কথোপকথন- গানের বাপ-বেটা- সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সুমনা শারমীন
সুমনা শারমীন: বাংলাদেশের দুই প্রজন্মের দুই জনপ্রিয় শিল্পী, এবং কাকতালীয়ভাবে এঁরা দুজন একই পরিবারের সদস্য। একজন বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদ, আরেকজন ছেলে হাবিব ওয়াহিদ। আমরা আনন্দিত যে দুজনকে একসঙ্গে পেয়ে গেলাম। প্রথমেই ফেরদৌস ওয়াহিদকে দিয়ে শুরু করব।
ফেরদৌস ওয়াহিদ যখন ‘এমন একটা মা দে না’ দিয়ে শুরু করলেন, তখন মোটামুটি ওনার সঙ্গে বাংলাদেশের সব তরুণ-তরুণী তো বটেই, আমার যত দূর মনে আছে, তাদের মা-বাবারাও ফেরদৌস ওয়াহিদের ভক্ত হয়ে গেলেন। সেই ফেরদৌস ওয়াহিদ, এখন এসে হাবিবের আমলেও যখন, ‘মামুনিয়া’ গান, তখন মনে হয়, এখনো ওই গানের বয়স বাড়েনি। ফেরদৌস ওয়াহিদ, আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টা?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: প্রথমত, আমি যেটা বিশ্বাস করতে চাই, সেটা বাংলা গানের একটা পরম পরশকাঠি। এরপর এটা ভাগ্যেরও একটি বিষয়। আছে অনুশীলন এবং সাধনার একটি ব্যাপার। যোগাযোগের বিষয়টাও আছে। এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলারও ব্যাপারটা তো রয়েছেই। আমার মনে হয় যে এই তিনটির সমন্বয়ে আমি নিজেকে তৈরি করতে পেরেছি।
সুমনা শারমীন: তার মানে, আপনি যে তিনটি কথা বলেছেন, এর একটা হচ্ছে ভাগ্য, একটা হচ্ছে সাধনা আর শেষটা হচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল মেলানো।
ফেরদৌস ওয়াহিদ: হ্যাঁ, এ তিনটাকে আমি মনে করি আমার তরুণ থাকার মূল চাবিকাঠি।
সুমনা শারমীন: এখন আমরা যদি বলি—হাবিব ওয়াহিদ যদি সংগীতশিল্পী না হয়ে অন্য কিছু হতো, তা হলে কি আপনার মনে কোনো কষ্ট হতো?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: কষ্টের কারণ তো ছিল না। কারণ, আমি কখনো আশা করিনি ও সংগীতশিল্পী হবে। ও যখন সিক্সে পড়ত তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ও সংগীতশিল্পী হবে। ও তো এসেই পড়েছে, তবে সংগীত অঙ্গনে এসে যদি ও কিছু না হতে পারত তা হলে কষ্ট হতো।
সুমনা শারমীন: যখন শুরু করলেন, তখন আপনার সময়ের আপনি, ফিরোজ সাঁই...আর কার কার কথা বলবেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আজম খান, পিলু মমতাজ। সেই সময়ে পিলু মমতাজ আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী নারী। একজন মেয়ে সেজেগুজে স্টেজে গান করবে, এমনটা বেশ কষ্টকর ছিল। পিলু মমতাজ সেটা করে দেখিয়েছেন। এর পরপরই এল ফকির আলমগীর... জিঙ্গাগোষ্ঠী। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান থাকতে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। নাজমা জামান, শায়লা জামান তাঁরা দুই বোন ছিলেন, তাঁদের ভাই শাফায়েত। কাদেরি কিবরিয়াও ছিলেন।...স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ‘উচ্চারণ’-এর যাত্রা শুরু।
সুমনা শারমীন: সেটা কি আজম খান দিয়ে শুরু?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আজম খান হলেন প্রথম জনপ্রিয় শিল্পী। সাংগঠনিকভাবে ফিরোজ সাঁই অসাধারণ। সুতরাং দুজনকে দুই রকমভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আজম খান অবশ্যই এ দেশের এযাবৎ কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী। জনপ্রিয়তার মুকুটটা যদি কেউ প্রথম মাথায় পরে, সেটা আজম খান।
কিন্তু শুরুটা, সাংগঠনিক তৎপরতা যদি না চলত, ফিরোজ সাঁই যদি না হতেন, তা হলে আমাদের গানের ইতিহাসটা এমন হতোই না। কেননা ,আমার সঙ্গে আজম খানের পরিচয় ঘটিয়ে দেন ফিরোজ সাঁই। ওই সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল...
সুমনা শারমীন: যেটা এখন রূপসী বাংলা...
ফেরদৌস ওয়াহিদ: সেখানে যাঁরা বাজাতেন, ওদের ধরে নিয়ে এসে সমন্বয় করে প্রথম গান রেকর্ড করা হলো। যে রেকর্ডে সহযোগিতা করলেন এনায়েতুল্লাহ খান। বর্তমানে ঢাকা কুরিয়ারের সম্পাদক। ক্যাটস আইয়ের মালিক সাঈদ সিদ্দিকী রুমী, শামীম, এখন মারা গেছে। এই তিনজনই সহযোগিতা করেছেন। আজম খানের বড় ভাই আলম খান ছিলেন। যেখান থেকে আজমের উত্থান।
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আলম খানের তত্ত্বাবধানে সেখানে বেশির ভাগ গান করল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যারা বাজাত, তারাই। ইশতিয়াক ছিল, মোস্তাফিজুর রহমান সাহেবও ছিলেন। এহতেশাম সাহেবের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান কৃতী পরিচালক ছিলেন। পাকিস্তানের একজন জনপ্রিয় নায়ক নাদিমকে আবিষ্কার করেন এই মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব। ওনার দুই ছেলে। ইদু ও ইশতিয়াক। তারা সেখানে বাজাত। তখন রোববার ছুটি ছিল। শনিবার বাজাত। এনায়েতুল্লাহ খানের কথা বলি। ও হলো আমার ক্লাসমেট। ওর বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। ওর মাধ্যমেই আমি এই ইদু, ইশতিয়াকের সঙ্গে পরিচিত হই। ইদু, ইশতিয়াক যদি আমাদের ফিরোজ সাঁইয়ের প্রতিষ্ঠানে না আসত, তা হলে আজকের ইতিহাসটা হতো আরেক রকম। তখন লিলু গিটার বাজাত। ইশতিয়াক লিড গিটার আর ইদু আসল ড্রামসে। বেইজ গিটারে ছিল ল্যারি।
সুমনা শারমীন: এই প্ল্যাটফর্মটার নাম কী?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: তখন ছিল স্পন্দন। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্ম থেকে যখন সিডি বের হয়, তখন যার যার নামে বের হয়। আমারটা বের হয় আমার নামে, আজম খানেরটা আজম খানের নামে। এবং সে সময় যখন এটা রিলিজ হয়, তখন ছিল রংবাজ ছবি। তখন তো সিডি ছিল না, ছিল লংপ্লে। তখন রংবাজ ছবির গান ‘সে যে কেন এল না’ বিক্রি হয়েছিল সাড়ে সাত হাজার কপি, সাড়ে সাত হাজার কপি বিক্রি মানে সুপার-ডুপার হিট। তখন একটা গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল থার্টি থ্রি আরপিএম। দাম ছিল সাড়ে সাত টাকা। তখন আজমেরটা সাড়ে সাত হাজার কপিও পার হয়েছে। ‘সে যে কেন এল না’র শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এরপর আজম খানের ‘সালেকা মালেকা’ ‘হাইকোর্টের মাজারে’ গানের পর তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এখানে আরেকটি বিষয় বলতে চাই—আজম খান আমাদের দেশের সংগীতাঙ্গনের তারকা শিল্পী বটে, কিন্তু তাঁকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয় আজম খান পপস্টার। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তিনি হলেন রকস্টার।
সুমনা শারমীন: আপনাদের সংগীত ঘরানা, পুরো ধরনটাকেই কি আপনি রক বলতে চান?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: না। আজমেরটা রক। কিন্তু আমারটা আবার পপ। পপ ও রক সংগীতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রকের ধরন অনেকটা ভাবলেশহীন। এই শিল্পীদের পোশাক ও আচরণ সবকিছুর মধ্যেই এ ব্যাপারটি আছে। এমনকি তাদের গায়নশৈলীটাও চড়া মাত্রায় বাঁধা। পপসংগীতের গায়নভঙ্গি একটু ভিন্নতর। পপ হলো ডিজাইনেবল একটি ধারা। এর মধ্যে ঢং আছে। ড্রেসের একটা ব্যাপার থাকে। গায়কির একটা ব্যাপার থাকে। ছন্দের একটা ব্যাপার থাকে। এদিক থেকে আমি বলব আমি রকস্টার নই। কিন্তু আজমকে আমি রকস্টারই বলব।
সুমনা শারমীন: শিল্পীজীবনের এ পর্যায়ে পৌঁছে আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়—আপনার টার্নিং পয়েন্ট কোনটি? সেটা কি ‘এমন একটা মা দে না’?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: অবশ্যই। ‘এমন একটা মা দে না’র প্রসঙ্গে এখানে একটি ছোট্ট কাহিনি উল্লেখ করতে চাই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন টেলিভিশনে সপ্তবর্ণা নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। তিনি ঢাকা কলেজে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘ফেরদৌস, আমি টিভিতে একটি অনুষ্ঠান করছি।’ তখন আমি স্যারকে বললাম, স্যার, আমার একটি অনুরোধ রাখতে হবে। আমাকে আপনার অনুষ্ঠানের শেষ দিকে একটি গান করতে দিতে হবে। এবং গানটিতে আমি লিপসিং করতে চাই। বলে রাখা ভালো, তখনো টিভিতে লিপসিংয়ের চল ছিল না। সরাসরি গান রেকর্ড করা হতো। ‘এমন একটা মা দে না’র মাধ্যমে আমি প্রথম লিপসিং শুরু করি। প্রথমেই স্যারকে আমি গানটি গেয়ে শোনাই। স্যার উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে বললেন, ‘গানটি তো আমি অনুষ্ঠানে রাখবই, তোমাকে বলে রাখি, গানটি শুধু এখন নয়, আজ থেকে বিশ বছর পরও সমান জনপ্রিয় থাকবে।’ স্যারের সে অনুমান মিথ্যা হয়নি। গানটি ১৯৭৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। প্রচারের পর থেকে গানটি হিট। তখন বুঝলাম, দর্শক আমার গান গ্রহণ করেছে।
সুমনা শারমীন: গানের সঙ্গে আপনি পারফরম্যান্সও করেন। মানে বলতে চাইছি, একধরনের নৃত্যভঙ্গিমা থাকে আপনার মধ্যে। নাচটি কোথা থেকে শিখলেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আমার শৈশব কেটেছে কানাডায়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিল্পী—যেমন এলভিস প্রিসলির শোগুলো আমি দেখেছি। টিভিতেও দেখেছি। দেখেছি অ্যাঙ্গেল বার্ড, হ্যাম্পারটিং, জনি ক্যাশ, টম জোনসের গান। ভাবতাম, বাংলাদেশে কখনো যদি আমি গান গাইতে পারি, এমনভাবেই গাইব।
সুমনা শারমীন: আপনার বন্ধুদের মধ্যে কার গানের রেকর্ড আগে বের হয়েছিল? আপনার, না আজম খানের?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আজম খানের। তখন মজিদ খান সাহেব ঢাকা রেকর্ড কোম্পানিতে ছিলেন। তিনি আমাকে খুব আদর করতেন। একদিন তিনি বললেন, কার রেকর্ড আগে বের করব? তোমার না আজমের? আমি বললাম, আজমের। মজার ব্যাপার হলো, আজম নিজেও জানত না, তার রেকর্ড বের হয়েছে। মজিদ খান আমার হাতে আজমের রেকর্ডটি দিলেন এবং আমি সেটা লুকিয়ে নিয়ে তার বাসায় গেলাম। আমরা মোট নয়জন ছিলাম। তাকে বললাম, আগে ভরপেট খাওয়া। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আজম মোট ৪৬ টাকা খরচ করে শিঙাড়াসহ অনেক কিছু খাওয়াল। এরপর আজমকে আমি রেকর্ডটি দিলাম। সে এত খুশি হলো...তার সেই উচ্ছল মুখ আমার এখনো মনে পড়ে। আসলে মানুষের স্বীকৃতিই তো তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমার টার্নিং পয়েন্ট যেমন ‘এমন একটা মা দে না’, তেমনি আজমের টার্নিং পয়েন্ট ওর এই রেকর্ডটি।
সুমনা শারমীন: আপনার এবং আজম খানের কথা তো শুনলাম। এবার ফিরোজ সাঁই সম্পর্কে বলুন। তাঁর টার্নিং পয়েন্ট কী?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: এটা একটা মজার ঘটনা। ও আমাদের জন্য অনেক কিছু করত। একদিন আমি তাকে বললাম, তুই যে আমাদের জন্য এত কিছু করছিস, তোর জন্য আমরা কী করতে পারি বল। তখন সে আমাকে বলল, আমার জন্য আর কে কী করবে? আমি যদি দুটো গান করতে পারতাম। এরপর আমি আর ওকে কিছু বলিনি। আমি সোজা ইপ্সা রেকর্ডিং স্টুডিওতে চলে গেলাম। ওটা ছিল বিজয়নগরে। ওই স্টুডিওর মালিক আমার পূর্বপরিচিত। তাকে গিয়ে বললাম, আমি ফিরোজ সাঁইয়ের দুটো গান রেকর্ড করতে চাই। তখন পর্যন্ত কিন্তু ফিরোজ এসবের বিন্দুবিসর্গও জানে না। পরে গান রেকর্ডের কথা শুনে ও তো অবাক। এরপর ওর দুটো গান রেকর্ড হলো—‘মন তুই চিনলি না রে’, আর একটা ‘সাধের লাউ’। গান রেকর্ডের পর ফিরোজ সাঁই সুপারহিট। ‘মন তুই চিনলি না রে’ ওর টার্নিং পয়েন্ট।
সুমনা শারমীন: ‘স্কুল খুইলাছে রে মাওলা’ কি আরও পরে এল?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: হ্যাঁ, পরে।
সুমনা শারমীন: কখনো কি এ রকম অভিযোগ আপনাদের শুনতে হয়েছে—তোমরা তো বিজাতীয় সংস্কৃতি আমদানি করে আমাদের ডুবিয়ে দিচ্ছ। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, কিন্তু তোমরা বাঙালি সংস্কৃতির পরিপন্থী বিষয়গুলো আমদানি করছ?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: প্রচুর, প্রচুর। এ রকম অভিযোগ এসেছিল কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে। আমি এখন আর তাঁদের নাম বলতে চাইছি না। তাঁরা সরাসরি নাক সিঁটকিয়েছিলেন। আবার বেশ কয়েকটি পত্রপত্রিকাও আমাদের বিরুদ্ধে লিখেছিল। কিন্তু যৌবনস্রোতের কাছে তাঁরা হেরে গেছেন।
সুমনা শারমীন: আমরা এতক্ষণ ফেরদৌস ওয়াহিদের কথা শুনেছি। এবার তাঁর ছেলে হাবিব ওয়াহিদের কাছে আসব। আপনি যখন প্রথম গান শুনেছেন, তখন কাদের গান আকৃষ্ট করেছে?
হাবিব ওয়াহিদ: ছেলেবেলা থেকেই বাবার ইনস্ট্রুমেন্ট এবং বিভিন্ন সংগীতশিল্পীকে দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। আমার যত দূর মনে পড়ে, ভারতীয় কোনো একটি সংগীত আমাকে প্রথম আকৃষ্ট করেছিল। তবে সেটি বাবার নয়, ছিল আমার মায়ের সংগ্রহ।
সুমনা শারমীন: আমাদের দেশের কোন শিল্পীর গান প্রথম আপনার ভালো লেগেছিল?
হাবিব ওয়াহিদ: সত্যি বলতে কি, আমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। আসলে ঘরেই দেখতাম, বাবা গান করছেন, মা গান শুনছেন, ফলে তখন সেই ছেলেবেলায় এ রকম কোনো ভালো লাগাকে বুঝতে পারিনি।
সুমনা শারমীন: কোন সময় থেকে বাংলাদেশের গানের প্রতি আপনার আকর্ষণ তৈরি হলো?
হাবিব ওয়াহিদ: সেটা আমার টিনএজ বয়সে, ওই সময়টা থেকে শুরু। মানে নিজের উৎসাহে গান শোনা শুরু হলো। তবে বাংলা গানের চেয়ে ইংরেজি গান আমি বেশি শুনতাম। বাংলা গানের মধ্যে প্রথম যাঁদের গান পছন্দ হলো, যাঁদের গান অনুভব করতে শুরু করলাম, তাঁরা হলেন, ফিডব্যাক। সে সময়ে ফিডব্যাকে মাকসুদ ভাই ছিলেন। ফিডব্যাক তখন পাশ্চাত্য ধারায় বাংলা গান করত। ফিডব্যাকের পর মাইলস এবং এলআরবি—এদের গানেও ভীষণ রকম মজা পেয়েছি। এ ছাড়া আমাকে আরও একটি ব্যান্ড আকৃষ্ট করেছে, সেটা হলো আর্ক।
সুমনা শারমীন: আমরা চারটি ব্যান্ডদলকে পেলাম—ফিডব্যাক, মাইলস, এলআরবি, আর্ক। আর্কের সদস্যরা কি জানতেন যে তাঁদের গান আপনার এত ভালো লাগে?
হাবিব ওয়াহিদ: এখানে একটা মজা আছে। আমি তো আর্কের ভয়াবহ ফ্যান, বিশেষত টুলু ভাইয়ের। এর মধ্যে আবার মাইলসের মানাম আহমেদ এবং কি-বোর্ডিস্ট হিসেবে শওকত আলী ইমনেরও খুব ভক্ত ছিলাম আমি। তিনি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। কি-বোর্ড বাজাতেন। ওখানেই আমি তাঁর প্লেয়িং দেখি এবং ভক্ত হয়ে যাই। আমার বয়স যখন সতেরো, তখন আমাদের নিজেদের একটা ব্যান্ড ছিল—বন্ধুরা মিলে করেছিলাম। ওখানে বালাম ছিল। আমাদের বাসার পাশে ছিল ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়ার বাড়ি। ওনার ছেলে রিপন, ও ছিল আমাদের ‘ফিরোজ সাঁই’। মানে সাংগঠনিক কাজকর্মে খুবই দক্ষ। সে বেইজ গিটার বাজাত। গানের খুব ভক্ত ছিল। তখন ব্যান্ডের জোয়ার। তো রিপন ভাই, খুব ছোট্ট পরিসরে হলেও আমাদের জড়ো করে একটা ব্যান্ডদল গঠন করেছিলেন। এটা তিরানব্বই সালের কথা। এ সময় একটা মজার ঘটনা ঘটল। আর্কে বাজানোর ডাক পেলাম আমি। এটা ছিল আমার কাছে অভিভূত হওয়ার মতো একটি ঘটনা। আমি যাদের ফ্যান, তাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছি, কথা বলছি, সে বয়সে এটা বিরাট ব্যাপার ছিল আমার কাছে। আর্কে দু-এক বছর বাজানোর পরই আমি লন্ডন চলে গেলাম।
সুমনা শারমীন: আপনার লন্ডন যাওয়ার গল্প শুনতে চাই...
হাবিব ওয়াহিদ: এটা আমার জীবনের খুব আকস্মিক ঘটনা। এ ঘটনাই হয়তো আমার জীবন বদলে দিয়েছে। ইন্টারমিডিয়েটের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পরীক্ষা দিলাম, চান্স পেলাম না। অন্য কোথাও চান্স পেলাম না। আমার মায়ের তো খুব মন খারাপ। আমি ভাবছি কী আর করা, এবার প্রাইভেটে ভর্তি হতে হবে। এ সময় চিশতি ভাইয়ের (ব্যারিস্টার) সঙ্গে দেখা। তিনি রিপন ভাইয়ের বন্ধু, আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় অনেক আগ থেকে। তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তেন। আমার সঙ্গে দেখা হতেই জানতে চাইলেন, কী করছি আমি। তাঁকে বললাম, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনি। তখন তিনি আমাকে বললেন, লন্ডনে চলো। আমি বললাম, মানে, ওখানে গিয়ে আমি কী করব? আমার মা শুনলে তো হার্টফেল করবে। এক ছেলে বলে তিনি কখনো আমাকে কাছ ছাড়া হতে দেন না। এরপর চিশতি ভাই আমাকে তাঁর কলেজে ডিপ্লোমা ইন ল-এর কোর্সে ভর্তি হতে পরামর্শ দিলেন। বললেন, তুই এখানে আগে ভর্তি হ, পরে দেখে-শুনে মিউজিকের ওপর পড়ালেখা করিস। যাহোক বেশ ভয়ে ভয়ে বাড়িতে এসে মাকে কথাটি বললাম। মা যথারীতি যেতে না দেওয়ার পক্ষে। তবে বাবা ছিলেন পজিটিভ। বাবাকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে চিশতি ভাইয়েরও ভূমিকা ছিল। চিশতি ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। নিজের অজান্তেই তিনি আমার জীবন বদলে দিয়েছেন।
সুমনা শারমীন: লন্ডন এবং হাবিবের প্রকাশ নিয়ে বলুন।
হাবিব ওয়াহিদ: লন্ডন যাওয়ার পর আমি প্রথম বাংলাদেশের ফোক মিউজিক শুনি। বাংলাদেশে থাকাবস্থায় লোকসংগীতের প্রতি আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। কারণ, আমি সব সময় প্রচলিত লোকসংগীত শুনেছি। যেমন ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ ইত্যাদি। লন্ডন গিয়ে আমি সিলেটি লোকসংগীত শুনলাম। ওগুলো আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করল। সিলেটের ফোকগানগুলো নতুন মনে হলো আমার কাছে। শুনলাম হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম—এঁদের অসাধারণ গানগুলো। এ সময় আমার মনে হলো, আমি নতুন একটি ভান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি মিউজিক করব সেটা আগেই ঠিক করে ফেলেছিলাম। সেটা রিমিক্স বা মৌলিক গান যা-ই হোক না কেন। লন্ডনে থাকতেই পরিকল্পনা করলাম, কোর্স শেষ হলে দেশে ফিরে আমি নিজে একটা স্টুডিও দেব। এখানে মানুষজন আসবে, মিউজিক হবে। কিন্তু কৃষ্ণ অ্যালবামটা যে করলাম, এটা অনেকটা খেয়ালের বশেই। সত্যি বলতে কি, এই অ্যালবামটি অনেকটা ফান করতে করতে তৈরি হয়েছে। এই অ্যালবামের গানগুলোয় আমি আধুনিক মিউজিকের সঙ্গে ফোক মিউজিকের ফিউশন ঘটিয়ে দেখতে চেয়েছি কেমন লাগে শুনতে। দেখলাম, ভালোই লাগছে। ফলে অ্যালবামটি বের করলাম। কায়ার গাওয়া।
সুমনা শারমীন: কৃষ্ণ তো বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছে?
হাবিব ওয়াহিদ: হ্যাঁ, বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছে। তবে পুরো অ্যালবামের কাজ করেছি লন্ডনে। লন্ডন থেকে ফিরে আসার সময় আমি কৃষ্ণর গানের সিডি সঙ্গে নিয়ে আসি এবং বাংলাদেশে এসে রিলিজ করি।
সুমনা শারমীন: তা হলে হাবিব ওয়াহিদের টার্নিং পয়েন্ট হলো কৃষ্ণ?
হাবিব ওয়াহিদ: হ্যাঁ, কৃষ্ণ। কৃষ্ণ আমাকে ভিন্নধর্মী এক ভ্রমণের মুখোমুখি করেছে। কৃষ্ণ না বের হলে হয়তো আমি আমার নিজের গানই করতাম।
সুমনা শারমীন: কৃষ্ণ কেন মানুষ পছন্দ করল?
হাবিব ওয়াহিদ: কৃষ্ণর মধ্যে একটা ফ্রেশ সাউন্ড আছে। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন পর এ রকম ফ্রেশ সাউন্ড পেল। নতুন একটা সাউন্ড। এ জন্যই মানুষ অ্যালবামটি গ্রহণ করেছে।
সুমনা শারমীন: হাবিব এখন খুব বড় একজন মিউজিশিয়ান। সে যদি আপনার ছেলে না হতো এবং সে যদি আপনার ‘এমন একটা মা দে না’ গানটি নতুন করে গাইত, বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখতেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: খুব ভালো লাগত। আমি ৪০ বছর ধরে গাইছি। এখন নতুন কারও গাওয়া উচিত।
সুমনা শারমীন: আমরা সাক্ষাৎকারের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এখন পিতা ফেরদৌস ওয়াহিদের কাছে জানতে চাই—পুত্র হাবিব ওয়াহিদের সবচেয়ে ভালো গুণ কোনটা?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: ওর সবচেয়ে ভালো গুণ হলো নিজের প্রতি নিজের সততা। ও যদি কোনো খারাপ কাজ করে, সেটাও ও অকপটে স্বীকার করতে পারে। আর ভালো কাজ করলে তো কথাই নেই। এ তো বললাম, মানুষ হিসেবে আমার ছেলে হাবিবের কথা। এবার যদি সংগীত পরিচালক হাবিব সম্পর্কে বলতে চাই, তবে একবাক্যে বলব, ওর শতকরা ৯০ ভাগই ভালো। কাজের ব্যাপারে ওর পেশাদারি মনোভাব প্রচণ্ড। ও সংগীতের প্রতি সৎ।
সুমনা শারমীন: বাবা হিসেবে হাবিবের কোন জিনিসটি বদলে গেলে আপনি খুশি হবেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: রাগ, ওর রাগটা বদলে গেলে আমার ভালো লাগবে।
সুমনা শারমীন: এবার হাবিবের কাছে তাঁর বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদ সম্পর্কে জানতে চাই।
হাবিব ওয়াহিদ: বাবা যেমন আমার সম্পর্কে পুরোপুরি বলতে পারলেন, আমি তাঁর সম্পর্কে তেমনভাবে বলতে পারব না। কেননা বাবা আমাকে জন্ম থেকে দেখে আসছেন। কিন্তু আমি যখন বাবাকে দেখি, যখন থেকে বাবাকে বুঝতে শিখলাম, তখন তিনি জীবনের অনেকটা পথ পার করে ফেলেছেন। এর পরও বলব, বাবাকে যত দূর দেখেছি, উনি খুব সাধারণ। এটা যেমন তাঁর ভালো গুণ, তেমনি আবার খারাপ গুণও এটি। এ ছাড়া কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ সম্পর্কে বলব যে তাঁর কণ্ঠটি ভিন্ন রকম। কিন্তু তাঁর সঠিক ব্যবহার হয়নি।
ফেরদৌস ওয়াহিদ: ভাগ্যেরও ব্যাপার এটা।
হাবিব ওয়াহিদ: বাবার সঙ্গে আমার একটা মতপার্থক্য আছে। বাবা বলেন ভাগ্যের কথা। আমি মনে করি, সবটাই ভাগ্য নয়। এ আর রহমানের জীবনী থেকে জেনেছি, কতটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেই এ আর রহমান আজকে কোথায়? ম্যাডোনা তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চান। বিনয়ী কিন্তু ভারতীয় গৌরব ধারণ করা এ আর রহমান তাঁকে উত্তর দেন ‘ম্যাডোনাজি’ সম্বোধন করে। এ আর রহমানের জীবনযাপন নিয়মতান্ত্রিক। খ্যাতির চূড়ান্তে থেকেও তিনি পা পিছলে যাননি। নারীঘটিত স্ক্যান্ডাল নেই তাঁর। ধূমপান পর্যন্ত করেন না। তিনি আছেন তাঁর সংগীত সাধনা নিয়েই। একটা পেতে হলে আর একটা ছাড়তে হয়।
ফেরদৌস ওয়াহিদ: প্রথমত, আমি যেটা বিশ্বাস করতে চাই, সেটা বাংলা গানের একটা পরম পরশকাঠি। এরপর এটা ভাগ্যেরও একটি বিষয়। আছে অনুশীলন এবং সাধনার একটি ব্যাপার। যোগাযোগের বিষয়টাও আছে। এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলারও ব্যাপারটা তো রয়েছেই। আমার মনে হয় যে এই তিনটির সমন্বয়ে আমি নিজেকে তৈরি করতে পেরেছি।
সুমনা শারমীন: তার মানে, আপনি যে তিনটি কথা বলেছেন, এর একটা হচ্ছে ভাগ্য, একটা হচ্ছে সাধনা আর শেষটা হচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল মেলানো।
ফেরদৌস ওয়াহিদ: হ্যাঁ, এ তিনটাকে আমি মনে করি আমার তরুণ থাকার মূল চাবিকাঠি।
সুমনা শারমীন: এখন আমরা যদি বলি—হাবিব ওয়াহিদ যদি সংগীতশিল্পী না হয়ে অন্য কিছু হতো, তা হলে কি আপনার মনে কোনো কষ্ট হতো?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: কষ্টের কারণ তো ছিল না। কারণ, আমি কখনো আশা করিনি ও সংগীতশিল্পী হবে। ও যখন সিক্সে পড়ত তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ও সংগীতশিল্পী হবে। ও তো এসেই পড়েছে, তবে সংগীত অঙ্গনে এসে যদি ও কিছু না হতে পারত তা হলে কষ্ট হতো।
সুমনা শারমীন: যখন শুরু করলেন, তখন আপনার সময়ের আপনি, ফিরোজ সাঁই...আর কার কার কথা বলবেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আজম খান, পিলু মমতাজ। সেই সময়ে পিলু মমতাজ আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী নারী। একজন মেয়ে সেজেগুজে স্টেজে গান করবে, এমনটা বেশ কষ্টকর ছিল। পিলু মমতাজ সেটা করে দেখিয়েছেন। এর পরপরই এল ফকির আলমগীর... জিঙ্গাগোষ্ঠী। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান থাকতে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। নাজমা জামান, শায়লা জামান তাঁরা দুই বোন ছিলেন, তাঁদের ভাই শাফায়েত। কাদেরি কিবরিয়াও ছিলেন।...স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ‘উচ্চারণ’-এর যাত্রা শুরু।
সুমনা শারমীন: সেটা কি আজম খান দিয়ে শুরু?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আজম খান হলেন প্রথম জনপ্রিয় শিল্পী। সাংগঠনিকভাবে ফিরোজ সাঁই অসাধারণ। সুতরাং দুজনকে দুই রকমভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আজম খান অবশ্যই এ দেশের এযাবৎ কালের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী। জনপ্রিয়তার মুকুটটা যদি কেউ প্রথম মাথায় পরে, সেটা আজম খান।
কিন্তু শুরুটা, সাংগঠনিক তৎপরতা যদি না চলত, ফিরোজ সাঁই যদি না হতেন, তা হলে আমাদের গানের ইতিহাসটা এমন হতোই না। কেননা ,আমার সঙ্গে আজম খানের পরিচয় ঘটিয়ে দেন ফিরোজ সাঁই। ওই সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল...
সুমনা শারমীন: যেটা এখন রূপসী বাংলা...
ফেরদৌস ওয়াহিদ: সেখানে যাঁরা বাজাতেন, ওদের ধরে নিয়ে এসে সমন্বয় করে প্রথম গান রেকর্ড করা হলো। যে রেকর্ডে সহযোগিতা করলেন এনায়েতুল্লাহ খান। বর্তমানে ঢাকা কুরিয়ারের সম্পাদক। ক্যাটস আইয়ের মালিক সাঈদ সিদ্দিকী রুমী, শামীম, এখন মারা গেছে। এই তিনজনই সহযোগিতা করেছেন। আজম খানের বড় ভাই আলম খান ছিলেন। যেখান থেকে আজমের উত্থান।
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আলম খানের তত্ত্বাবধানে সেখানে বেশির ভাগ গান করল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যারা বাজাত, তারাই। ইশতিয়াক ছিল, মোস্তাফিজুর রহমান সাহেবও ছিলেন। এহতেশাম সাহেবের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান কৃতী পরিচালক ছিলেন। পাকিস্তানের একজন জনপ্রিয় নায়ক নাদিমকে আবিষ্কার করেন এই মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব। ওনার দুই ছেলে। ইদু ও ইশতিয়াক। তারা সেখানে বাজাত। তখন রোববার ছুটি ছিল। শনিবার বাজাত। এনায়েতুল্লাহ খানের কথা বলি। ও হলো আমার ক্লাসমেট। ওর বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। ওর মাধ্যমেই আমি এই ইদু, ইশতিয়াকের সঙ্গে পরিচিত হই। ইদু, ইশতিয়াক যদি আমাদের ফিরোজ সাঁইয়ের প্রতিষ্ঠানে না আসত, তা হলে আজকের ইতিহাসটা হতো আরেক রকম। তখন লিলু গিটার বাজাত। ইশতিয়াক লিড গিটার আর ইদু আসল ড্রামসে। বেইজ গিটারে ছিল ল্যারি।
সুমনা শারমীন: এই প্ল্যাটফর্মটার নাম কী?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: তখন ছিল স্পন্দন। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্ম থেকে যখন সিডি বের হয়, তখন যার যার নামে বের হয়। আমারটা বের হয় আমার নামে, আজম খানেরটা আজম খানের নামে। এবং সে সময় যখন এটা রিলিজ হয়, তখন ছিল রংবাজ ছবি। তখন তো সিডি ছিল না, ছিল লংপ্লে। তখন রংবাজ ছবির গান ‘সে যে কেন এল না’ বিক্রি হয়েছিল সাড়ে সাত হাজার কপি, সাড়ে সাত হাজার কপি বিক্রি মানে সুপার-ডুপার হিট। তখন একটা গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল থার্টি থ্রি আরপিএম। দাম ছিল সাড়ে সাত টাকা। তখন আজমেরটা সাড়ে সাত হাজার কপিও পার হয়েছে। ‘সে যে কেন এল না’র শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এরপর আজম খানের ‘সালেকা মালেকা’ ‘হাইকোর্টের মাজারে’ গানের পর তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এখানে আরেকটি বিষয় বলতে চাই—আজম খান আমাদের দেশের সংগীতাঙ্গনের তারকা শিল্পী বটে, কিন্তু তাঁকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয় আজম খান পপস্টার। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তিনি হলেন রকস্টার।
সুমনা শারমীন: আপনাদের সংগীত ঘরানা, পুরো ধরনটাকেই কি আপনি রক বলতে চান?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: না। আজমেরটা রক। কিন্তু আমারটা আবার পপ। পপ ও রক সংগীতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রকের ধরন অনেকটা ভাবলেশহীন। এই শিল্পীদের পোশাক ও আচরণ সবকিছুর মধ্যেই এ ব্যাপারটি আছে। এমনকি তাদের গায়নশৈলীটাও চড়া মাত্রায় বাঁধা। পপসংগীতের গায়নভঙ্গি একটু ভিন্নতর। পপ হলো ডিজাইনেবল একটি ধারা। এর মধ্যে ঢং আছে। ড্রেসের একটা ব্যাপার থাকে। গায়কির একটা ব্যাপার থাকে। ছন্দের একটা ব্যাপার থাকে। এদিক থেকে আমি বলব আমি রকস্টার নই। কিন্তু আজমকে আমি রকস্টারই বলব।
সুমনা শারমীন: শিল্পীজীবনের এ পর্যায়ে পৌঁছে আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়—আপনার টার্নিং পয়েন্ট কোনটি? সেটা কি ‘এমন একটা মা দে না’?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: অবশ্যই। ‘এমন একটা মা দে না’র প্রসঙ্গে এখানে একটি ছোট্ট কাহিনি উল্লেখ করতে চাই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন টেলিভিশনে সপ্তবর্ণা নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। তিনি ঢাকা কলেজে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘ফেরদৌস, আমি টিভিতে একটি অনুষ্ঠান করছি।’ তখন আমি স্যারকে বললাম, স্যার, আমার একটি অনুরোধ রাখতে হবে। আমাকে আপনার অনুষ্ঠানের শেষ দিকে একটি গান করতে দিতে হবে। এবং গানটিতে আমি লিপসিং করতে চাই। বলে রাখা ভালো, তখনো টিভিতে লিপসিংয়ের চল ছিল না। সরাসরি গান রেকর্ড করা হতো। ‘এমন একটা মা দে না’র মাধ্যমে আমি প্রথম লিপসিং শুরু করি। প্রথমেই স্যারকে আমি গানটি গেয়ে শোনাই। স্যার উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে বললেন, ‘গানটি তো আমি অনুষ্ঠানে রাখবই, তোমাকে বলে রাখি, গানটি শুধু এখন নয়, আজ থেকে বিশ বছর পরও সমান জনপ্রিয় থাকবে।’ স্যারের সে অনুমান মিথ্যা হয়নি। গানটি ১৯৭৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। প্রচারের পর থেকে গানটি হিট। তখন বুঝলাম, দর্শক আমার গান গ্রহণ করেছে।
সুমনা শারমীন: গানের সঙ্গে আপনি পারফরম্যান্সও করেন। মানে বলতে চাইছি, একধরনের নৃত্যভঙ্গিমা থাকে আপনার মধ্যে। নাচটি কোথা থেকে শিখলেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আমার শৈশব কেটেছে কানাডায়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিল্পী—যেমন এলভিস প্রিসলির শোগুলো আমি দেখেছি। টিভিতেও দেখেছি। দেখেছি অ্যাঙ্গেল বার্ড, হ্যাম্পারটিং, জনি ক্যাশ, টম জোনসের গান। ভাবতাম, বাংলাদেশে কখনো যদি আমি গান গাইতে পারি, এমনভাবেই গাইব।
সুমনা শারমীন: আপনার বন্ধুদের মধ্যে কার গানের রেকর্ড আগে বের হয়েছিল? আপনার, না আজম খানের?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: আজম খানের। তখন মজিদ খান সাহেব ঢাকা রেকর্ড কোম্পানিতে ছিলেন। তিনি আমাকে খুব আদর করতেন। একদিন তিনি বললেন, কার রেকর্ড আগে বের করব? তোমার না আজমের? আমি বললাম, আজমের। মজার ব্যাপার হলো, আজম নিজেও জানত না, তার রেকর্ড বের হয়েছে। মজিদ খান আমার হাতে আজমের রেকর্ডটি দিলেন এবং আমি সেটা লুকিয়ে নিয়ে তার বাসায় গেলাম। আমরা মোট নয়জন ছিলাম। তাকে বললাম, আগে ভরপেট খাওয়া। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আজম মোট ৪৬ টাকা খরচ করে শিঙাড়াসহ অনেক কিছু খাওয়াল। এরপর আজমকে আমি রেকর্ডটি দিলাম। সে এত খুশি হলো...তার সেই উচ্ছল মুখ আমার এখনো মনে পড়ে। আসলে মানুষের স্বীকৃতিই তো তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমার টার্নিং পয়েন্ট যেমন ‘এমন একটা মা দে না’, তেমনি আজমের টার্নিং পয়েন্ট ওর এই রেকর্ডটি।
সুমনা শারমীন: আপনার এবং আজম খানের কথা তো শুনলাম। এবার ফিরোজ সাঁই সম্পর্কে বলুন। তাঁর টার্নিং পয়েন্ট কী?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: এটা একটা মজার ঘটনা। ও আমাদের জন্য অনেক কিছু করত। একদিন আমি তাকে বললাম, তুই যে আমাদের জন্য এত কিছু করছিস, তোর জন্য আমরা কী করতে পারি বল। তখন সে আমাকে বলল, আমার জন্য আর কে কী করবে? আমি যদি দুটো গান করতে পারতাম। এরপর আমি আর ওকে কিছু বলিনি। আমি সোজা ইপ্সা রেকর্ডিং স্টুডিওতে চলে গেলাম। ওটা ছিল বিজয়নগরে। ওই স্টুডিওর মালিক আমার পূর্বপরিচিত। তাকে গিয়ে বললাম, আমি ফিরোজ সাঁইয়ের দুটো গান রেকর্ড করতে চাই। তখন পর্যন্ত কিন্তু ফিরোজ এসবের বিন্দুবিসর্গও জানে না। পরে গান রেকর্ডের কথা শুনে ও তো অবাক। এরপর ওর দুটো গান রেকর্ড হলো—‘মন তুই চিনলি না রে’, আর একটা ‘সাধের লাউ’। গান রেকর্ডের পর ফিরোজ সাঁই সুপারহিট। ‘মন তুই চিনলি না রে’ ওর টার্নিং পয়েন্ট।
সুমনা শারমীন: ‘স্কুল খুইলাছে রে মাওলা’ কি আরও পরে এল?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: হ্যাঁ, পরে।
সুমনা শারমীন: কখনো কি এ রকম অভিযোগ আপনাদের শুনতে হয়েছে—তোমরা তো বিজাতীয় সংস্কৃতি আমদানি করে আমাদের ডুবিয়ে দিচ্ছ। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, কিন্তু তোমরা বাঙালি সংস্কৃতির পরিপন্থী বিষয়গুলো আমদানি করছ?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: প্রচুর, প্রচুর। এ রকম অভিযোগ এসেছিল কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে। আমি এখন আর তাঁদের নাম বলতে চাইছি না। তাঁরা সরাসরি নাক সিঁটকিয়েছিলেন। আবার বেশ কয়েকটি পত্রপত্রিকাও আমাদের বিরুদ্ধে লিখেছিল। কিন্তু যৌবনস্রোতের কাছে তাঁরা হেরে গেছেন।
সুমনা শারমীন: আমরা এতক্ষণ ফেরদৌস ওয়াহিদের কথা শুনেছি। এবার তাঁর ছেলে হাবিব ওয়াহিদের কাছে আসব। আপনি যখন প্রথম গান শুনেছেন, তখন কাদের গান আকৃষ্ট করেছে?
হাবিব ওয়াহিদ: ছেলেবেলা থেকেই বাবার ইনস্ট্রুমেন্ট এবং বিভিন্ন সংগীতশিল্পীকে দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। আমার যত দূর মনে পড়ে, ভারতীয় কোনো একটি সংগীত আমাকে প্রথম আকৃষ্ট করেছিল। তবে সেটি বাবার নয়, ছিল আমার মায়ের সংগ্রহ।
সুমনা শারমীন: আমাদের দেশের কোন শিল্পীর গান প্রথম আপনার ভালো লেগেছিল?
হাবিব ওয়াহিদ: সত্যি বলতে কি, আমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। আসলে ঘরেই দেখতাম, বাবা গান করছেন, মা গান শুনছেন, ফলে তখন সেই ছেলেবেলায় এ রকম কোনো ভালো লাগাকে বুঝতে পারিনি।
সুমনা শারমীন: কোন সময় থেকে বাংলাদেশের গানের প্রতি আপনার আকর্ষণ তৈরি হলো?
হাবিব ওয়াহিদ: সেটা আমার টিনএজ বয়সে, ওই সময়টা থেকে শুরু। মানে নিজের উৎসাহে গান শোনা শুরু হলো। তবে বাংলা গানের চেয়ে ইংরেজি গান আমি বেশি শুনতাম। বাংলা গানের মধ্যে প্রথম যাঁদের গান পছন্দ হলো, যাঁদের গান অনুভব করতে শুরু করলাম, তাঁরা হলেন, ফিডব্যাক। সে সময়ে ফিডব্যাকে মাকসুদ ভাই ছিলেন। ফিডব্যাক তখন পাশ্চাত্য ধারায় বাংলা গান করত। ফিডব্যাকের পর মাইলস এবং এলআরবি—এদের গানেও ভীষণ রকম মজা পেয়েছি। এ ছাড়া আমাকে আরও একটি ব্যান্ড আকৃষ্ট করেছে, সেটা হলো আর্ক।
সুমনা শারমীন: আমরা চারটি ব্যান্ডদলকে পেলাম—ফিডব্যাক, মাইলস, এলআরবি, আর্ক। আর্কের সদস্যরা কি জানতেন যে তাঁদের গান আপনার এত ভালো লাগে?
হাবিব ওয়াহিদ: এখানে একটা মজা আছে। আমি তো আর্কের ভয়াবহ ফ্যান, বিশেষত টুলু ভাইয়ের। এর মধ্যে আবার মাইলসের মানাম আহমেদ এবং কি-বোর্ডিস্ট হিসেবে শওকত আলী ইমনেরও খুব ভক্ত ছিলাম আমি। তিনি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। কি-বোর্ড বাজাতেন। ওখানেই আমি তাঁর প্লেয়িং দেখি এবং ভক্ত হয়ে যাই। আমার বয়স যখন সতেরো, তখন আমাদের নিজেদের একটা ব্যান্ড ছিল—বন্ধুরা মিলে করেছিলাম। ওখানে বালাম ছিল। আমাদের বাসার পাশে ছিল ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়ার বাড়ি। ওনার ছেলে রিপন, ও ছিল আমাদের ‘ফিরোজ সাঁই’। মানে সাংগঠনিক কাজকর্মে খুবই দক্ষ। সে বেইজ গিটার বাজাত। গানের খুব ভক্ত ছিল। তখন ব্যান্ডের জোয়ার। তো রিপন ভাই, খুব ছোট্ট পরিসরে হলেও আমাদের জড়ো করে একটা ব্যান্ডদল গঠন করেছিলেন। এটা তিরানব্বই সালের কথা। এ সময় একটা মজার ঘটনা ঘটল। আর্কে বাজানোর ডাক পেলাম আমি। এটা ছিল আমার কাছে অভিভূত হওয়ার মতো একটি ঘটনা। আমি যাদের ফ্যান, তাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছি, কথা বলছি, সে বয়সে এটা বিরাট ব্যাপার ছিল আমার কাছে। আর্কে দু-এক বছর বাজানোর পরই আমি লন্ডন চলে গেলাম।
সুমনা শারমীন: আপনার লন্ডন যাওয়ার গল্প শুনতে চাই...
হাবিব ওয়াহিদ: এটা আমার জীবনের খুব আকস্মিক ঘটনা। এ ঘটনাই হয়তো আমার জীবন বদলে দিয়েছে। ইন্টারমিডিয়েটের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পরীক্ষা দিলাম, চান্স পেলাম না। অন্য কোথাও চান্স পেলাম না। আমার মায়ের তো খুব মন খারাপ। আমি ভাবছি কী আর করা, এবার প্রাইভেটে ভর্তি হতে হবে। এ সময় চিশতি ভাইয়ের (ব্যারিস্টার) সঙ্গে দেখা। তিনি রিপন ভাইয়ের বন্ধু, আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় অনেক আগ থেকে। তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তেন। আমার সঙ্গে দেখা হতেই জানতে চাইলেন, কী করছি আমি। তাঁকে বললাম, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনি। তখন তিনি আমাকে বললেন, লন্ডনে চলো। আমি বললাম, মানে, ওখানে গিয়ে আমি কী করব? আমার মা শুনলে তো হার্টফেল করবে। এক ছেলে বলে তিনি কখনো আমাকে কাছ ছাড়া হতে দেন না। এরপর চিশতি ভাই আমাকে তাঁর কলেজে ডিপ্লোমা ইন ল-এর কোর্সে ভর্তি হতে পরামর্শ দিলেন। বললেন, তুই এখানে আগে ভর্তি হ, পরে দেখে-শুনে মিউজিকের ওপর পড়ালেখা করিস। যাহোক বেশ ভয়ে ভয়ে বাড়িতে এসে মাকে কথাটি বললাম। মা যথারীতি যেতে না দেওয়ার পক্ষে। তবে বাবা ছিলেন পজিটিভ। বাবাকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে চিশতি ভাইয়েরও ভূমিকা ছিল। চিশতি ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। নিজের অজান্তেই তিনি আমার জীবন বদলে দিয়েছেন।
সুমনা শারমীন: লন্ডন এবং হাবিবের প্রকাশ নিয়ে বলুন।
হাবিব ওয়াহিদ: লন্ডন যাওয়ার পর আমি প্রথম বাংলাদেশের ফোক মিউজিক শুনি। বাংলাদেশে থাকাবস্থায় লোকসংগীতের প্রতি আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। কারণ, আমি সব সময় প্রচলিত লোকসংগীত শুনেছি। যেমন ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ ইত্যাদি। লন্ডন গিয়ে আমি সিলেটি লোকসংগীত শুনলাম। ওগুলো আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করল। সিলেটের ফোকগানগুলো নতুন মনে হলো আমার কাছে। শুনলাম হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম—এঁদের অসাধারণ গানগুলো। এ সময় আমার মনে হলো, আমি নতুন একটি ভান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি মিউজিক করব সেটা আগেই ঠিক করে ফেলেছিলাম। সেটা রিমিক্স বা মৌলিক গান যা-ই হোক না কেন। লন্ডনে থাকতেই পরিকল্পনা করলাম, কোর্স শেষ হলে দেশে ফিরে আমি নিজে একটা স্টুডিও দেব। এখানে মানুষজন আসবে, মিউজিক হবে। কিন্তু কৃষ্ণ অ্যালবামটা যে করলাম, এটা অনেকটা খেয়ালের বশেই। সত্যি বলতে কি, এই অ্যালবামটি অনেকটা ফান করতে করতে তৈরি হয়েছে। এই অ্যালবামের গানগুলোয় আমি আধুনিক মিউজিকের সঙ্গে ফোক মিউজিকের ফিউশন ঘটিয়ে দেখতে চেয়েছি কেমন লাগে শুনতে। দেখলাম, ভালোই লাগছে। ফলে অ্যালবামটি বের করলাম। কায়ার গাওয়া।
সুমনা শারমীন: কৃষ্ণ তো বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছে?
হাবিব ওয়াহিদ: হ্যাঁ, বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছে। তবে পুরো অ্যালবামের কাজ করেছি লন্ডনে। লন্ডন থেকে ফিরে আসার সময় আমি কৃষ্ণর গানের সিডি সঙ্গে নিয়ে আসি এবং বাংলাদেশে এসে রিলিজ করি।
সুমনা শারমীন: তা হলে হাবিব ওয়াহিদের টার্নিং পয়েন্ট হলো কৃষ্ণ?
হাবিব ওয়াহিদ: হ্যাঁ, কৃষ্ণ। কৃষ্ণ আমাকে ভিন্নধর্মী এক ভ্রমণের মুখোমুখি করেছে। কৃষ্ণ না বের হলে হয়তো আমি আমার নিজের গানই করতাম।
সুমনা শারমীন: কৃষ্ণ কেন মানুষ পছন্দ করল?
হাবিব ওয়াহিদ: কৃষ্ণর মধ্যে একটা ফ্রেশ সাউন্ড আছে। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন পর এ রকম ফ্রেশ সাউন্ড পেল। নতুন একটা সাউন্ড। এ জন্যই মানুষ অ্যালবামটি গ্রহণ করেছে।
সুমনা শারমীন: হাবিব এখন খুব বড় একজন মিউজিশিয়ান। সে যদি আপনার ছেলে না হতো এবং সে যদি আপনার ‘এমন একটা মা দে না’ গানটি নতুন করে গাইত, বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখতেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: খুব ভালো লাগত। আমি ৪০ বছর ধরে গাইছি। এখন নতুন কারও গাওয়া উচিত।
সুমনা শারমীন: আমরা সাক্ষাৎকারের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এখন পিতা ফেরদৌস ওয়াহিদের কাছে জানতে চাই—পুত্র হাবিব ওয়াহিদের সবচেয়ে ভালো গুণ কোনটা?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: ওর সবচেয়ে ভালো গুণ হলো নিজের প্রতি নিজের সততা। ও যদি কোনো খারাপ কাজ করে, সেটাও ও অকপটে স্বীকার করতে পারে। আর ভালো কাজ করলে তো কথাই নেই। এ তো বললাম, মানুষ হিসেবে আমার ছেলে হাবিবের কথা। এবার যদি সংগীত পরিচালক হাবিব সম্পর্কে বলতে চাই, তবে একবাক্যে বলব, ওর শতকরা ৯০ ভাগই ভালো। কাজের ব্যাপারে ওর পেশাদারি মনোভাব প্রচণ্ড। ও সংগীতের প্রতি সৎ।
সুমনা শারমীন: বাবা হিসেবে হাবিবের কোন জিনিসটি বদলে গেলে আপনি খুশি হবেন?
ফেরদৌস ওয়াহিদ: রাগ, ওর রাগটা বদলে গেলে আমার ভালো লাগবে।
সুমনা শারমীন: এবার হাবিবের কাছে তাঁর বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদ সম্পর্কে জানতে চাই।
হাবিব ওয়াহিদ: বাবা যেমন আমার সম্পর্কে পুরোপুরি বলতে পারলেন, আমি তাঁর সম্পর্কে তেমনভাবে বলতে পারব না। কেননা বাবা আমাকে জন্ম থেকে দেখে আসছেন। কিন্তু আমি যখন বাবাকে দেখি, যখন থেকে বাবাকে বুঝতে শিখলাম, তখন তিনি জীবনের অনেকটা পথ পার করে ফেলেছেন। এর পরও বলব, বাবাকে যত দূর দেখেছি, উনি খুব সাধারণ। এটা যেমন তাঁর ভালো গুণ, তেমনি আবার খারাপ গুণও এটি। এ ছাড়া কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ সম্পর্কে বলব যে তাঁর কণ্ঠটি ভিন্ন রকম। কিন্তু তাঁর সঠিক ব্যবহার হয়নি।
ফেরদৌস ওয়াহিদ: ভাগ্যেরও ব্যাপার এটা।
হাবিব ওয়াহিদ: বাবার সঙ্গে আমার একটা মতপার্থক্য আছে। বাবা বলেন ভাগ্যের কথা। আমি মনে করি, সবটাই ভাগ্য নয়। এ আর রহমানের জীবনী থেকে জেনেছি, কতটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেই এ আর রহমান আজকে কোথায়? ম্যাডোনা তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চান। বিনয়ী কিন্তু ভারতীয় গৌরব ধারণ করা এ আর রহমান তাঁকে উত্তর দেন ‘ম্যাডোনাজি’ সম্বোধন করে। এ আর রহমানের জীবনযাপন নিয়মতান্ত্রিক। খ্যাতির চূড়ান্তে থেকেও তিনি পা পিছলে যাননি। নারীঘটিত স্ক্যান্ডাল নেই তাঁর। ধূমপান পর্যন্ত করেন না। তিনি আছেন তাঁর সংগীত সাধনা নিয়েই। একটা পেতে হলে আর একটা ছাড়তে হয়।
No comments