ধর্ম-প্রসূতির পরিচর্যা ও নিরাপদ মাতৃত্ব by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ইসলামে প্রসূতির নিরাপদ মাতৃত্ব লাভের অধিকার ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যাপারে বিভিন্ন শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা রয়েছে। মাতৃত্ব অর্জন যেকোনো নারীসত্তাকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। গর্ভবতী মাকে ধর্মীয় অনুশাসন এবং অনেক কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়, অন্যথায় মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। তাই যিনি মা হবেন, তাঁর অবশ্যই স্বাস্থ্য
উন্নয়ন, সচেতনতা বাড়ানো ও যথেষ্ট পরিচর্যা করতে হবে। একজন সুস্থ মা-ই একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারেন। সুস্থ শিশুর জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ মাতৃত্ব। এ জন্য গর্ভবতী মায়ের প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, যত্ন ও সেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টা মুসলিম পরিবারের সদস্যদের বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে। একজন নারী নিরাপদে মা হবেন—এ দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি গর্ভবতী নারীরই ন্যায্য প্রাপ্য বা ন্যায়সংগত অধিকার। এর সঙ্গে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর সন্তানের পিতার দায়িত্ব হলো মাতার খাওয়া-পরার উত্তম ব্যবস্থা করা।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৩৩)
অথচ দেশের অধিকাংশ গর্ভবতী নারীই নানা ধরনের অপুষ্টির শিকার। ফলে তাঁদের নবজাতকও হয় পুষ্টিহীন। ভবিষ্যতে কন্যাশিশুটিও একদিন পরিবারে মায়ের অবস্থানে যায়। এ মা-ই অপুষ্টিতে নিজে ভুগে জন্ম দেন পুষ্টিহীন সন্তান। কেননা, সাধারণত সমাজজীবনে স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের খাবার পরিবেশনের পর স্ত্রী নিজের জন্য প্রয়োজনীয় সুষম খাবার রাখেন না। স্ত্রী বা সন্তানের মা যাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে যত্নবান হন—এদিকে পরিবারের প্রধান বা স্বামীর দৃষ্টি রাখা অবশ্য কর্তব্য। সন্তান পেটে এলে গর্ভবতী মাকে পুষ্টিকর এবং পরিমাণে বেশি খাবার খাওয়া প্রয়োজন। কেননা, তাঁর খাবারে একটি নয়, দুটি প্রাণ বাঁচে। গর্ভকালীন এবং শিশুকে দুধ দানকালে এ ব্যাপারে বেশি সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। তাই গর্ভবতী স্ত্রীর খাবারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী দিয়েছেন, ‘তোমরা (স্বামীরা) যা খাবে, তাঁদের (নারীদের) তা-ই খেতে দেবে।’
ইসলামের দৃষ্টিতে গর্ভবতীর যত্ন মূলত শিশুর যত্ন। সন্তান যে মুহূর্তে মাতৃগর্ভে আসে, ঠিক তখন থেকেই তার যত্নের সঙ্গে সঙ্গে মায়েরও যত্ন নিতে হয়। সন্তান গর্ভে এলে মা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জীবন যাপন করবেন, অন্যথায় মা ও শিশু উভয়েরই সমূহ বিপদ হতে পারে। গর্ভবতী মায়ের অবশ্যই তাকওয়া বা আল্লাহভীতি থাকতে হবে। তাঁকে সব ধরনের খারাপ কাজ, অসদাচরণ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। সন্তান গর্ভে এলে মায়ের শরীরে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য ও পুষ্টির দরকার হয়। এ সময় মায়ের নিজের ও গর্ভের শিশু—দুজনেরই খাদ্য প্রয়োজন। তাই গর্ভবতী মাকে বেশি করে পুষ্টিকর ও পরিমিত সুষম খাবার খেতে হবে। এই মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক থেকে তোমরা উত্তম খাবার খাও।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭২)
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা নারীকে দিয়েছেন মাতৃত্বের অধিকার তথা গর্ভধারণের ক্ষমতা। যদিও নারীর গর্ভধারণ ও শিশু জন্মদানের প্রক্রিয়াটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবছর সারা বিশ্বে পাঁচ লাখ নারী জন্মদানসংক্রান্ত জটিলতায় মারা যান। সন্তান প্রসবজনিত কারণে বিশ্বে প্রতি মিনিটে একজন মা মারা যান। প্রসবকালীন জটিলতার কারণে কেউ কেউ আজীবন অসুস্থ জীবন যাপন করেন। পারিবারিক অসচেতনতা, স্বাস্থ্যসেবার নিম্নমুখী মান, ভুল চিকিৎসা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সর্বোপরি নারীর প্রতি পরিবারের পুরুষদের অবহেলার কারণে নারীরা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারে কোনো নারীই নিজের জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান না। গর্ভধারণের সময় স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য সবার আগে তাঁর স্বামীর সহযোগিতা প্রয়োজন। এ জন্য সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রতি সবার দায়িত্ব রয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রোগ এবং দাওয়া (ওষুধ) দুটিই পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি রোগেরই ওষুধ প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। তবে হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা কোরো না।’ (মিশকাত ও আবু দাউদ)
ইসলামে প্রসূতি ও নবজাতকের জীবন রক্ষার জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মায়েদের জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ শিশুদের জীবন রক্ষায় সমানভাবে সহায়তা করে। শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা প্রতিবছর সন্তান ধারণ করে থাকেন। এ কারণে শিশুর সঠিক পরিচর্যা না হওয়ায় পুষ্টিহীন ও রোগাক্রান্ত মা ও শিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অথচ মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির কারণে রোগাক্রান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটায় অনেক সময় মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বাল্যবিবাহ ও গর্ভসঞ্চার, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীর নিরাপদে মা হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সুতরাং নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু রোধ করতে হলে গর্ভধারণের আগে থেকেই সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। এ ছাড়া গর্ভকালীন ও প্রসবের পর মায়ের একাধিকবার প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য মুসলিম পরিবারের সবাই গর্ভবতী হওয়া থেকে প্রসব-পরবর্তী সময় পর্যন্ত মাকে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা, সৎ পরামর্শ ও উৎসাহ দিতে পারেন। আল্লাহর ওপর ভরসার পাশাপাশি ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করাও ইসলামের শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা করো। কারণ, যিনি রোগ দিয়েছেন, তিনি তার প্রতিকারের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
ইসলামে সন্তান প্রসবকালীন পবিত্রতা ও সাবধানতা অবলম্বনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা রয়েছে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রসূতিকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় মায়েরা গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে ভুল চিকিৎসা নেন। এ কারণে অনেক মা সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন। গর্ভধারণের সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সুচিকিৎসা না করালে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নারী যখন গর্ভবতী হন, তখন তাঁর খাবার, বিশেষ করে আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রধানত, আয়রনের অভাবেই এ সময় রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এ ছাড়া এ সময় জরুরি ওষুধগুলো হাতের কাছে রাখতে হবে। প্রসূতি ও শিশুকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি গ্রামে গণসচেতনতামূলক ব্যবস্থাসহ ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
পরিবারে নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। তাঁকে ভারী ও কঠিন কাজ না দিয়ে তাঁর কষ্ট লাঘব করা যায়। ঘন ঘন সন্তান প্রসব থেকে বিরত রাখার জন্য মাঠপর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এগিয়ে এসে জনগণকে সচেতন করতে সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। যেসব মা স্বাস্থ্যসেবা পান না, তাঁদের কাছে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হবে। যেসব মা পুষ্টিকর খাবার পান না, তাঁদের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। প্রসূতির প্রজনন স্ব্বাস্থ্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা সেবা আরও বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃস্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। তাই প্রসূতির নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য জাতি- ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। আমরা যদি নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করে প্রসূতিকে সুস্থ রাখতে সচেষ্ট হতে পারি, তাহলে সন্তানেরা সুস্থ থাকবে এবং গড়ে উঠবে একটি সুস্থ জাতি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
অথচ দেশের অধিকাংশ গর্ভবতী নারীই নানা ধরনের অপুষ্টির শিকার। ফলে তাঁদের নবজাতকও হয় পুষ্টিহীন। ভবিষ্যতে কন্যাশিশুটিও একদিন পরিবারে মায়ের অবস্থানে যায়। এ মা-ই অপুষ্টিতে নিজে ভুগে জন্ম দেন পুষ্টিহীন সন্তান। কেননা, সাধারণত সমাজজীবনে স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের খাবার পরিবেশনের পর স্ত্রী নিজের জন্য প্রয়োজনীয় সুষম খাবার রাখেন না। স্ত্রী বা সন্তানের মা যাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে যত্নবান হন—এদিকে পরিবারের প্রধান বা স্বামীর দৃষ্টি রাখা অবশ্য কর্তব্য। সন্তান পেটে এলে গর্ভবতী মাকে পুষ্টিকর এবং পরিমাণে বেশি খাবার খাওয়া প্রয়োজন। কেননা, তাঁর খাবারে একটি নয়, দুটি প্রাণ বাঁচে। গর্ভকালীন এবং শিশুকে দুধ দানকালে এ ব্যাপারে বেশি সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। তাই গর্ভবতী স্ত্রীর খাবারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী দিয়েছেন, ‘তোমরা (স্বামীরা) যা খাবে, তাঁদের (নারীদের) তা-ই খেতে দেবে।’
ইসলামের দৃষ্টিতে গর্ভবতীর যত্ন মূলত শিশুর যত্ন। সন্তান যে মুহূর্তে মাতৃগর্ভে আসে, ঠিক তখন থেকেই তার যত্নের সঙ্গে সঙ্গে মায়েরও যত্ন নিতে হয়। সন্তান গর্ভে এলে মা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জীবন যাপন করবেন, অন্যথায় মা ও শিশু উভয়েরই সমূহ বিপদ হতে পারে। গর্ভবতী মায়ের অবশ্যই তাকওয়া বা আল্লাহভীতি থাকতে হবে। তাঁকে সব ধরনের খারাপ কাজ, অসদাচরণ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। সন্তান গর্ভে এলে মায়ের শরীরে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য ও পুষ্টির দরকার হয়। এ সময় মায়ের নিজের ও গর্ভের শিশু—দুজনেরই খাদ্য প্রয়োজন। তাই গর্ভবতী মাকে বেশি করে পুষ্টিকর ও পরিমিত সুষম খাবার খেতে হবে। এই মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক থেকে তোমরা উত্তম খাবার খাও।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭২)
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা নারীকে দিয়েছেন মাতৃত্বের অধিকার তথা গর্ভধারণের ক্ষমতা। যদিও নারীর গর্ভধারণ ও শিশু জন্মদানের প্রক্রিয়াটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবছর সারা বিশ্বে পাঁচ লাখ নারী জন্মদানসংক্রান্ত জটিলতায় মারা যান। সন্তান প্রসবজনিত কারণে বিশ্বে প্রতি মিনিটে একজন মা মারা যান। প্রসবকালীন জটিলতার কারণে কেউ কেউ আজীবন অসুস্থ জীবন যাপন করেন। পারিবারিক অসচেতনতা, স্বাস্থ্যসেবার নিম্নমুখী মান, ভুল চিকিৎসা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সর্বোপরি নারীর প্রতি পরিবারের পুরুষদের অবহেলার কারণে নারীরা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারে কোনো নারীই নিজের জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান না। গর্ভধারণের সময় স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য সবার আগে তাঁর স্বামীর সহযোগিতা প্রয়োজন। এ জন্য সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রতি সবার দায়িত্ব রয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রোগ এবং দাওয়া (ওষুধ) দুটিই পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি রোগেরই ওষুধ প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। তবে হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা কোরো না।’ (মিশকাত ও আবু দাউদ)
ইসলামে প্রসূতি ও নবজাতকের জীবন রক্ষার জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মায়েদের জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ শিশুদের জীবন রক্ষায় সমানভাবে সহায়তা করে। শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা প্রতিবছর সন্তান ধারণ করে থাকেন। এ কারণে শিশুর সঠিক পরিচর্যা না হওয়ায় পুষ্টিহীন ও রোগাক্রান্ত মা ও শিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অথচ মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির কারণে রোগাক্রান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটায় অনেক সময় মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বাল্যবিবাহ ও গর্ভসঞ্চার, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীর নিরাপদে মা হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সুতরাং নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু রোধ করতে হলে গর্ভধারণের আগে থেকেই সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। এ ছাড়া গর্ভকালীন ও প্রসবের পর মায়ের একাধিকবার প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্য মুসলিম পরিবারের সবাই গর্ভবতী হওয়া থেকে প্রসব-পরবর্তী সময় পর্যন্ত মাকে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা, সৎ পরামর্শ ও উৎসাহ দিতে পারেন। আল্লাহর ওপর ভরসার পাশাপাশি ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করাও ইসলামের শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা করো। কারণ, যিনি রোগ দিয়েছেন, তিনি তার প্রতিকারের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
ইসলামে সন্তান প্রসবকালীন পবিত্রতা ও সাবধানতা অবলম্বনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা রয়েছে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রসূতিকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় মায়েরা গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে ভুল চিকিৎসা নেন। এ কারণে অনেক মা সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন। গর্ভধারণের সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সুচিকিৎসা না করালে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নারী যখন গর্ভবতী হন, তখন তাঁর খাবার, বিশেষ করে আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রধানত, আয়রনের অভাবেই এ সময় রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। এ ছাড়া এ সময় জরুরি ওষুধগুলো হাতের কাছে রাখতে হবে। প্রসূতি ও শিশুকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি গ্রামে গণসচেতনতামূলক ব্যবস্থাসহ ইসলামের আলোকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
পরিবারে নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। তাঁকে ভারী ও কঠিন কাজ না দিয়ে তাঁর কষ্ট লাঘব করা যায়। ঘন ঘন সন্তান প্রসব থেকে বিরত রাখার জন্য মাঠপর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এগিয়ে এসে জনগণকে সচেতন করতে সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। যেসব মা স্বাস্থ্যসেবা পান না, তাঁদের কাছে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হবে। যেসব মা পুষ্টিকর খাবার পান না, তাঁদের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। প্রসূতির প্রজনন স্ব্বাস্থ্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা সেবা আরও বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃস্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। তাই প্রসূতির নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য জাতি- ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। আমরা যদি নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করে প্রসূতিকে সুস্থ রাখতে সচেষ্ট হতে পারি, তাহলে সন্তানেরা সুস্থ থাকবে এবং গড়ে উঠবে একটি সুস্থ জাতি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments