যুক্তি তর্ক গল্প-লিমন ও র্যাবে নয়, সমস্যা আরও গভীরে by আবুল মোমেন
এই লেখা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রথম আলোর বক্তব্য নয়। তাঁর বক্তব্য দেশের সচেতন অনেক মানুষকেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। একজন নাগরিক ও সাংবাদিক হিসেবে সে রকম ভাবনা থেকেই মূলত এ লেখা।
সরকার কেবল একটি ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান নয়, জনকল্যাণে দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানও। সংবাদপত্র, তার পাঠক ও জনসমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে, তবে সেটাই আসল নয়, আসল কাজ দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা। এ বাস্তবতায় সরকার ও সংবাদপত্র পরস্পরের পরিপূরক ভূমিকা নিতে পারে, তবে এই পরিপূরকতা সরকারের অন্ধ সমর্থন বা পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতায় সম্পন্ন হবে না। এর জন্য চাই নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে গঠনমূলক সমালোচনা। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার ভূমিকা ও বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, সরকার র্যাবের বিষয়ে প্রথম আলোর খবর, বক্তব্যকে গঠনমূলকের মাত্রা ছাড়িয়ে ক্ষতিকর বলে মনে করছে। তাঁর বক্তব্যকে সরকারের বক্তব্য হিসেবেই ধরে নিতে হবে। কারণ, তিনি নিজেই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তা ছাড়া পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষ্কার করেই জানিয়েছেন, তাঁর বক্তব্য সরকারের ভাষ্য। সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বৈঠকে জেনারেল সিদ্দিক প্রথম আলোর সাংবাদিক ডাকতে নিষেধ করেছিলেন, তাঁর বক্তব্যে লিমনকে পঙ্গু করার ঘটনাসহ র্যাবের সব কাজের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন ও প্রথম আলোকে র্যাবের বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত (৪০ দিনে ৪৮টা খবর) খবর প্রকাশের জন্য অভিযোগ প্রকাশই ছিল মুখ্য বিষয়।
র্যাবের বিষয়টি কেবল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বিচার্য হতে পারে না। আরও বড় প্রেক্ষাপটে এটি বিবেচনার বিষয়।
এ কথা সত্য, র্যাবের মতো একটি এলিট স্ট্রাইক ফোর্সের প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষ বোধ করেছে বহুকাল ধরে। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকেই, বিশেষত সামরিক স্বৈরশাসনের সময়, ধাপে ধাপে দেশে একদিকে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে আর অন্যদিকে অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কেবল প্রলম্বিত হয়নি, অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক দলে, ছাত্রসংগঠনে, রাজনীতি-সম্পৃক্ত অঙ্গ দলে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, প্রশাসনে ব্যাপক হারে অপরাধ-সংশ্লিষ্টতা বাড়তে বাড়তে প্রায় স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাধারণ মানুষের পক্ষে, এমনকি উচ্চবিত্ত পরিবারের পক্ষেও খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ, লুট, দখল ইত্যাদির শিকার হয়ে এসব গুরুতর জঘন্য অপরাধের বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই অবস্থায় মানুষ প্রচলিত আইন ও বিধিব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাতে থাকে। অর্থাৎ সমাজ ও সরকারের বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তি ও কার্যকারিতা ক্ষয় পেতে থাকে। এই বাস্তবতা জনগণ ও সরকার উভয়কেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে উদ্বুদ্ধ করে। অনেক সময় মরিয়া হয়ে (আউট অব ডেসপারেশন) মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে প্রতিশোধের পথ ধরে। আমার ধারণা, অপরাধ ও বিচারহীনতার যে বাস্তবতায় দীর্ঘকাল কাটাচ্ছে মানুষ, সেই অভিজ্ঞতা তাকে র্যাবের মতো একটি এলিট স্ট্রাইক ফোর্সের সমর্থক করে তুলেছে। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার দাবি যে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ র্যাবকে সমর্থন করে, তা এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে হয়তো অতিরঞ্জন নাও হতে পারে। কিন্তু এটা স্বাভাবিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোর ব্যাপকতা কতটা, তা-ই বোঝাতে পারে সহজে। র্যাবের প্রতি নিরাপত্তা উপদেষ্টার ঢালাও সমর্থনও একই মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটায়।
কিন্তু কথা হলো, দীর্ঘ অব্যবস্থায় সৃষ্ট বাস্তবতায় যে মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়েছে এবং যে বিশেষ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে, তাকে আমরা বিশেষ এবং তা-ই সাময়িক, আপৎকালীন ব্যবস্থা মনে করছি কি না। আমরা দিনে দিনে কেবলই এ রকম বিশেষ বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি কি না। কিংবা এ বাহিনীকে মাঠে রেখে একেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমানোর স্বাভাবিক ব্যবস্থা ধরে নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ ও উপযুক্ত করার কাজকে অবহেলা করছি কি না। আমরা ভেঙে-পড়া প্রায় অকার্যকর বিচারব্যবস্থাকে কার্যকর ও দক্ষ করে তুলছি কি না।
এ বিষয়গুলো ভাবা জরুরি। কারণ, বিশেষ ফোর্সের মর্যাদা রক্ষা করা উচিত, তাকে চোর-ডাকাত ধরার কাজে ব্যবহার করলে পুলিশ ও র্যাবে মানুষ গুলিয়ে ফেলবে। তা ছাড়া র্যাব সদস্যরা এভাবে ব্যবহূত হতে হতে তাঁদের বিশেষ মর্যাদা ও ভূমিকার কথা মনে রাখতে পারবেন না। অন্তত তানভির সিদ্দিক র্যাব সদস্যদের অপরাধ ও শাস্তির যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে আশঙ্কাটা প্রকাশ না করে পারা যায় না। গত সাত বছরে এক হাজার ১৪৭ জনের শাস্তি, ৬৭ জনের চাকরিচ্যুতি ও ১৬ জনের কারাদণ্ড র্যাবের সদস্যসংখ্যার অনুপাতে নেহাত কম নয়। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানাচ্ছেন, কেবল গত বছরই র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় এক হাজার ১০০ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ে এ কারণে যে সরকার র্যাবের ওপর যেভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বাভাবিক ফোর্স পুলিশ বাহিনী এ বিষয়ে এক নম্বর ফোর্সের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি হারাচ্ছে আর অন্যদিকে স্পেশাল ফোর্সের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি অর্ডিনারি ফোর্সের মতো হয়ে যাচ্ছে। এ কাজটা সরকারের করা উচিত কি না, তা ভেবে দেখতে বলব।
এতে আরও একটা ক্ষতি হয়। র্যাবের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকায় পুলিশি ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধ নির্মূলের প্রক্রিয়ার কোনো উন্নতি হয়নি। দেখা গেছে, র্যাবের অপারেশন শুরু হওয়ার পর গত সাত বছরে সহস্রাধিক অপরাধী মারা পড়লেও অপরাধের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। দুঃখের বিষয়, সাধারণ মানুষের মনে র্যাবও স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। এখন এই অশান্তির আগুনে জ্বলে ভুক্তভোগী মানুষ যদি র্যাবকেও পর্যাপ্ত মনে না করে, র্যাবকেও অকার্যকর মনে করতে শুরু করে, তখন কী হবে? তাহলে বুঝতে হবে, অপরাধ দমনের প্রক্রিয়া এটি নয়। কেবল এ প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে ‘এনকাউন্টার’ বাড়বে। বাহিনীগুলো মৃত্যুর ফাঁদ পেতে কার্যকর হতে চাইবে। তাতে বিতর্কও বাড়বে। অপরাধও কমবে না।
এখন আমরা যদি সমস্যার মূলে না গিয়ে কেবল র্যাব-পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হতে থাকি, তাহলে একদিকে সমস্যা কেবল জটিল হবে ও বাড়বে আর অন্যদিকে র্যাব-পুলিশ ক্রমাগত ও ক্রমবর্ধমান হারে অভিযান চালিয়ে বদনামের ভাগীদার হবে। কারণ, নির্বিচারে অভিযান চালাতে হলে ভুল হবে, ভুল বাড়বে।
তাহলে সমস্যার মূল কোথায়? এভাবে বিষয়টাকে সাজানো যায়—
১. আমাদের রাজনীতি নীতিহীন, অপরাধপ্রবণ, ক্ষমতা-অন্ধ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
২. আমাদের প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত, পক্ষপাতদুষ্ট ও ঢিলেঢালা।
৩. আমাদের সমাজের ঐতিহ্যগত বন্ধন ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এর স্বাভাবিক অভিভাবকত্ব অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
৪. সামগ্রিকভাবে মানুষের নৈতিকতার মান নেমে গেছে এবং এ সমাজ অপরাধ ও অপরাধীর সঙ্গে আপস করে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
৫. টাকা ও ক্ষমতার দাপটের কাছে সব প্রতিষ্ঠান ও নীতি বশীভূত ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
কোনো সমাজের নীতিনৈতিকতার সাধারণ মান কেমন, তা নির্ভর করে ওপরে বর্ণিত বাস্তবতাগুলো কেমন তার ওপর। নির্দ্বিধায় আমাদের সমাজকে অবক্ষয়িত ও অধঃপতিত সমাজ বলা যাবে। সমাজের নৈতিক-মানবিক মানোন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো হওয়া প্রয়োজন, তা কি হচ্ছে?
এ কথা মানতে হবে, সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য সঠিক পথেই এগোচ্ছে। আমরা আশা নিয়ে এই দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু সমাজের নৈতিকতার মান এবং সামগ্রিকভাবে সব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যদি কাজ না হয়, তাহলে শিক্ষার কাজ থেকেও অভীষ্ট ফল আসবে না। সরকার, অর্থাৎ সরকারি দলের ভেতর থেকেই শুদ্ধির কাজটি শুরু হতে হবে। শেয়ার কেলেঙ্কারির ইস্যুতে বিরোধী দলহীন জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সাংসদেরাই তো অভিযোগের আঙুল তুলেছেন নিজ দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে (তাঁদের ভাষায় আওয়ামী লীগ নামধারী)। দুর্নীতি, অপরাধ, জবরদস্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অস্বচ্ছতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া যদি সরকারি দল থেকে শুরু না হয়, তাহলে কেবল র্যাব নয়, সামরিক বাহিনী নিয়োগ করেও উদ্ধার পাওয়া যাবে না। অতীতে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটেছে। আজকে নীতিনৈতিকতার দিক থেকে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ সমাজের কোন অংশটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে রয়েছে? সবাইকে বিতর্কিত করে রেখে, বিতর্কিত হতে দিয়ে কেবল র্যাবকে অতিরিক্ত খাটাতে থাকলে তাদের অতিরিক্ত বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকিতেই ফেলা হবে।
পত্রিকার সম্পাদক বা পত্রিকাকে ভয় দেখিয়ে বা ‘ব্যবস্থা নিয়ে’ যদি মুখ বন্ধও করা যায়, তাতেও কিন্তু ফায়দা কিছু হবে না। সরকার যদি শেয়ার কেলেঙ্কারির মতো বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে, টেন্ডারবাজি-দখলদারির পুরোনো অপরাধবৃত্ত থেকে দলের নেতা-কর্মীদের বের করে আনতে না পারে, তবে তাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে আর তাদের সেবা দিয়ে র্যাবও বিতর্কের বাইরে থাকতে পারবে না। সরকার যখন কঠোর সমালোচনার হাত থেকে রেহাই চায়, যখন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বললে কুপিত হয়, তখন সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। র্যাব ও সরকার যদি তাদের কর্মকাণ্ডকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখতে চায়, তখন ভুক্তভোগী জনগণ কি সত্যোদ্ঘাটনের জন্য পত্রিকার মুখাপেক্ষী হবে না? সরকার কি বোঝে, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের ওপর আশা ও ভরসা হারিয়ে মানুষ দিনে দিনে অনেক ক্ষেত্রেই পত্রিকার ওপর নির্ভর করতে চাইছে? পত্রিকা না চাইলেও অনেক সময় উপেক্ষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত প্রান্তিক মানুষের পাশে পত্রিকাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। সরকার ও পত্রিকার পরিপূরকতার ধারণা ও সংস্কৃতিকে জোরদার করতে পারলেই রাজনীতি, গণতন্ত্র, সরকারসহ দেশ উপকৃত হতো। কিন্তু রাজনীতি যদি অপরাধের সঙ্গে আপস করে চলে, তবে সরকারের পক্ষে যথার্থ ভূমিকা পালন কঠিন বৈকি। তখন সরকারের মধ্যে একধরনের অন্ধ পক্ষপাতিত্ব তৈরি হয়। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স বইয়ে এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘আমি বা আমার লোকেরাই সব, এই একটিমাত্র একাত্মতা যখন অন্য একাত্মতাকে দমিয়ে বা দাবিয়ে রাখে, তখনই সমস্যা তৈরি হয়।’ ক্ষমতা অপরাধের সঙ্গে একাত্মতায় জড়িয়ে গেলে সমস্যা গভীরতর হয় বৈকি।
একেবারে হতাশার কথা বলব না। কেননা সংসদে বেশ কিছু কণ্ঠস্বর এখন শোনা যাচ্ছে, যাঁরা সরকারি দলের রাঘববোয়াল-চুনোপুঁটি অনেকের অন্যায় ও অপরাধ নিয়ে কথা বলছেন। নিশ্চয় সংসদের বাইরেও এ রকম কণ্ঠস্বর আছে, যা ধীরে ধীরে শোনা যাবে। তাঁদের জন্য মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। গান্ধীজি বলেছেন, সাতটি গুরুতর পাপ আছে—নীতিহীন বাণিজ্য, বিবেক ছাড়া উপভোগ, আদর্শহীন রাজনীতি, চরিত্র ছাড়া জ্ঞান, মানবতা ব্যতীত বিজ্ঞান, কাজ ছাড়া সম্পদ, ত্যাগ ছাড়া ধর্মসাধনা।
সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এই মহাত্মা-কথিত পাপ আমাদের কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে।
এর থেকে উদ্ধারের পথ র্যাবের অভিযানেও নেই, র্যাবের সমালোচক পত্রিকার বিরুদ্ধে লেগেও মিলবে না। বিষয়টা আরও বড় ও গভীর। আওয়ামী লীগের প্রবীণ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাখঢাক না করে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’। সেদিকে নজর দেওয়ার কি সময় এখনো আসেনি?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
র্যাবের বিষয়টি কেবল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বিচার্য হতে পারে না। আরও বড় প্রেক্ষাপটে এটি বিবেচনার বিষয়।
এ কথা সত্য, র্যাবের মতো একটি এলিট স্ট্রাইক ফোর্সের প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষ বোধ করেছে বহুকাল ধরে। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকেই, বিশেষত সামরিক স্বৈরশাসনের সময়, ধাপে ধাপে দেশে একদিকে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে আর অন্যদিকে অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কেবল প্রলম্বিত হয়নি, অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক দলে, ছাত্রসংগঠনে, রাজনীতি-সম্পৃক্ত অঙ্গ দলে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, প্রশাসনে ব্যাপক হারে অপরাধ-সংশ্লিষ্টতা বাড়তে বাড়তে প্রায় স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাধারণ মানুষের পক্ষে, এমনকি উচ্চবিত্ত পরিবারের পক্ষেও খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ, লুট, দখল ইত্যাদির শিকার হয়ে এসব গুরুতর জঘন্য অপরাধের বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই অবস্থায় মানুষ প্রচলিত আইন ও বিধিব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাতে থাকে। অর্থাৎ সমাজ ও সরকারের বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তি ও কার্যকারিতা ক্ষয় পেতে থাকে। এই বাস্তবতা জনগণ ও সরকার উভয়কেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে উদ্বুদ্ধ করে। অনেক সময় মরিয়া হয়ে (আউট অব ডেসপারেশন) মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে প্রতিশোধের পথ ধরে। আমার ধারণা, অপরাধ ও বিচারহীনতার যে বাস্তবতায় দীর্ঘকাল কাটাচ্ছে মানুষ, সেই অভিজ্ঞতা তাকে র্যাবের মতো একটি এলিট স্ট্রাইক ফোর্সের সমর্থক করে তুলেছে। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার দাবি যে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ র্যাবকে সমর্থন করে, তা এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে হয়তো অতিরঞ্জন নাও হতে পারে। কিন্তু এটা স্বাভাবিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোর ব্যাপকতা কতটা, তা-ই বোঝাতে পারে সহজে। র্যাবের প্রতি নিরাপত্তা উপদেষ্টার ঢালাও সমর্থনও একই মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটায়।
কিন্তু কথা হলো, দীর্ঘ অব্যবস্থায় সৃষ্ট বাস্তবতায় যে মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়েছে এবং যে বিশেষ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে, তাকে আমরা বিশেষ এবং তা-ই সাময়িক, আপৎকালীন ব্যবস্থা মনে করছি কি না। আমরা দিনে দিনে কেবলই এ রকম বিশেষ বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি কি না। কিংবা এ বাহিনীকে মাঠে রেখে একেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমানোর স্বাভাবিক ব্যবস্থা ধরে নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ ও উপযুক্ত করার কাজকে অবহেলা করছি কি না। আমরা ভেঙে-পড়া প্রায় অকার্যকর বিচারব্যবস্থাকে কার্যকর ও দক্ষ করে তুলছি কি না।
এ বিষয়গুলো ভাবা জরুরি। কারণ, বিশেষ ফোর্সের মর্যাদা রক্ষা করা উচিত, তাকে চোর-ডাকাত ধরার কাজে ব্যবহার করলে পুলিশ ও র্যাবে মানুষ গুলিয়ে ফেলবে। তা ছাড়া র্যাব সদস্যরা এভাবে ব্যবহূত হতে হতে তাঁদের বিশেষ মর্যাদা ও ভূমিকার কথা মনে রাখতে পারবেন না। অন্তত তানভির সিদ্দিক র্যাব সদস্যদের অপরাধ ও শাস্তির যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে আশঙ্কাটা প্রকাশ না করে পারা যায় না। গত সাত বছরে এক হাজার ১৪৭ জনের শাস্তি, ৬৭ জনের চাকরিচ্যুতি ও ১৬ জনের কারাদণ্ড র্যাবের সদস্যসংখ্যার অনুপাতে নেহাত কম নয়। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানাচ্ছেন, কেবল গত বছরই র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় এক হাজার ১০০ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ে এ কারণে যে সরকার র্যাবের ওপর যেভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, তাতে একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বাভাবিক ফোর্স পুলিশ বাহিনী এ বিষয়ে এক নম্বর ফোর্সের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি হারাচ্ছে আর অন্যদিকে স্পেশাল ফোর্সের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি অর্ডিনারি ফোর্সের মতো হয়ে যাচ্ছে। এ কাজটা সরকারের করা উচিত কি না, তা ভেবে দেখতে বলব।
এতে আরও একটা ক্ষতি হয়। র্যাবের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকায় পুলিশি ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধ নির্মূলের প্রক্রিয়ার কোনো উন্নতি হয়নি। দেখা গেছে, র্যাবের অপারেশন শুরু হওয়ার পর গত সাত বছরে সহস্রাধিক অপরাধী মারা পড়লেও অপরাধের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। দুঃখের বিষয়, সাধারণ মানুষের মনে র্যাবও স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। এখন এই অশান্তির আগুনে জ্বলে ভুক্তভোগী মানুষ যদি র্যাবকেও পর্যাপ্ত মনে না করে, র্যাবকেও অকার্যকর মনে করতে শুরু করে, তখন কী হবে? তাহলে বুঝতে হবে, অপরাধ দমনের প্রক্রিয়া এটি নয়। কেবল এ প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে ‘এনকাউন্টার’ বাড়বে। বাহিনীগুলো মৃত্যুর ফাঁদ পেতে কার্যকর হতে চাইবে। তাতে বিতর্কও বাড়বে। অপরাধও কমবে না।
এখন আমরা যদি সমস্যার মূলে না গিয়ে কেবল র্যাব-পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হতে থাকি, তাহলে একদিকে সমস্যা কেবল জটিল হবে ও বাড়বে আর অন্যদিকে র্যাব-পুলিশ ক্রমাগত ও ক্রমবর্ধমান হারে অভিযান চালিয়ে বদনামের ভাগীদার হবে। কারণ, নির্বিচারে অভিযান চালাতে হলে ভুল হবে, ভুল বাড়বে।
তাহলে সমস্যার মূল কোথায়? এভাবে বিষয়টাকে সাজানো যায়—
১. আমাদের রাজনীতি নীতিহীন, অপরাধপ্রবণ, ক্ষমতা-অন্ধ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
২. আমাদের প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত, পক্ষপাতদুষ্ট ও ঢিলেঢালা।
৩. আমাদের সমাজের ঐতিহ্যগত বন্ধন ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এর স্বাভাবিক অভিভাবকত্ব অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
৪. সামগ্রিকভাবে মানুষের নৈতিকতার মান নেমে গেছে এবং এ সমাজ অপরাধ ও অপরাধীর সঙ্গে আপস করে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
৫. টাকা ও ক্ষমতার দাপটের কাছে সব প্রতিষ্ঠান ও নীতি বশীভূত ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
কোনো সমাজের নীতিনৈতিকতার সাধারণ মান কেমন, তা নির্ভর করে ওপরে বর্ণিত বাস্তবতাগুলো কেমন তার ওপর। নির্দ্বিধায় আমাদের সমাজকে অবক্ষয়িত ও অধঃপতিত সমাজ বলা যাবে। সমাজের নৈতিক-মানবিক মানোন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো হওয়া প্রয়োজন, তা কি হচ্ছে?
এ কথা মানতে হবে, সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য সঠিক পথেই এগোচ্ছে। আমরা আশা নিয়ে এই দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু সমাজের নৈতিকতার মান এবং সামগ্রিকভাবে সব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যদি কাজ না হয়, তাহলে শিক্ষার কাজ থেকেও অভীষ্ট ফল আসবে না। সরকার, অর্থাৎ সরকারি দলের ভেতর থেকেই শুদ্ধির কাজটি শুরু হতে হবে। শেয়ার কেলেঙ্কারির ইস্যুতে বিরোধী দলহীন জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সাংসদেরাই তো অভিযোগের আঙুল তুলেছেন নিজ দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে (তাঁদের ভাষায় আওয়ামী লীগ নামধারী)। দুর্নীতি, অপরাধ, জবরদস্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অস্বচ্ছতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া যদি সরকারি দল থেকে শুরু না হয়, তাহলে কেবল র্যাব নয়, সামরিক বাহিনী নিয়োগ করেও উদ্ধার পাওয়া যাবে না। অতীতে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটেছে। আজকে নীতিনৈতিকতার দিক থেকে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ সমাজের কোন অংশটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে রয়েছে? সবাইকে বিতর্কিত করে রেখে, বিতর্কিত হতে দিয়ে কেবল র্যাবকে অতিরিক্ত খাটাতে থাকলে তাদের অতিরিক্ত বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকিতেই ফেলা হবে।
পত্রিকার সম্পাদক বা পত্রিকাকে ভয় দেখিয়ে বা ‘ব্যবস্থা নিয়ে’ যদি মুখ বন্ধও করা যায়, তাতেও কিন্তু ফায়দা কিছু হবে না। সরকার যদি শেয়ার কেলেঙ্কারির মতো বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে, টেন্ডারবাজি-দখলদারির পুরোনো অপরাধবৃত্ত থেকে দলের নেতা-কর্মীদের বের করে আনতে না পারে, তবে তাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে আর তাদের সেবা দিয়ে র্যাবও বিতর্কের বাইরে থাকতে পারবে না। সরকার যখন কঠোর সমালোচনার হাত থেকে রেহাই চায়, যখন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বললে কুপিত হয়, তখন সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। র্যাব ও সরকার যদি তাদের কর্মকাণ্ডকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখতে চায়, তখন ভুক্তভোগী জনগণ কি সত্যোদ্ঘাটনের জন্য পত্রিকার মুখাপেক্ষী হবে না? সরকার কি বোঝে, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের ওপর আশা ও ভরসা হারিয়ে মানুষ দিনে দিনে অনেক ক্ষেত্রেই পত্রিকার ওপর নির্ভর করতে চাইছে? পত্রিকা না চাইলেও অনেক সময় উপেক্ষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত প্রান্তিক মানুষের পাশে পত্রিকাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। সরকার ও পত্রিকার পরিপূরকতার ধারণা ও সংস্কৃতিকে জোরদার করতে পারলেই রাজনীতি, গণতন্ত্র, সরকারসহ দেশ উপকৃত হতো। কিন্তু রাজনীতি যদি অপরাধের সঙ্গে আপস করে চলে, তবে সরকারের পক্ষে যথার্থ ভূমিকা পালন কঠিন বৈকি। তখন সরকারের মধ্যে একধরনের অন্ধ পক্ষপাতিত্ব তৈরি হয়। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স বইয়ে এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘আমি বা আমার লোকেরাই সব, এই একটিমাত্র একাত্মতা যখন অন্য একাত্মতাকে দমিয়ে বা দাবিয়ে রাখে, তখনই সমস্যা তৈরি হয়।’ ক্ষমতা অপরাধের সঙ্গে একাত্মতায় জড়িয়ে গেলে সমস্যা গভীরতর হয় বৈকি।
একেবারে হতাশার কথা বলব না। কেননা সংসদে বেশ কিছু কণ্ঠস্বর এখন শোনা যাচ্ছে, যাঁরা সরকারি দলের রাঘববোয়াল-চুনোপুঁটি অনেকের অন্যায় ও অপরাধ নিয়ে কথা বলছেন। নিশ্চয় সংসদের বাইরেও এ রকম কণ্ঠস্বর আছে, যা ধীরে ধীরে শোনা যাবে। তাঁদের জন্য মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। গান্ধীজি বলেছেন, সাতটি গুরুতর পাপ আছে—নীতিহীন বাণিজ্য, বিবেক ছাড়া উপভোগ, আদর্শহীন রাজনীতি, চরিত্র ছাড়া জ্ঞান, মানবতা ব্যতীত বিজ্ঞান, কাজ ছাড়া সম্পদ, ত্যাগ ছাড়া ধর্মসাধনা।
সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এই মহাত্মা-কথিত পাপ আমাদের কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে।
এর থেকে উদ্ধারের পথ র্যাবের অভিযানেও নেই, র্যাবের সমালোচক পত্রিকার বিরুদ্ধে লেগেও মিলবে না। বিষয়টা আরও বড় ও গভীর। আওয়ামী লীগের প্রবীণ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাখঢাক না করে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’। সেদিকে নজর দেওয়ার কি সময় এখনো আসেনি?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments