ছাত্র রাজনীতির সুবাতাস কবে বইবে? by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

প্রবাদ আছে 'যে যতটুকু পানিতে নামবে সে ততটুটু ভিজবে'। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে এ প্রবাদটি হাড়ে হাড়ে সত্য। গত দুই দশকে সরকার গঠন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কাঠামোগত ও এর আনুষঙ্গিক যে পরিবর্তন আমরা পেয়েছি, সে ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের মিষ্টি কথায় যে চিঁড়া ভেজে না তা পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে।


গত চারটি নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্পন্ন হয়েছে। ছোটখাটো অভিযোগ ছাড়া নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়েছে সন্দেহ নেই। ভোটদানের ক্ষেত্রে ভোটাররা পেয়েছে স্বাধীনতা, ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা এবং আনন্দময় পরিবেশ। পাশাপাশি শাসনব্যবস্থায় তাদের ইচ্ছারও প্রতিফলন ঘটেছে। টেকসই গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য এ ব্যবস্থা কার্যকর বলে অনেকের ধারণা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে কিন্তু ভোটাররা নিজেদের ভোটদানের ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা ভোগ করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা একটি সময় ছিল, যখন ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত না।
সরকার গঠন প্রক্রিয়ার একমাত্র মাধ্যম যেখানে ভোটদান প্রক্রিয়া সেখানে নিজের ভোট নিজে দেওয়াটা আসল কাজ। বর্তমানে ছবিসহ ভোটার তালিকা এ ক্ষেত্রে ভোটারদের সহায়তা করছে। রাজনীতিবিদদের ভালো ভালো কাজ ভোটারদের ভোটদানে আকৃষ্ট করতে পারে কিন্তু জোর করে কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হওয়া এখন আর সহজ নয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের ক্ষমতায়ন অর্জিত হয়েছে এবং তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা ধীরে ধীরে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার দিকে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষ যত বেশি এ ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র তত দ্রুত টেকসই ও উন্নতির দিকে ধাবিত হবে।
সরকার গঠন প্রক্রিয়ার আনুষঙ্গিক পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম হলো গণমাধ্যম অবাধ প্রবাহ ও স্বাধীনতা। গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত ও সুসংগত করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনন্য। গণমাধ্যমের অবাধ প্রবাহে সাধারণ মানুষের কাছে ছোট-বড় সব ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। গণমাধ্যম সত্য ঘটনা যেটি ঘটেছে বলে প্রমাণিত, ঘটনার কারণ, প্রাসঙ্গিক ঘটনা এবং এর ফল সাধারণের কাছে তুলে ধরছে। নিবৃত্ত গ্রামে বসে মানুষ এখন দেশ-বিদেশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা জানতে পারছে। বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে সাধারণের ধারণা জন্মায়। এ সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে, বুঝতে পারে কোনটি সঠিক এবং কোনটি সঠিক নয়। নিজের মেধা ও বুদ্ধির সমন্বয়ে পাঁচ বছর পর সঠিক সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে থাকে প্রচণ্ড আশা, যা নতুন সরকার পূরণ করবে বলে ধারণা। গত এক দশকে গণমাধ্যমে যে বিপ্লব ঘটেছে তা আমাদের দেশের গণতন্ত্র মজবুত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে অনেকের ধারণা। ভোটারদের কাছে সস্তা আশ্বাস, আকর্ষণীয় পরিকল্পনা, আকাশচুম্বী প্রকল্প বাস্তবায়নের আশা ভোটাররা সহজেই বুঝতে পারে। প্রত্যাশা পূরণ না হলে নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটায়। ফলে ২০ বছরে কোনো রাজনৈতিক দলই পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়নি।
রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। সাধারণ মানুষ চায় রাজনৈতিক সরকারের ওয়াদা পূরণ। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারগুলো নিজেদের এতটাই ক্ষমতাধর ভাবেন, তাঁদের সব কিছুই যেন মানুষ গ্রহণ করবে। তাঁদের ধারণা, জনগণ তাদের পক্ষে, জনরায় আবার তাঁদের পক্ষে যাবে। দলের অফিসগুলোয় প্রচুর জনগণের সমাবেশ ঘটে ও নতুন নতুন নেতা-কর্মী দলে ভিড়েন। নেতারা অনেকের কাছ থেকে সালাম গ্রহণ করেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাঁদের শ্রদ্ধা করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। বিভিন্ন জায়গায় নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কম রাখেন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বোঝার সময় তাঁদের মধ্যে অনেকেরই নেই। কখনো কখনো কে সালাম পেশ করল আর কে করল না তা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। ফলে নিজের ও দলের অবস্থানকে বেশি মূল্য দেওয়ার দায়ে জনগণ ক্ষমতাসীন দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় ছোট বড় অনেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেমন_উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, কিংবা সিটি করপোরেশন। এ নির্বাচনগুলো যদিও স্থানীয় পর্যায়ের এবং স্থানীয় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক তবুও রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা এখানে বিবেচ্য হয়ে দেখা দেয়। প্রতিটি নির্বাচন কম-বেশি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়। এখানেও ভোটারদের ক্ষোভ ও তৃপ্ততার প্রতিফলন ঘটে যেটি শুধু ক্ষমতাসীন দলের জন্যেই নয়, বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জনগণ শুধু ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতায় বিপক্ষেই ভোট দেয় না, বিরোধী দলের অগঠনমূলক কর্মকাণ্ডের বিপক্ষেও দাঁড়ায়। তবে বেশি বেকায়দায় থাকে ক্ষমতাসীন দল, কেননা রাষ্ট্রের সব ম্যাকানিজমের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের যোগাযোগ বেশি থাকে। রাষ্ট্রপরিচালনার ভালো-মন্দ অনেক কিছুই ক্ষমতাসীন দলের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু তারা যদি ব্যর্থ হয়, তখন তার সুযোগ গ্রহণ করে বিরোধী দল। জনগণ এখানে প্রচণ্ড আশাবাদী, আশা করা ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প পথে যে খোলা নেই। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া প্রচলিত আইনের বিরোধী। তাই তো নতুন আশায় বুক বাঁধে এবং নতুন দলকে ক্ষমতাসীন করে। আবারও আশা ও প্রত্যাশা। কিন্তু কতটুকু পূরণ হবে জনগণ তা জানে না।
রাজনৈতিক বুলি দেওয়া খুবই সহজ কাজ। বর্তমানে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা কম নয়। চ্যানেলের সামনে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দেওয়া যায়। পরিপাটি এসি রুমে বসে কথা বলতে ভালোই লাগে কিন্তু এর বাস্তবায়ন কখন ও কিভাবে হবে তা কে জানে। লাভ এতটুকু, জনগণ জানতে পারে যে তাদের জন্য কী কী করা হবে। জনগণ আশায় থাকে কিন্তু তাদের আশা একদিন নিরাশায় পরিণত হয়। কিন্তু একমাত্র পথ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল। জনগণ প্রতি পাঁচ বছর পর পর তাই করে।
জনগণ ভালো কাজের যেমন স্বীকৃতি দেয় তেমনি খারাপ কাজকে তিরস্কারও করে। কিন্তু কখনো কখনো অসংখ্য ভালো কাজ দু-একটি খারাপ কাজের জন্য ম্লান হয়ে যায়। আবার অনেক খারাপ কাজ দু-একটি ভালো কাজের জন্য জনপ্রিয়তা পায়। অবশ্য শেষেরটির ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করা সহজ নয়। খারাপ কাজগুলো মানুষ সব সময় খারাপই বলে। এমনকি আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোও খারাপ কাজগুলো যত আগ্রহ করে প্রকাশ করে, ভালো কাজকে তত আগ্রহ করে প্রকাশ করে না। রাজনৈতিক দলগুলো যতটুকু করতে পারবে তার চেয়ে বেশি করে প্রচার করে। রাজনৈতিক দলগুলো যত বেশি খারাপ কাজ করবে তত বেশি জনগণ তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর যত বেশি ভালো কাজ করবে, তত বেশি ভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের কাজের স্বীকৃতি দেবে। বারবার রাজনৈতিক সরকারের ব্যর্থতায় যেমন গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে তেমনি আবার ক্ষমতায় আসার পথকে করেছে ম্লান। যে প্রবাদটি দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, তা কি সত্যি নয়? রাজনৈতিক দলগুলোর বোধোদয় হবে কবে? কবে?

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.