চারদিক-পথের পাশে শিল্প কারিগর by আজাদুর রহমান
লোকে ‘ঋষি’ নামে ডাকে না, ‘মুচি’ বলে। সমাজের অন্যরা যখন মাথা উঁচু করে নানা ধরনের ব্যবসা সাজায়, তখন ঋষিদের চোখ থাকে মানুষের পায়ের দিকে। কার জুতায় কালি কম, রংচটা কারটা, কোন স্যান্ডেলটা ছেঁড়াফাঁড়া—জীবিকার তাগিদে সেসবেই তাঁদের নজর বেশি যায়। বারোয়ারিরা অবশ্য হাতে বাক্স ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে ফেরি করে।
সুযোগমতো হাঁক ছাড়ে, ‘জুতা কালি করাবেন, কালি...।’ ঋষির সঙ্গে মুনি-ঋষিদের একটা যোগ আছে বটে। তাতে কি! ‘মুচি’ শুনলেই নিম্নবর্গের সাদামাটা মুখই মনে পড়ে। মোড়ের পিচে বেনামি বাক্স ধরে গুটিধরা অভাবি মানুষটাই মুচি।
বগুড়ার প্রভাসের কথা ধরা যাক। সাতটা সড়কের মাথা একবিন্দুতে এসে জড়ো হয়ে সাতমাথা হয়েছে। গাড়িঘোড়ার মেলা। টংঘর পাতা তো দূরের কথা, দিনের বেলা নিয়মিত এক ঠিকানায় বসার জো নেই। সন্ধ্যার পর একটু আয়েসে তবু বসা যায়। মাথার অনেক ওপরে তখন সোডিয়াম জ্বলে। আর নিচের আবছায়ায় প্রভাস নিচু মনে টোটকা চামড়ায় সেলাইফোঁড়ে। ভিড়ের মধ্যেও তিনি একা। ব্যস্ত পথচারীদের নজর থাকে সমান্তরালে। যাত্রাপথে কারও স্যান্ডেল পটাং করে ছিঁড়ে গেল, কিংবা তড়িঘড়ি বের হতে গিয়ে জুতোটা আর কালি করানো হলো না, নয়তো টানতে গিয়ে ব্যাগের চেইনটা কট্ করে আটকে গেল। ব্যস, চোখ নামিয়ে খুঁজতে থাকো প্রভাসের মতো কাউকে।
অন্য সময় প্রভাসকে নিয়ে তাই আলাদা করে কেউ ভাবতে বসে না। শহরতলির বস্তিতে তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে ছাপড়ামতো দুটি ঘরে তিনি সংসার বেঁধেছেন। মুচির ব্যক্তিগত খোঁজখবর করাটা এখনো চোখসওয়া হয়ে ওঠেনি বোধ হয়। কৌতূহলী চোখগুলো অবহেলা করে কাঠের বাক্সে বসে আলাপ শুরু করলাম। বড় ভাই হরিস দাসও একই কাজ করেন। তবে হরিসের একটা টংঘর আছে পৌরসভার ড্রেনের ওপর। ঝাপতোলা ঘরটা এত ছোট যে হরিস কোনোমতে বসতে পারলেও প্রভাসকে বাধ্য হয়ে ইলেকট্রিকের পোলের গোড়ায় গিয়ে বসতে হয়। ফলে কোনো না কোনোভাবে প্রায় সারা দিনই রোদের হলকা লাগে গায়ে।
সারাইয়ের কাজ শিখেছিলেন বাবা লক্ষ্মণদাসের কাছ থেকে। তা-ও আজ ১৯ বছর। কাজ নিয়ে বড় কথা কম নয়, ‘আদত কাম কত্তে হামার ভালিই লাগে, কাম তো কামই। এ অ্যাডা মহৎ জিনিস। নোকে য্যাখন অবজ্ঞা দিয়ে মুচি কয়, তখন খারাপি লাগে।’
‘মুচি’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে প্রভাসের মুখে ছায়া নামল, ‘অনেকে হামাগোরক ঘিন্নে করে মুছি কয়। দ্যাকেন এই অ্যাডা নাম—মু...ছি...। হামাগেরে সাথে অ্যাডা ছি লাগাছে।’ প্রভাস থামেন না। দুঃখমুখে রা রা করে ওঠেন, ‘ছি ছি ছি, মুছি। দ্যাকেন তো ক্যামন কষ্টের কতা, অতচ হামরা কিন্তুক শিল্পীর কাম করি।’ লেখাপড়ায় আন্ডার মেট্রিক বলে প্রভাস খুব গুছিয়ে বলতে পারেন। গল্পের আদলে তিনি জীবনের আরও কথা বলতে থাকেন, ‘হামরা আপনার জিনিসক সোন্দর করি, পুজোতে ঢোল বাজাই। শশ্বানঘাটত যায়া চিতা সাজায়ে লাশের সৎকার করি। ঝুড়ি, কুলা বানাই। তার পরও নোকে ছোট ভাবে। আবার কাকো গাল দিবের সময় নোকে “মুচির বাচ্চা” কোয়ে গালাগাল করে।’
প্রভাস খানিকটা প্রতিবাদী বটে, কিন্তু রাজাবাজারের বয়সী পশুপতি দাসের মনে অত তাপ নেই। পশুপতিও পেশাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন, তবে শুধু যখন কেউ জুতা কালি করতে এসে তাঁর ঢালাই ফর্মার ওপর পা তুলে দাঁড়ায়, তখন তাঁর মনটা ভারী হয়ে যায়, ‘দ্যাকেন, যখন কোনো সাহেব জুতা পায়ে রেখেই ফর্মার ওপর পা তুলে দ্যায়, তখন তো আমাকে তাঁর পায়ের ওপরই কাজ করতে হয়। জুতার ফিতে খোলা, কালি-ব্রাশ করা ইত্যাদি সবকিছুই তখন পা ধরে ধরে করতে হয়। মন খারাপ লাগে। মনে হয়, যদি লোকটার জায়গায় আমি হতাম, আর পা তুলে দেওয়া লোকটাই যদি আমার জায়গায় থাকত, তাহলে ওই লোকটার কেমন লাগত?’
পশুপতির কথার পাল্টা জবাব দিতে পারি না বলে তিনি একটানা বলে গিয়ে খানিক দম টানেন, তারপর নিজের জাত-পুরুষ টেনে মুখের ওপর প্রশ্ন করেন। আফসোস মুখে উত্তর খোঁজেন। আমি আগের মতোই উত্তর করি না। চোখ নামিয়ে হেঁটে হেঁটে ফের সাতমাথায় এসে তরুণ যাদব দাসকে পেয়ে যাই। আবারও আলাপ। যাদব বাঁশি বাজাতে পারেন। ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয় বলে তাঁর কাছে এ এক আনন্দদায়ক পেশা বটে। পশুপতির মতো যাদব অতশত বোঝেন না, ‘আমাদের কিছুই চাওয়ার নাই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চাই। হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না, জাতের ভেদ থাকবে না, তা হলেই আমি খুব খুশি।’ যাদব গুছিয়ে কথার পিঠে কথা বলতে পারেন না। প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথায় চলে আসেন, ‘এ দ্যাখেন, ধর্মকথায় সকলের মর্যাদার কথা আছে। কিন্তু অনেকেই সেটুকু করে না। যেসব দাওয়াতে অন্যদের ওপর রেখে আমাদের নিচে বসিয়ে রাখে, সেখানে খাই না, চলে আসি।’ মানুষের ভালো ব্যবহার নিয়ে যাদব আরও কী কী সব বলে যান, কিন্তু সেদিকে আর মন লাগে না। কল্পনায় কেবল একদল মেহনতি মানুষকে দেখতে পাই, যাঁরা কাজকে ছোট-বড় করে দেখেন না বরং আমরা যাকে ছোট কাজ বলে সাব্যস্ত করতে চাই, সে রকম কাজই তাঁরা সানন্দে করে যান।
আজাদুর রহমান
বগুড়ার প্রভাসের কথা ধরা যাক। সাতটা সড়কের মাথা একবিন্দুতে এসে জড়ো হয়ে সাতমাথা হয়েছে। গাড়িঘোড়ার মেলা। টংঘর পাতা তো দূরের কথা, দিনের বেলা নিয়মিত এক ঠিকানায় বসার জো নেই। সন্ধ্যার পর একটু আয়েসে তবু বসা যায়। মাথার অনেক ওপরে তখন সোডিয়াম জ্বলে। আর নিচের আবছায়ায় প্রভাস নিচু মনে টোটকা চামড়ায় সেলাইফোঁড়ে। ভিড়ের মধ্যেও তিনি একা। ব্যস্ত পথচারীদের নজর থাকে সমান্তরালে। যাত্রাপথে কারও স্যান্ডেল পটাং করে ছিঁড়ে গেল, কিংবা তড়িঘড়ি বের হতে গিয়ে জুতোটা আর কালি করানো হলো না, নয়তো টানতে গিয়ে ব্যাগের চেইনটা কট্ করে আটকে গেল। ব্যস, চোখ নামিয়ে খুঁজতে থাকো প্রভাসের মতো কাউকে।
অন্য সময় প্রভাসকে নিয়ে তাই আলাদা করে কেউ ভাবতে বসে না। শহরতলির বস্তিতে তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে ছাপড়ামতো দুটি ঘরে তিনি সংসার বেঁধেছেন। মুচির ব্যক্তিগত খোঁজখবর করাটা এখনো চোখসওয়া হয়ে ওঠেনি বোধ হয়। কৌতূহলী চোখগুলো অবহেলা করে কাঠের বাক্সে বসে আলাপ শুরু করলাম। বড় ভাই হরিস দাসও একই কাজ করেন। তবে হরিসের একটা টংঘর আছে পৌরসভার ড্রেনের ওপর। ঝাপতোলা ঘরটা এত ছোট যে হরিস কোনোমতে বসতে পারলেও প্রভাসকে বাধ্য হয়ে ইলেকট্রিকের পোলের গোড়ায় গিয়ে বসতে হয়। ফলে কোনো না কোনোভাবে প্রায় সারা দিনই রোদের হলকা লাগে গায়ে।
সারাইয়ের কাজ শিখেছিলেন বাবা লক্ষ্মণদাসের কাছ থেকে। তা-ও আজ ১৯ বছর। কাজ নিয়ে বড় কথা কম নয়, ‘আদত কাম কত্তে হামার ভালিই লাগে, কাম তো কামই। এ অ্যাডা মহৎ জিনিস। নোকে য্যাখন অবজ্ঞা দিয়ে মুচি কয়, তখন খারাপি লাগে।’
‘মুচি’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে প্রভাসের মুখে ছায়া নামল, ‘অনেকে হামাগোরক ঘিন্নে করে মুছি কয়। দ্যাকেন এই অ্যাডা নাম—মু...ছি...। হামাগেরে সাথে অ্যাডা ছি লাগাছে।’ প্রভাস থামেন না। দুঃখমুখে রা রা করে ওঠেন, ‘ছি ছি ছি, মুছি। দ্যাকেন তো ক্যামন কষ্টের কতা, অতচ হামরা কিন্তুক শিল্পীর কাম করি।’ লেখাপড়ায় আন্ডার মেট্রিক বলে প্রভাস খুব গুছিয়ে বলতে পারেন। গল্পের আদলে তিনি জীবনের আরও কথা বলতে থাকেন, ‘হামরা আপনার জিনিসক সোন্দর করি, পুজোতে ঢোল বাজাই। শশ্বানঘাটত যায়া চিতা সাজায়ে লাশের সৎকার করি। ঝুড়ি, কুলা বানাই। তার পরও নোকে ছোট ভাবে। আবার কাকো গাল দিবের সময় নোকে “মুচির বাচ্চা” কোয়ে গালাগাল করে।’
প্রভাস খানিকটা প্রতিবাদী বটে, কিন্তু রাজাবাজারের বয়সী পশুপতি দাসের মনে অত তাপ নেই। পশুপতিও পেশাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন, তবে শুধু যখন কেউ জুতা কালি করতে এসে তাঁর ঢালাই ফর্মার ওপর পা তুলে দাঁড়ায়, তখন তাঁর মনটা ভারী হয়ে যায়, ‘দ্যাকেন, যখন কোনো সাহেব জুতা পায়ে রেখেই ফর্মার ওপর পা তুলে দ্যায়, তখন তো আমাকে তাঁর পায়ের ওপরই কাজ করতে হয়। জুতার ফিতে খোলা, কালি-ব্রাশ করা ইত্যাদি সবকিছুই তখন পা ধরে ধরে করতে হয়। মন খারাপ লাগে। মনে হয়, যদি লোকটার জায়গায় আমি হতাম, আর পা তুলে দেওয়া লোকটাই যদি আমার জায়গায় থাকত, তাহলে ওই লোকটার কেমন লাগত?’
পশুপতির কথার পাল্টা জবাব দিতে পারি না বলে তিনি একটানা বলে গিয়ে খানিক দম টানেন, তারপর নিজের জাত-পুরুষ টেনে মুখের ওপর প্রশ্ন করেন। আফসোস মুখে উত্তর খোঁজেন। আমি আগের মতোই উত্তর করি না। চোখ নামিয়ে হেঁটে হেঁটে ফের সাতমাথায় এসে তরুণ যাদব দাসকে পেয়ে যাই। আবারও আলাপ। যাদব বাঁশি বাজাতে পারেন। ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয় বলে তাঁর কাছে এ এক আনন্দদায়ক পেশা বটে। পশুপতির মতো যাদব অতশত বোঝেন না, ‘আমাদের কিছুই চাওয়ার নাই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চাই। হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না, জাতের ভেদ থাকবে না, তা হলেই আমি খুব খুশি।’ যাদব গুছিয়ে কথার পিঠে কথা বলতে পারেন না। প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথায় চলে আসেন, ‘এ দ্যাখেন, ধর্মকথায় সকলের মর্যাদার কথা আছে। কিন্তু অনেকেই সেটুকু করে না। যেসব দাওয়াতে অন্যদের ওপর রেখে আমাদের নিচে বসিয়ে রাখে, সেখানে খাই না, চলে আসি।’ মানুষের ভালো ব্যবহার নিয়ে যাদব আরও কী কী সব বলে যান, কিন্তু সেদিকে আর মন লাগে না। কল্পনায় কেবল একদল মেহনতি মানুষকে দেখতে পাই, যাঁরা কাজকে ছোট-বড় করে দেখেন না বরং আমরা যাকে ছোট কাজ বলে সাব্যস্ত করতে চাই, সে রকম কাজই তাঁরা সানন্দে করে যান।
আজাদুর রহমান
No comments