহত হয়েছেন। সাম্প্রতিককালে নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণের শিকার হয়ে বেশকিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। শুধু স্কুল-কলেজ বা বিদ্যাপীঠগুলোতে নয়, কর্মক্ষেত্রে বহুভাবে নারীকে হেনস্তা হতে হচ্ছে। নানা নির্যাতন-নিপীড়ন, অবজ্ঞা-অবহেলার শিকার হয়ে পথ চলতে হচ্ছে। ফলে অন্য অনেক অধিকারের চেয়ে বাংলাদেশে নারীদের জন্য 'নিরাপত্তা'র অধিকার সবচেয়ে জরুরি। ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে যে অগ্রগতির পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে তা কখনোই পূর্ণতা পাবে না। আমাদের নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছেন; তারা শিক্ষায়, চাকরিতে, গার্হস্থ্যে বিপুল সাফল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু এর প্রায় সবটাই ঘটেছে তাদের নিজস্ব চেষ্টায়। সমাজের পুরুষ নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিভঙ্গির খুব বদল হয়নি বলেই অনেকে মনে করেন। নারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার, তাদের সুযোগ করে দেওয়ার যে দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ছিল তা অনেক ক্ষেত্রেই পালিত হয়নি। ফলে বাংলাদেশে নারী দিবসের শতবর্ষ পালনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা মনে করি, গালভরা বুলি নয়, আশ্বাসের ফাঁপানো বেলুনও নয়_ নারীর জন্য প্রকৃতপক্ষেই কিছু করার সময় এখন। রাষ্ট্র যদি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরির জন্য কাজ করে, যেখানে বখাটেদের নির্যাতনের শিকার নারীরা বিহিত পাবেন, সমাজের শক্তি যেখানে নিপীড়িত নারীর পাশে দাঁড়াবে, পুরুষের করুণা নয়_ আপন শক্তিতে ভর দিয়ে নারী যখন পুরুষের পাশাপাশি পথ চলতে পারবে, তখনই নারী দিবস শুধু নয়, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিও সফল হবে। সেদিন আসুক শিগগিরই_ নারী দিবসে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments