কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদার সাক্ষাৎকার
বাঙালির জাতিসত্তার কবি হিসাবে স্বীকৃত কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা। তাঁর জীবন ও সৃষ্টি বৈচিত্রে ভরপুর। ১৯৪৯ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের পোকখালীতে জন্ম গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘জাতিসত্তার কবিতা’, ‘আমরা তামাটে জাতি’ এবং উপন্যাস ‘জন্মজাতি’ ইত্যাদি। বাংলানিউজটেয়েন্টিফোর.কম’র পাঠকদের জন্য কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদার একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তরুণ কবি শ্যামল চন্দ্র নাথ।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: শিল্প সাহিত্যের অনেকগুলো মাধ্যমেই আপনার পদচারণা আছে; কিন্তু যাত্রা শুরু করেছেন কবিতা দিয়ে, কেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আমি কবিতা দিয়ে শুরু করেছি এটা যেমন সত্য কিন্তু শুধু কবিতাতে আছি এটা সত্য নয়। আমি কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখছি। আমার উপন্যাস আছে তিনটি এগুলোকে আত্মজৈবনিক বলা যেতে পারে। এছাড়া আরো একটি উপন্যাস আছে যেটি বিদেশি সাহিত্যের ছায়া অবলম্বনে লিখেছি। আরো উপন্যাস লেখার চিন্তা আছে। কবিতা লেখার জন্য একটা আবহ ছিল। তখন আমাদের বাড়িতে পুঁথি পাঠ হত। যেমন- আমির হামজার পুঁথি, সোনাবানের পুঁথি পাঠের রেওয়াজ ছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আমার দাদী পুঁথি পাঠ করতেন ঘরে বসে। গ্রামের তরুণেরাও পুঁথি পাঠ করত। এটা একটা perfoming art ছিল। স্কুলে যখন আমি যাই যে লেখাটি আমাকে আকৃষ্ট করে তা হল রবীন্দ্রনাথের “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে”। যা পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হই। কবিয়ালদের একটা প্রভাব ছিল। আমি দু-একবার কবিয়ালদের সাথে মিলিত হই। এরপর প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় আমি কবিতা লিখি তখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আমাকে প্রেরণা দেন সেই থেকে শুরু। আমার চারপাশের প্রকৃতি আমাকে বেলেছে লেখ, লেখ।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার প্রিয় কবি কে? কাকে আপনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি বলে মনে করেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার প্রথম অনুপ্রেরণা তিনি। কারণ তাঁর কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হই। তারও আগে বলবো লোককবি, কবিয়ালদের কথা। যেমন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি... লোক কবি গগন হরকরার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা হিসাবে পাওয়া। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সার্বভৌম; তিনি এবং তিনি আমার প্রিয় কবি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার কবিতাগ্রন্থ জাতিসত্তা সম্পর্কে বলুন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: ১৯৬৫ সালে আমি ঢাকায় আসি। তখন ঢাকা ছিল উত্তাল এরপর ৭৯-এ গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করি। ওই সময়ে আমি এক জন টগবগে তরুণ। আমি তখন বুঝতে পেরেছি, অনুভব করেছি এবং আমি লিখে ফেলি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনি তো কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন আমি যেটা জানি আপনার একটি বই সূচীপত্র থেকে বের হয়েছে ‘কাব্য কোরআন’ যা সম্পূর্ণ ধর্ম বিষয়ক।
মুহাস্মদ নুরুল হুদা: আমি ছোটবেলা থেকে দেখি আসছি আমার দাদী কোরআন পড়তেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠও একটি আনন্দের বিষয়। আমি হাম্দ্ নাত নিজে মুখস্ত করেছি কোরআন মুখস্ত করেছি। এ বিষয়ে নজরুল ইসলামও লিখেছেন কিন্তু আমার মনে হল এ নিয়ে লেখা উচিত তাই লিখে ফেলি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনি বলেছেন যে আপনি মুসলিম পরিবারের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন বলে এগুলো আপনাকে শিখতে হয়েছে, কিন্তু আমি বলতে চাই আপনি নিজেকে কবি, মুসলমান না বাঙালি হিসাবে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: এক কথায় আমি বাঙালি মুসলমান। বাঙালি যে কেউ হতে পারে তবে আমি বলব আমি প্রথমত মানুষ, এরপরে বাঙালি এরও পরে আমি মুসলিম। লেখক হিসাবে আমি কবি শুনতে বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার জীবনে বা আত্মপ্রকাশলগ্নে আপনার কোন প্রতিবন্ধকতা…
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আসলে আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তাই প্রকাশলগ্নে কিছু পারিবারিক সমস্যা ছিল। মানে অর্থনৈতিক সমস্যা। কিন্তু আমার প্রতি আমার বাবার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: শিল্প-সাহিত্যের আর কোন মাধ্যমে আপনার আগ্রহ আছে কিনা?
যেমন- সঙ্গীত…?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: হ্যাঁ, গানের প্রতি আমার ঝোক রয়েছে। আমি গানও লিখেছি। ‘সুর সমুদ্র’ নামে আমার গানের গ্রন্থ রয়েছে। আমি আজ থেকে ৩০ বছর আগে লিখি। সব কিছু ফেলে গানের পিছনে আমি দৌড়াতে পারিনি। কারণ গান করতে গেলে লিখতে গেলে দৌড়াতে হয় অন্যের পিছনে। যেটা আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না বা আমি দৌড়াইনি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’… এটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে- যে মানব বিদ্রোহ হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করে লেখা। বের করেন রফিক নওশাদ। শব্দরূপ প্রকাশণী থেকে বের হয়। এর সাথে কবি সাজ্জাদ কাদিরও জড়িত ছিল। ওই সয়টা ছিল নিরগ্রন্থশূণ্য কারণ ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে এক আব্দুল মান্নান সৈয়দ ছাড়া আর কারো কবিতার বই বের হয় নি। এরও আগে আমি রঙশিশু নামে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। যা ওই সময়ে প্রকাশ করিনি। ওই সময়ে ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ বইটির বেশ কিছু আলোচনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমাদের অগ্রজ বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আমার এবং শহীদ কাদরীর কবিতার বইয়ের আলোচনা করেন।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনি শহীদ কাদরীর কথা বললেন, আপনি জানেন কি তিনি এখন আমেরিকায় একটি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন? শহীদ কাদরী সম্পর্কে কিছু যদি বলেন…
মুহাম্মদ নুরুল হুদা : হ্যাঁ, আমি জানি। পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি। শক্তি চট্রোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদকে যেমন আলাদা করা যায় তেমনি আমি শহীদ কাদরীর কথাও বলবো। তিনি কম লিখেছেন কিন্তু তাঁর কবিতা অসাধারণ। আন্তমহাদেশীয় যে কবিতা যেমন রবার্ট লাওলের কবিতা আত্মজৈনিক কবিতা। সেই আত্মজৈবনিক কবিতা তিনিই প্রথম লিখেন বাংলা সাহিত্যে। তাঁর কবিতা অসাধারণ। চিত্রকল্প ও অন্যান্য। তিনি আমার নিকট সান্নিধ্যে ছিলেন। আমাদের মধ্যে আবার অম্লমধুর সম্পর্কও ছিল। আমরা আড্ডা দিতাম নিউমার্কেটের মনিকো নামে এক রেস্তোরায়। তাঁর বৃষ্টির কবিতা অসাধারণ।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার সমসাময়িক কোন কবিকে আপনি এগিয়ে রাখবেন এবং কার কবিতায় আপনি ঈর্ষাবোধ করেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আবুল হাসান। আবুল হাসানের থাকার জায়গা ছিল না। সে আমার সাথেই ছিল। কবিতার জন্য সে অনেক পরিশ্রম করতো। আমি যা স্বচক্ষে দেখেছি। লিখছে ছিড়ে ফেলছে। যা আমরা সাধারণত করি না। ও অনেক একনিষ্ঠ ছিল কবিতার প্রতি। যা আমি অন্য কাউকে দেখি নি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: কোন বই আপনি অনেক বার পড়েন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: খলিল জিবরানের ‘দ্যা প্রফেট’ আমি পড়তাম। শেক্সপিয়রের সনেট অনেক পড়েছি, বারবার পড়েছি। এরপর জীবনানন্দ দাসের ‘বণলতা সেন’।
শ্যামল চন্দ্র নাথ : হ্যাঁ, আপনি বনলতা সেনের কথা বলছেন! বনলতা সেন যখন বের হয় তখন এর আলোচনা লিখেন কবি বুদ্ধদেব বসু ও কবি আবুল হোসেন এই সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আবুল হোসেন ৪০ দশকের এক বড় প্রাজ্ঞজন কবি। অনেক বড় কবি। আর বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের বইয়ের প্রথম আলোচনা লিখেন। ইংরেজি কবিতা হেলেনকে নিয়ে কবি জীবনানন্দ লিখেন বণলতা সেন। বাংলা সাহিত্যে এরকম দ্বিতীয় কবিতা সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আত্মপুরাণ এবং ব্যক্তিপুরান সম্পর্কিত লেখা জীবনানন্দই প্রথম লিখেন বাংলা সাহিত্যে। সুধীন দত্তের জীবনানন্দ দাসের কবিতা নিয়ে সংশয় ছিল। বুদ্ধদেব বসু এতে নতুন ধারা খুঁজে পেয়েছেন। এটা প্রেমের কবিতা, অসাধারণ কবিতা বলে আমি মনে করি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: ব্যক্তি মুহাম্মদ নুরুল হুদা এবং কবি মুহাস্মদ নুরুল হুদার মধ্যে পার্থক্য বলুন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: তুমিই তো আজ দেখলে রিক্সায় আসার সময় রিক্সাওয়ালার সাথে ঝগড়া। কত রকমের প্রতিবন্ধকতা। এক বন্ধু (শ্যামল চন্দ্র নাথ), তোমাকে বসিয়ে রেখে স্নান করেছি। এরপর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে এসে সাক্ষাৎকার দিতে হলো। আমার বয়স ষাটের উর্ধে। এরপরও বেঁচে থাকার জন্য উপার্জনের জন্য সংগ্রাম করছি। আর কবি নুরুল হুদা একটি জগৎ নির্মাণ করতে চায় তার লেখনির মাধ্যমে। কবি নুরুল হুদা লেখে খুব সকালে আর গভীর রাত্রে।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার জীবনের প্রিয় উদ্বৃতি সম্পর্কে বলুন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: স্মৃতি। আমার জন্ম হওয়ার পরের স্মৃতি। জীবন স্মৃতিময়। বোদলেয়ারের একটি কথা আমার খুব প্রিয় যা আমি বলবো- হাজার বছর যেন বেঁচে আছি এত স্মৃতি। এটাই আমার প্রিয় উদ্বৃতি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: কবি হিসাবে আপনার দায়বদ্ধতা দেশ ও সমাজের প্রতি, কেমন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: কবিতায় যদি মানবিক সৌন্দর্য না থাকে তা হলে সেটা কবিতা হতে পারে না। শিল্প-সাহিত্যের যে কোন মাধ্যমই হোক না কেন তাকে মানবিক হতে হবে। যেটা আমাকে আমার মত বাঁচতে শিখায়। সেটা প্রেমও হতে পারে। আবার প্রেম শুধু ত্যাগ নয়, প্রেমকে ছিনিয়ে আনার মাঝেও সৌন্দর্য আছে।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: তোমাকেও।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: শিল্প সাহিত্যের অনেকগুলো মাধ্যমেই আপনার পদচারণা আছে; কিন্তু যাত্রা শুরু করেছেন কবিতা দিয়ে, কেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আমি কবিতা দিয়ে শুরু করেছি এটা যেমন সত্য কিন্তু শুধু কবিতাতে আছি এটা সত্য নয়। আমি কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখছি। আমার উপন্যাস আছে তিনটি এগুলোকে আত্মজৈবনিক বলা যেতে পারে। এছাড়া আরো একটি উপন্যাস আছে যেটি বিদেশি সাহিত্যের ছায়া অবলম্বনে লিখেছি। আরো উপন্যাস লেখার চিন্তা আছে। কবিতা লেখার জন্য একটা আবহ ছিল। তখন আমাদের বাড়িতে পুঁথি পাঠ হত। যেমন- আমির হামজার পুঁথি, সোনাবানের পুঁথি পাঠের রেওয়াজ ছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আমার দাদী পুঁথি পাঠ করতেন ঘরে বসে। গ্রামের তরুণেরাও পুঁথি পাঠ করত। এটা একটা perfoming art ছিল। স্কুলে যখন আমি যাই যে লেখাটি আমাকে আকৃষ্ট করে তা হল রবীন্দ্রনাথের “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে”। যা পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হই। কবিয়ালদের একটা প্রভাব ছিল। আমি দু-একবার কবিয়ালদের সাথে মিলিত হই। এরপর প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় আমি কবিতা লিখি তখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আমাকে প্রেরণা দেন সেই থেকে শুরু। আমার চারপাশের প্রকৃতি আমাকে বেলেছে লেখ, লেখ।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার প্রিয় কবি কে? কাকে আপনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি বলে মনে করেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার প্রথম অনুপ্রেরণা তিনি। কারণ তাঁর কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হই। তারও আগে বলবো লোককবি, কবিয়ালদের কথা। যেমন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি... লোক কবি গগন হরকরার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা হিসাবে পাওয়া। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সার্বভৌম; তিনি এবং তিনি আমার প্রিয় কবি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার কবিতাগ্রন্থ জাতিসত্তা সম্পর্কে বলুন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: ১৯৬৫ সালে আমি ঢাকায় আসি। তখন ঢাকা ছিল উত্তাল এরপর ৭৯-এ গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করি। ওই সময়ে আমি এক জন টগবগে তরুণ। আমি তখন বুঝতে পেরেছি, অনুভব করেছি এবং আমি লিখে ফেলি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনি তো কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন আমি যেটা জানি আপনার একটি বই সূচীপত্র থেকে বের হয়েছে ‘কাব্য কোরআন’ যা সম্পূর্ণ ধর্ম বিষয়ক।
মুহাস্মদ নুরুল হুদা: আমি ছোটবেলা থেকে দেখি আসছি আমার দাদী কোরআন পড়তেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠও একটি আনন্দের বিষয়। আমি হাম্দ্ নাত নিজে মুখস্ত করেছি কোরআন মুখস্ত করেছি। এ বিষয়ে নজরুল ইসলামও লিখেছেন কিন্তু আমার মনে হল এ নিয়ে লেখা উচিত তাই লিখে ফেলি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনি বলেছেন যে আপনি মুসলিম পরিবারের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন বলে এগুলো আপনাকে শিখতে হয়েছে, কিন্তু আমি বলতে চাই আপনি নিজেকে কবি, মুসলমান না বাঙালি হিসাবে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: এক কথায় আমি বাঙালি মুসলমান। বাঙালি যে কেউ হতে পারে তবে আমি বলব আমি প্রথমত মানুষ, এরপরে বাঙালি এরও পরে আমি মুসলিম। লেখক হিসাবে আমি কবি শুনতে বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার জীবনে বা আত্মপ্রকাশলগ্নে আপনার কোন প্রতিবন্ধকতা…
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আসলে আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তাই প্রকাশলগ্নে কিছু পারিবারিক সমস্যা ছিল। মানে অর্থনৈতিক সমস্যা। কিন্তু আমার প্রতি আমার বাবার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: শিল্প-সাহিত্যের আর কোন মাধ্যমে আপনার আগ্রহ আছে কিনা?
যেমন- সঙ্গীত…?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: হ্যাঁ, গানের প্রতি আমার ঝোক রয়েছে। আমি গানও লিখেছি। ‘সুর সমুদ্র’ নামে আমার গানের গ্রন্থ রয়েছে। আমি আজ থেকে ৩০ বছর আগে লিখি। সব কিছু ফেলে গানের পিছনে আমি দৌড়াতে পারিনি। কারণ গান করতে গেলে লিখতে গেলে দৌড়াতে হয় অন্যের পিছনে। যেটা আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না বা আমি দৌড়াইনি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’… এটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে- যে মানব বিদ্রোহ হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করে লেখা। বের করেন রফিক নওশাদ। শব্দরূপ প্রকাশণী থেকে বের হয়। এর সাথে কবি সাজ্জাদ কাদিরও জড়িত ছিল। ওই সয়টা ছিল নিরগ্রন্থশূণ্য কারণ ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে এক আব্দুল মান্নান সৈয়দ ছাড়া আর কারো কবিতার বই বের হয় নি। এরও আগে আমি রঙশিশু নামে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। যা ওই সময়ে প্রকাশ করিনি। ওই সময়ে ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ বইটির বেশ কিছু আলোচনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমাদের অগ্রজ বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আমার এবং শহীদ কাদরীর কবিতার বইয়ের আলোচনা করেন।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনি শহীদ কাদরীর কথা বললেন, আপনি জানেন কি তিনি এখন আমেরিকায় একটি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন? শহীদ কাদরী সম্পর্কে কিছু যদি বলেন…
মুহাম্মদ নুরুল হুদা : হ্যাঁ, আমি জানি। পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য কবি। শক্তি চট্রোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদকে যেমন আলাদা করা যায় তেমনি আমি শহীদ কাদরীর কথাও বলবো। তিনি কম লিখেছেন কিন্তু তাঁর কবিতা অসাধারণ। আন্তমহাদেশীয় যে কবিতা যেমন রবার্ট লাওলের কবিতা আত্মজৈনিক কবিতা। সেই আত্মজৈবনিক কবিতা তিনিই প্রথম লিখেন বাংলা সাহিত্যে। তাঁর কবিতা অসাধারণ। চিত্রকল্প ও অন্যান্য। তিনি আমার নিকট সান্নিধ্যে ছিলেন। আমাদের মধ্যে আবার অম্লমধুর সম্পর্কও ছিল। আমরা আড্ডা দিতাম নিউমার্কেটের মনিকো নামে এক রেস্তোরায়। তাঁর বৃষ্টির কবিতা অসাধারণ।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার সমসাময়িক কোন কবিকে আপনি এগিয়ে রাখবেন এবং কার কবিতায় আপনি ঈর্ষাবোধ করেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আবুল হাসান। আবুল হাসানের থাকার জায়গা ছিল না। সে আমার সাথেই ছিল। কবিতার জন্য সে অনেক পরিশ্রম করতো। আমি যা স্বচক্ষে দেখেছি। লিখছে ছিড়ে ফেলছে। যা আমরা সাধারণত করি না। ও অনেক একনিষ্ঠ ছিল কবিতার প্রতি। যা আমি অন্য কাউকে দেখি নি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: কোন বই আপনি অনেক বার পড়েন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: খলিল জিবরানের ‘দ্যা প্রফেট’ আমি পড়তাম। শেক্সপিয়রের সনেট অনেক পড়েছি, বারবার পড়েছি। এরপর জীবনানন্দ দাসের ‘বণলতা সেন’।
শ্যামল চন্দ্র নাথ : হ্যাঁ, আপনি বনলতা সেনের কথা বলছেন! বনলতা সেন যখন বের হয় তখন এর আলোচনা লিখেন কবি বুদ্ধদেব বসু ও কবি আবুল হোসেন এই সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: আবুল হোসেন ৪০ দশকের এক বড় প্রাজ্ঞজন কবি। অনেক বড় কবি। আর বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের বইয়ের প্রথম আলোচনা লিখেন। ইংরেজি কবিতা হেলেনকে নিয়ে কবি জীবনানন্দ লিখেন বণলতা সেন। বাংলা সাহিত্যে এরকম দ্বিতীয় কবিতা সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আত্মপুরাণ এবং ব্যক্তিপুরান সম্পর্কিত লেখা জীবনানন্দই প্রথম লিখেন বাংলা সাহিত্যে। সুধীন দত্তের জীবনানন্দ দাসের কবিতা নিয়ে সংশয় ছিল। বুদ্ধদেব বসু এতে নতুন ধারা খুঁজে পেয়েছেন। এটা প্রেমের কবিতা, অসাধারণ কবিতা বলে আমি মনে করি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: ব্যক্তি মুহাম্মদ নুরুল হুদা এবং কবি মুহাস্মদ নুরুল হুদার মধ্যে পার্থক্য বলুন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: তুমিই তো আজ দেখলে রিক্সায় আসার সময় রিক্সাওয়ালার সাথে ঝগড়া। কত রকমের প্রতিবন্ধকতা। এক বন্ধু (শ্যামল চন্দ্র নাথ), তোমাকে বসিয়ে রেখে স্নান করেছি। এরপর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে এসে সাক্ষাৎকার দিতে হলো। আমার বয়স ষাটের উর্ধে। এরপরও বেঁচে থাকার জন্য উপার্জনের জন্য সংগ্রাম করছি। আর কবি নুরুল হুদা একটি জগৎ নির্মাণ করতে চায় তার লেখনির মাধ্যমে। কবি নুরুল হুদা লেখে খুব সকালে আর গভীর রাত্রে।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনার জীবনের প্রিয় উদ্বৃতি সম্পর্কে বলুন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: স্মৃতি। আমার জন্ম হওয়ার পরের স্মৃতি। জীবন স্মৃতিময়। বোদলেয়ারের একটি কথা আমার খুব প্রিয় যা আমি বলবো- হাজার বছর যেন বেঁচে আছি এত স্মৃতি। এটাই আমার প্রিয় উদ্বৃতি।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: কবি হিসাবে আপনার দায়বদ্ধতা দেশ ও সমাজের প্রতি, কেমন?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: কবিতায় যদি মানবিক সৌন্দর্য না থাকে তা হলে সেটা কবিতা হতে পারে না। শিল্প-সাহিত্যের যে কোন মাধ্যমই হোক না কেন তাকে মানবিক হতে হবে। যেটা আমাকে আমার মত বাঁচতে শিখায়। সেটা প্রেমও হতে পারে। আবার প্রেম শুধু ত্যাগ নয়, প্রেমকে ছিনিয়ে আনার মাঝেও সৌন্দর্য আছে।
শ্যামল চন্দ্র নাথ: আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: তোমাকেও।
No comments