জনপ্রশাসন-রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের ধারা by মোহীত উল আলম

আইনানুগ অসহযোগিতা বা সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সের প্রবক্তা ঊনবিংশ শতাব্দীর মার্কিন লেখক ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো দুই বছর বোস্টন নগরের পাশে ওয়াল্ডেন পন্ডের পাড়ে কোনো রকম নাগরিক সাহায্য ছাড়া বাস করে প্রমাণ করেছিলেন যে, সহজ উপায়ে কম খরচে প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাপন সম্ভব।

তাঁরই রাজনৈতিক ভাবধারার অনুসারী এবং ‘সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’-এর মূর্ত ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন যে তিনি সাধনা করেন, কত জিনিস ছাড়া বাঁচা যায়—‘হাউ মেনি থিংস আই ক্যান লিভ উইদাউট’।
আমার বাবা লেখক ছিলেন। টুকরাটাকরা কাগজ জড়ো করে আলপিন দিয়ে গেঁথে অব্যবহূত পিঠে সারা জীবন লিখে গেছেন। আমার বৃদ্ধা নানিকে দেখতাম, চাল বাছার সময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া চালের দানা একটি একটি করে চালুনিতে আবার তুলে রাখতেন। আমি কখনো লাইট-ফ্যান-কল বন্ধ না করে রুম ছাড়ি না। পারিবারিক ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে অপচয়ের বিপক্ষে এ অনুশাসন সহজেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের বিরুদ্ধে মনে তাগিদ তৈরি করে।
আজ ২৭ মে প্রথম আলোয় ‘সরকারি চাকরি ছাড়ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা’ এবং ‘১১ বছরে প্রশাসনের ৯৫ কর্মকর্তা স্বেচ্ছা-অবসরে’ শীর্ষক খবর দুটি পড়ে আমার মনের চাপা কিন্তু জাগ্রত বেদনা, অপচয়ের বিপক্ষে তাগিদ সম্পর্কে লেখার ইচ্ছাটা জেগে উঠল।
গত সপ্তাহে অফিসে দেখা করতে এল আমার এক পুরোনো বন্ধু। বর্তমানে সরকারের অতিরিক্ত সচিব। বললাম, ‘অফিস ফেলে এলে যে?’ বলল, ‘অফিস গত আড়াই বছর ধরে নেই।’ বন্ধু ওএসডি হয়ে বসে আছে। তখন আরেকজন বন্ধুর কথা মনে পড়ল, যে একসময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিল এবং এখন অতিরিক্ত সচিব, সেও এ সরকার আসার পর থেকে ওএসডি হয়ে বসে আছে। বন্ধুটি জানাল, বর্তমান সরকারের সময় সব স্তরের ক্যাডার মিলে শ-তিনেক কর্মকর্তা ওএসডি অর্থাৎ কর্মহীন হয়ে বসে আছেন—৬৪ জন সচিবের মধ্যে দু-তিনজন, অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে ৩০-এর ওপর, যুগ্ম সচিব পর্যায়ে আছেন প্রায় ২০০ জন, আর নিচেও আছেন। বন্ধুটি জানাল, কে না কোথায় কাকে লাগিয়ে দিয়েছে যে অমুক অফিসার এ সরকারি দলকে সমর্থন করেন না, কাজেই তাঁকে বানাও ওএসডি। বন্ধু আরও জানাল যে ওএসডি মানে বেতনসহ সব আর্থিক এবং আবাসিক সুবিধা বজায় থাকবে, শুধু অফিসে গিয়ে কাজ করা চলবে না। আগে ওএসডির প্রয়োজন পড়ত যখন কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা হতো; কিন্তু তাঁর পদ খালি না থাকলে ওই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তিন দিন থেকে এক সপ্তাহ তাঁকে ওএসডি করে রাখা হতো। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের সময় শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি করে সক্ষম, কর্মক্ষম ও মেধাবী কর্মকর্তাদের বছরের পর বছর বসিয়ে রাখা জাতীয় সীমিত সম্পদের বিবেচনায় অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে ধারণা হয়।
যেমন প্রথম আলোর সাংবাদিককে তরুণ চিকিৎসক, যাঁরা চাকরি ছেড়েছেন, তাঁদের ‘প্রত্যেকেই বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে মেধার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন।’
একজন চিকিৎসক তৈরি করতে সরকারের খরচ পড়ে সাত থেকে আট লাখ টাকা এবং ওই চিকিৎসকের কাজ থেকে জাতি সেবা না পেলে বুঝতে হবে, ওই টাকার অপচয় হলো। আবার, একজন ওএসডি সচিবকে পুষতে সরকারের শুধু বেতনাদি বাবদ খরচ পড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা, তা ছাড়া গৃহ, গাড়ি, টেলিফোনের খরচ তো রইলই। সব মিলিয়ে দেখা যায়, ওএসডি বাবদ সব স্তরের কর্মকর্তার পেছনে সরকারের মাসিক গড়পড়তা খরচ হয় দেড় কোটি টাকা, যার বিনিময়ে সরকার কোনো লাভ পাচ্ছে না। যেখানে আধুনিক বিশ্বে চাউর করা হয়, নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি লাঞ্চ, সেখানে এ অপচয়ের বিলাসিতা নিশ্চয় সবার বিবেককে কামড়াবে। আমার সরাসরি দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয়করণের ফলে মেধা ও যোগ্যতার বিসর্জন জাতীয় সম্পদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে। এ ক্ষতি যে শুধু আর্থিক হিসেবে বড়, তা নয়; মানবসম্পদ-প্রয়োজনের ক্ষেত্রে এ ক্ষতি আরও মারাত্মক। সরকারি দায়িত্বশীল মহলের কাছে আমার যাচনা থাকবে, ওএসডি-প্রথাসহ দলীয়করণের ক্ষেত্রে যেন নিতান্তই সংগত পেশাগত কারণ বিবেচনায় আসে, অন্য কিছু নয়।
আর দলীয়করণের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পদের, আর্থিক ও মানবসম্পদগত উভয় ধরনের অপচয় কীভাবে সম্পর্কিত, তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ আমার পেশাগত ক্ষেত্র থেকে দিতে চাই। কোনো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য সিনেট নির্বাচনে জেতার জন্য একজন সিনেটরের স্ত্রীকে নির্বাচন কমিটির একজন সদস্যের নোট অব ডিসেন্টকে বা দ্বিমতকে উপেক্ষা করে একটি বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি নির্বাচিত হয়ে উপাচার্যও হয়েছিলেন এবং কালক্রমে তা হারিয়েও ফেলেন। কিন্তু যে শিক্ষককে রেখে গেলেন, তাঁর অযোগ্যতার কারণে যে বিভাগের শিক্ষার্থীরা ৩৫ বছর (একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের গড়পড়তা চাকরির কাল) ধরে ঠকে গেল এবং এর ফলে যে আকাঙ্ক্ষিত মানবসম্পদ অর্জিত হলো না এবং এর ফলে যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হলো, এর হিসাব বাংলাদেশকে অবশ্যই করতে হবে। সরকারকেই তার দায়িত্ব নিতে হবে, কেননা দিনবদলের বীজ লুকিয়ে আছে এ অব্যবস্থাকে সংশোধন করার মাধ্যমে। দলীয়করণের অভিলাষে নিয়োগ বা অনিয়োগ বস্তুত কয়েকটি বড় কারণের মধ্যে একটি, যার কারণে বাংলাদেশ, ধরুন সমভিত্তিক আরেকটি রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার চেয়ে পিছিয়ে আছে। যে ক্ষতি দেখা যায় বা পরিমাপ করা যায়, সে ক্ষতি নিশ্চয় বড়। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক হলো না-দেখা ক্ষতি। সর্দি হলেই মানুষ ফোঁসফাঁস করে, হাঁচিতে হাঁচিতে পরিবেশ অস্থির করে তোলে। কিন্তু মরণব্যাধি কর্কট রোগ ছড়ায় নীরবে-নিভৃতে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি পদ্ধতি চালু রাখার সঙ্গে মরণব্যাধি ছড়ানোর রূপের সম্পর্ক আছে।
দলীয় কারণে প্রশাসনে ওএসডির ব্যবস্থা চালু রাখা এ কারণেও অযৌক্তিক যে সরকারের জন্য তো দলীয়করণের সুবিধা মন্ত্রী ও নেতা নির্বাচনের মধ্যেই আছে। কিন্তু প্রশাসন সংস্থা তো একটি অভিজ্ঞতা ও দক্ষতানির্ভর ব্যবস্থা। সেখানে মতবাদ দিয়ে তো কাজ চালানো যাবে না। তা হলে ওপরে যে নিয়োগের কথা উদাহরণস্বরূপ বললাম, সে রকমের অবস্থাই হবে। স্বাচিপ বা ড্যাব-নিয়ন্ত্রিত পরামর্শে নিয়োগ দিলে চিকিৎসাক্ষেত্রে যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি দলীয়করণের মনোবাঞ্ছায় ওএসডি প্রবর্তন করলে প্রশাসনের তথা দেশের ক্ষতি হয়।
প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জালটা তো ওপর থেকে নিচে, নিচ থেকে ওপরে গমনাগমনের প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। এখানে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বিধান করার প্রক্রিয়া সব সময় উপস্থিত। একজন কর্মকর্তা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, যার ফলে সরকার বিপদগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই যেকোনো সরকারকে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার ব্যাপারে অতিসংবেদনশীল হয়ে তাঁকে কর্মহীন করে রাখার মধ্যে একটি গেঁয়ো রাজনৈতিক মান্ধাতা-যুগের কৌশল আছে, কিন্তু আধুনিক যুগের সে দৃষ্টিভঙ্গি নেই, যেখানে একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে শাণিত ছুরির মতো দলমতনির্বিশেষে ব্যবহারযোগ্য মনে করা হয়। একজন অভিজ্ঞ প্রশাসনিক কর্মকর্তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, রুচি সবই একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য সম্পদ। ওএসডির নামে দেশীয় সম্পদ অপচয়ের বিনিময়ে এটিকে উপেক্ষা করা কতটা যুক্তিযুক্ত?
আমেরিকার কথা বলি। ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের হোতা সিআইএর বর্তমান প্রধান লিওন প্যানেট্টা শুধু যে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময় চাকরি করতেন, তা নয়; এর আগে প্রতিপক্ষ দল রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসনেও ছিলেন তিনি। আর বারাক ওবামা তাঁকে অন্য জায়গা থেকে তুলে এনে বর্তমান পদে আসীন করেন। অর্থাৎ প্যানেট্টার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে ওবামা সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। প্যানেট্টা ঠিকই ওবামার জন্য কাজটা করে দিলেন।
তা ছাড়া প্রশাসনিক চাকরির চরিত্র সম্পর্কে নতুন করে ভাবারও সময় এসেছে। তরুণ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিরাট দেশসেবার স্বপ্ন নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। পরিবেশের কালো প্রভাবে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে বা তিনি নিজেই সবচেয়ে বড় ঘুষখোরে পরিণত হয়েছেন—এ ধরনের উদাহরণ সাধারণের কাছে প্রশাসনকে বরং পরিচিত করেছে। কিন্তু উল্টো দিকে এর আরেকটি বাস্তবতা আছে, যেটিও কম সত্য নয়। যেকোনো পেশার চরিত্র হচ্ছে সে পেশায় ঢুকে মানুষ প্রথমে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে থাকে; কিন্তু ক্রমশ অভিজ্ঞতা বাড়তে বাড়তে, বড় দায়িত্ব পেতে পেতে সে মানুষ, দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবতে থাকে। পেশা মানুষকে ক্রমশ স্বার্থপরতা থেকে দেশসেবামূলক পরার্থপরতার দিকে নিয়ে যায়। চারপাশে অনেক পেশাজীবী মানুষকে দেখেছি, যারা চাকরির প্রথম জীবনে শুধু নিজেদের নিয়ে চিন্তা করতেন, পরে কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ দেশ ও জাতি নিয়েও ভাবতে শুরু করেছেন।
মানুষের দক্ষতা, যোগ্যতা, বিবেচনাবোধ, সহনশীলতা, সমাজসচেতনতা, দেশসেবাবোধ এগুলো এক দিনে হয় না। সরকারি প্রশাসনের ভেতরে এমন কর্মকর্তা নিশ্চয় অনেক আছেন, যাঁরা ওপরের সবগুলো গুণের অধিকারী। এঁরা দায়িত্ব পালনের সময় তাঁদের বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করবেন, সিদ্ধান্ত দেবেন দেশের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে। ওএসডির নামে এতজন কর্মকর্তার চাকরিকালীন অবসর যৌক্তিক চিন্তানির্ভর জীবন-দর্শনের ভিত্তিতে গ্রহণ করা যায় না।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি ও মানববিদ্যা, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.