উচ্চশিক্ষা-ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, মন্দ বিশ্ববিদ্যালয় by আবদুল মান্নান
আমার সাবেক এক সহকর্মী সেদিন আরেক সহকর্মীকে আলাপ প্রসঙ্গে জানালেন, আমি যে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করি তার একমাত্র কারণ, আমি কোনো কিছু পাওয়ার আশায় বর্তমান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। একেবারে নাদান উক্তি, তা-ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে! একজন উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কখনো তাঁর
একজন সাবেক সহকর্মী সম্পর্কে এমন অনুদার মন্তব্য করতে পারেন, তা জানা ছিল না। আমার দীর্ঘ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাধিক্যের কারণে অনেক ‘শিক্ষক’ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে ঢুকে পড়েছেন, যাঁদের ওই পর্যায়ে শিক্ষকতা করার তেমন কোনো যোগ্যতাই নেই। গত তিন দশকে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—উভয়ের সংখ্যা বেড়েছে ঠিক, তবে শিক্ষার মান কতটুকু বেড়েছে বা যা ছিল তা কতটুকু বজায় থেকেছে, এ নিয়ে এখন ভাবার সময় হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এখনো কম, সেহেতু এ মন্তব্য অনেকটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ মন্তব্যের আওতামুক্ত, তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁদের এই পেশায় আসা উচিত হয়নি।
প্রতিবছর যখন এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়, তখন আমার কাছে অনেক অভিভাবক জানতে চান, তাঁদের সন্তানকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন বা কোন বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো হবে। অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রধান ভরসা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেহেতু এখানে স্বল্পতম খরচে ভর্তি ও পাঁচ বা সাত বছর পর একটি ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া যায়। তবে বর্তমানে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে গরিব মেধাবী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তায় পড়ালেখা করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি নির্দেশনাও আছে। যেখানে বলা হয়েছে, মোট ছাত্রসংখ্যার অন্তত সাত শতাংশকে লেখাপড়ার জন্য উদার অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে হবে। ঢাকা শহরেই একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা এই নির্দেশনা শুধু শতভাগ পালনই করে না, বরং তার চেয়েও বেশি করে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় বছরে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রায় দুই কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ‘বিশ্বের বিদ্যার আলয়’। এই আলয়ের বাতায়ন দিয়ে তামাম বিশ্ব বা জ্ঞানকে দেখা যাবে। এটি হবে এমন একটি আদর্শের আলয়, যেখানে জ্ঞান সৃষ্টি, ধারণ ও সেখান থেকে তা বিতরণ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে ইদানীং তা কিন্তু তেমন একটা হচ্ছে না। অনুজপ্রতিম সহকর্মী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বছর কয়েক আগে অনেকটা আক্ষেপ করে প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একদিন হয়তো আদমজী পাটকলের মতো বন্ধ করে দিতে হবে। এর মধ্যে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো গর্ববোধ করি এটা বলতে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তেমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যদি সত্যি সত্যি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কিছু হতে পারে না। ড. জাফর ইকবাল আসলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চরম হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা দেখে এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে হরদম একশ্রেণীর গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বিজ্ঞ আলোচক-বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন ফোরাম মাতিয়ে রাখেন। কদাচিৎ তাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামান।
বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এশিয়ার পাঁচ শ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় কখনো স্থান পায় না। কেন পায় না? আমি যখন ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমার বিভাগেই অর্ধডজন মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা তখন শতাধিক হবে। এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী তেমন একটা আসে না। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে বিশ্বমানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অন্যান্য দেশের অবস্থাও তাই। শুধু পিছিয়ে রইলাম আমরা। এর দায়-দায়িত্ব সরকার, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সমাজ, রাজনৈতিক দল—সবাইকে সমষ্টিগতভাবে বহন করতে হবে। বাংলাদেশে আইন বা রীতি-নীতি না মানার সংস্কৃতি চালু রয়েছে বহুদিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তা থেকে মুক্ত নয়। এটি সরকারি-বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। একজন শিক্ষক শুধু অভিভাবকই নন, তার চেয়েও বেশি। ভালো শিক্ষক হচ্ছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। সুতরাং যিনি শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, তাঁকে এই সত্যটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আদর্শ শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষক নিয়োগ অবশ্যই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। ১০-১৫ বছর আগেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে তেমন একটা বড় ধরনের অনিয়মের কথা শোনাযেত না। পচনটা শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ সে সময় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তো মহামারি আকার ধারণ করেছিল। যাঁরা এই চরম অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা হয়তো একবারও চিন্তা করেননি, যেসব অযোগ্য শিক্ষক এ পদ্ধতিতে নিয়োগ পাচ্ছেন, একদিন তাঁদের মধ্য থেকে কেউ হবেন বিভাগীয় প্রধান বা ডিন অথবা কোনো একসময় হয়ে যেতে পারেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আবার অনেক সময় স্রেফ কোনো একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাসী বলে কেউ হয়তো শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, আবার কেউ ক্ষমতাধর ব্যক্তির নিকটাত্মীয় বলে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, একবার চাকরি হলে সেই চাকরি আর কখনো যায় না, যদি না সেই শিক্ষক বা কর্মচারী কোনো নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত হন। তবে এমন শিক্ষকও পাওয়া যাবে, যিনি কখনো কোনো ক্লাস ফাঁকি দেননি, ক্লাসে সব সময় প্রস্তুতি নিয়ে আসেন, শিক্ষার্থীদের সব একাডেমিক বিষয়ে উৎসাহিত করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁদের অবদানকে কদাচিৎ মূল্যায়ন করা হয়।
যতই নিয়মিত বিরতি দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ইটপাটকেল মারা হোক, একটি কথা সবাইকে মানতেই হবে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। এখানে প্রথমে যোগ্যতা অনুসারে প্রার্থীদের ছোট তালিকা করা হয়। এরপর তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকদের সামনে একটি ছোট সেমিনার দিতে হয়। তারপর মৌখিক পরীক্ষা হয় এবং তাঁকে যদি যোগ্য মনে করা হয়, তাহলে তাঁর প্রথম চুক্তি হয় এক বছরের জন্য। এই এক বছর (সাধারণত তিনটি সেমিস্টার) ছাত্র ও বিভাগীয় প্রধান বা কোনো কোনো সময় ডিন তাঁকে কেমন মূল্যায়ন করেন, তা দেখা হয় এবং সবকিছু যদি সন্তোষজনক হয় তাহলে তাঁর চুক্তি নবায়ন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস মিস করা বা দেরিতে আসা অনেকটা অকল্পনীয়।
মোদ্দা কথা, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ভালো ছাত্র ভর্তি, যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি এবং তা নিয়মিত সংস্কার করা, শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ জোগান দেওয়া—এর মধ্যে অবশ্যই ভালো গ্রন্থাগার, ল্যাব, বিনোদনের ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। কারও কারও একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মানে তার অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের জমি থাকতে হবে। যাঁরা এমন ভাবনা পোষণ করেন, তাঁদের জানা উচিত, বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য জমির পরিমাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতি ঘনফুট বা মিটার স্পেস। একটি বাড়ির এখন মাপ হয় কত বর্গফুট, কত একর জমির ওপর নয়। এক হাজার ২০০ স্কয়ার ফুটের বাড়িতে যেমন কুড়িজন মানুষের বাস করা সমীচীন নয়, একইভাবে পাঁচ হাজার ছাত্রের জন্য কত বর্গফুট জমি প্রয়োজন, তা পরিমাপ করা কঠিন নয়। বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ শ থেকে হাজার একরের ওপর জমি আছে। তার পরও কেন তারা তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না? আমি অনেক তরুণ প্রতিভাবান শিক্ষককে দেখেছি, তাদের তারুণ্যকে নষ্ট করছে প্রাইভেট পড়িয়ে অথবা বিভাগীয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে। অনেককে দেখেছি, পরীক্ষার খাতা ছাড়া অন্য কিছু পড়াতে দারুণ অনীহা। এটি একটি জাতীয় ক্ষতি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্ডারি বা উপাচার্য নিয়োগ। একাডেমিক নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকলে স্রেফ দলীয় আনুগত্যের কারণে কাউকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। বর্তমান সরকারের আমলে সব সময় এ বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা মনে হয় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তো বেশ কয়েক মাস কোনো পূর্ণকালীন উপাচার্য ছাড়াই চলছে।
সুতরাং ওই বিশ্ববিদ্যালয়কেই আমি ভালো হিসেবে আখ্যায়িত করব, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ উদ্যোগে জ্ঞানচর্চার একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা উদার, সংবেদনশীল, শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবে পরিচিত—সেটাই সত্যিকার অর্থে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার উপকরণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়, যা আগে উল্লেখ করেছি, তা তো থাকতেই হবে। বাংলাদেশে এমন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য চাই সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (বিমক) সহায়তা ও দিকনির্দেশনা। বিমকের নতুন চেয়ারম্যান সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রস্তাব করেছেন, বিমককে যেন উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করা হয়। অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে এবং তাতে উচ্চশিক্ষা উপকৃত হয়েছে। বাংলাদেশে তা হতে বাধা কোথায়? ১৯৭৩ সালে জন্মলগ্নে বিমকের যে ভূমিকা ছিল, এখন তো তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু যোগ হয়েছে। সুতরাং এর সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিবছর যখন এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়, তখন আমার কাছে অনেক অভিভাবক জানতে চান, তাঁদের সন্তানকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন বা কোন বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো হবে। অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রধান ভরসা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেহেতু এখানে স্বল্পতম খরচে ভর্তি ও পাঁচ বা সাত বছর পর একটি ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া যায়। তবে বর্তমানে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে গরিব মেধাবী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তায় পড়ালেখা করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি নির্দেশনাও আছে। যেখানে বলা হয়েছে, মোট ছাত্রসংখ্যার অন্তত সাত শতাংশকে লেখাপড়ার জন্য উদার অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে হবে। ঢাকা শহরেই একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা এই নির্দেশনা শুধু শতভাগ পালনই করে না, বরং তার চেয়েও বেশি করে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় বছরে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের প্রায় দুই কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ‘বিশ্বের বিদ্যার আলয়’। এই আলয়ের বাতায়ন দিয়ে তামাম বিশ্ব বা জ্ঞানকে দেখা যাবে। এটি হবে এমন একটি আদর্শের আলয়, যেখানে জ্ঞান সৃষ্টি, ধারণ ও সেখান থেকে তা বিতরণ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে ইদানীং তা কিন্তু তেমন একটা হচ্ছে না। অনুজপ্রতিম সহকর্মী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বছর কয়েক আগে অনেকটা আক্ষেপ করে প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একদিন হয়তো আদমজী পাটকলের মতো বন্ধ করে দিতে হবে। এর মধ্যে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো গর্ববোধ করি এটা বলতে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তেমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যদি সত্যি সত্যি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কিছু হতে পারে না। ড. জাফর ইকবাল আসলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চরম হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা দেখে এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে হরদম একশ্রেণীর গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বিজ্ঞ আলোচক-বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন ফোরাম মাতিয়ে রাখেন। কদাচিৎ তাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামান।
বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এশিয়ার পাঁচ শ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় কখনো স্থান পায় না। কেন পায় না? আমি যখন ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমার বিভাগেই অর্ধডজন মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা তখন শতাধিক হবে। এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী তেমন একটা আসে না। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে বিশ্বমানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অন্যান্য দেশের অবস্থাও তাই। শুধু পিছিয়ে রইলাম আমরা। এর দায়-দায়িত্ব সরকার, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সমাজ, রাজনৈতিক দল—সবাইকে সমষ্টিগতভাবে বহন করতে হবে। বাংলাদেশে আইন বা রীতি-নীতি না মানার সংস্কৃতি চালু রয়েছে বহুদিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তা থেকে মুক্ত নয়। এটি সরকারি-বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। একজন শিক্ষক শুধু অভিভাবকই নন, তার চেয়েও বেশি। ভালো শিক্ষক হচ্ছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। সুতরাং যিনি শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, তাঁকে এই সত্যটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আদর্শ শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষক নিয়োগ অবশ্যই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। ১০-১৫ বছর আগেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে তেমন একটা বড় ধরনের অনিয়মের কথা শোনাযেত না। পচনটা শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ সে সময় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তো মহামারি আকার ধারণ করেছিল। যাঁরা এই চরম অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা হয়তো একবারও চিন্তা করেননি, যেসব অযোগ্য শিক্ষক এ পদ্ধতিতে নিয়োগ পাচ্ছেন, একদিন তাঁদের মধ্য থেকে কেউ হবেন বিভাগীয় প্রধান বা ডিন অথবা কোনো একসময় হয়ে যেতে পারেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আবার অনেক সময় স্রেফ কোনো একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাসী বলে কেউ হয়তো শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, আবার কেউ ক্ষমতাধর ব্যক্তির নিকটাত্মীয় বলে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, একবার চাকরি হলে সেই চাকরি আর কখনো যায় না, যদি না সেই শিক্ষক বা কর্মচারী কোনো নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত হন। তবে এমন শিক্ষকও পাওয়া যাবে, যিনি কখনো কোনো ক্লাস ফাঁকি দেননি, ক্লাসে সব সময় প্রস্তুতি নিয়ে আসেন, শিক্ষার্থীদের সব একাডেমিক বিষয়ে উৎসাহিত করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁদের অবদানকে কদাচিৎ মূল্যায়ন করা হয়।
যতই নিয়মিত বিরতি দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ইটপাটকেল মারা হোক, একটি কথা সবাইকে মানতেই হবে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। এখানে প্রথমে যোগ্যতা অনুসারে প্রার্থীদের ছোট তালিকা করা হয়। এরপর তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকদের সামনে একটি ছোট সেমিনার দিতে হয়। তারপর মৌখিক পরীক্ষা হয় এবং তাঁকে যদি যোগ্য মনে করা হয়, তাহলে তাঁর প্রথম চুক্তি হয় এক বছরের জন্য। এই এক বছর (সাধারণত তিনটি সেমিস্টার) ছাত্র ও বিভাগীয় প্রধান বা কোনো কোনো সময় ডিন তাঁকে কেমন মূল্যায়ন করেন, তা দেখা হয় এবং সবকিছু যদি সন্তোষজনক হয় তাহলে তাঁর চুক্তি নবায়ন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস মিস করা বা দেরিতে আসা অনেকটা অকল্পনীয়।
মোদ্দা কথা, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ভালো ছাত্র ভর্তি, যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি এবং তা নিয়মিত সংস্কার করা, শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ জোগান দেওয়া—এর মধ্যে অবশ্যই ভালো গ্রন্থাগার, ল্যাব, বিনোদনের ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। কারও কারও একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মানে তার অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের জমি থাকতে হবে। যাঁরা এমন ভাবনা পোষণ করেন, তাঁদের জানা উচিত, বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য জমির পরিমাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতি ঘনফুট বা মিটার স্পেস। একটি বাড়ির এখন মাপ হয় কত বর্গফুট, কত একর জমির ওপর নয়। এক হাজার ২০০ স্কয়ার ফুটের বাড়িতে যেমন কুড়িজন মানুষের বাস করা সমীচীন নয়, একইভাবে পাঁচ হাজার ছাত্রের জন্য কত বর্গফুট জমি প্রয়োজন, তা পরিমাপ করা কঠিন নয়। বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ শ থেকে হাজার একরের ওপর জমি আছে। তার পরও কেন তারা তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না? আমি অনেক তরুণ প্রতিভাবান শিক্ষককে দেখেছি, তাদের তারুণ্যকে নষ্ট করছে প্রাইভেট পড়িয়ে অথবা বিভাগীয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে। অনেককে দেখেছি, পরীক্ষার খাতা ছাড়া অন্য কিছু পড়াতে দারুণ অনীহা। এটি একটি জাতীয় ক্ষতি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্ডারি বা উপাচার্য নিয়োগ। একাডেমিক নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকলে স্রেফ দলীয় আনুগত্যের কারণে কাউকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। বর্তমান সরকারের আমলে সব সময় এ বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা মনে হয় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তো বেশ কয়েক মাস কোনো পূর্ণকালীন উপাচার্য ছাড়াই চলছে।
সুতরাং ওই বিশ্ববিদ্যালয়কেই আমি ভালো হিসেবে আখ্যায়িত করব, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ উদ্যোগে জ্ঞানচর্চার একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা উদার, সংবেদনশীল, শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবে পরিচিত—সেটাই সত্যিকার অর্থে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার উপকরণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়, যা আগে উল্লেখ করেছি, তা তো থাকতেই হবে। বাংলাদেশে এমন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য চাই সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (বিমক) সহায়তা ও দিকনির্দেশনা। বিমকের নতুন চেয়ারম্যান সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রস্তাব করেছেন, বিমককে যেন উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করা হয়। অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে এবং তাতে উচ্চশিক্ষা উপকৃত হয়েছে। বাংলাদেশে তা হতে বাধা কোথায়? ১৯৭৩ সালে জন্মলগ্নে বিমকের যে ভূমিকা ছিল, এখন তো তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু যোগ হয়েছে। সুতরাং এর সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments