রাজনীতি-প্রধান দুটি দলের শ্রেণীচরিত্র by এরশাদ মজুমদার

আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। প্রথমে দলটির নাম রাখা হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানী বলতেন, মুসলিম লীগ সরকারের মুসলিম লীগ, আর আওয়ামী মুসলিম লীগ হলো জনগণের দল। আওয়ামী মানে জনগণ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ২২ মাসের মাথায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কেন এই নতুন দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন

মুসলিম লীগের কিছু নেতা। ওই সময়ে মওলানা সাহেবকে যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা ও কর্মী। শুরুতেই পাকিস্তান সরকার ভাষার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে। প্রদেশের মুসলিম লীগ নেতারা ছাত্র ও সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট বোঝার চেষ্টা করেননি। মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগ যাত্রা শুরু করেছিল প্রদেশের মধ্যবিত্তদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পতন হয়। আইয়ুবের আমলে মুসলিম লীগ বিশেষ সুবিধাভোগী দল হিসেবে আবার ক্ষমতায় আসে। ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করা হয়। ছোটখাটো অনেক সেক্যুলার দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়। এমনকি নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির বহু সদস্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে যায়। একসময় আওয়ামী লীগ কেন্দ্র ও প্রদেশে সরকার গঠন করে। প্রদেশের চিফ মিনিস্টার ছিলেন আতাউর রহমান খান ও কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। এ সময় ফরেন পলিসি বা বিদেশবিষয়ক নীতি নিয়ে মওলানা সাহেবের সঙ্গে সরকারের দ্বিমত তৈরি হয়। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আমেরিকার সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার পক্ষে। কিন্তু মওলানা ভাসানী ছিলেন আমেরিকাবিরোধী নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে এবং একসময় তিনি নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। তবে এ কথা ঠিক, ছয় দফা ঘোষণা করার পর থেকেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সেভাবেই ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বাঙালিদের একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এর একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল ছিল। স্বাধীনতার পর হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রী দল হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে। পরে ছাত্রলীগের কিছু নেতা মিলে একটি বামঘেঁষা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন—জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ।
লেখাটি আমি শুরু করেছি প্রথম ১৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত স্নেহভাজন বন্ধু সোহরাব হাসানের লেখা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিল-অমিল পড়ে এবং উৎসাহিত হয়ে। এই ফাঁকে একই বিষয়ে আমার মুরব্বি এবিএম মূসা ও সাহাবুদ্দিন সাহেবের লেখাও আমি পড়ে নিয়েছি। সুযোগ পেয়ে আমি নিজের সম্পর্কেও দুটো কথা বলে নিতে চাই। পাকিস্তান আমলে ছাত্র ইউনিয়ন করার কারণে আমার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর দল ন্যাপের যোগাযোগ ছিল। আমরা যখন ছাত্র ইউনিয়ন করি, তখন তা অখণ্ড ছিল। ন্যাপও অখণ্ড ছিল। আমি তখন সংবাদ-এ চাকরি করি। অবজারভার-এর স্থায়ী চাকরি ছেড়ে অধিকতর রাজনৈতিক হওয়ার জন্য সংবাদ-এ যোগ দিয়েছিলাম। সম্পাদক ছিলেন জহুর হুসেন চৌধুরী। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে বাম রাজনীতি ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ চীনের সঙ্গে, আরেক ভাগ রাশিয়ার সঙ্গে। মওলানা সাহেব ছিলেন চীনের সঙ্গে। সংবাদ চলে যায় রাশিয়ার সঙ্গে। সংবাদ-এ তিন বছরের বেশি সময় থাকার পর আমি পূর্ণাঙ্গ রাজনীতি করার জন্য ফেনীতে চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমি কৃষক আন্দোলন করার জন্য ফসল নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করি। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছর কৃষক আন্দোলন করে আমি ঢাকায় ফিরে আসি এবং দৈনিক পূর্বদেশ-এ সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিই। আমার মনে হয়েছে, রাজনীতিতে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অপরিহার্য, যা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। ভাবলাম, কৃষকদের ঠকানো উচিত হবে না।
তিনটি লেখাতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সম্পর্কে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মূল নিবন্ধের লেখক সোহরাব হাসান আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এর গুণাবলি ও সীমাবদ্ধতা বর্ণনা করেছেন। সাহাবুদ্দিন সাহেবও খোলামেলাভাবে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমি বিষয়টি ওভাবে দেখছি না। আওয়ামী লীগ কী পরিস্থিতি ও পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা দেখতে হবে। মূসা ভাই আরও অনেক বেশি ভালো বলতে পারবেন। তখন তিনি বাম ধারার প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সুতরাং এখানে প্রেক্ষাপটটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন প্রগতিশীল মুসলিম লীগ কর্মীদের সামনে অন্য আর কোনো পথ খোলা ছিল না। মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলিম লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। একটি নতুন রাজনৈতিক দল সময়ের দাবি ছিল। মুসলিম ছাত্রলীগের বাইরে মধ্যপন্থী চিন্তাধারার একটি ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজন ছিল। গঠিত হলো ছাত্র ইউনিয়ন। শুরু থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন ছিল বাম চিন্তাধারার সঙ্গে জড়িত। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। কমিউনিস্টরা গোপনে কাজ করতেন।
১৯৭৫-এর আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খন্দকার মোশতাক ৮৩ দিনের মতো ক্ষমতায় ছিলেন। ৬ নভেম্বর তিনি বিচারপতি সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেন। এর কিছুদিন পর জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বলা যেতে পারে, এ সময় থেকে জেনারেল জিয়ার যুগ শুরু হয়। জিয়ার নাম এ দেশবাসী প্রথম শুনেছে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। আর মুসলিম লীগ কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নাম জানে ১৯৪৬ সালের আগে থেকে। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি একজন নামজাদা যুব নেতা। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধু দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সুতরাং জেনারেল জিয়া আর বঙ্গবন্ধু কখনোই তুল্য ব্যক্তিত্ব নন। দুজন আলাদা পথের যাত্রী। কিন্তু ভাগ্য জিয়াকে রাজনীতিতে টেনে নিয়ে এসেছে। জিয়া যখন দল গঠনের উদ্যোগ নিলেন, তখন ন্যাপকে সঙ্গে নিয়ে যাদু মিয়া জেনারেল জিয়ার সঙ্গে হাত মেলান। এখনো বিএনপিতে সাবেক ন্যাপের নেতাদের প্রভাব বেশি। ন্যাপ ছাড়া বেশ কিছু ছোট দল ও নেতা বিএনপিতে আসে। এর মধ্যে মুসলিম লীগসহ কয়েকটি ইসলামি দলও ছিল।
দল দুটির ফারাক বা মিল-অমিল সোহরাব হাসান যেভাবে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে আমার তেমন দ্বিমত নেই। দুটোই বুর্জোয়া রাজনীতির তাঁবেদার। দুই দলই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির পূজারি। স্বাবলম্বী বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে দুই দলেরই ব্যর্থতা রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের সাফল্য হলো, দলটি নিজের ইমেজ তৈরি করেছে সেক্যুলার প্রগতিশীল হিসেবে। বিএনপির তেমন ইমেজ নেই। দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বিএনপিকে দক্ষিণপন্থী দল মনে করে। বিএনপি অবশ্য নিজেকে ইসলামপন্থী জাতীয়তাবাদী দল মনে করে। আওয়ামী লীগ জয় বাংলা বলে। বিএনপি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে। যদিও বিশ্ব ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইসিসির সভাপতি ও ভারতের মন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলেছেন। আসলে এসব দেশের উন্নতির জন্য তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এসব লোক দেখানো ও লোক ঠকানো স্লোগান। সাধারণ মানুষ এতে খুশি হয় এবং ভোট দেয়। ভোটাররা মার্কা দেখেই সিল মারেন। মার্কা নিয়ে রাস্তায় মিছিল করেন। কোন দলের জন্ম কোথায়, তা নিয়ে কেউ ভাবে না। কোন দলের প্রতিষ্ঠাতা কে, তা নিয়েও তেমন ভাবে না। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরও তাঁর দল শক্তিশালী। বারবার ক্ষমতায় আসছে। বিএনপিও জিয়ার আমল থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। কোন দলে মাস্তান কত, কোন দল কেমন স্বজনপ্রীতি করে, কোন দল দলীয়করণ করে বা কোন আমলে কত খুন হচ্ছে, তাকে আমি কোনো মাপকাঠি করতে চাই না। এ ব্যাপারে দুই দলই এক। কেউ ২০ আর কেউ ১৮। আমরা এ দুই দলের ওপর নানা ধরনের গুণ ও দোষ আরোপ করি। আওয়ামী লীগ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের দল মনে করে। এটা তো ঠিক আছে। তখন তো বিএনপির জন্মই হয়নি। আমি মনে করি, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বড় দল হিসেবে বিকশিত হয়েছে। জনগণের জন্য সুবিধা হয়েছে। একবার চিন্তা করুন, বিএনপি না থাকলে দেশের রাজনীতির কী হতো? বিএনপিকে আমরা বলতে পারি দক্ষিণ-মধ্যপন্থী দল। মুসলিম লীগের আধুনিক সংস্করণ। আওয়ামী লীগ তো মুসলিম লীগ ছিলই। যদিও এখন তারা নিজেদের সেক্যুলার বাম-মধ্যপন্থী দল মনে করে। বুদ্ধিজীবী আর সুশীল সমাজ দল দুটিকে কীভাবে দেখছে, তা নিয়ে ভোটাররা মোটেও মাথা ঘামান না।
এরশাদ মজুমদার: সাংবাদিক।
ershadmz40@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.