দূর দেশ-ওবামার মধ্যপ্রাচ্য প্রস্তাবে নতুন কিছু নেই by আলী রীয়াজ
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি-প্রক্রিয়ার জন্য ১৯৬৭ সালের সীমান্তকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ১৯ মে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কূটনৈতিক নীতিমালা বিষয়ে দেওয়া এক বক্তৃতায় ওবামা বলেন, ১৯৬৭ সালের সীমান্তরেখা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের
মধ্যে শান্তি আলোচনার সূচনা বিশুদ্ধ হওয়া উচিত, তবে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় ওই সীমান্তরেখার পাশাপাশি কিছু কিছু ভূমি আদান-প্রদান হতে পারে। সহজ ভাষায় বললে, ওবামা মনে করেন, ১৯৬৭ সালের জুন মাসের যুদ্ধের আগে এই দুই দেশের যে সীমান্ত ছিল, সেটাই হওয়া উচিত দুটি দেশের সীমান্ত। তবে যেহেতু তার পরে ইসরায়েল অধিকৃত অনেক স্থানে বসতি স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর বিনিময়ে ইসরায়েলের উচিত ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র ভূমি দিয়ে দেওয়া। ওবামার এই প্রস্তাব ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেন এই বলে, ওই সীমান্ত ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না এবং ওই সীমান্ত প্রতিরক্ষা যোগ্য কোনো সীমানা নয়।
প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তব্য ও নেতানিয়াহুর প্রত্যাখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, এটা ইসরায়েল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে কি না। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল-সমর্থক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর একাংশ বলার চেষ্টা করছে যে, ওবামার প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে পরিত্যাগ করতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল-সমর্থকদের সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী আমেরিকান ইসরায়েল পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির (এইপিএসি) বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ওবামা তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন ২২ মে। সেখানে দেওয়া ব্যাখ্যা যদিও ১৯ মের বক্তৃতার চেয়ে তুলনামূলকভাবে নরম—ওবামা তাঁর প্রধান প্রস্তাব ১৯৬৭ সালের সীমানা প্রশ্নে একেবারে পিছু হটে আসেননি। ওবামার এই প্রস্তাবের প্রতি ‘মিডল ইস্ট কোয়ার্টেট’ বা চারটি দেশ ও সংস্থার জোট জোর সমর্থন দিয়েছে। এই চারটি সংস্থা ও দেশ হচ্ছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এই কোয়ার্টেট মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি-প্রক্রিয়ার সক্রিয় মধ্যস্থতাকারী। ফিলিস্তিনিদের একাংশ ওবামার প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও হামাস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এ যাবৎ আলোচনায় সীমান্তের প্রশ্নটি এতটাই গুরুত্ব পেয়েছে যে, অনেকেই এটাকে ওবামা-প্রশাসনের নতুন নীতি বলে ধরে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে জোর বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। এই বক্তব্যের গুরুত্বকে ছোট না করেও বলা যায়, এটি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ১৯ ও ২২ মের দুটি বক্তৃতায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক ওবামা তুলে ধরেছেন, যা ততটা মনোযোগ পায়নি। সীমান্তরেখার প্রশ্নটিকে যাঁরা গুরুত্ববহ মনে করেন, তাঁদের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো, অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ধরনের বক্তব্য দেননি। এই বক্তব্য অংশত সত্যি এই কারণে যে, ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, চূড়ান্ত আলোচনার ফলাফল হিসেবে ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি রেখায় ফিরে যাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন না। ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি রেখাই ছিল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সীমান্ত। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ২০০০ সালে যখন শান্তি আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তখনো সরাসরি ১৯৬৭ সালের সীমানা নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু পাশাপাশি এটাও স্মারণ করা দরকার, ২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি দেওয়া এক বক্তৃতায় জর্জ বুশ স্পষ্ট করে বলেন, তিনি মনে করেন যে বাস্তবসম্মত কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি রেখা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমান্ত বলে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন প্রশাসন ক্লিনটন ও বুশ সমেত সব সময়ই ১৯৬৭ সালের সীমান্তকে ভিত্তি ধরেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমান্ত তৈরির কথা বিবেচনা করেছেন। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার এই বক্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে রিপাবলিকান পার্টির একাংশ যে বিতর্ক সৃষ্টি করছে, তা কতটা নির্বাচনী রাজনীতিপ্রসূত এবং কতটা সত্যি, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্লেষকেরা এই বিষয়ে নজর দিতে গিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছেন না। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ইসরায়েল সফরে গিয়েছিলেন ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। তখনো তাঁর উপদেষ্টারা ইসরায়েলি নেতাদের জানিয়েছিলেন যে তিনি ২০০২ সালের দেওয়া সৌদি আরবের শান্তি প্রস্তাবের পক্ষে। আরব লীগের সমর্থনপুষ্ট ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমান্তরেখায় প্রত্যাবর্তন করলে আরব বিশ্বের দেশগুলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।
মোট কথায়, বারাক ওবামার প্রস্তাব তাঁর পক্ষ থেকে বা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া কোনো নতুন প্রস্তাব নয়। কিন্তু ১৯ ও ২২ মের দেওয়া বক্তৃতা দুটোয় ওবামা শান্তি-প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা এবং দ্রুত সাফল্য অর্জনের জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। ওবামার প্রস্তাবের নতুন দিক হচ্ছে, একটি সর্বাত্মক বা কমপ্রিহেনসিভ শান্তিচুক্তির বদলে পর্যায়ক্রমিকভাবে অগ্রসর হওয়াকে ওবামা-প্রশাসন বাস্তবসম্মত বলে ধরে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সীমান্ত ও নিরাপত্তার বিষয়কে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও জেরুজালেমের স্ট্যাটাস প্রশ্নটিকে এই মুহূর্তে মোকাবিলা করা যাবে না এবং তার জন্য অন্য পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে আসার বিরোধিতা করছে ওবামা প্রশাসন। সে কারণেই ২০০৮ সালে এআইপিএসির সম্মেলনে জেরুজালেম বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিলেও ওবামা এখন এ নিয়ে কোনো আলোচনার প্রশ্ন তুলছেন না।
ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তিপ্র-ক্রিয়ায় ইসরায়েলকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে যুক্ত করার জন্য ওবামা-প্রশাসন যে তাগিদ দিচ্ছে, সেটাই এই প্রশাসনের ‘নতুন’ নীতির দিক। ওবামার দুটি বক্তৃতায় এটা স্পষ্ট যে তিনি মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মিসরে পরিবর্তনের ফলে ইসরায়েলের পক্ষে কেবল প্রতিবেশী দেশের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতাই যথেষ্ট নয়। সেই সব দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে আস্থা অর্জন না করা গেলে ইসরায়েলের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে। দ্বিতীয়ত, ওবামা-প্রশাসন ক্রমেই উপলব্ধি করতে পারছে যে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা বাড়ছে, অধিকৃত এলাকায়ও ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এবং ফিলিস্তিনিদের আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হলে ইসরায়েলের বেতরে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলে ইসরায়েলের পক্ষে তার ইহুদি রাষ্ট্রের চরিত্র রক্ষা সম্ভব হবে না। অনেক বিশ্লেষক কিছুদিন ধরে, বিশেষ করে জন মিয়েরশাইমার ও স্টিফেন ওয়াল্ট ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে এই যুক্তি উপস্থাপন করে আসছেন। জন মিয়েরশাইমার দুই বছর ধরে জোর দিয়ে বলছেন, দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এখন আর সম্ভব নয়। এই কথাগুলোকে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ গুরুত্ব দিলেও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তা গুরুত্ব পায়নি, সুস্পষ্টভাবে বলাও হয়নি। ওবামার সাম্প্রতিক বক্তৃতায় তা খোলামেলাভাবে হাজির করায় এখন এ নিয়ে কথাবার্তা উঠবে বলেই মনে হয়।
ওবামা-প্রশাসন তৃতীয় যে কারণে শান্তিপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আশু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন মনে করছে, তা হলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বিষয়ে জাতিসংঘের আসন্ন আলোচনা। সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি চাইবে। কোনো কোনো সূত্রের খবর যে কমপক্ষে ১০০ দেশ ইতিমধ্যে এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাব সমর্থন করবে না বলে ওবামা স্পষ্ট করে বলেছেন। কিন্তু পাশাপাশি তিনি হুঁশিয়ার করছেন, এতে করে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ফলে তার আগে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা মোকাবিলা করার জন্যই ওবামা-প্রশাসনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ। ইসরায়েলের ভেতরেও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাক এপ্রিলের গোড়ার দিকে আসন্ন এই পরিস্থিতিকে ‘কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সুনামি’ বলে বর্ণনা করে বলেছেন, এটি একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি।
প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপ ব্যাখ্যা করতে এবং সমর্থন সংগ্রহ করতে ইউরোপ সফরে গেছেন। ইউরোপে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা অনেক দিনের পুরোনো। ফলে ওবামা যে ইউরোপীয় নেতাদের সমর্থন পাবেন, তা অনুমান করা যায়। কিন্তু ইসরায়েল এই বাস্তবতার মুখে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ও সক্ষম কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
ইলিনয়, ২৩ মে ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তব্য ও নেতানিয়াহুর প্রত্যাখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, এটা ইসরায়েল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে কি না। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল-সমর্থক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর একাংশ বলার চেষ্টা করছে যে, ওবামার প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে পরিত্যাগ করতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল-সমর্থকদের সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী আমেরিকান ইসরায়েল পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির (এইপিএসি) বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ওবামা তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন ২২ মে। সেখানে দেওয়া ব্যাখ্যা যদিও ১৯ মের বক্তৃতার চেয়ে তুলনামূলকভাবে নরম—ওবামা তাঁর প্রধান প্রস্তাব ১৯৬৭ সালের সীমানা প্রশ্নে একেবারে পিছু হটে আসেননি। ওবামার এই প্রস্তাবের প্রতি ‘মিডল ইস্ট কোয়ার্টেট’ বা চারটি দেশ ও সংস্থার জোট জোর সমর্থন দিয়েছে। এই চারটি সংস্থা ও দেশ হচ্ছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এই কোয়ার্টেট মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি-প্রক্রিয়ার সক্রিয় মধ্যস্থতাকারী। ফিলিস্তিনিদের একাংশ ওবামার প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও হামাস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এ যাবৎ আলোচনায় সীমান্তের প্রশ্নটি এতটাই গুরুত্ব পেয়েছে যে, অনেকেই এটাকে ওবামা-প্রশাসনের নতুন নীতি বলে ধরে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে জোর বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। এই বক্তব্যের গুরুত্বকে ছোট না করেও বলা যায়, এটি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ১৯ ও ২২ মের দুটি বক্তৃতায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক ওবামা তুলে ধরেছেন, যা ততটা মনোযোগ পায়নি। সীমান্তরেখার প্রশ্নটিকে যাঁরা গুরুত্ববহ মনে করেন, তাঁদের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো, অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ ধরনের বক্তব্য দেননি। এই বক্তব্য অংশত সত্যি এই কারণে যে, ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, চূড়ান্ত আলোচনার ফলাফল হিসেবে ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি রেখায় ফিরে যাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন না। ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি রেখাই ছিল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সীমান্ত। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ২০০০ সালে যখন শান্তি আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তখনো সরাসরি ১৯৬৭ সালের সীমানা নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু পাশাপাশি এটাও স্মারণ করা দরকার, ২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি দেওয়া এক বক্তৃতায় জর্জ বুশ স্পষ্ট করে বলেন, তিনি মনে করেন যে বাস্তবসম্মত কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি রেখা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমান্ত বলে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন প্রশাসন ক্লিনটন ও বুশ সমেত সব সময়ই ১৯৬৭ সালের সীমান্তকে ভিত্তি ধরেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমান্ত তৈরির কথা বিবেচনা করেছেন। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামার এই বক্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে রিপাবলিকান পার্টির একাংশ যে বিতর্ক সৃষ্টি করছে, তা কতটা নির্বাচনী রাজনীতিপ্রসূত এবং কতটা সত্যি, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্লেষকেরা এই বিষয়ে নজর দিতে গিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছেন না। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ইসরায়েল সফরে গিয়েছিলেন ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। তখনো তাঁর উপদেষ্টারা ইসরায়েলি নেতাদের জানিয়েছিলেন যে তিনি ২০০২ সালের দেওয়া সৌদি আরবের শান্তি প্রস্তাবের পক্ষে। আরব লীগের সমর্থনপুষ্ট ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমান্তরেখায় প্রত্যাবর্তন করলে আরব বিশ্বের দেশগুলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।
মোট কথায়, বারাক ওবামার প্রস্তাব তাঁর পক্ষ থেকে বা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া কোনো নতুন প্রস্তাব নয়। কিন্তু ১৯ ও ২২ মের দেওয়া বক্তৃতা দুটোয় ওবামা শান্তি-প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা এবং দ্রুত সাফল্য অর্জনের জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। ওবামার প্রস্তাবের নতুন দিক হচ্ছে, একটি সর্বাত্মক বা কমপ্রিহেনসিভ শান্তিচুক্তির বদলে পর্যায়ক্রমিকভাবে অগ্রসর হওয়াকে ওবামা-প্রশাসন বাস্তবসম্মত বলে ধরে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সীমান্ত ও নিরাপত্তার বিষয়কে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও জেরুজালেমের স্ট্যাটাস প্রশ্নটিকে এই মুহূর্তে মোকাবিলা করা যাবে না এবং তার জন্য অন্য পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে আসার বিরোধিতা করছে ওবামা প্রশাসন। সে কারণেই ২০০৮ সালে এআইপিএসির সম্মেলনে জেরুজালেম বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিলেও ওবামা এখন এ নিয়ে কোনো আলোচনার প্রশ্ন তুলছেন না।
ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তিপ্র-ক্রিয়ায় ইসরায়েলকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে যুক্ত করার জন্য ওবামা-প্রশাসন যে তাগিদ দিচ্ছে, সেটাই এই প্রশাসনের ‘নতুন’ নীতির দিক। ওবামার দুটি বক্তৃতায় এটা স্পষ্ট যে তিনি মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মিসরে পরিবর্তনের ফলে ইসরায়েলের পক্ষে কেবল প্রতিবেশী দেশের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতাই যথেষ্ট নয়। সেই সব দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে আস্থা অর্জন না করা গেলে ইসরায়েলের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে। দ্বিতীয়ত, ওবামা-প্রশাসন ক্রমেই উপলব্ধি করতে পারছে যে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা বাড়ছে, অধিকৃত এলাকায়ও ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এবং ফিলিস্তিনিদের আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হলে ইসরায়েলের বেতরে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলে ইসরায়েলের পক্ষে তার ইহুদি রাষ্ট্রের চরিত্র রক্ষা সম্ভব হবে না। অনেক বিশ্লেষক কিছুদিন ধরে, বিশেষ করে জন মিয়েরশাইমার ও স্টিফেন ওয়াল্ট ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে এই যুক্তি উপস্থাপন করে আসছেন। জন মিয়েরশাইমার দুই বছর ধরে জোর দিয়ে বলছেন, দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এখন আর সম্ভব নয়। এই কথাগুলোকে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ গুরুত্ব দিলেও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তা গুরুত্ব পায়নি, সুস্পষ্টভাবে বলাও হয়নি। ওবামার সাম্প্রতিক বক্তৃতায় তা খোলামেলাভাবে হাজির করায় এখন এ নিয়ে কথাবার্তা উঠবে বলেই মনে হয়।
ওবামা-প্রশাসন তৃতীয় যে কারণে শান্তিপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আশু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন মনে করছে, তা হলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বিষয়ে জাতিসংঘের আসন্ন আলোচনা। সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি চাইবে। কোনো কোনো সূত্রের খবর যে কমপক্ষে ১০০ দেশ ইতিমধ্যে এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাব সমর্থন করবে না বলে ওবামা স্পষ্ট করে বলেছেন। কিন্তু পাশাপাশি তিনি হুঁশিয়ার করছেন, এতে করে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ফলে তার আগে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা মোকাবিলা করার জন্যই ওবামা-প্রশাসনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ। ইসরায়েলের ভেতরেও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাক এপ্রিলের গোড়ার দিকে আসন্ন এই পরিস্থিতিকে ‘কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সুনামি’ বলে বর্ণনা করে বলেছেন, এটি একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি।
প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপ ব্যাখ্যা করতে এবং সমর্থন সংগ্রহ করতে ইউরোপ সফরে গেছেন। ইউরোপে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা অনেক দিনের পুরোনো। ফলে ওবামা যে ইউরোপীয় নেতাদের সমর্থন পাবেন, তা অনুমান করা যায়। কিন্তু ইসরায়েল এই বাস্তবতার মুখে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ও সক্ষম কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
ইলিনয়, ২৩ মে ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments