মধ্যপ্রাচ্য- ধ্বংসের কিনারে সিরিয়া by প্যাট্রিক সিল

একদা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে মজবুত রাষ্ট্র ছিল সিরিয়া। আঞ্চলিক ক্ষমতাকাঠামোর ভরকেন্দ্র সেই সিরিয়া আজ নির্বিচার ধ্বংসের মুখে। সিরিয়ার অখণ্ডতা, জনগণের কল্যাণ এবং আঞ্চলিক শান্তি আজ বিপন্ন। সিরীয় সংকটে বাইরের শক্তিগুলোও গভীরভাবে জড়িত এবং পরিণতিটি তাদেরও জানা নেই।


সিরিয়ায় চলমান গোলমাল আর দেশটির মিত্র ইরানের ওপর চাপাচাপি থেকে বড় দাবানল লেগে যেতে পারে, কেউ যা থেকে রক্ষা পাবে না। এটাই হলো আশু বিপদ।
কীভাবে অবস্থা এই জায়গায় এসে দাঁড়াল? এই সংকট তৈরিতে সব পক্ষেরই দায় আছে। সিরিয়া এর শত্রুদের আতঙ্ক আর আগ্রাসী মানসিকতার শিকার। কিন্তু দেশটির নেতৃত্বের দায়ও মোটেই কম নয়।
২০০০ সালে পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর সংস্কারের মাধ্যমে শাসনের বেড়াজাল আলগা করতে পারতেন বাশার আল-আসাদ। তিনি যে বছর ক্ষমতাসীন হন, সে সময়ের ‘দামেস্ক বসন্ত’ দাবি করেছিল রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ। সময়ের ডাকে সাড়া না দিয়ে তিনি বরং পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ালেন।
সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও চেপে বসল, মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির দুর্নীতি ও সুবিধাভোগ বাড়ল। অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে গেল। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ক্ষমতা এবং পুলিশের কঠোরতার রাশ টানা হলো না, কারাগারগুলোর পরিবেশও যেমন ছিল, তেমনই চলতে থাকল।
গত ১০টা বছর ছিল আসাদ আর তাঁর মিত্রদের সুবর্ণ সময়। তখন তাঁরা দুটি ঘটনার বিপ্লবী সম্ভাবনাকে আমলে নিতে পারতেন। এগুলো হলো: ১. সিরিয়ার জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এবং ২. ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের অভূতপূর্ব মারাত্মক খরা—গত কয়েক শ বছরের ইতিহাসে যা ঘটেনি। প্রথম ঘটনা থেকে বিরাট একদল অর্ধশিক্ষিত তরুণ বাহিনী গঠিত হলো, যারা বেকার। দ্বিতীয় ঘটনায় লাখ লাখ কৃষক গ্রামছাড়া হয়ে বড় বড় শহরের বস্তিতে ভিড় জমাল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রাখালেরা গবাদিপশুর ৮৫ শতাংশই খুইয়ে বসল। ২০১১ সালে হিসাব করে দেখা গেল, ২০ থেকে ৩০ লাখ সিরীয় এই সময়টায় চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। সন্দেহাতীতভাবে এই বিপর্যয়ের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। তা হলেও, সরকারের উদাসীনতা আর অযোগ্যতা বিপর্যয়কে আরও গভীর করল।
বেকার তারুণ্য এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর হতাশাই হলো আসাদবিরোধী বিক্ষোভের প্রধান জ্বালানি। ২০১১ সালে দারা শহরের একটি পুলিশি নৃশংসতার প্রতিবাদে তাই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে অসুবিধা হলো না। কিন্তু সরকার কি এটা মোকাবিলায় কিছু করতে পারত না? ২০০৬-০৭ সালের দিকে আসাদ সরকার বিশ্বকে এই বিপর্যয় সম্পর্কে হুঁশিয়ার করতে পারত। যা কিছু আছে তা নিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ব্যাপক ত্রাণ কর্মসূচি শুরু করতে পারত। বিপন্ন জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে আন্দোলিত করতে পারত সমগ্র জনগণকে। কার্যকর পরিকল্পনা হাজির করতে পারলে নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এবং ধনী উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোও এগিয়ে আসত।
তা না করে, আসাদ সরকার ব্যস্ত ছিল বাইরের হুমকি মোকাবিলায়। ইরান-হিজবুল্লাহ-হামাস-সিরিয়ার প্রতিরোধ বলয় ধ্বংসে বদ্ধপরিকর আমেরিকা-ইসরায়েল অক্ষ। কারণ, এই প্রতিরোধবলয় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ইসরায়েলি দাপটকে চ্যালেঞ্জ করে আসছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার শুরু থেকেই ইসরায়েল ও আমেরিকা বাশার আল-আসাদকে এক বিন্দু শান্তিতে থাকতে দেয়নি। ২০০৬ সালে রফিক হারিরি হত্যা-পরবর্তী লেবানন সংকট; হিজবুল্লাহ ধ্বংসে লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন, ২০০৭ সালে সিরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং ২০০৮-০৯ সালে হামাস ধ্বংসে গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা মোকাবিলার মতো বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সিরীয় সরকার।
২০০৩-০৪ সালেও সিরিয়া অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। পল উলফোভিৎসের নেতৃত্বে ইসরায়েলপন্থী নব্য রক্ষণশীলরা জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে থাবা গেড়ে বসে। ইসরায়েল ও আমেরিকার স্বার্থমতো তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ওলটপালট করে সাজাতে নেমে পড়ে। এদের প্রথম শিকার হয় ইসরায়েলের হুমকি বলে বিবেচিত ইরাকের সাদ্দাম হোসেন। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র সফল হলে সিরিয়াই হতো পরের শিকার। কিন্তু ইরাক যুদ্ধের বিপর্যয় থেকে ইরাক বা আমেরিকা কেউ-ই এখনো উঠে আসতে পারেনি। এই বিপর্যয়ের নকশাকার ছিলেন পল উলফোভিৎস।
সিরিয়া ও তার মিত্র ইরান এখন আবার আক্রমণের নিশানায়। তেহরান ও দামেস্কের ক্ষমতাসীনদের কুপোকাত করার ইচ্ছা খোলাখুলি জানিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল ও আমেরিকা। ইসরায়েলি ধুরন্ধরেরা ভাবছে, এতে তাদের অশেষ উপকার হবে। তারা চায় সিরিয়াকে ভেঙে স্থায়ীভাবে কমজোরি করে দিতে। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে বন্দরনগরী লাতাকিয়াকে ঘিরে একটা ছোট আলাওয়ি রাষ্ট্র বানানোর ইচ্ছা তাদের। ঠিক এভাবেই ইরাককে ভেঙে উত্তরাঞ্চলে কুর্দি আঞ্চলিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে; এর রাজধানী হয়েছে ইরবিল। আগ্রাসী একটি ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিবেশী হওয়া বিপদের ব্যাপার। এই রাষ্ট্র বিশ্বাস করে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তির মাধ্যমে নয় বরং আমেরিকার মদদে অন্তর্ঘাত চালিয়ে ধ্বংসের মাধ্যমেই তারা নিরাপদ থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলই কেবল সিরিয়ার দুশমন নয়। সিরিয়ার মুসলিম ব্রাদারহুডও ৩০ বছর আগে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে নেমেছে। সে সময় তারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে সিরিয়ার বাথবাদী ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফেজ-আল-আসাদ সেই অভিলাষ গুঁড়িয়ে দেন। ব্রাদারহুড পুরোনো হঠকারিতায় আবারও মেতেছে। বিদেশি সালাফিদের সাহায্য নিয়ে তারা সন্ত্রাসে নেমেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, তুরস্ক, জর্ডান ও অন্যান্য দেশের আল-কায়েদা সদস্যরা। সিরিয়ার প্রবাসী বিরোধীদের মধ্যে যারা আধুনিক, যাদের বেশিরভাগই মূলত শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, এরা ব্যবহূত হচ্ছে এসব চরমপন্থীকে আড়াল করার রাজনৈতিক ঢাকনা হিসেবে।
কিছু উপসাগরীয় রাষ্ট্রও সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা থেকে ঘটনাবলিকে প্রভাবিত করছে। তারা ইরানের তথাকথিত উচ্চভিলাষ নিয়ে ভীত। যে ইরাক একসময় সুন্নি নেতৃত্বাধীন ছিল, সেখানে এখন শিয়ারা ক্ষমতাসীন। ইরানকে সামলানোর এখন কেউ নেই বলে ভাবছে তারা। শিয়াদের এ রকম উত্থান দেখে সুন্নি ক্ষমতা তাই দিন গুনছে। এই জুজুর ভয়ে তারা সিরীয় বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও তহবিল জোগাচ্ছে। তাদের আশা, সিরিয়ার পতন হলে ইরান আরব দুনিয়ায় একঘরে হয়ে পড়বে। কিন্তু এই নীতি কেবল সিরিয়ার যন্ত্রণাই বাড়াবে, এর অনেক সেরা নাগরিকের জীবন যাবে, ঘটবে বিপুল সম্পদের ধ্বংস।
এই অঞ্চলের প্রভাবশালী বহিরাগত শক্তি আমেরিকা অতীতে অজস্র বিপর্যয়কর ভুল করেছে। গত কয়েক দশকে তারা তাদের জিগরি দোস্ত ইসরায়েলকে শান্তির পথে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তি এলে গোটা আরব দুনিয়াই ইসরায়েলকে মেনে নিত। অথচ তা হয়নি। অন্যদিকে আমেরিকা ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রলয়ঙ্কর দুটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। তারা ইরানের সঙ্গে ‘দরকষাকষি’তেও ব্যর্থ। একটা সমঝোতা হলে উপসাগরীয় অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ হানা দিত না এবং মধ্যপ্রাচ্য উথাল-পাতালও থাকত না। এই আমেরিকা এখন কফি আনানের সিরীয় শান্তি পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে রাশিয়ার সঙ্গে বিবাদে নেমেছে। বিশ্ব আবার প্রবেশ করছে শীতল যুদ্ধের বাস্তবতায়।
সিরীয় সংকটের কোনো সামরিক সমাধান থাকতে পারে না। বিপর্যয় নেমে এলে ক্ষতিপূরণ করতে করতে কয়েক প্রজন্মের জীবন যাবে। সাম্প্রতিক দুঃস্বপ্ন শেষ হওয়ার একমাত্র উপায় হলো উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘটানো। তার সঙ্গে সঙ্গে দরকার হলো সমঝোতা সৃষ্টির মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা। শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের তদারকি করাই হবে এই সরকারের কাজ। একমাত্র এভাবেই সিরিয়া নির্বিচার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।

গ্লোবাল এজেন্সে থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
প্যাট্রিক সিল: ব্রিটিশ মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.