মুখোমুখি মুক্তিযুদ্ধের দুই অধিনায়ক জে এফ আর জ্যাকব এবং এ কে খন্দকারপাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের নানা তথ্য-মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে by মিজানুর রহমান খান
সাক্ষাৎ হতেই তাঁরা দুজন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম আলোর আয়োজনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুই অধিনায়ক গতকাল রোববার মুখোমুখি হয়েছিলেন রূপসী বাংলা হোটেলের বিজনেস সেন্টারে। তাঁরা হলেন, একাত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল (অব.) জ্যাক ফ্রেডেরিক রালফ জ্যাকব এবং একাত্তরে
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপ-অধিনায়ক বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার।
জ্যাকব ৯০ ছুঁইছেন। খন্দকার ৮২। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের রেসকোর্সের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কথা শীর্ষ দুই কুশীলব স্মৃতিচারণা করলেন। জ্যাকব বললেন, খন্দকারই বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। একই সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রত্যুত্তরে খন্দকার জেনারেল জ্যাকবের বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান স্মরণ করলেন। বললেন, জেনারেল জ্যাকব সব সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকেই বড় করে দেখেছেন।
তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। যেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন যৌথ বাহিনীর সদর দপ্তর। গতকাল রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টা ৪৫—এই ৭৫ মিনিটে দুই বীর সেনানী স্মৃতিচারণা করলেন মুক্তিযুদ্ধের কিছু দিক, ৪০ বছর পরে। এই প্রাণবন্ত আলোচনায় সূত্রধর হয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ইতিহাসের একটি তথ্যের পর্দা নতুন করে উন্মোচিত হলো। সেটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী কেন রেসকোর্সের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না, সে বিষয়টি।
কমরেড ও স্যার: দুজনের একান্ত সাক্ষাতের আগেও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। জেনারেল জ্যাকব এ কে খন্দকারকে বন্ধু ও কমরেড বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। খন্দকার অবশ্য ফৌজি রীতি অনুযায়ী তাঁকে এখনো স্যার হিসেবেই সম্বোধন করেন, মন্ত্রী হয়েও এর হেরফের নেই। তবে এ প্রসঙ্গে তিনি একটি মধুর স্মৃতি স্মরণ করেন। জেনারেল অরোরা ১৬ ডিসেম্বরে দমদমে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক বিবেচনায় তাঁকে আগে বিমানে উঠিয়েছিলেন। অরোরা পরে ওঠেন।
জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে দিল্লি ও ঢাকায় এই প্রতিবেদকের যখনই দেখা হয়েছে, তখনই তিনি খন্দকারের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গতকালের রূপসী বাংলাতেও তার ছাপ ছিল। জ্যাকব তাঁর সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা বইয়ে লিখেছেন, ‘ওসমানীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন উইং কমান্ডার খন্দকার। তিনি ছিলেন মার্জিত স্বভাবের দক্ষ অফিসার। যেকোনো সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বাস্তবানুগ। জরুরি কাজ আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন খোলা মনের অধিকারী, যে কারণে তাঁর সঙ্গে কাজ করা সহজ ছিল।’
১৯৯৭ সালে জ্যাকবের এই লেখা সম্পর্কে এ কে খন্দকার গতকালই অবহিত হন। তাঁর স্মৃতিচারণামূলক কোনো বই লেখা হয়নি। কারণ, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত পরিবর্তনের পরে তিনি সরকারের কাছে পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। বিচারপতি সায়েম তাঁকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার করে পাঠান ১৯৭৬ সালে। বোনের বাসায় একটি চামড়ার স্যুটকেসে তাঁর যুদ্ধকালীন ডায়েরি, নোটস ও ছবি সযত্নে রাখা ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সাড়ে ছয় বছর ও সেখান থেকে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে আরও কয়েক বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে দেখেন, টিনের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে সব নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বই লেখা আর হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসায় সরব: তবে প্রশ্নের জবাবে জেনারেল জ্যাকবের যুদ্ধকালীন অনেক প্রসঙ্গই সামনে টেনে এনে খন্দকার বলেন, জেনারেল জ্যাকব শুরু থেকেই বলতেন, মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ময়কর সাফল্য দেখাচ্ছে। লক্ষ করেছি, এই একটি বিষয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুনর্ব্যক্ত করতে জ্যাকবের উৎসাহের কোনো কমতি নেই। গতকালও তিনি অকপটে বললেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ তাদের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর আমরা তাদের সহায়তা দিয়েছিলাম।’
এ কে খন্দকার বলেন, জ্যাকব মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে ‘ওয়ান্ডারফুল জব’ কথাটি ব্যবহার করতেন। আমি এ কথা তাঁর মুখে বহুবার শুনেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জ্যাকবের কাছে যখন যে জিনিসই চাওয়া হয়েছে, তা-ই তিনি দিতে রাজি ছিলেন। হয়তো কখনো বলেছেন, সময় লাগবে কিছুটা। অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের অন্যান্য রসদ জোগাতে তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। এককথায় জ্যাকবকে আমি সব সময় ইতিবাচক দেখেছি। ফোর্ট উইলিয়ামসে আমি অনেকবার গিয়েছি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে টার্গেটস, স্ট্র্যাটেজি ইত্যাদি আলোচনায় আমিই অংশ নিয়েছি। ওসমানীর অংশগ্রহণ মনে পড়ে না। এসব আলোচনায় জ্যাকব থাকতেন।
হেলিকপ্টার রহস্য: দুই অধিনায়ক একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যাঁরা উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই দুজনই শুধু বেঁচে আছেন। খন্দকারই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এই বিষয়ে জেনারেল জ্যাকব ও এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারের বিবরণে একটু তফাৎ লক্ষণীয়। জ্যাকব গতকালের আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে বলেন, ওসমানী অনেক সময় সদর দপ্তরে থাকতেন না। তিনি সিলেট অঞ্চলে ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন গঠনে ব্যস্ত থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠনে তাঁর আগ্রহ সঠিক ছিল না। কারণ, কর্মক্ষম সেনাবাহিনী গঠনে দীর্ঘ সময়ের দরকার পড়ে। এ কে খন্দকার তাঁর সঙ্গে দ্রুত একমত হন।
জ্যাকব তাঁর বইয়ে ও প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একাধিকবার বলেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বরে ঢাকায় তিনি তাঁর কর্মকর্তা মি. সেথনাকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানী ও খন্দকারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আদেশ দিয়েছিলেন। ওসমানীকে আনতে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। কিন্তু সেটি পথিমধ্যে শত্রুর গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সময়মতো সেটা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।’ ১৯৯৭ সালেই জ্যাকব লিখেছিলেন, ‘ওসমানীর অনুপস্থিতির ভুল ব্যাখ্যা করা হয় এবং পরে তা অনেক সমস্যার জন্ম দেয়।’ গতকালের আলোচনায় জ্যাকব পুনরায় একই বিবরণ দিলে এই প্রতিবেদক জ্যাকবকে বলেন যে আপনার এই বিবরণের সঙ্গে আপনার বন্ধু ভিন্নমত পোষণ করেন। গতকাল সকালেই এ কে খন্দকার তাঁর মিন্টো রোডের বাসভবনে বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি সতর্ক ইঙ্গিত দেন যে যৌথ কমান্ড গঠনের পর ওসমানীর মধ্যে একটা শিথিল মনোভাব দেখা দেয়। যৌথ কমান্ডের ধারণা তাঁর মনঃপূত ছিল না। তবে এ বিষয়ে তিনি নির্দিষ্ট মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর বর্ণনায়, ‘আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম, চূড়ান্ত কিছু একটা ঘটতে চলেছে। থিয়েটার রোডের দপ্তরে ১৩ ডিসেম্বরের দিকে এ নিয়ে আমি ওসমানীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে বলি যে স্যার, যুদ্ধের গতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। আপনাকে ঢাকায় দরকার পড়তে পারে। তিনি একরোখা ধরনের মানুষ ছিলেন। বললেন, “আমার এলাকা (সিলেট) মুক্ত, আমি সেখানে যাব।” তিনি চলে গেলেন।’ এ সময় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ওসমানী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে না জানিয়েই কলকাতা ত্যাগ করেছিলেন।’ খন্দকার বলেন, ‘চেষ্টা করেও প্রবাসী সরকার ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। ঢাকায় আমার আগমনের সিদ্ধান্ত মুজিবনগর সরকারই দিয়েছিল। আমি কলকাতায় একটা সোয়েটার ও প্যান্ট-শার্ট পরা ছিলাম। সকাল সোয়া ১০টার মতো হবে। আমাকে আদেশ করামাত্রই গাড়িতে উঠি। বিমানে দমদম থেকে আগরতলা হয়ে ঢাকায় পৌঁছাই। জেনারেল অরোরাসহ তাঁদের দলকে অভ্যর্থনা জানাতে জ্যাকব বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার বলেন, জয়েন্ট কমান্ড মানে হলো যৌথভাবে পরিচালিত। এর নেতৃত্ব খণ্ডিত করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনী বহুজাতিক ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডার যৌথ বাহিনীর নেতা হিসেবেই আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিলেন। তদুপরি বাংলাদেশের অনেকের ধারণা, আরেকটি নাম (বাংলাদেশের) হয়তো সেখানে বসানো যেত। তবে সেটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। উল্লেখ্য, আত্মসমর্পণের দলিলে পাকিস্তানের পক্ষে নিয়াজি ও যৌথ বাহিনীর পক্ষে অরোরা সই করেন।
দিল্লির যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদেরা চেয়েছেন, বড় শহরগুলোকে আগে দখল করো। আর জ্যাকব নীতি নিয়েছিলেন বড় শহর এড়িয়ে ঢাকা দখল করো। জেনারেল জ্যাকবের এই একক কৃতিত্ব তাঁর বইয়ে বড় আকারে দেখানো হলেও ভারতের সরকারি মহলে তার স্বীকৃতি মেলেনি। জ্যাকবের এই কৃতিত্বের বিষয়ে এ কে খন্দকারের মন্তব্য হচ্ছে, ‘তাঁর মুখে আমি শুনেছিলাম যে ঢাকা দখল করতে হবে। এটা বোধহয় নভেম্বরের দিকেই তিনি বলেছিলেন।’
জেনারেল জ্যাকব একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি সুহূদদের সংবর্ধনায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন, ‘এবারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননার কথা জেনে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। বাংলাদেশ একটি মহান রাষ্ট্র এবং আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের জনগণই স্বাধীনতাযুদ্ধ চেয়েছে।’
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের দুই অধিনায়ক অভিন্ন কণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। জ্যাকবের কথায়, ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে নিজের আসন সুদৃঢ় করেছে। তার মর্যাদা উঁচু অবস্থানে নিয়ে গেছে। প্রতিবেশী দুই দেশেই এখন মেধাবী ও চমৎকার প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন। তাঁরা উভয়ই সার্কের সদস্য। একই সমস্যা তাঁদের মোকাবিলা করতে হয় এবং আমি আশাবাদী, তাঁরা উভয় দেশের জনগণের জন্য কল্যাণকর ফলাফল বয়ে আনবেন।’
জ্যাকব ৯০ ছুঁইছেন। খন্দকার ৮২। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের রেসকোর্সের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কথা শীর্ষ দুই কুশীলব স্মৃতিচারণা করলেন। জ্যাকব বললেন, খন্দকারই বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। একই সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রত্যুত্তরে খন্দকার জেনারেল জ্যাকবের বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান স্মরণ করলেন। বললেন, জেনারেল জ্যাকব সব সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকেই বড় করে দেখেছেন।
তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। যেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন যৌথ বাহিনীর সদর দপ্তর। গতকাল রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টা ৪৫—এই ৭৫ মিনিটে দুই বীর সেনানী স্মৃতিচারণা করলেন মুক্তিযুদ্ধের কিছু দিক, ৪০ বছর পরে। এই প্রাণবন্ত আলোচনায় সূত্রধর হয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ইতিহাসের একটি তথ্যের পর্দা নতুন করে উন্মোচিত হলো। সেটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী কেন রেসকোর্সের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না, সে বিষয়টি।
কমরেড ও স্যার: দুজনের একান্ত সাক্ষাতের আগেও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। জেনারেল জ্যাকব এ কে খন্দকারকে বন্ধু ও কমরেড বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। খন্দকার অবশ্য ফৌজি রীতি অনুযায়ী তাঁকে এখনো স্যার হিসেবেই সম্বোধন করেন, মন্ত্রী হয়েও এর হেরফের নেই। তবে এ প্রসঙ্গে তিনি একটি মধুর স্মৃতি স্মরণ করেন। জেনারেল অরোরা ১৬ ডিসেম্বরে দমদমে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক বিবেচনায় তাঁকে আগে বিমানে উঠিয়েছিলেন। অরোরা পরে ওঠেন।
জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে দিল্লি ও ঢাকায় এই প্রতিবেদকের যখনই দেখা হয়েছে, তখনই তিনি খন্দকারের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গতকালের রূপসী বাংলাতেও তার ছাপ ছিল। জ্যাকব তাঁর সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা বইয়ে লিখেছেন, ‘ওসমানীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন উইং কমান্ডার খন্দকার। তিনি ছিলেন মার্জিত স্বভাবের দক্ষ অফিসার। যেকোনো সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বাস্তবানুগ। জরুরি কাজ আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন খোলা মনের অধিকারী, যে কারণে তাঁর সঙ্গে কাজ করা সহজ ছিল।’
১৯৯৭ সালে জ্যাকবের এই লেখা সম্পর্কে এ কে খন্দকার গতকালই অবহিত হন। তাঁর স্মৃতিচারণামূলক কোনো বই লেখা হয়নি। কারণ, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত পরিবর্তনের পরে তিনি সরকারের কাছে পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। বিচারপতি সায়েম তাঁকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার করে পাঠান ১৯৭৬ সালে। বোনের বাসায় একটি চামড়ার স্যুটকেসে তাঁর যুদ্ধকালীন ডায়েরি, নোটস ও ছবি সযত্নে রাখা ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সাড়ে ছয় বছর ও সেখান থেকে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে আরও কয়েক বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে দেখেন, টিনের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে সব নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বই লেখা আর হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসায় সরব: তবে প্রশ্নের জবাবে জেনারেল জ্যাকবের যুদ্ধকালীন অনেক প্রসঙ্গই সামনে টেনে এনে খন্দকার বলেন, জেনারেল জ্যাকব শুরু থেকেই বলতেন, মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ময়কর সাফল্য দেখাচ্ছে। লক্ষ করেছি, এই একটি বিষয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুনর্ব্যক্ত করতে জ্যাকবের উৎসাহের কোনো কমতি নেই। গতকালও তিনি অকপটে বললেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ তাদের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর আমরা তাদের সহায়তা দিয়েছিলাম।’
এ কে খন্দকার বলেন, জ্যাকব মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে ‘ওয়ান্ডারফুল জব’ কথাটি ব্যবহার করতেন। আমি এ কথা তাঁর মুখে বহুবার শুনেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জ্যাকবের কাছে যখন যে জিনিসই চাওয়া হয়েছে, তা-ই তিনি দিতে রাজি ছিলেন। হয়তো কখনো বলেছেন, সময় লাগবে কিছুটা। অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের অন্যান্য রসদ জোগাতে তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। এককথায় জ্যাকবকে আমি সব সময় ইতিবাচক দেখেছি। ফোর্ট উইলিয়ামসে আমি অনেকবার গিয়েছি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে টার্গেটস, স্ট্র্যাটেজি ইত্যাদি আলোচনায় আমিই অংশ নিয়েছি। ওসমানীর অংশগ্রহণ মনে পড়ে না। এসব আলোচনায় জ্যাকব থাকতেন।
হেলিকপ্টার রহস্য: দুই অধিনায়ক একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যাঁরা উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই দুজনই শুধু বেঁচে আছেন। খন্দকারই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এই বিষয়ে জেনারেল জ্যাকব ও এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকারের বিবরণে একটু তফাৎ লক্ষণীয়। জ্যাকব গতকালের আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে বলেন, ওসমানী অনেক সময় সদর দপ্তরে থাকতেন না। তিনি সিলেট অঞ্চলে ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন গঠনে ব্যস্ত থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠনে তাঁর আগ্রহ সঠিক ছিল না। কারণ, কর্মক্ষম সেনাবাহিনী গঠনে দীর্ঘ সময়ের দরকার পড়ে। এ কে খন্দকার তাঁর সঙ্গে দ্রুত একমত হন।
জ্যাকব তাঁর বইয়ে ও প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একাধিকবার বলেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বরে ঢাকায় তিনি তাঁর কর্মকর্তা মি. সেথনাকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানী ও খন্দকারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আদেশ দিয়েছিলেন। ওসমানীকে আনতে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। কিন্তু সেটি পথিমধ্যে শত্রুর গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সময়মতো সেটা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।’ ১৯৯৭ সালেই জ্যাকব লিখেছিলেন, ‘ওসমানীর অনুপস্থিতির ভুল ব্যাখ্যা করা হয় এবং পরে তা অনেক সমস্যার জন্ম দেয়।’ গতকালের আলোচনায় জ্যাকব পুনরায় একই বিবরণ দিলে এই প্রতিবেদক জ্যাকবকে বলেন যে আপনার এই বিবরণের সঙ্গে আপনার বন্ধু ভিন্নমত পোষণ করেন। গতকাল সকালেই এ কে খন্দকার তাঁর মিন্টো রোডের বাসভবনে বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি সতর্ক ইঙ্গিত দেন যে যৌথ কমান্ড গঠনের পর ওসমানীর মধ্যে একটা শিথিল মনোভাব দেখা দেয়। যৌথ কমান্ডের ধারণা তাঁর মনঃপূত ছিল না। তবে এ বিষয়ে তিনি নির্দিষ্ট মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর বর্ণনায়, ‘আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম, চূড়ান্ত কিছু একটা ঘটতে চলেছে। থিয়েটার রোডের দপ্তরে ১৩ ডিসেম্বরের দিকে এ নিয়ে আমি ওসমানীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে বলি যে স্যার, যুদ্ধের গতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। আপনাকে ঢাকায় দরকার পড়তে পারে। তিনি একরোখা ধরনের মানুষ ছিলেন। বললেন, “আমার এলাকা (সিলেট) মুক্ত, আমি সেখানে যাব।” তিনি চলে গেলেন।’ এ সময় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ওসমানী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে না জানিয়েই কলকাতা ত্যাগ করেছিলেন।’ খন্দকার বলেন, ‘চেষ্টা করেও প্রবাসী সরকার ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। ঢাকায় আমার আগমনের সিদ্ধান্ত মুজিবনগর সরকারই দিয়েছিল। আমি কলকাতায় একটা সোয়েটার ও প্যান্ট-শার্ট পরা ছিলাম। সকাল সোয়া ১০টার মতো হবে। আমাকে আদেশ করামাত্রই গাড়িতে উঠি। বিমানে দমদম থেকে আগরতলা হয়ে ঢাকায় পৌঁছাই। জেনারেল অরোরাসহ তাঁদের দলকে অভ্যর্থনা জানাতে জ্যাকব বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার বলেন, জয়েন্ট কমান্ড মানে হলো যৌথভাবে পরিচালিত। এর নেতৃত্ব খণ্ডিত করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনী বহুজাতিক ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডার যৌথ বাহিনীর নেতা হিসেবেই আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিলেন। তদুপরি বাংলাদেশের অনেকের ধারণা, আরেকটি নাম (বাংলাদেশের) হয়তো সেখানে বসানো যেত। তবে সেটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। উল্লেখ্য, আত্মসমর্পণের দলিলে পাকিস্তানের পক্ষে নিয়াজি ও যৌথ বাহিনীর পক্ষে অরোরা সই করেন।
দিল্লির যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদেরা চেয়েছেন, বড় শহরগুলোকে আগে দখল করো। আর জ্যাকব নীতি নিয়েছিলেন বড় শহর এড়িয়ে ঢাকা দখল করো। জেনারেল জ্যাকবের এই একক কৃতিত্ব তাঁর বইয়ে বড় আকারে দেখানো হলেও ভারতের সরকারি মহলে তার স্বীকৃতি মেলেনি। জ্যাকবের এই কৃতিত্বের বিষয়ে এ কে খন্দকারের মন্তব্য হচ্ছে, ‘তাঁর মুখে আমি শুনেছিলাম যে ঢাকা দখল করতে হবে। এটা বোধহয় নভেম্বরের দিকেই তিনি বলেছিলেন।’
জেনারেল জ্যাকব একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি সুহূদদের সংবর্ধনায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন, ‘এবারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননার কথা জেনে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। বাংলাদেশ একটি মহান রাষ্ট্র এবং আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের জনগণই স্বাধীনতাযুদ্ধ চেয়েছে।’
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের দুই অধিনায়ক অভিন্ন কণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। জ্যাকবের কথায়, ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে নিজের আসন সুদৃঢ় করেছে। তার মর্যাদা উঁচু অবস্থানে নিয়ে গেছে। প্রতিবেশী দুই দেশেই এখন মেধাবী ও চমৎকার প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন। তাঁরা উভয়ই সার্কের সদস্য। একই সমস্যা তাঁদের মোকাবিলা করতে হয় এবং আমি আশাবাদী, তাঁরা উভয় দেশের জনগণের জন্য কল্যাণকর ফলাফল বয়ে আনবেন।’
No comments