স্মরণ- যে স্মৃতি আঁখিপল্লবে by সাহেদ ইমরান
জীবনকে ভালোবেসেছেন রাজিয়া বেগম। জামালপুরের মেয়ে তিনি। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কেটেছিল তাঁর ছেলেবেলা। ১৯৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সফলতার দিক দিয়ে ছিলেন তুঙ্গস্পর্শী। অহংবোধের গণ্ডি ছাড়িয়ে কেবল সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
রাজিয়া বেগম সবাইকে ভালোবেসেছেন অকৃত্রিমভাবে। অবাক হতাম তাঁর সরলতায়। কে ভেবেছিল এত অল্প সময়ে বিদায় নেবেন; জন্মের ঋণ শোধ করবেন জাগতিক মোহমুক্তি নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে সখ্য গড়ে? মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালনকালে ২০১০ সালের ৩১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ‘বিসিক’-এর সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান ও রাজিয়া বেগম। রাজিয়া বেগম ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব।
এই মমতাময়ী মানুষটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। বিভিন্ন মেডিকেলের কয়েকজন বন্ধু অপেক্ষা করছিলাম নিউরোলজি বিভাগের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক ডিএমসির অধ্যক্ষ কাজী দ্বীন মোহাম্মদ স্যারের চেম্বারের সামনে। হঠাৎ একজন ভদ্রমহিলা এলেন, সম্ভবত তাঁর মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারে। সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকজন সহযোগী লোকজন। তাঁদের কাছেই জানলাম তিনি সচিবালয়ের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা। সে সময়টাতে আমরা ছিলাম কিছুটা হতাশ এবং বিভ্রান্ত। আমার কেন যেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। অবশ্য কিছুটা ভয়ও লাগছিল, ওই পদের একজন আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন কি না। কিন্তু কই! খুব সাধারণ গোছের মানুষ বলে মনে হলো তাঁকে। আমাদের সমস্যাগুলো শুনলেন। যাওয়ার সময় তাঁর একটি ভিজিটিং কার্ড আমাদের দিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বললেন। তখন তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। বেশ কিছুদিন পর ফোন করলাম, খানিকটা কুণ্ঠিতচিত্তে। তাঁর অফিসে (সচিবালয়ে) আমন্ত্রণ করলেন আমাদের। মুগ্ধ ও অভিভূত হলাম তাঁর অনবদ্য ব্যবহারে, অসামান্য ব্যক্তিত্বে। সচিবদের ব্যাপারে আমার একটু বিরূপ ধারণা ছিল। তাঁকে দেখার পর থেকে আমার সে ধারণা অপসৃত হলো। এই পর্যায়ের একজন মানুষ এমন অমায়িক ও অসাধারণ হতে পারেন, তা ধারণাতেই আসে না। আমরা যখন মেডিকেল শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট অভিভাবক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো সহযোগিতাই পাচ্ছিলাম না, তখন ভিন্ন ক্ষেত্রের একজন নিঃস্বার্থভাবে বলিষ্ঠ অভিভাবকের মতন আমাদের ‘গাইড’ করতে থাকলেন। শিক্ষা-সংকট বিষয়গুলোতে সহযোগিতার ব্যাপারে তিনি এগিয়ে এসেছেন।
রাজিয়া বেগম ব্যক্তিজীবনে যেমন সফল ছিলেন, কর্মেও তাঁর প্রভাব ছিল প্রকট। নিজের সুচিন্তিত ধারণা এবং পরিকল্পনা থেকে অনেক যুগোপযোগী কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে তিনি লেখাপড়ার কাজ শেষ করেন। পরের বছর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাঁর পেশাগত জীবন শুরু। মেধাবী এই মানুষটি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। নোয়াখালীতে আরডিসি পদে, সিলেটে টিএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজিয়া বেগম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জেলা প্রশাসক (ডিসি)। এরপর সচিবালয়ের বাণিজ্য, অর্থ, শিক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নিজেকে সৎ, উদার ও কর্মিষ্ঠ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
একজন সফল সাংগঠনিক ও কল্যাণমুখী সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি দেশময়। রাজবাড়ীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ‘আয়না’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের আওতায় এতিমখানা, স্কুল ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন। পবিত্র হজব্রতও পালন করেন। চাকরির এত বড় দায়িত্বের পরও পরিবারকে ঠিকই সামলে নিয়েছেন। যোগ্য করেছেন তাঁর দুটি সন্তানকে।
অসীমের অমোঘ টানে চলে গেলেন রাজিয়া বেগম। আর পা বাড়াবেন না সচিবালয়ের দিকে। শূন্য করে গেলেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ, রিক্ত করলেন ভক্তকুলকে। তবে সততার যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন, তা ইতিহাস হয়েই রইল। আর আমার কাছে স্মৃতিময় হয়ে থাকল মমতাময়ী মায়ের মতন এই মানুষটির কথা আর শেষ এসএমএসটি।
আর কত মূল্যবান জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেশের ট্রাফিক আইন ব্যবস্থা মানুষের চলাচলের উপযোগী হবে? কত শোকার্ত শব্দমালা পত্রিকাগুলোকে শোকপত্রে পরিণত করবে? কবেই বা সচেতন হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ? এই মৃত্যুর উৎসব থামবে কবে তা আজও প্রশ্নই রয়ে গেল।
রাজিয়া বেগম সৎ, নির্ভীক ও ঋজু চরিত্রের একজন মানুষের নাম। তিনি তাঁর কর্মময় ব্যক্তিজীবন এবং সুকুমারবৃত্তি দিয়ে যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে গেছেন, তা অম্লান হয়ে থাক চিরকাল।
সাহেদ ইমরান
এই মমতাময়ী মানুষটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। বিভিন্ন মেডিকেলের কয়েকজন বন্ধু অপেক্ষা করছিলাম নিউরোলজি বিভাগের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক ডিএমসির অধ্যক্ষ কাজী দ্বীন মোহাম্মদ স্যারের চেম্বারের সামনে। হঠাৎ একজন ভদ্রমহিলা এলেন, সম্ভবত তাঁর মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারে। সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকজন সহযোগী লোকজন। তাঁদের কাছেই জানলাম তিনি সচিবালয়ের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা। সে সময়টাতে আমরা ছিলাম কিছুটা হতাশ এবং বিভ্রান্ত। আমার কেন যেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। অবশ্য কিছুটা ভয়ও লাগছিল, ওই পদের একজন আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন কি না। কিন্তু কই! খুব সাধারণ গোছের মানুষ বলে মনে হলো তাঁকে। আমাদের সমস্যাগুলো শুনলেন। যাওয়ার সময় তাঁর একটি ভিজিটিং কার্ড আমাদের দিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বললেন। তখন তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। বেশ কিছুদিন পর ফোন করলাম, খানিকটা কুণ্ঠিতচিত্তে। তাঁর অফিসে (সচিবালয়ে) আমন্ত্রণ করলেন আমাদের। মুগ্ধ ও অভিভূত হলাম তাঁর অনবদ্য ব্যবহারে, অসামান্য ব্যক্তিত্বে। সচিবদের ব্যাপারে আমার একটু বিরূপ ধারণা ছিল। তাঁকে দেখার পর থেকে আমার সে ধারণা অপসৃত হলো। এই পর্যায়ের একজন মানুষ এমন অমায়িক ও অসাধারণ হতে পারেন, তা ধারণাতেই আসে না। আমরা যখন মেডিকেল শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট অভিভাবক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোনো সহযোগিতাই পাচ্ছিলাম না, তখন ভিন্ন ক্ষেত্রের একজন নিঃস্বার্থভাবে বলিষ্ঠ অভিভাবকের মতন আমাদের ‘গাইড’ করতে থাকলেন। শিক্ষা-সংকট বিষয়গুলোতে সহযোগিতার ব্যাপারে তিনি এগিয়ে এসেছেন।
রাজিয়া বেগম ব্যক্তিজীবনে যেমন সফল ছিলেন, কর্মেও তাঁর প্রভাব ছিল প্রকট। নিজের সুচিন্তিত ধারণা এবং পরিকল্পনা থেকে অনেক যুগোপযোগী কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে তিনি লেখাপড়ার কাজ শেষ করেন। পরের বছর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাঁর পেশাগত জীবন শুরু। মেধাবী এই মানুষটি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। নোয়াখালীতে আরডিসি পদে, সিলেটে টিএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজিয়া বেগম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জেলা প্রশাসক (ডিসি)। এরপর সচিবালয়ের বাণিজ্য, অর্থ, শিক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নিজেকে সৎ, উদার ও কর্মিষ্ঠ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
একজন সফল সাংগঠনিক ও কল্যাণমুখী সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি দেশময়। রাজবাড়ীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ‘আয়না’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের আওতায় এতিমখানা, স্কুল ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন। পবিত্র হজব্রতও পালন করেন। চাকরির এত বড় দায়িত্বের পরও পরিবারকে ঠিকই সামলে নিয়েছেন। যোগ্য করেছেন তাঁর দুটি সন্তানকে।
অসীমের অমোঘ টানে চলে গেলেন রাজিয়া বেগম। আর পা বাড়াবেন না সচিবালয়ের দিকে। শূন্য করে গেলেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ, রিক্ত করলেন ভক্তকুলকে। তবে সততার যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন, তা ইতিহাস হয়েই রইল। আর আমার কাছে স্মৃতিময় হয়ে থাকল মমতাময়ী মায়ের মতন এই মানুষটির কথা আর শেষ এসএমএসটি।
আর কত মূল্যবান জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেশের ট্রাফিক আইন ব্যবস্থা মানুষের চলাচলের উপযোগী হবে? কত শোকার্ত শব্দমালা পত্রিকাগুলোকে শোকপত্রে পরিণত করবে? কবেই বা সচেতন হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ? এই মৃত্যুর উৎসব থামবে কবে তা আজও প্রশ্নই রয়ে গেল।
রাজিয়া বেগম সৎ, নির্ভীক ও ঋজু চরিত্রের একজন মানুষের নাম। তিনি তাঁর কর্মময় ব্যক্তিজীবন এবং সুকুমারবৃত্তি দিয়ে যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে গেছেন, তা অম্লান হয়ে থাক চিরকাল।
সাহেদ ইমরান
No comments