প্রতিক্রিয়া-জাপানি বালক এবং আমরা by মোস্তাক আহমেদ ও ইসহাক চৌধুরী

প্রথম আলোয় ১৭ মে প্রকাশিত অধ্যাপক শেখ আবদুস সালামের লেখা ‘জাপানি বালক, তোমাকে স্যালুট’ পড়ে মুগ্ধ হলাম। সেই সঙ্গে জাপানি ন্যায়বোধ আর শ্রেয়বোধের নিখাদ কর্মতৎপরতার দুটো ছোট্ট ঘটনা যোগ করার জন্যই আমার এ লেখা। পত্রিকান্তরে প্রকাশ একটা, আর অন্যটা এক বন্ধুর নিজ অভিজ্ঞতা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কপথে দাউদকান্দি-কাঁচপুরের মাঝে মেঘনা নদীর ওপর যে সেতুটি করা হয়েছে, তা জাপানি অর্থে নির্মিত। এ সেতুটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধন করতে এসে এত বড় সেতুর এত কম প্রশস্ততা দেখে দেশে ফিরে গিয়ে নাকি জাপানি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। এত ব্যস্ত সড়কে, এত ব্যয়ে নির্মিত একটা সেতু এত অপ্রশস্ত কেন হবে—এটাই উষ্মার কারণ!
অধ্যাপক সালামের সেই বালকের কাহিনি বলতে গিয়ে আমার বন্ধু শোনালেন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার যে গল্প, সেটাতে পাওয়া যায় জাপানিদের নিখাদ শুদ্ধতার পরিচয়। আমার ওই বন্ধু বিশ্বখ্যাত এক শিপিং কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়ার। একবার জাহাজ নিয়ে জাপানের কোনো বন্দরে পৌঁছালে নিয়মমাফিক বন্দরের জাপানি টেকনিশিয়ানরা জাহাজের ইঞ্জিনে আসেন। চিফ ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের কাজ তদারক করতে উপস্থিত হলে তাঁরা জানান, ‘চিফ, তোমার কষ্ট করে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই, তুমি না থাকলেও যা যা প্রয়োজন, আমরা করে দেব—নিশ্চিন্তে থাকো।’ আশ্বাস পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার তাঁর রুমে চলে আসেন। কাজ শেষে এক টেকনিশিয়ান চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা করে জানান, ‘চিফ, তোমার ইঞ্জিনরুমের এক মেশিনে একটি নাট নষ্ট ছিল, ওটা বদলে দিয়েছি, কিন্তু দুঃখিত, অরিজিনালটা ছিল স্টেইনলেস স্টিলের, আমাদের কাছে ও ধরনের নাট এখন নেই, তাই অন্য মানের একটি নাট লাগিয়ে দিলাম। তিন-চার সপ্তাহ পরে তুমি জাহাজ নিয়ে আবার এলে আমরা ওটা বদলে স্টেইনলেস স্টিলের নাট লাগিয়ে দেব।’ বন্ধু বললেন, ‘এটা যদি ওরা না বলত, তাহলে আমি হয়তো জানতেও পারতাম না।’ এবং অবাক ঘটনা, শ্রেয়বোধে শুদ্ধ জাপানি টেকনিশিয়ানরা তিন-চার সপ্তাহ পর জাহাজ নিয়ে ওই বন্দরে গেলে তাঁরা ওই নাট বদলে স্টেইনলেস স্টিলের নাট লাগিয়ে দিয়েছিলেন!
টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির (টেপকো) কর্মকর্তাদের ভূমিকম্প, সুনামি-আক্রান্তদের আশ্রয়শিবিরে গিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নের জন্য মাথা নিচু করে দুঃখ প্রকাশ করার ছবিও প্রথম আলোয় দেখলাম কিছুদিন আগে। মনে বড় আশা হয়, ওই বালকের মতো, ওই টেকনিশিয়ানদের মতো অথবা টেপকোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতো বেশ কিছু লোক যদি আমরা পেতাম!
প্রথম আলোকে অনুরোধ, এ ধরনের মানবিকতা, সিভিকভারচ্যু ও শ্রেয়বোধের পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের ঘটনা ছাপিয়ে যেতে। এতে যদি কিছুমাত্র শুদ্ধতায় আমরা স্নাত হই, সেটাই হবে আমাদের পরম পাওয়া।
ইসহাক চৌধুরী, মণিপুরীপাড়া, তেজগাঁও, ঢাকা।
ishaq_52@yahoo.com

২.
জীবনে প্রতিটি আলোচনায় আমরা উদাহরণ প্রয়োগ করি। উদাহরণ ব্যতীত কোনো কিছুরই সঠিক শিক্ষা বা প্রয়োগ হয় না। গত ১৭ মে যাঁরা প্রথম আলোয় ‘জাপানি বালক, তোমাকে স্যালুট’ শীর্ষক কলামটি পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, ঘটনাটি শুধুই একটি উদাহরণ নয়। মানুষের তরে মানুষ অথবা জীবনের জন্য জীবন—কথাগুলো আমরা সব সময় শুনি ও বলি। কিন্তু কতজন এই উক্তি পালন করি! আমরা গরিবের চাল-ডাল ভাগাভাগি করে খাই, গরিবের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করি। মানুষকে ঠকিয়ে খাওয়াই আজ মানুষের কাজ।
লেখক মূল গল্পে আসার আগে বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। ওই জাপানি বালকটির কাছে বাংলাদেশের এই উদাহরণগুলো ম্লান হয়ে গেছে। যে জাপান শতাব্দীর ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরও পদ্মা সেতুর নির্মাণ-সহায়তা বাতিল করেনি, তার জনগণ হিসেবে ওই বালকটির এমন উদাহরণই সম্ভব। লেখাটি আমাদের অনেক ভাবিয়েছে। প্রতিদিন রাজনৈতিক দলের দলাদলি-জাতীয় কলাম যাঁরা পড়তে পড়তে ক্লান্ত, ওই কলামটি তাঁদের একটু শান্তি দিয়েছে, হয়তো বা কাঁদিয়েছে। অনেক পাঠকই হয়তো বা সেদিন ওই পুলিশ সদস্যের মতো কান্না লুকানোর জন্য চেষ্টা করেছিলেন। একটি বালক স্কুলের বারান্দা থেকে দেখল, তার বাবা গাড়ি করে তাকে নিতে আসছেন। কিন্তু চোখের পলকেই স্রোতের টানে তার বাবা উধাও, তেমনি উপকূলের একটি সুন্দর বাড়ি থেকে স্রোতের টানে ভেসে গেছে তার ভাইবোন। পরিবার হারানো হূদয়ভাঙা বালকটি খাবারের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তার খাবার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। একজন পুলিশ সদস্য তার কাহিনি শুনলেন এবং তাঁর নিজের খাবারের প্যাকেটটি তাকে দিলেন। কিন্তু বালকটি ঘটাল একটি অবাক কাণ্ড! সে খাবারের প্যাকেটটি যথাস্থানে রেখে এসে নিজের লাইনে দাঁড়াল। কিন্তু সে জানত, তার খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। পুলিশ বালকটির এমন ঘটনার কারণ জানতে চাইলে সে যে জবাব দেয়, তাতে ওই পুলিশ সদস্য কেঁদে ফেলেছিলেন। আমি ঘটনাটি লিখলাম, কেননা আমাদের প্রত্যেকেরই এটা পড়া দরকার। মানুষ তার নিজের দেশের প্রতি, নিজের প্রতি কতটুকু কর্তব্যবোধ থাকলে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব। পাঠকেরা, নিজের দেশকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, নিজের দেশের জনগণকে কীভাবে আপন করা যায়।
আমাদের দেশে প্রতিবছর বন্যাসহ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। এতে খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য আসে কিন্তু তার বেশির ভাগই চলে যায় মুষ্টিমেয় লোকের কাছে। সেই লোকগুলো ধনী শ্রেণীর, আবার শিক্ষিতও বটে। আমি তাঁদের বলব, আপনারা ওই বালকটির দিকে তাকান, যে মা-বাবা, বোন হারিয়েও হাসিমুখে দেশের জনগণের জন্য ক্ষুধা সহ্য করতে পারে, তবে আপনি কেন পারবেন না। আপনার দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিন। দামি গাড়িতে চড়ে আপনার সন্তানকে দামি স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। পথে নিশ্চয়ই আপনার সন্তানের মতো অন্য সন্তানদেরও দেখেন। তাদের কাছে যান না তাদের শরীরে গন্ধ বলে, তাদের সঙ্গে কথা বলেন না তাদের মুখে গন্ধ বলে, তাদের দাম দেন না তাদের গায়ে দামি কাপড় নেই বলে। অথচ ওরা আপনার সন্তান না হলেও আমাদের দেশের সন্তান। আর এই সন্তানদের যদি সুযোগ-সুবিধা না দেন, তবে আমরা কোনো দিন এই মানবতার জয়গান গাইতে পারব না।
মোস্তাক আহমেদ
শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.