প্রেমের গল্প- আকাশে শুধু একটি ঘুড়ি by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
‘একটা চিঠি লিখে দিতে হবে দোস্ত...।’ ‘কেন, চিঠি কেন? ই-মেইল, এফবির যুগে হঠাৎ চিঠি লিখলে কেমন দেখায়, তার চেয়ে সেলফোনে একটা এসএমএস করে দে।’ ‘এই জন্যই তো শালা তোর চেম্বারে রোগী নেই, তোর মাথা মোটা। ই-মেইল ফেসবুক আর এসএমএস দিয়ে সত্যিকারের ভালোবাসা হয়? ভালোবাসা হচ্ছে ট্র্যাডিশনাল একটি বিষয়, প্রপোজও করতে হবে ট্র্যাডিশনাল ওয়েতে।’
মেজাজটা খিঁচড়ে গেল আমার। বললাম, ‘তা হলে কর, ট্র্যাডিশনাল ওয়েতেই কর, আমার কাছে এলি কেন?’
আমার প্র্যাকটিসটা ঠিকমতো জমে ওঠেনি এখনো। সুযোগ পেলেই এই খোঁচাটা দেয় শাহরিয়ার। আমরা দুজন একসঙ্গে পাস করেছি মেডিকেল কলেজ থেকে। চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও শুরু করলাম দুজনে প্রায় একই সঙ্গে। ওরটা এখন রমরমা, কিন্তু আমার চলছে খুঁড়িয়ে। দুর্বল জায়গায় বন্ধুরাই যদি আঘাত দেয়...!
আমার মনের অবস্থা টের পেল বোধকরি, শাহরিয়ার বলল, ‘মাইন্ড করিস না শাহেদ, তুই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, ছোটখাটো ডিগ্রি নিয়ে প্র্যাকটিস করা তোর কাজ না, এফসিপিএস, এমডি করে ফেল, দেখবি...।’
ওর কথা শুনে ম্লান হেসে বললাম, ‘এবার ঝেড়ে কাশো, চিঠিটা লিখতে হবে কার কাছে?’
চোখ টিপে অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করে বলল, ‘ওই যে...’
‘ওই যে মানে?’
‘এই জন্যই তো বলি তোর মাথা মোটা। আকালমান্দেক লিয়ে ইশারা কাফি। চিঠিটা লিখতে হবে রুবি... মানে রুবিনার কাছে।’
‘রুবিনা!’ নামটা শুনে আমার দুই ঠোঁটের ব্যবধানটা কি বেড়ে গিয়েছিল?
শাহরিয়ার বলল, ‘হাঁ হয়ে আছিস কেন? রুবিনাকে আমি চিঠি দিলে তোর কোনো আপত্তি আছে?’
ঢোক গিলে বললাম, ‘আমার?...আমার কেন আপত্তি থাকবে? তোর ইচ্ছা হলে চিঠি দিবি, আমার কী?’
বললাম বটে আমার কী, মনের ভেতর কোথায় যেন একটু চিনচিন করে উঠল।
আমাদের তিনতলা বাড়ির নিচতলায় আমার চেম্বারটা। রুবিনা আমার পাশের বাড়ির মেয়ে। আমি তো আসলে একটু বইপোকা ধরনের মানুষ, পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে কখন বড় হয়ে উঠল খেয়ালই করিনি। যখন দৃষ্টিসীমায় এল, তখন সে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। কিছুদিন আগে হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে এসেছিল আমার চেম্বারে। আমার ছোট বোন তিথির সঙ্গে। অদ্ভুত মেয়ে। কাচের বোতল ভেঙে গুঁড়ো করছিল ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেবে বলে। ভাঙা এক ফালি কাচে দুই আঙুলের মাঝখানে অনেকটাই কেটে গেছে। ডেটল দিয়ে ওয়াশের পর ড্রেসিং দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি ঘুড়ি ওড়ান?’
নিজের হাতের দিকে তাকিয়েই মাথা কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
এবার মাথা তুলে তাকাল আমার দিকে, চোখে প্রশ্ন ও বিস্ময় দুটোই, ‘কেন মানে?’
আমি আবার নিরীহ কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করলাম একই প্রশ্ন, ‘মানে, জানতে চাইছি আপনি ঘুড়ি ওড়ান কেন?’
‘ওমা এটা আবার কী ধরনের প্রশ্ন। আপনি কি সানিয়া মির্জাকে প্রশ্ন করতে পারবেন ও টেনিস খেলে কেন? নিশাত বা ওয়াসফিয়াকে জিগাইবেন ওরা এভারেস্টে উঠতে গেল কেন?’
কিসের সঙ্গে কী! বুঝলাম মেয়েটা মুখরা। আমি নিজের কাজে, মানে ওর হাতে ব্যান্ডেজ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘জানি আপনি মনে মনে ভাবছেন কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা, মেয়েটা তো খুব মুখরা, তাই না?’
‘না না, ও রকম কিছু না।’
‘ভাবলে ভাবেন, তয় ঘুড়ির মধ্যে আমি চ্যাম্পিয়ন, একদিন ছাদে আইসেন, দেখবেন দশ মিনিটে কেমন আকাশটা ফাঁকা, ঘুড়ি আছে একটাই, খালি আমারটা।’
কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝার উপায় নেই এ মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, যখন-তখন মুখের ভাষায় ঢুকে পড়ছে লোকাল।
তিথি মহাউৎসাহে জানাল, ‘কথা সত্যি ভাইজান, এই এলাকায় ওর সঙ্গে কেউ পারে না।’
আমি বললাম, ‘তুই চুপ কর।’
তিথি চুপ করে গেল।
দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন শাহরিয়ার আমার চেম্বারে উপস্থিত ছিল। রুবিনা চলে যাওয়ার পর বলল, ‘মেয়েটা তো খুব ইন্টারেস্টিং।’
জানি, পৃথিবীর সব মেয়েই শাহরিয়ারের কাছে ইন্টারেস্টিং। তবু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন বল তো, তোর কেন মনে হলো মেয়েটা ইন্টারেস্টিং?’
‘আমি বলব, সো কলড পলিশড ব্যাপারটা যে নেই, এটাই ওর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট, কেমন একটা স্বতঃস্ফূর্ততা আছে...।’
যুক্তিটা কি আমার মনে ধরেছিল? জানি না। তবে মেয়েটাকে মোটের ওপর ভালোই লেগেছিল আমার। সেই ভালো লাগার টানে কিনা জানি না, একদিন ছাদেও উঠেছিলাম। আমাদের ছাদ থেকে ওদের ছাদের দূরত্ব বড়জোর তিন বা চার হাত। তখন প্রায় শেষ বিকেল। পাখিদের ঘরে ফেরার সময়। ঘুড়িদেরও নেমে আসতে হয় এই সময়ে। কিন্তু রুবিনার হাতে তখনো লাটাই, চোখটা আকাশের দিকে। ওকে ঘিরে রয়েছে কয়েকটি কম বয়সী ছেলে। এর মধ্যে কী করে যেন দেখতে পেল আমাকে। লাটাইটা সহকারী এক বালকের হাতে দিয়ে এগিয়ে এল।
‘কেমন আছেন ডাক্তার ভাই?’
এ রকম অদ্ভুত সম্বোধন আমি জীবনে শুনিনি, বললাম, ‘ভালো আছি। আপনি?’
‘বলেন তো আমি কেমন আছি?’
‘আমি কী করে বলব?’
‘রোগী কেমন আছে বলতে পারেন না, আপনি কেমন ডাক্তার?’ বলে খিলখিল হাসি।
এ ধরনের ন্যাকামি সাধারণত আমার পছন্দ না। কিন্তু রুবিনাকে বিরক্তিকর মনে হয়নি সেদিন। এমনকি নিজের ঘরে এসেও ওর কথা মনে করে দু-একবার হেসে ফেলেছি প্রায় নিজের অজান্তেই।
প্রথম দিন ওকে তেমন ভালো করে দেখা হয়নি। ছাদে বিকেলের ম্লান আলোয় দেখে বুঝলাম রীতিমতো সুন্দরী। গায়ের রং শ্যামলা, তবে উজ্জ্বল। ছিপছিপে শরীর, খালি পায়ে ছাদে উঠে এসেছে। অনুমান করা যায় লম্বায় কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ। পানপাতার মতো মুখের গড়ন। কলকাতার ছবিতে দেবশ্রী নামের এক নায়িকাকে দেখেছিলাম, অনেকটা তাঁর মতো। চোখের মণিটা ঠিক কালো না, একটু নীলচে ধরনের। আকাশি নীল একটা কামিজের সঙ্গে পরেছে গাঢ় নীল সালোয়ার, গলায় জড়ানো ওড়নার রংটাও সালোয়ারের সঙ্গে ম্যাচ করা। মাথার দুপাশে দুটো কলাবেণি, আগায় নীল ফিতা। পড়ন্ত বিকেলে এমন রূপ কী এক বিভ্রম তৈরি করে!
এই রুবিনাকে শাহরিয়ারের ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল। ঠিক আছে, মনে হতেই পারে কিন্তু বদমাশটা প্রেমে পড়ল কবে?
শাহরিয়ারকে বললাম, ‘ভেবে দ্যাখ, ব্যাপারটা কি ভালো দেখায়? আফটার অল তুই একজন ডাক্তার, এভাবে চিঠি লিখে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া...।’
‘শোন, প্রেম আর যুদ্ধ—এ দুটো ব্যাপারে কোনো আইন নেই, যেকোনো উপায়ে জিততে হবে, তুই লিখে দে।’
‘ঠিক আছে কী লিখতে হবে বল...।’
‘আরে বাবা আমিই যদি সব বলব, তাহলে তোর কাছে এলাম কেন?...তবে তুই এভাবে শুরুটা করতে পারিস—প্রিয়তমা রুবিনা, তুমি বিনা বাজে না মনোবীণা...এ জাতীয় কিছু একটা, শেষে লিখবি, ইতি তোমারই শা।’
‘জঘন্য! হলে থাকার সময় নিয়মিত বাংলা ফিল্ম দেখে দেখে তোর রুচির বারোটা বেজেছে।’
‘তাই তো বলছি তুই যা খুশি লিখে দে।’
আমি গভীর আবেগে লিখলাম: প্রিয় রুবিনা, যাকে আমি ভালোবাসি অনন্ত তৃষ্ণায়, কাছে গেলে বড় কষ্ট, দূরে গেলে আরও কষ্ট পাই—এ রকম আরও কিছু পঙিক্ত।
চিঠি পড়ে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে শাহরিয়ার, ‘এই জন্যই তো তোর কাছে আসা দোস্ত, সত্যি মেডিকেল লাইনে না এলে জাতি তোর কাছ থেকে অনেক কিছু পেত...’ ইত্যাদি।
আমি কিছু বলি না। চিঠি নিয়ে চলে গেল শাহরিয়ার। বুকের ভেতর তখন চিনচিনে ব্যথাটা আরও একটু বেড়ে যায়। মনটা উদাসীন হয়ে গেল। শাহরিয়ার আমার অনেক দিনের বন্ধু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এত দিন ওকে চিনতে পারিনি, ও আসলে খুবই স্বার্থপর।
কয়েকটা দিন ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। যে ব্যাপারটা কখনো ভাবিনি সেটাই শুরু করলাম হঠাৎ করে, বিদেশে স্কলারশিপের খোঁজ নিতে থাকলাম জোরেশোরে। কেন জানি মনে হচ্ছিল দেশে থেকে আর কী হবে, বিদেশে চলে যাওয়াটাই ভালো। এ রকম মনের অবস্থার মধ্যে এক দুপুরে হঠাৎ চেম্বারে এসে হাজির হলো রুবিনা।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘কী সমস্যা?’
হেসে বলল, ‘কোনো সমস্যা না।’
আমি প্রশ্নবোধকের মতো তাকিয়ে আছি দেখে সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার চিঠি পেয়েছি।’
আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘আমার না, আমার চিঠি না...।’
‘আপনার না মানে?’ হাতব্যাগ থেকে চিঠি বের করে রুবিনা বলল, ‘এটা আপনার হাতের লেখা না? সেদিন ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন, আপনার লেখা আমি চিনি না? তা ছাড়া ইতি তোমার শা মানে কী?’
‘বিলিভ মি’ আমি তখন তোতলাতে শুরু করেছি, ‘শা মানে তো শাহেদ না, শাহরিয়ার, শাহরিয়ার আমার বন্ধু, ও-ই আমাকে চিঠিটা লিখে দিতে বলেছে আপনাকে দেওয়ার জন্য।’
‘শাহরিয়ার ভাই বলেছে চিঠি লিখতে?’—চোখে অবিশ্বাস, তার সঙ্গে মুখের হাসি মিশিয়ে অদ্ভুত গলায় রুবিনা বলল, ‘শাহরিয়ার ভাই কেন আমাকে চিঠি লিখতে বলবেন, ওনার সঙ্গে তিথির কত দিনের সম্পর্ক...।’
আমি বিস্মিত, ‘কোন তিথি?’
‘ফারহানা ইয়াসমিন, আপনার বোন, আমার বান্ধবী তিথি।’
‘তার মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘না বোঝার কিছুই নেই, এ চিঠি আপনিই আমাকে দিয়েছেন।’
আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে জট খুলছে। শাহরিয়ারকে স্বার্থপর ভেবে ভুল করেছি। তবে শালা মহাবদমাশ! এক ঢিলে ব্যাটা টিয়া-ময়না দুটোই শিকারের ব্যবস্থা করেছে।
রুবিনা এবার অসহিষ্ণু, ‘চিঠিটা আপনার কি না বলেন?’
‘জি, মানে ধরে নিতে পারেন আমারই...যদি আমার হয় তাহলে আপনার মতামত, মানে উত্তরটা কী হতে পারে?’
‘দ্যাখেন এত ঘোরপ্যাঁচ বাদ দিয়ে সোজা কথাটা কইয়া ফালান, চিঠিটা আপনার কি না?’ সভয়ে বলি, ‘জি আমার।’
‘তা হলে এদিকে তাকান, আমার চোখের দিকে...এখানে উত্তর লেখা আছে।’
আমি আসলে বইপোকা ধরনের মানুষ, চোখের ভাষা বুঝি না। রুবিনার চোখের মণি নীলচে, সরাসরি তাকাতে পারি না, আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে মনে হলো আমি যেন আকাশ দেখছি, সেই আকাশজুড়ে উড়ছে শুধু একটি ঘুড়ি।
আমার প্র্যাকটিসটা ঠিকমতো জমে ওঠেনি এখনো। সুযোগ পেলেই এই খোঁচাটা দেয় শাহরিয়ার। আমরা দুজন একসঙ্গে পাস করেছি মেডিকেল কলেজ থেকে। চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও শুরু করলাম দুজনে প্রায় একই সঙ্গে। ওরটা এখন রমরমা, কিন্তু আমার চলছে খুঁড়িয়ে। দুর্বল জায়গায় বন্ধুরাই যদি আঘাত দেয়...!
আমার মনের অবস্থা টের পেল বোধকরি, শাহরিয়ার বলল, ‘মাইন্ড করিস না শাহেদ, তুই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, ছোটখাটো ডিগ্রি নিয়ে প্র্যাকটিস করা তোর কাজ না, এফসিপিএস, এমডি করে ফেল, দেখবি...।’
ওর কথা শুনে ম্লান হেসে বললাম, ‘এবার ঝেড়ে কাশো, চিঠিটা লিখতে হবে কার কাছে?’
চোখ টিপে অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করে বলল, ‘ওই যে...’
‘ওই যে মানে?’
‘এই জন্যই তো বলি তোর মাথা মোটা। আকালমান্দেক লিয়ে ইশারা কাফি। চিঠিটা লিখতে হবে রুবি... মানে রুবিনার কাছে।’
‘রুবিনা!’ নামটা শুনে আমার দুই ঠোঁটের ব্যবধানটা কি বেড়ে গিয়েছিল?
শাহরিয়ার বলল, ‘হাঁ হয়ে আছিস কেন? রুবিনাকে আমি চিঠি দিলে তোর কোনো আপত্তি আছে?’
ঢোক গিলে বললাম, ‘আমার?...আমার কেন আপত্তি থাকবে? তোর ইচ্ছা হলে চিঠি দিবি, আমার কী?’
বললাম বটে আমার কী, মনের ভেতর কোথায় যেন একটু চিনচিন করে উঠল।
আমাদের তিনতলা বাড়ির নিচতলায় আমার চেম্বারটা। রুবিনা আমার পাশের বাড়ির মেয়ে। আমি তো আসলে একটু বইপোকা ধরনের মানুষ, পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে কখন বড় হয়ে উঠল খেয়ালই করিনি। যখন দৃষ্টিসীমায় এল, তখন সে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। কিছুদিন আগে হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে এসেছিল আমার চেম্বারে। আমার ছোট বোন তিথির সঙ্গে। অদ্ভুত মেয়ে। কাচের বোতল ভেঙে গুঁড়ো করছিল ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেবে বলে। ভাঙা এক ফালি কাচে দুই আঙুলের মাঝখানে অনেকটাই কেটে গেছে। ডেটল দিয়ে ওয়াশের পর ড্রেসিং দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি ঘুড়ি ওড়ান?’
নিজের হাতের দিকে তাকিয়েই মাথা কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
এবার মাথা তুলে তাকাল আমার দিকে, চোখে প্রশ্ন ও বিস্ময় দুটোই, ‘কেন মানে?’
আমি আবার নিরীহ কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করলাম একই প্রশ্ন, ‘মানে, জানতে চাইছি আপনি ঘুড়ি ওড়ান কেন?’
‘ওমা এটা আবার কী ধরনের প্রশ্ন। আপনি কি সানিয়া মির্জাকে প্রশ্ন করতে পারবেন ও টেনিস খেলে কেন? নিশাত বা ওয়াসফিয়াকে জিগাইবেন ওরা এভারেস্টে উঠতে গেল কেন?’
কিসের সঙ্গে কী! বুঝলাম মেয়েটা মুখরা। আমি নিজের কাজে, মানে ওর হাতে ব্যান্ডেজ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘জানি আপনি মনে মনে ভাবছেন কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা, মেয়েটা তো খুব মুখরা, তাই না?’
‘না না, ও রকম কিছু না।’
‘ভাবলে ভাবেন, তয় ঘুড়ির মধ্যে আমি চ্যাম্পিয়ন, একদিন ছাদে আইসেন, দেখবেন দশ মিনিটে কেমন আকাশটা ফাঁকা, ঘুড়ি আছে একটাই, খালি আমারটা।’
কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝার উপায় নেই এ মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, যখন-তখন মুখের ভাষায় ঢুকে পড়ছে লোকাল।
তিথি মহাউৎসাহে জানাল, ‘কথা সত্যি ভাইজান, এই এলাকায় ওর সঙ্গে কেউ পারে না।’
আমি বললাম, ‘তুই চুপ কর।’
তিথি চুপ করে গেল।
দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন শাহরিয়ার আমার চেম্বারে উপস্থিত ছিল। রুবিনা চলে যাওয়ার পর বলল, ‘মেয়েটা তো খুব ইন্টারেস্টিং।’
জানি, পৃথিবীর সব মেয়েই শাহরিয়ারের কাছে ইন্টারেস্টিং। তবু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন বল তো, তোর কেন মনে হলো মেয়েটা ইন্টারেস্টিং?’
‘আমি বলব, সো কলড পলিশড ব্যাপারটা যে নেই, এটাই ওর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট, কেমন একটা স্বতঃস্ফূর্ততা আছে...।’
যুক্তিটা কি আমার মনে ধরেছিল? জানি না। তবে মেয়েটাকে মোটের ওপর ভালোই লেগেছিল আমার। সেই ভালো লাগার টানে কিনা জানি না, একদিন ছাদেও উঠেছিলাম। আমাদের ছাদ থেকে ওদের ছাদের দূরত্ব বড়জোর তিন বা চার হাত। তখন প্রায় শেষ বিকেল। পাখিদের ঘরে ফেরার সময়। ঘুড়িদেরও নেমে আসতে হয় এই সময়ে। কিন্তু রুবিনার হাতে তখনো লাটাই, চোখটা আকাশের দিকে। ওকে ঘিরে রয়েছে কয়েকটি কম বয়সী ছেলে। এর মধ্যে কী করে যেন দেখতে পেল আমাকে। লাটাইটা সহকারী এক বালকের হাতে দিয়ে এগিয়ে এল।
‘কেমন আছেন ডাক্তার ভাই?’
এ রকম অদ্ভুত সম্বোধন আমি জীবনে শুনিনি, বললাম, ‘ভালো আছি। আপনি?’
‘বলেন তো আমি কেমন আছি?’
‘আমি কী করে বলব?’
‘রোগী কেমন আছে বলতে পারেন না, আপনি কেমন ডাক্তার?’ বলে খিলখিল হাসি।
এ ধরনের ন্যাকামি সাধারণত আমার পছন্দ না। কিন্তু রুবিনাকে বিরক্তিকর মনে হয়নি সেদিন। এমনকি নিজের ঘরে এসেও ওর কথা মনে করে দু-একবার হেসে ফেলেছি প্রায় নিজের অজান্তেই।
প্রথম দিন ওকে তেমন ভালো করে দেখা হয়নি। ছাদে বিকেলের ম্লান আলোয় দেখে বুঝলাম রীতিমতো সুন্দরী। গায়ের রং শ্যামলা, তবে উজ্জ্বল। ছিপছিপে শরীর, খালি পায়ে ছাদে উঠে এসেছে। অনুমান করা যায় লম্বায় কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ। পানপাতার মতো মুখের গড়ন। কলকাতার ছবিতে দেবশ্রী নামের এক নায়িকাকে দেখেছিলাম, অনেকটা তাঁর মতো। চোখের মণিটা ঠিক কালো না, একটু নীলচে ধরনের। আকাশি নীল একটা কামিজের সঙ্গে পরেছে গাঢ় নীল সালোয়ার, গলায় জড়ানো ওড়নার রংটাও সালোয়ারের সঙ্গে ম্যাচ করা। মাথার দুপাশে দুটো কলাবেণি, আগায় নীল ফিতা। পড়ন্ত বিকেলে এমন রূপ কী এক বিভ্রম তৈরি করে!
এই রুবিনাকে শাহরিয়ারের ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল। ঠিক আছে, মনে হতেই পারে কিন্তু বদমাশটা প্রেমে পড়ল কবে?
শাহরিয়ারকে বললাম, ‘ভেবে দ্যাখ, ব্যাপারটা কি ভালো দেখায়? আফটার অল তুই একজন ডাক্তার, এভাবে চিঠি লিখে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া...।’
‘শোন, প্রেম আর যুদ্ধ—এ দুটো ব্যাপারে কোনো আইন নেই, যেকোনো উপায়ে জিততে হবে, তুই লিখে দে।’
‘ঠিক আছে কী লিখতে হবে বল...।’
‘আরে বাবা আমিই যদি সব বলব, তাহলে তোর কাছে এলাম কেন?...তবে তুই এভাবে শুরুটা করতে পারিস—প্রিয়তমা রুবিনা, তুমি বিনা বাজে না মনোবীণা...এ জাতীয় কিছু একটা, শেষে লিখবি, ইতি তোমারই শা।’
‘জঘন্য! হলে থাকার সময় নিয়মিত বাংলা ফিল্ম দেখে দেখে তোর রুচির বারোটা বেজেছে।’
‘তাই তো বলছি তুই যা খুশি লিখে দে।’
আমি গভীর আবেগে লিখলাম: প্রিয় রুবিনা, যাকে আমি ভালোবাসি অনন্ত তৃষ্ণায়, কাছে গেলে বড় কষ্ট, দূরে গেলে আরও কষ্ট পাই—এ রকম আরও কিছু পঙিক্ত।
চিঠি পড়ে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে শাহরিয়ার, ‘এই জন্যই তো তোর কাছে আসা দোস্ত, সত্যি মেডিকেল লাইনে না এলে জাতি তোর কাছ থেকে অনেক কিছু পেত...’ ইত্যাদি।
আমি কিছু বলি না। চিঠি নিয়ে চলে গেল শাহরিয়ার। বুকের ভেতর তখন চিনচিনে ব্যথাটা আরও একটু বেড়ে যায়। মনটা উদাসীন হয়ে গেল। শাহরিয়ার আমার অনেক দিনের বন্ধু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এত দিন ওকে চিনতে পারিনি, ও আসলে খুবই স্বার্থপর।
কয়েকটা দিন ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। যে ব্যাপারটা কখনো ভাবিনি সেটাই শুরু করলাম হঠাৎ করে, বিদেশে স্কলারশিপের খোঁজ নিতে থাকলাম জোরেশোরে। কেন জানি মনে হচ্ছিল দেশে থেকে আর কী হবে, বিদেশে চলে যাওয়াটাই ভালো। এ রকম মনের অবস্থার মধ্যে এক দুপুরে হঠাৎ চেম্বারে এসে হাজির হলো রুবিনা।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ‘কী সমস্যা?’
হেসে বলল, ‘কোনো সমস্যা না।’
আমি প্রশ্নবোধকের মতো তাকিয়ে আছি দেখে সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার চিঠি পেয়েছি।’
আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘আমার না, আমার চিঠি না...।’
‘আপনার না মানে?’ হাতব্যাগ থেকে চিঠি বের করে রুবিনা বলল, ‘এটা আপনার হাতের লেখা না? সেদিন ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন, আপনার লেখা আমি চিনি না? তা ছাড়া ইতি তোমার শা মানে কী?’
‘বিলিভ মি’ আমি তখন তোতলাতে শুরু করেছি, ‘শা মানে তো শাহেদ না, শাহরিয়ার, শাহরিয়ার আমার বন্ধু, ও-ই আমাকে চিঠিটা লিখে দিতে বলেছে আপনাকে দেওয়ার জন্য।’
‘শাহরিয়ার ভাই বলেছে চিঠি লিখতে?’—চোখে অবিশ্বাস, তার সঙ্গে মুখের হাসি মিশিয়ে অদ্ভুত গলায় রুবিনা বলল, ‘শাহরিয়ার ভাই কেন আমাকে চিঠি লিখতে বলবেন, ওনার সঙ্গে তিথির কত দিনের সম্পর্ক...।’
আমি বিস্মিত, ‘কোন তিথি?’
‘ফারহানা ইয়াসমিন, আপনার বোন, আমার বান্ধবী তিথি।’
‘তার মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘না বোঝার কিছুই নেই, এ চিঠি আপনিই আমাকে দিয়েছেন।’
আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে জট খুলছে। শাহরিয়ারকে স্বার্থপর ভেবে ভুল করেছি। তবে শালা মহাবদমাশ! এক ঢিলে ব্যাটা টিয়া-ময়না দুটোই শিকারের ব্যবস্থা করেছে।
রুবিনা এবার অসহিষ্ণু, ‘চিঠিটা আপনার কি না বলেন?’
‘জি, মানে ধরে নিতে পারেন আমারই...যদি আমার হয় তাহলে আপনার মতামত, মানে উত্তরটা কী হতে পারে?’
‘দ্যাখেন এত ঘোরপ্যাঁচ বাদ দিয়ে সোজা কথাটা কইয়া ফালান, চিঠিটা আপনার কি না?’ সভয়ে বলি, ‘জি আমার।’
‘তা হলে এদিকে তাকান, আমার চোখের দিকে...এখানে উত্তর লেখা আছে।’
আমি আসলে বইপোকা ধরনের মানুষ, চোখের ভাষা বুঝি না। রুবিনার চোখের মণি নীলচে, সরাসরি তাকাতে পারি না, আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে মনে হলো আমি যেন আকাশ দেখছি, সেই আকাশজুড়ে উড়ছে শুধু একটি ঘুড়ি।
No comments