প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ডাকটিকিট by এ টি এম আনোয়ারুল কাদির
১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ নামে প্রথম আটটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। একটি ডাকটিকিট যে শুধু ডাকমাশুল আদায়ের মাধ্যম নয়, ইতিহাসেরও একটি অংশ, তা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিট।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে (যা বর্তমানে মুজিবনগর
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে (যা বর্তমানে মুজিবনগর
নামে অধিক পরিচিত) বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, আলোকচিত্রী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার অর্থাৎ মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। দেশে তখন অবিরাম যুদ্ধ চলছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। সে সময় মুজিবনগর সরকার একটি ডাকব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব অনুভব করে এবং একটি কেন্দ্রীয় ডাকঘরসহ বেশ কিছু ফিল্ড পোস্ট অফিস স্থাপন করে। মওদুদ আহমদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল করে চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, আশরাফ আলী চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু ও ভারতের প্রতিনিধি এল এন মিশ্রকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই ডাকব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চিঠি আদান-প্রদানে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিফৌজ ও স্কাউটের সদস্যরা। মুজিবনগর সরকার একসময় উপলব্ধি করে, স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য ডাকটিকিট একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। এরপর মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশ নামে ডাকটিকিট প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তৎকালীন সদস্য ও ব্রিটিশ ডাক বিভাগের তৎকালীন পোস্টমাস্টার জেনারেল জন স্টোনহাউস মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, মুক্তাঞ্চলে ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশের ডাকটিকিট প্রচলন করা হলে মুক্তাঞ্চল থেকে প্রেরিত চিঠিপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাস্তব সত্য হিসেবে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। মন্ত্রিসভা ডাকটিকিট প্রকাশের অনুমোদন প্রদান করে এবং জন স্টোনহাউসকে দায়িত্ব প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল জন স্টোনহাউস লন্ডন প্রবাসী বাঙালি ডিজাইনার বিমান মল্লিককে বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিটের ডিজাইন করার অনুরোধ জানান। বিমান মল্লিকের পুরো নাম বিমান চাঁদ মল্লিক। ১৯৩৩ সালে কলকাতার হাওড়ায় তাঁর জন্ম। ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ ডাক বিভাগ থেকে মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিটের ডিজাইন করে স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। বিনা পারিশ্রমিকে ডাকটিকিটের ডিজাইন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিমান মল্লিক। ডাকটিকিটের ডিজাইন প্রাথমিকভাবে অনুমোদন করেন প্রবাসে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও জন স্টোনহাউস। এরপর ব্রিটেনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড নেসওয়ার্থ ডাকটিকিটের নকশা নিয়ে কলকাতায় আসেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য মন্ত্রীদের অনুমোদন গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই লন্ডনের হাউস অব কমন্সে বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা আটটি ডাকটিকিট ও ফার্স্ট ডে কভার বা উদ্বোধনী খাম প্রদর্শন করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পরদিন ফলাও করে লন্ডনের দি টাইমস, দি গার্ডিয়ান, দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ডাকটিকিটের সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২৬ জুলাই প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিট প্রেস রিলিজের মাধ্যমে একযোগে মুজিবনগর, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। আটটি ডাকটিকিট লাগানো খাম ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে হাত উঁচিয়ে সবাইকে দেখানো হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জোর দাবি উত্থাপন করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টসদস্য জন স্টোনহাউস। হাউস অব কমন্সে বিতর্কের ঝড় ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড ও জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ব্রিটেনের ট্রাফালগার স্কয়ারে ডাকটিকিটের ডিজাইনার বিমান মল্লিক বাংলাদেশের আটটি ডাকটিকিট জনসমক্ষে হাত উঁচিয়ে তুলে ধরেন। এই অনুষ্ঠানে জন স্টোনহাউসসহ অনেক গণ্যমান্য অতিথি, প্রবাসী বাঙালি ও ব্রিটিশ নাগরিক উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এ আটটি ডাকটিকিট বড় ভূমিকা পালন করেছিল। পাকিস্তান সরকার এই ডাকটিকিটগুলো বেআইনি ঘোষণা করলেও তা উপেক্ষা করে বিশ্বের বহু দেশে এ ডাকটিকিট লাগিয়ে চিঠি প্রেরণ করা হয়। মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো অনেক চিঠিপত্রে এই ডাকটিকিট ব্যবহার করা হয়েছিল।
ডাকটিকিটগুলো লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল প্রেস থেকে ছাপানো হয়। ডাকটিকিটগুলোর দুটি বিষয় লক্ষণীয়। একটি দেশের নাম, অপরটি মুদ্রার নাম। ডাকটিকিটে দেশের নাম দুটি আলাদা শব্দে বাংলায় ‘বাংলা দেশ’ এবং ইংরেজিতে ‘Bangla Desh’ এবং মুদ্রার নাম রুপি ছাপা হয়। তখন ধারণা ছিল না দেশের নাম কীভাবে লেখা হবে এবং মুদ্রার নাম কী হবে। দেশের নাম দুটি আলাদা শব্দে লেখার বিষয়ে ডিজাইনার বিমান মল্লিক বলেন, ‘জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে “বাঙ্গালা দেশ”-এর উল্লেখ রয়েছে দুটি শব্দে। তারই অনুসরণে তিনি দুই শব্দে দেশের নাম ব্যবহার করেন এবং ডিজাইনও অনুমোদিত হয়।’ বিমান মল্লিক ১৯৭১ সালে লন্ডনে বসে টেলিভিশনে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ নিজ চোখে দেখেছিলেন এবং এসব দৃশ্য তাঁকে বিচলিত করেছিল। তিনি এক লেখায় উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করার ঘটনাটি আজও ভুলতে পারেননি। বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা ডাকটিকিটগুলো যেন মুক্তিযুদ্ধের কথাই বলে।
তবে বাংলাদেশে ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের অন্যতম সংগঠন ‘ফিলাটেলিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (পিএবি)’ বেসরকারিভাবে ২০০৩ সাল থেকে ২৯ জুলাই তারিখটি ‘জাতীয় ডাকটিকিট দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। ২০০৮ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দিনটিকে শুধু ডাকটিকিট দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০০৮ সালের ২৯ জুলাই একটি স্যুভেনির শিট ও ফোল্ডার প্রকাশ করে।
এ টি এম আনোয়ারুল কাদির: সাধারণ সম্পাদক, ফিলাটেলিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই লন্ডনের হাউস অব কমন্সে বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা আটটি ডাকটিকিট ও ফার্স্ট ডে কভার বা উদ্বোধনী খাম প্রদর্শন করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পরদিন ফলাও করে লন্ডনের দি টাইমস, দি গার্ডিয়ান, দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ডাকটিকিটের সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২৬ জুলাই প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিট প্রেস রিলিজের মাধ্যমে একযোগে মুজিবনগর, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। আটটি ডাকটিকিট লাগানো খাম ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে হাত উঁচিয়ে সবাইকে দেখানো হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জোর দাবি উত্থাপন করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টসদস্য জন স্টোনহাউস। হাউস অব কমন্সে বিতর্কের ঝড় ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড ও জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ব্রিটেনের ট্রাফালগার স্কয়ারে ডাকটিকিটের ডিজাইনার বিমান মল্লিক বাংলাদেশের আটটি ডাকটিকিট জনসমক্ষে হাত উঁচিয়ে তুলে ধরেন। এই অনুষ্ঠানে জন স্টোনহাউসসহ অনেক গণ্যমান্য অতিথি, প্রবাসী বাঙালি ও ব্রিটিশ নাগরিক উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এ আটটি ডাকটিকিট বড় ভূমিকা পালন করেছিল। পাকিস্তান সরকার এই ডাকটিকিটগুলো বেআইনি ঘোষণা করলেও তা উপেক্ষা করে বিশ্বের বহু দেশে এ ডাকটিকিট লাগিয়ে চিঠি প্রেরণ করা হয়। মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো অনেক চিঠিপত্রে এই ডাকটিকিট ব্যবহার করা হয়েছিল।
ডাকটিকিটগুলো লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল প্রেস থেকে ছাপানো হয়। ডাকটিকিটগুলোর দুটি বিষয় লক্ষণীয়। একটি দেশের নাম, অপরটি মুদ্রার নাম। ডাকটিকিটে দেশের নাম দুটি আলাদা শব্দে বাংলায় ‘বাংলা দেশ’ এবং ইংরেজিতে ‘Bangla Desh’ এবং মুদ্রার নাম রুপি ছাপা হয়। তখন ধারণা ছিল না দেশের নাম কীভাবে লেখা হবে এবং মুদ্রার নাম কী হবে। দেশের নাম দুটি আলাদা শব্দে লেখার বিষয়ে ডিজাইনার বিমান মল্লিক বলেন, ‘জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে “বাঙ্গালা দেশ”-এর উল্লেখ রয়েছে দুটি শব্দে। তারই অনুসরণে তিনি দুই শব্দে দেশের নাম ব্যবহার করেন এবং ডিজাইনও অনুমোদিত হয়।’ বিমান মল্লিক ১৯৭১ সালে লন্ডনে বসে টেলিভিশনে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ নিজ চোখে দেখেছিলেন এবং এসব দৃশ্য তাঁকে বিচলিত করেছিল। তিনি এক লেখায় উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করার ঘটনাটি আজও ভুলতে পারেননি। বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা ডাকটিকিটগুলো যেন মুক্তিযুদ্ধের কথাই বলে।
তবে বাংলাদেশে ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের অন্যতম সংগঠন ‘ফিলাটেলিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (পিএবি)’ বেসরকারিভাবে ২০০৩ সাল থেকে ২৯ জুলাই তারিখটি ‘জাতীয় ডাকটিকিট দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। ২০০৮ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দিনটিকে শুধু ডাকটিকিট দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০০৮ সালের ২৯ জুলাই একটি স্যুভেনির শিট ও ফোল্ডার প্রকাশ করে।
এ টি এম আনোয়ারুল কাদির: সাধারণ সম্পাদক, ফিলাটেলিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ
No comments