বিজ্ঞান- সত্যেন বসুর নামে by মুহাম্মদ ইব্রাহীম
সম্প্রতি হিগস বোসন বাস্তবে উদ্ঘাটিত হওয়ার খবর সারা দুনিয়াতে খুব সাড়া জাগিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ও বাঙালিদের মধ্যে এই সাড়াটি আরও বিশেষভাবে এসেছে, কারণ যে জিনিসটি উদ্ঘাটিত হয়েছে তার সঙ্গে আমাদের একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে রয়েছে—তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার একসময়ের অধ্যাপক
সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আমাদের কেউ কেউ নিরাশ হয়েছেন এই ভেবে যে খবরটির আলোচনায় পিটার হিগসের নাম যতটা উঠে এসেছে, সত্যেন বসুর নাম ততটা আসেনি। এটি অবশ্য হওয়ার কথাও নয়, কারণ বসুর নামটি জড়িত বোসনের সঙ্গে—যেকোনো বোসনের সঙ্গে। হিগসের তত্ত্ব থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা কণিকাটি যেহেতু একটি বোসন হতে বাধ্য, সে কারণেই ওটির নাম হিগস বোসন। এতে মোটেও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই, বরং আমাদের খুশি হওয়ার কথা এ জন্য যে বোসনের ধারণাটি আরও মৌলিক এবং বসুর নামটি আরও ব্যাপকভাবে প্রযুক্ত।
সত্যেন বসুর নাম নিয়ে এ দেশের অনেকের মতো আমিও খুব অধিকারপ্রবণ। দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় প্রাসঙ্গিক, অর্ধপ্রাসঙ্গিক যেকোনো আলাপচারিতায় বা বক্তব্যে সুযোগ পেলেই আমি কথাটি পাড়ি যে পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকে বোসন বলে যে কথাটি সব ছাত্রকে বারবার পড়তে হয়, সে নামটি আমাদের একজনের। হোক না সেই গৌরবজনক অবদানটি এসেছিল বহু আগে ১৯২৪ সালের তরুণ অধ্যাপক সত্যেন বসুর থেকে, আমরা বিভাগের শিক্ষকেরা এখনো তাঁরই ব্যবহূত টেবিলের চারধারে বসেই সভা করি কার্জন হলে তাঁরই অফিস ঘরে। সে কথা না বলি কেমন করে?
সত্যেন বসু ঢাকা ছেড়ে গিয়েছেন ১৯৪৫ সালে। আর ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমরা যাঁরা কার্জন হলে পদার্থবিদ্যা পড়তে এসেছি, তাঁদের কাছে সত্যেন বসুর স্মৃতিচিহ্নগুলো ছিল বিরাট রোমান্সের ব্যাপার। প্রধানত তাঁর কল্যাণে ভাবতে পারছিলাম যে বিশ্ব পদার্থবিদ্যার একটি পাদপীঠে আমরা লেখাপড়া করছি। রোমান্সের একটি গোড়া ছিলেন আমাদের গঙ্গা দা এবং সুরেশ দা—যাঁদের কাছ থেকে আমরা অসংখ্য চা আর বাটারটোস্ট সেবন করে টিকে থাকতাম সারা দিন। তাঁদের গর্ব তাঁরা বোস সাহেবের খাস লোক ছিলেন, কাজেই বাটারটোস্টের সঙ্গে সঙ্গে বোস সাহেবের গল্প বলাটি নিত্যকার বিষয় ছিল—যেমন বোস সাহেব পিএইচডি করেননি বটে তবে তাঁর ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেওয়া কাগজ ঘেঁটে অনেকে দেশেবিদেশে বড় বড় ডিগ্রি করেছেন ইত্যাকার সব গল্প। তবে এটি ঠিক যে কার্জন হলের সবকিছু জড়িয়ে তখনো সত্যেন বসুর একটি রোমান্টিক অবস্থা বিরাজ করছিল।
তাঁর সরাসরি ছাত্র অধ্যাপক মতীন চৌধুরী বলতেন সত্যেন বসু তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হলে কী হবে, পরীক্ষণ গবেষণায়ও তাঁর জুড়ি নেই; রিসার্চ সুপারভাইজার হিসেবে মাস্টার ছিলেন বড় কড়া—ছাত্র মতীন চৌধুরীর ত্রাহি ত্রাহি ভাব। কার্জন হলের ওয়ার্কশপে বসু নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি করেছিলেন এক্স-রে যন্ত্র—আর তাই দিয়ে গবেষণা। নষ্ট হওয়া অবস্থায় এ যন্ত্রপাতি তখনো আমাদের ল্যাবরেটরিতে ছিল। আসলে কার্জন হলের সবকিছুকেই আমরা তখন একটি জীবন্ত ঐতিহ্য হিসেবে কল্পনা করছিলাম—যেন অন্য এক বসু বিজ্ঞান মন্দির। এমনকি তাঁর অফিস ঘরের যে বিশাল গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটি তখনো সশব্দে সময় দিয়ে যাচ্ছিল, সেটিকেও ঐতিহ্যের অংশ মনে হতো। সম্প্রতি নাইট অ্যাট দি মিউজিয়াম বলে একটি সিনেমা দেখেছি—ছবিটিতে মিউজিয়ামে সদ্য যোগদানকারী এক নাইট সিকিউরিটি গার্ডের মনে হচ্ছিল, যেন জাদুঘরের সবকিছু জীবন্ত হয়ে নড়েচড়ে হইচই করছে। সেদিনের কার্জন হলেও কেন জানি আমাদের তা-ই মনে হতো। শুধু সত্যেন বসু তো নন—খাস্তগীর, কৃষ্ণান পরবর্তীকালের খ্যাতনামা পদার্থবিদেরা তো সেখানেই কাজ করতেন বসুর সঙ্গে। পদার্থবিদ্যার ছাত্র না হয়েও যাঁরা সত্যেন বসুকে দেখেছেন, তাঁদের কাছেও তিনি ছিলেন মুগ্ধ হয়ে তাকানোর এক জ্ঞানবর্তিকা। তাই সেদিনের আর্টসের ছাত্র সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন কীভাবে তাঁরা কার্জন হলে রাতের বাতি দেখে বুঝতেন সত্যেন বসু এখনো কাজ করছেন। কিছু পরে রাস্তাটি পার হয়ে হেঁটে ওই বিখ্যাত লাল বাংলো বাড়িটিতে যাবেন—বোস সাহেবের বাড়ি বলে যা সবার কাছে পরিচিত। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন বহুকাল পরে ওই বাড়িটি যেদিন বিজ্ঞান ভবনের জায়গা করতে ভেঙে ফেলা হলো সেদিন, তাঁর স্মৃতিচিহ্নটি লুপ্ত হওয়ার বেদনা নিয়ে।
আমাদের কিংবদন্তির অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন বলতেন কীভাবে সত্যেন বসু তাঁকে যে অঙ্ক সকালে দিয়েছেন, তিনি সেটির ওপর সারা দিন কসরত করে রাতে বসুর বাসায় গিয়ে গুরু-শিষ্য মিলে খাবার টেবিলে বসে শেষ পর্যন্ত তার সুরাহা করতে হয়েছে। বিজ্ঞান ইতিহাসের এক ব্যাখ্যানে দেখেছি, ১৯২৪ সালের সেই বিখ্যাত আবিষ্কারের মূলেও ছিল এমনি ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর কিছু আলাপের সূত্র। একটু গোড়া থেকে দেখা যাক ঘটনাটিকে।
একটি লোহার চিমটাকে অত্যন্ত উত্তপ্ত করে তুললে সেটি যে লাল রঙের আলো ছড়ায়, যে রকম ব্যাপারকে ব্যাখ্যা করতে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রবর্তন করতে হয়েছিল। শীতের রোদে কালো রঙের বস্তু যে হালকা রঙের বস্তু থেকে বেশি গরম হয়, কিছুটা পরোক্ষভাবে তার ব্যাখ্যা পেতেও প্ল্যাঙ্কের সেই কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োজন। বসুর ওই সময়ের কাছাকাছি কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছিল যে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে কণিকার অবস্থান ও বেগ উভয়টি নির্ণয় করতে হলে তার মধ্যে একটি অনিবার্য অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বসু ছাত্রদের সঙ্গে এই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করছিলেন। তিনি এগুলোকে দেখছিলেন একগুচ্ছ অভিন্ন আলোক কণিকা ফোটন কীভাবে একগুচ্ছ শক্তি-অবস্থার মধ্যে বণ্টিত হতে পারে তা নিয়ে, অর্থাৎ এর সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে। তিনি দেখছিলেন যে এ ক্ষেত্রে সাধারণ সংখ্যাতাত্ত্বিক নিয়মে যে ফলাফল দাঁড়ায় তা পরীক্ষণ ফলাফলের সঙ্গে মেলে না।
মনে হলো খুব সাধারণ কিছু ভুল করার মাধ্যমেই তিনি ছাত্রদের কাছে বিষয়টি উপস্থাপিত করলেন—যে রকম ভুল কোনো মামুলি সংখ্যাতত্ত্ববিদও করবেন না। উপমা দিয়ে সহজ করে বললে ভুলটি অনেকটা এ রকমের। দুটি মুদ্রা বারবার টস করলে উভয়টিতে ‘হেড’ আসার সম্ভাবনাকে তিনি যেন বললেন তিনের মধ্যে এক—কারণ তাকে হেড-হেড, হেড-টেইল (যা টেইল-হেডের সঙ্গে অভিন্ন) এবং টেইল-টেইল এই তিনটির একটি হতে হবে। অথচ সংখ্যাতত্ত্বের যেকোনো ছাত্রই জানে যে সেটি তা নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ওই জাতীয় ভুল করে বসু দেখলেন যে এর ফলে তাঁর মূল বিষয়টিতে ফলাফল পরীক্ষণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। অদ্ভুত সৃজনশীলতার সঙ্গে বসু বুঝলেন আসলে ভুল তিনি করেননি, এই আলোক কণিকার ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বটিই বরং ব্যতিক্রমী প্রকৃতির হতে হবে। বসুর এই নতুন সংখ্যাতত্ত্বে অদ্ভুত ব্যাপারটি যা হলো তাতে একই শক্তি-অবস্থার মধ্যে একাধিক ফোটন থাকতে পারবে। বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে এ সম্পর্কে প্রবন্ধটি পাঠিয়ে ব্যর্থ হলেন বসু। কিন্তু দমে না গিয়ে এটি তিনি স্বয়ং আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আইনস্টাইন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন এটি কত বড় আবিষ্কার, তাই তিনি আর একটি বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নালে সেটি ছাপানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। সেটিই ছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সেই অবিস্মরণীয় আবিষ্কার বসু সংখ্যাতত্ত্ব।
বসু আবিষ্কারটি করেছিলেন আলোক কণিকা ফোটনের ক্ষেত্রে। কিন্তু আইনস্টাইন দেখলেন এটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বস্তু কণিকার ওপরও প্রযুক্ত হতে পারে। এই বর্ধিত পরিসরে বসুর তত্ত্ব পুনঃপ্রকাশিত হলো বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব রূপে। পরে পদার্থবিদ্যার আর এক দিকপাল ডিরাক এই সংখ্যাতত্ত্বের অনুসারী সব কণিকার নাম দিলেন বোসন। এর বিপরীতে রয়েছে অন্য রকম সব কণিকা—যা ফার্মি ও ডিরাকের সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে এবং সে ক্ষেত্রে একটি শক্তি-অবস্থায় শুধু একটি কণিকাই থাকতে পারে। ‘বর্জন নীতি’ নামে এক বৈশিষ্ট্যের কারণে একাধিক কণিকা সেখানে থাকতে পারে না। ও রকম কণিকাগুলোর নাম দেওয়া হলো ফার্মিয়ন। ব্যস, সব কণিকা হয় বোসন হবে, নইলে ফার্মিয়ন হবে। সারা দুনিয়ার পদার্থবিদ্যার ছাত্রকে এটি জানতে হয়, আর বোসন কণিকার কথা যতবারই আসে ততবারই নিতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম।
ওপরে আমরা দেখেছি আইনস্টাইন সেই তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে শুধু আলোক কণিকা নয়, বিশেষ বিশেষ বস্তু কণিকাও বোসন হতে পারে। গাণিতিকভাবে তিনি দেখালেন হিলিয়াম-৪-এর মতো পরমাণুকে অত্যন্ত নিম্ন উত্তাপে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে সেগুলো একেবারে নিম্নতম একই শক্তি-অবস্থায় গিয়ে জমা হবে, যাকে পরে বলা হয়েছে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। এটি বলতে গেলে কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থার বাইরে পদার্থের সম্পূর্ণ একটি নতুন অবস্থা। আইনস্টাইনের কাছে এটি নেহাত একটি গাণিতিক বিষয় হিসেবে থাকলেও পরে অনেকে এর ওপর আরও কাজ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বহু দিন পর ১৯৯৫ সালে কোয়ান্টাম সুপার-ফ্লুইড তত্ত্বে অতি শীতল হিলিয়াম-৪কে বসু সংখ্যাতত্ত্বের কারণেই দেখা গেছে চরম ধরনের প্রবহতা লাভ করতে, যা কিনা মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে পাত্রের দেয়াল বেয়ে আপনা আপনি উঠে আসতে পারে। শুধু এই গুণই নয়, বসু সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োগেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে লেজার আলোর সৃষ্টি, সুপার কন্ডাকটিভিটি বা বিদ্যুতের অসীম পরিবাহিতা ইত্যাদি চমকপ্রদ আরও অনেক আবিষ্কার।
ওপরে আমরা দেখলাম কেমন করে গোটা একটি পরমাণু (হিলিয়াম-৪) বোসন হতে পারে, যা কিনা নিজেই একাধিক কণিকার সমন্বয়। তেমনি আরও নানা রকম কণিকা-সমন্বয় বোসন হতে পারে। কিন্তু কণিকাবিদ্যার ক্ষেত্রে বর্তমানের যে সর্বস্বীকৃত তত্ত্ব রয়েছে যা স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে পরিচিত, তাতে পাঁচটি মৌলিক বোসনের অস্তিত্ব রয়েছে। এগুলো অন্য কণিকার সমন্বয় নয়। এদের মধ্যে চারটির দায়িত্ব হলো চার রকমের বলের বাহক হিসেবে কাজ করা। এ রকম এক একটি বোসন এক এক ধরনের ‘অলীক’ কণিকা রূপে ‘বাস্তব’ কিছু কণিকার সঙ্গে বিক্রিয়ার মাধ্যমে এক এক ধরনের বলের সৃষ্টি করে আর ওই বোসন হয় বলটির বাহক। এভাবে বিদ্যুৎ-চৌম্বক বলের বাহক হলো ফোটন, নিউক্লিয়ার দুর্বল বলের বাহক W বোসন ও Z বোসন, নিউক্লিয়ার সবল বলের বাহক গ্লুয়ন নামের বোসন। তা ছাড়া মাধ্যাকর্ষণ বলের বাহক হিসেবে আর একটি বোসন গ্রাভিটনেরও একটি তাত্ত্বিক কল্পনা রয়েছে, যেটি এখনো স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ১৯৬০-এর দশক থেকে অন্তর্ভুক্ত ছিল হিগস বোসন—যা পিটার হিগসের তাত্ত্বিক আবিষ্কার। একে বাস্তবে উদ্ঘাটিত না করা পর্যন্ত কণিকাবিদেরা শান্তি পাচ্ছিলেন না। এর সঙ্গে যে জড়িয়ে রয়েছে বস্তু কণিকাগুলোর ভরের প্রশ্নটি—মহাবিশ্বের সৃষ্টির শুরুতে ভরহীন সব কণিকা যেভাবে হিগসের তত্ত্ব অনুযায়ী ভর লাভ করেছিল, সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাটি। এ কারণেই জেনেভার সার্ন ল্যাবরেটরি থেকে আসা সেই দারুণ সুখবরটি সবাই খুব উপভোগ করছেন। ঘটনাটির গুরুত্বের কারণে পদার্থবিদদের বাইরেও অনেক মানুষ এর আলোচনা করতে গিয়ে হিগসের সঙ্গে সঙ্গে বসুর নামটিও ব্যাপকভাবে উচ্চারণ করছেন। বোসনের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা কিন্তু নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিস্তৃত হচ্ছে। এমনি একটি চাঞ্চল্যকর ক্ষেত্রে সত্যেন বসুর নাম এসেছে ‘বোসনোভা’ হিসেবে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেটকে বিশেষ ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তনের সম্মুখীন করলে তাতে মহাকাশের সুপারনোভা বিস্ফোরণের মতো একটি অতি ক্ষুদ্র বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষণে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই বিস্ফোরণে কনডেনসেটের অর্ধেক পরিমাণ পরমাণু কোথায় জানি হারিয়ে যায়—কোথায়, কীভাবে তা বর্তমান পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব দিয়ে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও এই বিস্ফোরণটি অতি ক্ষুদ্র, তবুও এর সঙ্গে কিন্তু সুপারনোভা বিস্ফোরণের দারুণ সাদৃশ্য রয়েছে। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে বোস-সুপারনোভা, সংক্ষেপে বোসনোভা। সুপারনোভা হলো সুদূর মহাকাশে বৃদ্ধ দশায় উপনীত তারার স্বতঃবিস্ফোরণ, যার মাধ্যমে মহাবিশ্বে তারার বস্তুগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এমনি একটি মহাজাগতিক ঘটনার ক্ষুদ্র সংস্করণের সঙ্গেও জড়িয়ে রইল আমাদের সত্যেন বসুর নাম।
একটি পাদটীকা দিয়ে লেখাটি শেষ করব। ১৯৭৪ সালে তাঁর প্রয়াণের মাত্র কিছুদিন আগে সত্যেন্দ্রনাথ বসু কলকাতা থেকে আমাকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন, আমাদের মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকীর সম্পাদক হিসেবে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা যেসব সৃষ্টিশীল কাজ করছে তার নিয়মিত খবর রাখছেন বলে জানিয়েছিলেন। সে সঙ্গে জানিয়েছিলেন আমাদের পত্রিকাটি নিয়ে বেশ কিছু পরামর্শও। আমাদের একজন হিসেবে আমরা যেমন পদার্থবিদ্যার এতসব চমকপ্রদ বিষয়ে বসু নামের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিয়ে গর্ব করি, তিনিও কিন্তু তাঁর ঢাকার ছেলেমেয়েদের কথা কখনো ভোলেননি।
ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, বিজ্ঞান লেখক
সত্যেন বসুর নাম নিয়ে এ দেশের অনেকের মতো আমিও খুব অধিকারপ্রবণ। দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় প্রাসঙ্গিক, অর্ধপ্রাসঙ্গিক যেকোনো আলাপচারিতায় বা বক্তব্যে সুযোগ পেলেই আমি কথাটি পাড়ি যে পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকে বোসন বলে যে কথাটি সব ছাত্রকে বারবার পড়তে হয়, সে নামটি আমাদের একজনের। হোক না সেই গৌরবজনক অবদানটি এসেছিল বহু আগে ১৯২৪ সালের তরুণ অধ্যাপক সত্যেন বসুর থেকে, আমরা বিভাগের শিক্ষকেরা এখনো তাঁরই ব্যবহূত টেবিলের চারধারে বসেই সভা করি কার্জন হলে তাঁরই অফিস ঘরে। সে কথা না বলি কেমন করে?
সত্যেন বসু ঢাকা ছেড়ে গিয়েছেন ১৯৪৫ সালে। আর ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমরা যাঁরা কার্জন হলে পদার্থবিদ্যা পড়তে এসেছি, তাঁদের কাছে সত্যেন বসুর স্মৃতিচিহ্নগুলো ছিল বিরাট রোমান্সের ব্যাপার। প্রধানত তাঁর কল্যাণে ভাবতে পারছিলাম যে বিশ্ব পদার্থবিদ্যার একটি পাদপীঠে আমরা লেখাপড়া করছি। রোমান্সের একটি গোড়া ছিলেন আমাদের গঙ্গা দা এবং সুরেশ দা—যাঁদের কাছ থেকে আমরা অসংখ্য চা আর বাটারটোস্ট সেবন করে টিকে থাকতাম সারা দিন। তাঁদের গর্ব তাঁরা বোস সাহেবের খাস লোক ছিলেন, কাজেই বাটারটোস্টের সঙ্গে সঙ্গে বোস সাহেবের গল্প বলাটি নিত্যকার বিষয় ছিল—যেমন বোস সাহেব পিএইচডি করেননি বটে তবে তাঁর ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেওয়া কাগজ ঘেঁটে অনেকে দেশেবিদেশে বড় বড় ডিগ্রি করেছেন ইত্যাকার সব গল্প। তবে এটি ঠিক যে কার্জন হলের সবকিছু জড়িয়ে তখনো সত্যেন বসুর একটি রোমান্টিক অবস্থা বিরাজ করছিল।
তাঁর সরাসরি ছাত্র অধ্যাপক মতীন চৌধুরী বলতেন সত্যেন বসু তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হলে কী হবে, পরীক্ষণ গবেষণায়ও তাঁর জুড়ি নেই; রিসার্চ সুপারভাইজার হিসেবে মাস্টার ছিলেন বড় কড়া—ছাত্র মতীন চৌধুরীর ত্রাহি ত্রাহি ভাব। কার্জন হলের ওয়ার্কশপে বসু নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি করেছিলেন এক্স-রে যন্ত্র—আর তাই দিয়ে গবেষণা। নষ্ট হওয়া অবস্থায় এ যন্ত্রপাতি তখনো আমাদের ল্যাবরেটরিতে ছিল। আসলে কার্জন হলের সবকিছুকেই আমরা তখন একটি জীবন্ত ঐতিহ্য হিসেবে কল্পনা করছিলাম—যেন অন্য এক বসু বিজ্ঞান মন্দির। এমনকি তাঁর অফিস ঘরের যে বিশাল গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটি তখনো সশব্দে সময় দিয়ে যাচ্ছিল, সেটিকেও ঐতিহ্যের অংশ মনে হতো। সম্প্রতি নাইট অ্যাট দি মিউজিয়াম বলে একটি সিনেমা দেখেছি—ছবিটিতে মিউজিয়ামে সদ্য যোগদানকারী এক নাইট সিকিউরিটি গার্ডের মনে হচ্ছিল, যেন জাদুঘরের সবকিছু জীবন্ত হয়ে নড়েচড়ে হইচই করছে। সেদিনের কার্জন হলেও কেন জানি আমাদের তা-ই মনে হতো। শুধু সত্যেন বসু তো নন—খাস্তগীর, কৃষ্ণান পরবর্তীকালের খ্যাতনামা পদার্থবিদেরা তো সেখানেই কাজ করতেন বসুর সঙ্গে। পদার্থবিদ্যার ছাত্র না হয়েও যাঁরা সত্যেন বসুকে দেখেছেন, তাঁদের কাছেও তিনি ছিলেন মুগ্ধ হয়ে তাকানোর এক জ্ঞানবর্তিকা। তাই সেদিনের আর্টসের ছাত্র সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন কীভাবে তাঁরা কার্জন হলে রাতের বাতি দেখে বুঝতেন সত্যেন বসু এখনো কাজ করছেন। কিছু পরে রাস্তাটি পার হয়ে হেঁটে ওই বিখ্যাত লাল বাংলো বাড়িটিতে যাবেন—বোস সাহেবের বাড়ি বলে যা সবার কাছে পরিচিত। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন বহুকাল পরে ওই বাড়িটি যেদিন বিজ্ঞান ভবনের জায়গা করতে ভেঙে ফেলা হলো সেদিন, তাঁর স্মৃতিচিহ্নটি লুপ্ত হওয়ার বেদনা নিয়ে।
আমাদের কিংবদন্তির অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন বলতেন কীভাবে সত্যেন বসু তাঁকে যে অঙ্ক সকালে দিয়েছেন, তিনি সেটির ওপর সারা দিন কসরত করে রাতে বসুর বাসায় গিয়ে গুরু-শিষ্য মিলে খাবার টেবিলে বসে শেষ পর্যন্ত তার সুরাহা করতে হয়েছে। বিজ্ঞান ইতিহাসের এক ব্যাখ্যানে দেখেছি, ১৯২৪ সালের সেই বিখ্যাত আবিষ্কারের মূলেও ছিল এমনি ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর কিছু আলাপের সূত্র। একটু গোড়া থেকে দেখা যাক ঘটনাটিকে।
একটি লোহার চিমটাকে অত্যন্ত উত্তপ্ত করে তুললে সেটি যে লাল রঙের আলো ছড়ায়, যে রকম ব্যাপারকে ব্যাখ্যা করতে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রবর্তন করতে হয়েছিল। শীতের রোদে কালো রঙের বস্তু যে হালকা রঙের বস্তু থেকে বেশি গরম হয়, কিছুটা পরোক্ষভাবে তার ব্যাখ্যা পেতেও প্ল্যাঙ্কের সেই কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োজন। বসুর ওই সময়ের কাছাকাছি কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছিল যে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে কণিকার অবস্থান ও বেগ উভয়টি নির্ণয় করতে হলে তার মধ্যে একটি অনিবার্য অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বসু ছাত্রদের সঙ্গে এই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করছিলেন। তিনি এগুলোকে দেখছিলেন একগুচ্ছ অভিন্ন আলোক কণিকা ফোটন কীভাবে একগুচ্ছ শক্তি-অবস্থার মধ্যে বণ্টিত হতে পারে তা নিয়ে, অর্থাৎ এর সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে। তিনি দেখছিলেন যে এ ক্ষেত্রে সাধারণ সংখ্যাতাত্ত্বিক নিয়মে যে ফলাফল দাঁড়ায় তা পরীক্ষণ ফলাফলের সঙ্গে মেলে না।
মনে হলো খুব সাধারণ কিছু ভুল করার মাধ্যমেই তিনি ছাত্রদের কাছে বিষয়টি উপস্থাপিত করলেন—যে রকম ভুল কোনো মামুলি সংখ্যাতত্ত্ববিদও করবেন না। উপমা দিয়ে সহজ করে বললে ভুলটি অনেকটা এ রকমের। দুটি মুদ্রা বারবার টস করলে উভয়টিতে ‘হেড’ আসার সম্ভাবনাকে তিনি যেন বললেন তিনের মধ্যে এক—কারণ তাকে হেড-হেড, হেড-টেইল (যা টেইল-হেডের সঙ্গে অভিন্ন) এবং টেইল-টেইল এই তিনটির একটি হতে হবে। অথচ সংখ্যাতত্ত্বের যেকোনো ছাত্রই জানে যে সেটি তা নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ওই জাতীয় ভুল করে বসু দেখলেন যে এর ফলে তাঁর মূল বিষয়টিতে ফলাফল পরীক্ষণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। অদ্ভুত সৃজনশীলতার সঙ্গে বসু বুঝলেন আসলে ভুল তিনি করেননি, এই আলোক কণিকার ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বটিই বরং ব্যতিক্রমী প্রকৃতির হতে হবে। বসুর এই নতুন সংখ্যাতত্ত্বে অদ্ভুত ব্যাপারটি যা হলো তাতে একই শক্তি-অবস্থার মধ্যে একাধিক ফোটন থাকতে পারবে। বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে এ সম্পর্কে প্রবন্ধটি পাঠিয়ে ব্যর্থ হলেন বসু। কিন্তু দমে না গিয়ে এটি তিনি স্বয়ং আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আইনস্টাইন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন এটি কত বড় আবিষ্কার, তাই তিনি আর একটি বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নালে সেটি ছাপানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। সেটিই ছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সেই অবিস্মরণীয় আবিষ্কার বসু সংখ্যাতত্ত্ব।
বসু আবিষ্কারটি করেছিলেন আলোক কণিকা ফোটনের ক্ষেত্রে। কিন্তু আইনস্টাইন দেখলেন এটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বস্তু কণিকার ওপরও প্রযুক্ত হতে পারে। এই বর্ধিত পরিসরে বসুর তত্ত্ব পুনঃপ্রকাশিত হলো বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব রূপে। পরে পদার্থবিদ্যার আর এক দিকপাল ডিরাক এই সংখ্যাতত্ত্বের অনুসারী সব কণিকার নাম দিলেন বোসন। এর বিপরীতে রয়েছে অন্য রকম সব কণিকা—যা ফার্মি ও ডিরাকের সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে এবং সে ক্ষেত্রে একটি শক্তি-অবস্থায় শুধু একটি কণিকাই থাকতে পারে। ‘বর্জন নীতি’ নামে এক বৈশিষ্ট্যের কারণে একাধিক কণিকা সেখানে থাকতে পারে না। ও রকম কণিকাগুলোর নাম দেওয়া হলো ফার্মিয়ন। ব্যস, সব কণিকা হয় বোসন হবে, নইলে ফার্মিয়ন হবে। সারা দুনিয়ার পদার্থবিদ্যার ছাত্রকে এটি জানতে হয়, আর বোসন কণিকার কথা যতবারই আসে ততবারই নিতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম।
ওপরে আমরা দেখেছি আইনস্টাইন সেই তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে শুধু আলোক কণিকা নয়, বিশেষ বিশেষ বস্তু কণিকাও বোসন হতে পারে। গাণিতিকভাবে তিনি দেখালেন হিলিয়াম-৪-এর মতো পরমাণুকে অত্যন্ত নিম্ন উত্তাপে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে সেগুলো একেবারে নিম্নতম একই শক্তি-অবস্থায় গিয়ে জমা হবে, যাকে পরে বলা হয়েছে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। এটি বলতে গেলে কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থার বাইরে পদার্থের সম্পূর্ণ একটি নতুন অবস্থা। আইনস্টাইনের কাছে এটি নেহাত একটি গাণিতিক বিষয় হিসেবে থাকলেও পরে অনেকে এর ওপর আরও কাজ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বহু দিন পর ১৯৯৫ সালে কোয়ান্টাম সুপার-ফ্লুইড তত্ত্বে অতি শীতল হিলিয়াম-৪কে বসু সংখ্যাতত্ত্বের কারণেই দেখা গেছে চরম ধরনের প্রবহতা লাভ করতে, যা কিনা মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে পাত্রের দেয়াল বেয়ে আপনা আপনি উঠে আসতে পারে। শুধু এই গুণই নয়, বসু সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োগেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে লেজার আলোর সৃষ্টি, সুপার কন্ডাকটিভিটি বা বিদ্যুতের অসীম পরিবাহিতা ইত্যাদি চমকপ্রদ আরও অনেক আবিষ্কার।
ওপরে আমরা দেখলাম কেমন করে গোটা একটি পরমাণু (হিলিয়াম-৪) বোসন হতে পারে, যা কিনা নিজেই একাধিক কণিকার সমন্বয়। তেমনি আরও নানা রকম কণিকা-সমন্বয় বোসন হতে পারে। কিন্তু কণিকাবিদ্যার ক্ষেত্রে বর্তমানের যে সর্বস্বীকৃত তত্ত্ব রয়েছে যা স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে পরিচিত, তাতে পাঁচটি মৌলিক বোসনের অস্তিত্ব রয়েছে। এগুলো অন্য কণিকার সমন্বয় নয়। এদের মধ্যে চারটির দায়িত্ব হলো চার রকমের বলের বাহক হিসেবে কাজ করা। এ রকম এক একটি বোসন এক এক ধরনের ‘অলীক’ কণিকা রূপে ‘বাস্তব’ কিছু কণিকার সঙ্গে বিক্রিয়ার মাধ্যমে এক এক ধরনের বলের সৃষ্টি করে আর ওই বোসন হয় বলটির বাহক। এভাবে বিদ্যুৎ-চৌম্বক বলের বাহক হলো ফোটন, নিউক্লিয়ার দুর্বল বলের বাহক W বোসন ও Z বোসন, নিউক্লিয়ার সবল বলের বাহক গ্লুয়ন নামের বোসন। তা ছাড়া মাধ্যাকর্ষণ বলের বাহক হিসেবে আর একটি বোসন গ্রাভিটনেরও একটি তাত্ত্বিক কল্পনা রয়েছে, যেটি এখনো স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ১৯৬০-এর দশক থেকে অন্তর্ভুক্ত ছিল হিগস বোসন—যা পিটার হিগসের তাত্ত্বিক আবিষ্কার। একে বাস্তবে উদ্ঘাটিত না করা পর্যন্ত কণিকাবিদেরা শান্তি পাচ্ছিলেন না। এর সঙ্গে যে জড়িয়ে রয়েছে বস্তু কণিকাগুলোর ভরের প্রশ্নটি—মহাবিশ্বের সৃষ্টির শুরুতে ভরহীন সব কণিকা যেভাবে হিগসের তত্ত্ব অনুযায়ী ভর লাভ করেছিল, সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাটি। এ কারণেই জেনেভার সার্ন ল্যাবরেটরি থেকে আসা সেই দারুণ সুখবরটি সবাই খুব উপভোগ করছেন। ঘটনাটির গুরুত্বের কারণে পদার্থবিদদের বাইরেও অনেক মানুষ এর আলোচনা করতে গিয়ে হিগসের সঙ্গে সঙ্গে বসুর নামটিও ব্যাপকভাবে উচ্চারণ করছেন। বোসনের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা কিন্তু নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিস্তৃত হচ্ছে। এমনি একটি চাঞ্চল্যকর ক্ষেত্রে সত্যেন বসুর নাম এসেছে ‘বোসনোভা’ হিসেবে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেটকে বিশেষ ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তনের সম্মুখীন করলে তাতে মহাকাশের সুপারনোভা বিস্ফোরণের মতো একটি অতি ক্ষুদ্র বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষণে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই বিস্ফোরণে কনডেনসেটের অর্ধেক পরিমাণ পরমাণু কোথায় জানি হারিয়ে যায়—কোথায়, কীভাবে তা বর্তমান পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব দিয়ে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও এই বিস্ফোরণটি অতি ক্ষুদ্র, তবুও এর সঙ্গে কিন্তু সুপারনোভা বিস্ফোরণের দারুণ সাদৃশ্য রয়েছে। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে বোস-সুপারনোভা, সংক্ষেপে বোসনোভা। সুপারনোভা হলো সুদূর মহাকাশে বৃদ্ধ দশায় উপনীত তারার স্বতঃবিস্ফোরণ, যার মাধ্যমে মহাবিশ্বে তারার বস্তুগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এমনি একটি মহাজাগতিক ঘটনার ক্ষুদ্র সংস্করণের সঙ্গেও জড়িয়ে রইল আমাদের সত্যেন বসুর নাম।
একটি পাদটীকা দিয়ে লেখাটি শেষ করব। ১৯৭৪ সালে তাঁর প্রয়াণের মাত্র কিছুদিন আগে সত্যেন্দ্রনাথ বসু কলকাতা থেকে আমাকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন, আমাদের মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকীর সম্পাদক হিসেবে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা যেসব সৃষ্টিশীল কাজ করছে তার নিয়মিত খবর রাখছেন বলে জানিয়েছিলেন। সে সঙ্গে জানিয়েছিলেন আমাদের পত্রিকাটি নিয়ে বেশ কিছু পরামর্শও। আমাদের একজন হিসেবে আমরা যেমন পদার্থবিদ্যার এতসব চমকপ্রদ বিষয়ে বসু নামের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিয়ে গর্ব করি, তিনিও কিন্তু তাঁর ঢাকার ছেলেমেয়েদের কথা কখনো ভোলেননি।
ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, বিজ্ঞান লেখক
No comments