শিক্ষায় ঘটবে বৈপ্লবিক রূপান্তর by এম এম আকাশ
স্বাধীন দেশ হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একচলি্লশ বছরের পথপরিক্রমা শেষ হলো আজ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালে। সরকারের ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি ওয়ান রয়েছে এ সময়কালের জন্য। সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে শিক্ষা, বিদ্যুৎ, কৃষিতে আমরা কতটা এগিয়ে যেতে পারব, এ ক্ষেত্রে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং তা কাটিয়ে ওঠার পথ কী_ সেটা
নিয়েই সাজানো হয়েছে সম্পাদকীয় আয়োজন। আরও রয়েছে সমুদ্র প্রসঙ্গ। আমাদের নিশ্চিত সমৃদ্ধিতে নতুন হাতছানি মিলছে বঙ্গোপসাগর থেকে। এর ঢেউ যখন আছড়ে পড়ছে স্থলভাবে, তখন আমরা প্রসারিত দিগন্ত যেমন অনুভব করি, তেমনি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে অফুরান সম্পদ। এ নিয়েও রয়েছে একটি বিশেষ নিবন্ধ।
এ চার লেখার মূল বিষয় সুবর্ণজয়ন্তীর স্বপ্ন
কল্পনা করুন, যে লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর রয়েছে অষ্টম শ্রেণীর এবং আরও হাজার হাজারের ভকেশনাল সার্টিফিকেট। তারা শত শত বৃত্তিতে যোগদানের জন্য প্রস্তুত। এ অবস্থায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা কি থাকবে? আমার তো মনে হয়, থাকবে না। আমরা যদি নিজেরা অর্থনৈতিক কর্মনিয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি করতে নাও পারি, এই বিশ্বায়নের যুগে শ্রম ঘাটতির দেশগুলো তাদের আগ্রহ করেই নিয়ে যাবে
বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের সামাজিক খাতে ঈর্ষণীয় অগ্রগতির বিষয়টি সাধারণভাবে স্বীকার করে নিয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর সদর দফতর এবং এ দেশটি সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন এমন পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জনবহুল দেশটির অর্থনৈতিক খাতে সাফল্য কমবেশি যাই থাকুক না কেন_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক।
শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির একটি সূচক প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির বয়স হয়েছে এমন শিশুদের প্রায় একশ' ভাগকেই আমরা কোনো না কোনো স্কুলে দেখতে পাই। জাতিসংঘ এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল, তার আগেই বাংলাদেশ এ কৃতিত্ব দেখিয়েছে। আরও একটি বিষয় বিশ্বসমাজের দৃষ্টি কেড়েছে_ একটি মুসলিমপ্রধান দেশে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ও ছাত্রী সমান সমান কিংবা কোথাও কোথাও ছাত্রীরা সংখ্যায় কিছুটা বেশি।
এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, সম্প্রতি যে শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় যেসব পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে তার কিছু সুফল প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে পড়তে শুরু করেছে। সরকার নীতিগতভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বেতন প্রদান করতে হবে না। উপরন্তু সব ছাত্রছাত্রীকে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান করছে। অনেক বৃত্তি ও উপবৃত্তির মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ানো হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, সংখ্যাতত্ত্ব বা পরিমাণগত বিচারে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল পর্যায়ের শিক্ষায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও মনোযোগের বিষয় শিক্ষার গুণগত মান। এটা নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ এবং এজন্য দরকার অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ।
বর্তমান শিক্ষানীতি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক পুনর্মূল্যায়ন করে ইতিহাস বিকৃতিরোধ এবং গুণগত মান উন্নত করে নতুন বই প্রকাশ করা হচ্ছে। বইগুলো অনলাইনে দেওয়া আছে এবং যে কেউ তা থেকে খুব কম পয়সা ব্যয় করেই নিজের প্রয়োজনীয় অংশ পাঠ বা মুদ্রণ করে নিতে পারে। সরকারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে। অনেক বিদ্যালয় নিজস্ব উদ্যোগেও কম্পিউটার সংগ্রহ করছে। কল্পনা করুন, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পটুয়াখালীর উপকূলবর্তী দশমিনা উপজেলার কোনো গণ্ডগ্রামে শিক্ষার্থীরা আলোকসংশ্লেষণ কিংবা অর্থনীতির তত্ত্বের পাঠ নিচ্ছে। এভাবে শিক্ষা হয়ে উঠবে আকর্ষণীয় এবং একই সঙ্গে বাড়বে মান। এমনটি ঘটতে পারে উত্তরের পঞ্চগড়ে, বঙ্গোপসাগর বুকের সেন্ট মার্টিনে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী কোনো গ্রামে। এটা এখনও হয়তো স্বপ্ন, কিন্তু বর্তমান শিক্ষানীতিতে এমন লক্ষ্যই লিপিবদ্ধ এবং বাস্তবে আংশিক হলেও চালু রয়েছে।
তবে পরিকল্পনা যাই করা হোক, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সম্পদ। এর প্রধান জোগান আসতে হবে সরকারের তহবিল থেকেই। যেহেতু শিক্ষাকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ও আবশ্যকীয় হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা দুটি_ প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান ঘটানো এবং প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে তার ব্যয় করা। বস্তুত ব্যর্থতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এখানেই। এই ব্যর্থতার কারণেই গ্রামের বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর উন্নতির গতি কচ্ছপের মতো। অন্যদিকে,মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণীর সন্তানরা যেসব স্থানে বসবাস ও স্কুলে পড়ে, সেখানে সুবিধা বাড়ে খরগোশের গতিতে। অবশ্য বাংলাদেশে যেসব ইংরেজিমাধ্যম স্কুল-কলেজ রয়েছে, যেখানে মাসিক ছাত্র বেতন ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, যাদের পরীক্ষা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়_ তাদের খবর যেটুকু শুনতে পাই, তাতে বুঝতে পারি সেখানেও শিক্ষা তার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। মূল্যবোধের অবক্ষয়, একাধিক গৃহশিক্ষক রেখে তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় শেষ পর্যন্ত মিস-ফিট তৈরি হচ্ছে। এক সময়ে ঠাট্টা করে বলা হতো, ফার্মের মুরগি হৃষ্টপুষ্ট, কিন্তু সুস্বাদু নয়। এখনও মূলধারার স্কুল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের প্রচুর ভিড়। এগুলোতে অবকাঠামো সুবিধা কম হলেও প্রচুর জ্ঞান অর্জন করা যায়। ছাত্রছাত্রীদের অনেকে বহির্বিশ্বের প্রতিযোগিতায় ভালো করে। তাদের সম্ভাবনা বুঝতে আমাদের সমস্যা হয় না। যদি সমাজে আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং সমাজের সব শ্রেণী-পেশার সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্নত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে শিক্ষা শুধু পরিমাণে নয়, গুণের ক্ষেত্রেও বিরাট মাত্রা এনে দিতে পারত। আমাদের দুটি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। শিক্ষার প্রয়োগ এবং শিক্ষিত মানুষের মূল্যবোধ। আমরা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করেছি। এ পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ও তাৎপর্য রয়েছে। আমরা জানি, দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা দু'চার বছর স্কুলে গিয়েই ঝরে পড়ত, যাদের আমরা ড্রপ আউট বলে থাকি। আমার ধারণা, জাতীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষায় সার্টিফিকেট পাওয়ার কারণে দরিদ্র বাবা-মায়েরাও কষ্ট করে হলেও সন্তানদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতে চাইবেন। ছেলে বা মেয়ে এ ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এবং এ ক্ষেত্রে যদি নূ্যনতম মান বজায় রাখা যায় তার অনেক সুবিধা। তখন যদি তারা আর পড়তে নাও চায়, তাহলেও বৃত্তিমুখী বা কর্মমুখী কোনো কোর্স বেছে নিতে পারবে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য পাসপোর্ট হিসেবে কাজ করবে ওই সার্টিফিকেট। কল্পনা করুন, যে লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর রয়েছে অষ্টম শ্রেণীর এবং আরও হাজার হাজারের ভকেশনাল সার্টিফিকেট। তারা শত শত বৃত্তিতে যোগদানের জন্য প্রস্তুত। এ অবস্থায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা কি থাকবে? আমার তো মনে হয়, থাকবে না। আমরা যদি নিজেরা অর্থনৈতিক কর্মনিয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি করতে নাও পারি, এই বিশ্বায়নের যুগে শ্রম ঘাটতির দেশগুলো তাদের আগ্রহ করেই নিয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে তখন আমরা অদক্ষ বা নিম্নমানের কাজ করে এমন শ্রমিক না পাঠিয়ে মাঝারি মানের দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারব। এ অবস্থায় দেশে এবং প্রবাস থেকে শ্রমিক পিছু আয় অনেক বাড়বে। দেশের শিল্প ও কৃষিতে দক্ষ শ্রম প্রদান করে অর্থনীতির উল্লম্ফন ঘটবে। সম্ভবত পূর্ব এশীয় উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর উন্নয়ন মডেলে শিক্ষা যেভাবে বৈপ্লবিক অবদান রেখেছিল, বাংলাদেশে সে ধরনের প্রক্রিয়ার সূচনা হবে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ মানবসম্পদ। বিশেষত, বর্তমানে যে ডেমোগ্রাফিক বোনাসের যে সুযোগ আমরা পেয়েছি তার কারণ আমাদের শ্রমমক্তির আয়তন নির্ভরশীল জনগণের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে আগে একজনের রোজগারে যেখানে ৫-৬ জনকে খাওয়াতে হতো, সেখানে এখন ২-৩ জনের বেশি চালাতে হয় না। এই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বর্ধিত আয়ের ছোট সংসারে যে সুযোগ পাবে সেটা সমগ্র অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করবে।
এসব এখন মোটেই কল্পনাপ্রসূত নয়_ বাস্তবে বিদ্যমান প্রক্রিয়া। কিন্তু ঝুঁকি হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যদি পালাবদলের নষ্টচক্রে নিক্ষিপ্ত হয়, যেখানে সবকিছু ফের অস্থিতিশীল, কোথাও কোথাও উল্টোযাত্রা; কিংবা কেউ কেউ যখন বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের পরিবর্তে আসছে টু-টুয়েন্টি টু_ সেই দুঃস্বপ্ন সত্য হলে শিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন মিথ্যা হয়ে যাবে।
ড. এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ চার লেখার মূল বিষয় সুবর্ণজয়ন্তীর স্বপ্ন
কল্পনা করুন, যে লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর রয়েছে অষ্টম শ্রেণীর এবং আরও হাজার হাজারের ভকেশনাল সার্টিফিকেট। তারা শত শত বৃত্তিতে যোগদানের জন্য প্রস্তুত। এ অবস্থায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা কি থাকবে? আমার তো মনে হয়, থাকবে না। আমরা যদি নিজেরা অর্থনৈতিক কর্মনিয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি করতে নাও পারি, এই বিশ্বায়নের যুগে শ্রম ঘাটতির দেশগুলো তাদের আগ্রহ করেই নিয়ে যাবে
বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের সামাজিক খাতে ঈর্ষণীয় অগ্রগতির বিষয়টি সাধারণভাবে স্বীকার করে নিয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর সদর দফতর এবং এ দেশটি সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন এমন পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জনবহুল দেশটির অর্থনৈতিক খাতে সাফল্য কমবেশি যাই থাকুক না কেন_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক।
শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির একটি সূচক প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির বয়স হয়েছে এমন শিশুদের প্রায় একশ' ভাগকেই আমরা কোনো না কোনো স্কুলে দেখতে পাই। জাতিসংঘ এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল, তার আগেই বাংলাদেশ এ কৃতিত্ব দেখিয়েছে। আরও একটি বিষয় বিশ্বসমাজের দৃষ্টি কেড়েছে_ একটি মুসলিমপ্রধান দেশে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ও ছাত্রী সমান সমান কিংবা কোথাও কোথাও ছাত্রীরা সংখ্যায় কিছুটা বেশি।
এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, সম্প্রতি যে শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় যেসব পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে তার কিছু সুফল প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে পড়তে শুরু করেছে। সরকার নীতিগতভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বেতন প্রদান করতে হবে না। উপরন্তু সব ছাত্রছাত্রীকে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান করছে। অনেক বৃত্তি ও উপবৃত্তির মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ানো হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, সংখ্যাতত্ত্ব বা পরিমাণগত বিচারে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল পর্যায়ের শিক্ষায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও মনোযোগের বিষয় শিক্ষার গুণগত মান। এটা নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ এবং এজন্য দরকার অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ।
বর্তমান শিক্ষানীতি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক পুনর্মূল্যায়ন করে ইতিহাস বিকৃতিরোধ এবং গুণগত মান উন্নত করে নতুন বই প্রকাশ করা হচ্ছে। বইগুলো অনলাইনে দেওয়া আছে এবং যে কেউ তা থেকে খুব কম পয়সা ব্যয় করেই নিজের প্রয়োজনীয় অংশ পাঠ বা মুদ্রণ করে নিতে পারে। সরকারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে। অনেক বিদ্যালয় নিজস্ব উদ্যোগেও কম্পিউটার সংগ্রহ করছে। কল্পনা করুন, মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পটুয়াখালীর উপকূলবর্তী দশমিনা উপজেলার কোনো গণ্ডগ্রামে শিক্ষার্থীরা আলোকসংশ্লেষণ কিংবা অর্থনীতির তত্ত্বের পাঠ নিচ্ছে। এভাবে শিক্ষা হয়ে উঠবে আকর্ষণীয় এবং একই সঙ্গে বাড়বে মান। এমনটি ঘটতে পারে উত্তরের পঞ্চগড়ে, বঙ্গোপসাগর বুকের সেন্ট মার্টিনে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী কোনো গ্রামে। এটা এখনও হয়তো স্বপ্ন, কিন্তু বর্তমান শিক্ষানীতিতে এমন লক্ষ্যই লিপিবদ্ধ এবং বাস্তবে আংশিক হলেও চালু রয়েছে।
তবে পরিকল্পনা যাই করা হোক, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সম্পদ। এর প্রধান জোগান আসতে হবে সরকারের তহবিল থেকেই। যেহেতু শিক্ষাকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ও আবশ্যকীয় হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা দুটি_ প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান ঘটানো এবং প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে তার ব্যয় করা। বস্তুত ব্যর্থতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এখানেই। এই ব্যর্থতার কারণেই গ্রামের বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর উন্নতির গতি কচ্ছপের মতো। অন্যদিকে,মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণীর সন্তানরা যেসব স্থানে বসবাস ও স্কুলে পড়ে, সেখানে সুবিধা বাড়ে খরগোশের গতিতে। অবশ্য বাংলাদেশে যেসব ইংরেজিমাধ্যম স্কুল-কলেজ রয়েছে, যেখানে মাসিক ছাত্র বেতন ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, যাদের পরীক্ষা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়_ তাদের খবর যেটুকু শুনতে পাই, তাতে বুঝতে পারি সেখানেও শিক্ষা তার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। মূল্যবোধের অবক্ষয়, একাধিক গৃহশিক্ষক রেখে তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় শেষ পর্যন্ত মিস-ফিট তৈরি হচ্ছে। এক সময়ে ঠাট্টা করে বলা হতো, ফার্মের মুরগি হৃষ্টপুষ্ট, কিন্তু সুস্বাদু নয়। এখনও মূলধারার স্কুল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের প্রচুর ভিড়। এগুলোতে অবকাঠামো সুবিধা কম হলেও প্রচুর জ্ঞান অর্জন করা যায়। ছাত্রছাত্রীদের অনেকে বহির্বিশ্বের প্রতিযোগিতায় ভালো করে। তাদের সম্ভাবনা বুঝতে আমাদের সমস্যা হয় না। যদি সমাজে আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং সমাজের সব শ্রেণী-পেশার সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্নত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে শিক্ষা শুধু পরিমাণে নয়, গুণের ক্ষেত্রেও বিরাট মাত্রা এনে দিতে পারত। আমাদের দুটি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। শিক্ষার প্রয়োগ এবং শিক্ষিত মানুষের মূল্যবোধ। আমরা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করেছি। এ পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ও তাৎপর্য রয়েছে। আমরা জানি, দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা দু'চার বছর স্কুলে গিয়েই ঝরে পড়ত, যাদের আমরা ড্রপ আউট বলে থাকি। আমার ধারণা, জাতীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষায় সার্টিফিকেট পাওয়ার কারণে দরিদ্র বাবা-মায়েরাও কষ্ট করে হলেও সন্তানদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতে চাইবেন। ছেলে বা মেয়ে এ ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এবং এ ক্ষেত্রে যদি নূ্যনতম মান বজায় রাখা যায় তার অনেক সুবিধা। তখন যদি তারা আর পড়তে নাও চায়, তাহলেও বৃত্তিমুখী বা কর্মমুখী কোনো কোর্স বেছে নিতে পারবে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য পাসপোর্ট হিসেবে কাজ করবে ওই সার্টিফিকেট। কল্পনা করুন, যে লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর রয়েছে অষ্টম শ্রেণীর এবং আরও হাজার হাজারের ভকেশনাল সার্টিফিকেট। তারা শত শত বৃত্তিতে যোগদানের জন্য প্রস্তুত। এ অবস্থায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা কি থাকবে? আমার তো মনে হয়, থাকবে না। আমরা যদি নিজেরা অর্থনৈতিক কর্মনিয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি করতে নাও পারি, এই বিশ্বায়নের যুগে শ্রম ঘাটতির দেশগুলো তাদের আগ্রহ করেই নিয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে তখন আমরা অদক্ষ বা নিম্নমানের কাজ করে এমন শ্রমিক না পাঠিয়ে মাঝারি মানের দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারব। এ অবস্থায় দেশে এবং প্রবাস থেকে শ্রমিক পিছু আয় অনেক বাড়বে। দেশের শিল্প ও কৃষিতে দক্ষ শ্রম প্রদান করে অর্থনীতির উল্লম্ফন ঘটবে। সম্ভবত পূর্ব এশীয় উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর উন্নয়ন মডেলে শিক্ষা যেভাবে বৈপ্লবিক অবদান রেখেছিল, বাংলাদেশে সে ধরনের প্রক্রিয়ার সূচনা হবে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ মানবসম্পদ। বিশেষত, বর্তমানে যে ডেমোগ্রাফিক বোনাসের যে সুযোগ আমরা পেয়েছি তার কারণ আমাদের শ্রমমক্তির আয়তন নির্ভরশীল জনগণের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে আগে একজনের রোজগারে যেখানে ৫-৬ জনকে খাওয়াতে হতো, সেখানে এখন ২-৩ জনের বেশি চালাতে হয় না। এই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বর্ধিত আয়ের ছোট সংসারে যে সুযোগ পাবে সেটা সমগ্র অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করবে।
এসব এখন মোটেই কল্পনাপ্রসূত নয়_ বাস্তবে বিদ্যমান প্রক্রিয়া। কিন্তু ঝুঁকি হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যদি পালাবদলের নষ্টচক্রে নিক্ষিপ্ত হয়, যেখানে সবকিছু ফের অস্থিতিশীল, কোথাও কোথাও উল্টোযাত্রা; কিংবা কেউ কেউ যখন বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের পরিবর্তে আসছে টু-টুয়েন্টি টু_ সেই দুঃস্বপ্ন সত্য হলে শিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন মিথ্যা হয়ে যাবে।
ড. এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments