ভয়াল রাতের স্মৃতি by মেঘনা গুহঠাকুরতা
১৯৭১ সালে আমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্রী, হলিক্রস স্কুলের। আমার বাবা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ছিলেন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট এবং ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। মা বাসন্তী গুহঠাকুরতা ছিলেন গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস। আমরা থাকতাম জগন্নাথ হলের পূর্ব পাশের কম্পাউন্ডে কিছু ফ্ল্যাট ছিল সেখানকার একটিতে, নিচতলায়।
মার্চের প্রথমেই ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা এলো_ সংসদ অধিবেশন বসবে না। তখনই ঢাকার মানুষজন রাস্তায় নেমে আসে। আমাদের বাসা ছিল হলের পূর্ব পাশে, সেখান থেকে শহীদ মিনারের পুরোটাই দেখা যেত। মার্চের ১ তারিখ থেকেই দেখেছিলাম ছাত্র-জনতা প্রতিদিনই শহীদ মিনারে একত্রিত হতো, মিছিল করত। ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যের প্রতিবাদে তারা জোর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে লাগল। এবং ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার পর অবস্থার আরও পরিবর্তন ঘটল। সবাই বন্দুক, লাঠি, দাসহ যার যার সহায় নিয়ে রাস্তায় এসে মিছিল করত। টিক্কা খানকে গভর্নর করার পর যে সব সরকারি কর্মচারী বাঙালি তার কাছে শপথ নিতে চায়নি, তারা শহীদ মিনারে এসে শপথ নিয়েছিল। সবখানেই সংগ্রাম এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল। দেশ কোন দিকে যাবে তার কোনো সুরাহা হচ্ছিল না। এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় ছিল নিত্যদিনের। এককথায় বলা যায়_ মার্চ মাসজুড়েই রাজনৈতিক এবং জনগণের অবস্থা ছিল অত্যন্ত অশান্ত এবং অস্থির। এর মাঝে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। সবাই যে যার মতো ঢাকা ছাড়তে লাগল। ইউনিভার্সিটিতে প্রায় প্রতিটি আবাসিক হলের ছাত্ররা হল ত্যাগ করতে লাগল। বাবার অনেক সহকর্মীকেও দেখেছি ঢাকা ছেড়ে নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে। বাবাকেও অনেকে বলতেন_ ঢাকায় থেকে লাভ নেই। স্ত্রী এবং মেয়ে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যান। আমাদের কম্পাউন্ডে যেসব শিক্ষক থাকতেন তাদের অনেকেই চলে গিয়েছিলেন। অনেকে আবার দরজায় তালা লাগিয়ে ভেতরে অবস্থান করতেন। বাবা মাকে বলতেন আমাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মা তাতে রাজি হননি। বাবার ধারণা ছিল, পাকিস্তান সরকার হয়তো বড়জোর অ্যারেস্ট করবে। এবং তাদেরকে ঘাড়ে বন্দুক রেখে ক্লাস নিতে বাধ্য করবে। সবাই মনে মনে এ রকম কিছুরই প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
২৫ মার্চ রাত ১২টা নাগাদ গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। এর আগে প্রায় প্রতি রাতেই ছাত্ররা ফাঁকা গুলির আওয়াজ করত। আমরা ভেবেছি সে রকম কিছুই হবে হয়তো। কিন্তু ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়তে লাগল। বাবা খাতা দেখছিলেন সেই সময়। আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর মা বাড়িতেই অন্য একটা ঘরে ছিলেন। গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে আমরা কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলাম। আমাকে জাগিয়ে তোলা হয় ঘুম থেকে। আমরা সবাই এক জায়গায় রুমের ফ্লোরে শুয়ে পড়ি। মা এক সময় জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে পেলেন এক বহর সেনা জিপ আমাদের কম্পাউন্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। আমরা নিচের তলায় থাকতাম বলে তারা পেছন দিক থেকে আমাদের বাসার দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগল। এ ছাড়াও অন্য বাসার লোকজনকেও ডেকে তোলা হলো। এর মাঝে আমাদের কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিল। এক পাকিস্তানি সৈন্য এসে বাবা সম্পর্কে জানতে চাইল। আমার মা এসে তখন তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সৈন্যটি বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। মা ভেতরে এসে বাবাকে এই কথা বলার পর বাবা বের হয়ে এলেন। বাবা বেরিয়ে আসার পর সৈন্যটি জানতে চাইল- 'আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায়?' বাবা উত্তর করলেন_ হ্যাঁ। তখন সৈন্যটি বলল, 'আপকো হাম লে জায়েঙ্গে।' বাবা এর কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু সৈন্যটি বাবাকে কোনো সদুত্তর না দিয়ে তার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। আমরা সর্বোচ্চ আশঙ্কা করেছিলাম, বাবাকে হয়তো অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান মনিরুজ্জামান স্যার আামাদের উপরের তলায় থাকতেন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তিনিই দরজা খুলেছিলেন। তার বাসা থেকে তাকে, তার ছেলে, তার ভাই এবং বোনের ছেলেসহ বেশ কয়েকজনকে তারা নিচে নামিয়ে আনতে থাকে। বাসার অন্য সবাই কান্নাকাটি করছিল। অনেকে স্বজনদের হাত ধরে রেখেছে। নিচে আনতে দিচ্ছিল না। আমার মা তখন তাদের বললেন বেশি জোর না করতে। কারণ তাতে সৈন্যরা গুলি করে দিতে পারে। এর পরই বিকট গুলির আওয়াজ পাই। বাইরে বেরিয়ে দেখি মনিরুজ্জামান স্যারসহ তার সঙ্গের সবাইকে সিঁড়ির নিচে এনে গুলি করা হয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। অনেকেই মারা গেছেন। অনেকেই মৃত্যুযন্ত্রণায় পানি-পানি বলে কাতরাচ্ছেন। আমরা তখন তাড়াতাড়ি জগ-কলসি নিয়ে বের হয়ে এলাম। এ সময় প্রফেসর সাহেবের স্ত্রী কিংবা তার বোন কেউ একজন মাকে বললেন, আপনার স্বামীকেও গুলি করা হয়েছে। এ কথা শুনে আমাদের টনক নড়ল। আমরা তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাবা বাইরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। বাবার মুখ থেকে শুনলাম_ তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে সৈন্যরা প্রথমে জানতে চাইল তার নাম। তিনি নাম বলার পর তারা জানতে চাইল তার ধর্ম। বাবা সচরাচর নিজেকে মানবতাবাদী বলেই পরিচয় দিতেন। কিন্তু সেদিন উত্তর করলেন_ হিন্দু। তৎক্ষণাৎ তাকে গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। বাবাকে প্রথমে ওরা ঘাড়ে গুলি করে। তারপর দ্বিতীয় গুলিটা করে কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা পড়ে যান এবং তার পুরো শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। তাই তিনি আর ভেতরে যেতে পারেননি। আমরা তাকে ধরাধরি করে মনিরুজ্জামান স্যারদের লাশগুলোর উপর দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসি। সেই রাতে চারদিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই আমরা। মাঝে একবার থেমে যায় আবার শুরু হয় গোলাগুলি। জগন্নাথ হল থেকে আগুনের ফুলকি দেখতে পাই। বাইরে কারফিউ চলছিল বিধায় বাবাকে নিয়ে হাসপাতালেও যেতে পারছিলাম না। এ সময় জগন্নাথ হল থেকে চার জন ছাত্র এসে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। ২৬ মার্চ দিন-রাত বাবাকে নিয়ে আমরা বাসাতেই থাকলাম। কোনো ওষুধপত্র কিংবা ডাক্তার নেই। এর মাঝে দিনের বেলা পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার এসেছিল মনিরুজ্জামান স্যারদের লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। ততক্ষণে তাদের বাসার লোকজন লাশগুলো তিন তলায় তাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। তারা আবার লাশগুলো টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে গেল জগন্নাথ হলে যে গণকবর খোঁড়া হয়েছিল সেখানে কবর দেওয়ার জন্য। আমরা ভয় পেয়েছিলাম_ এবার বাবাকে যদি এসে দেখে তাহলে তো আর রক্ষা নেই! আমরা তখন নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। সৈন্যরা বাইরে চার জনকে মেরেছে ভেবে ঐ বাসার চার জনকেই নিয়ে যায়। বাবার কথা তাদের আর খেয়াল ছিল না। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ভাঙার পর রাস্তার কিছু সাধারণ মানুষের দ্বারা বাবাকে উল্টো দিকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখনও বাবা সচেতন এবং জীবিত। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা জানান যে, 'ক্রিটিকাল ইনজুরি'র কারণে আর কিছুই করা সম্ভব নয়। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কোনো সিটে তুলতে পারিনি। কারণ এত আহত মানুষ ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল যে, কোনো আসনই ফাঁকা ছিল না। বাবাকে প্রথমে নিচে রাখা হয়। এর পর তার শিক্ষক পরিচয় পেয়ে তাকে আলাদা একটি বেডে স্থানান্তর করা হয়। আমি তখন কান্নাকাটি করছি মাকে বলছি, মা তুমি দেওয়াল টপকিয়ে নার্সদের হোস্টেলে যাও একজন নার্সকে নিয়ে এসো, বা স্বপ্ন দেখছি, ইস্, যদি একটা রেডক্রসের অ্যাম্বুুলেন্স পাওয়া যেত, তাহলে বাবাকে তাদের হাতেই তুলে দিতাম। বাবা সুচিকিৎসা পান, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন_ তখন সেটাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা। দেখতে পাচ্ছিলাম চারদিক থেকে অসংখ্য লাশ নিয়ে আসা হচ্ছিল রিকশা ভর্তি করে। লাশের মিছিলে ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ ভারি হয়ে গিয়েছিল। আমরা বাবার সঙ্গে হাসপাতালেই অবস্থান করতে লাগলাম। এর মাঝে ২৮ তারিখে ডিনামাইট দিয়ে শহীদ মিনার উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ডিনামাইট ফাটার প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠেছিল মেডিকেল ভবন। হাসপাতালে আক্রমণ হবে_ এই আশঙ্কায় অনেক রোগীই হাসপাতাল ছেড়ে যেতে লাগল। ডাক্তাররাও জীবনের ভয়ে পালিয়ে
গেলেন। শুধু আমরা থেকে গেলাম। চিকিৎসার অভাবে বাবা মারা যান ৩০ মার্চ তারিখে। তার পরেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হয় বাবাকে ওভাবে রেখেই তখন আর্মি হাসপাতাল আক্রমণ করার ফলে তার মৃতদেহের সৎকার আমরা করতে পারিনি। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে মা গিয়েছিলেন মর্গে বাবার লাশ খোঁজ করতে। কিন্তু তিনি তার লাশ খুঁজে পাননি। পরে একজন থেকে শুনেছিলাম, বাবাকে মেডিকেল প্রাঙ্গণেই সমাহিত করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো ভিত্তি নেই। আমার মা বাসন্তী গুহঠাকুরতা হতোদ্যম হয়ে পড়লেন।
সব দিকেই বিপদ_ যুদ্ধ আর যুদ্ধ। খ্রিস্টান পরিচয় দিয়ে তিনি নিজে ভর্তি হলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আর আমাকে রাখলেন ফার্মগেটের একটি অরফানেজে। এর পর ঢাকা শহরেই আমরা নয় মাস ছিলাম। বিভিন্ন মানুষের বাসায়, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রূপ নিয়ে থাকতে হয়েছিল আমাদের। তখন হিন্দু ছেলেমেয়েদের ওপর এক ধরনের আক্রমণ চলছিল। আর্মিরা এসে রেজিস্টারে রোল চেক করত_ কে হিন্দু আর কে মুসলমান। তারপর বেছে বেছে নিয়ে যেত হিন্দুদের। অনেকেই আমাদের ভারতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত থেকেই গিয়েছি। মায়ের স্থির বিশ্বাস ছিল, আমরা যদি অন্যদের মতো ভারতে চলে যাই, তাহলে বাবার মৃত্যু প্রমাণিত হবে না। মা যখন পরে হাসপাতালে বাবার ডেথ সার্টিফিকেট নিতে যান, তখন দেখেন যে তাতে লেখা আছে_ 'ডেথ বাই নিউমোনিয়া'! মা যখন এ ব্যাপারে ডাক্তারদের প্রশ্ন করেন; ডাক্তাররা বলেন, 'সত্য কথাটা আমরা এখন বলতে পারব না। এখন আপনাকে এই ডেথ সার্টিফিকেটই নিতে হবে'। বাধ্য হয়ে সে যাত্রায় ভুল সার্টিফিকেটই নিতে হয়েছিল আমাদের। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নানা বেশে নানা পরিচয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। সময় গড়াতে লাগল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ জোরদার হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে দেশ স্বাধীনতার দিকে এগুতে লাগল। অজস্র জীবন, ত্যাগ আর স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে একটা সময় দেশ স্বাধীনও হলো। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষরা আর ফিরে এলো না। তারা জানতে পারল না_ তাদের জীবনের বিনিময়েই এই দেশ আজ স্বাধীন। স্বাধীনতার অজর্নকে রক্ষায় সবাইকে একাত্ম হয়ে কাজ করার সময় এসেছে বর্তমানে। হ
লেখক : গবেষক, উন্নয়নকর্মী
শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কন্যা
২৫ মার্চ রাত ১২টা নাগাদ গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। এর আগে প্রায় প্রতি রাতেই ছাত্ররা ফাঁকা গুলির আওয়াজ করত। আমরা ভেবেছি সে রকম কিছুই হবে হয়তো। কিন্তু ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়তে লাগল। বাবা খাতা দেখছিলেন সেই সময়। আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর মা বাড়িতেই অন্য একটা ঘরে ছিলেন। গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে আমরা কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলাম। আমাকে জাগিয়ে তোলা হয় ঘুম থেকে। আমরা সবাই এক জায়গায় রুমের ফ্লোরে শুয়ে পড়ি। মা এক সময় জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে পেলেন এক বহর সেনা জিপ আমাদের কম্পাউন্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। আমরা নিচের তলায় থাকতাম বলে তারা পেছন দিক থেকে আমাদের বাসার দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগল। এ ছাড়াও অন্য বাসার লোকজনকেও ডেকে তোলা হলো। এর মাঝে আমাদের কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিল। এক পাকিস্তানি সৈন্য এসে বাবা সম্পর্কে জানতে চাইল। আমার মা এসে তখন তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সৈন্যটি বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। মা ভেতরে এসে বাবাকে এই কথা বলার পর বাবা বের হয়ে এলেন। বাবা বেরিয়ে আসার পর সৈন্যটি জানতে চাইল- 'আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায়?' বাবা উত্তর করলেন_ হ্যাঁ। তখন সৈন্যটি বলল, 'আপকো হাম লে জায়েঙ্গে।' বাবা এর কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু সৈন্যটি বাবাকে কোনো সদুত্তর না দিয়ে তার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। আমরা সর্বোচ্চ আশঙ্কা করেছিলাম, বাবাকে হয়তো অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান মনিরুজ্জামান স্যার আামাদের উপরের তলায় থাকতেন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তিনিই দরজা খুলেছিলেন। তার বাসা থেকে তাকে, তার ছেলে, তার ভাই এবং বোনের ছেলেসহ বেশ কয়েকজনকে তারা নিচে নামিয়ে আনতে থাকে। বাসার অন্য সবাই কান্নাকাটি করছিল। অনেকে স্বজনদের হাত ধরে রেখেছে। নিচে আনতে দিচ্ছিল না। আমার মা তখন তাদের বললেন বেশি জোর না করতে। কারণ তাতে সৈন্যরা গুলি করে দিতে পারে। এর পরই বিকট গুলির আওয়াজ পাই। বাইরে বেরিয়ে দেখি মনিরুজ্জামান স্যারসহ তার সঙ্গের সবাইকে সিঁড়ির নিচে এনে গুলি করা হয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। অনেকেই মারা গেছেন। অনেকেই মৃত্যুযন্ত্রণায় পানি-পানি বলে কাতরাচ্ছেন। আমরা তখন তাড়াতাড়ি জগ-কলসি নিয়ে বের হয়ে এলাম। এ সময় প্রফেসর সাহেবের স্ত্রী কিংবা তার বোন কেউ একজন মাকে বললেন, আপনার স্বামীকেও গুলি করা হয়েছে। এ কথা শুনে আমাদের টনক নড়ল। আমরা তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাবা বাইরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। বাবার মুখ থেকে শুনলাম_ তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে সৈন্যরা প্রথমে জানতে চাইল তার নাম। তিনি নাম বলার পর তারা জানতে চাইল তার ধর্ম। বাবা সচরাচর নিজেকে মানবতাবাদী বলেই পরিচয় দিতেন। কিন্তু সেদিন উত্তর করলেন_ হিন্দু। তৎক্ষণাৎ তাকে গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। বাবাকে প্রথমে ওরা ঘাড়ে গুলি করে। তারপর দ্বিতীয় গুলিটা করে কোমরে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা পড়ে যান এবং তার পুরো শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। তাই তিনি আর ভেতরে যেতে পারেননি। আমরা তাকে ধরাধরি করে মনিরুজ্জামান স্যারদের লাশগুলোর উপর দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসি। সেই রাতে চারদিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই আমরা। মাঝে একবার থেমে যায় আবার শুরু হয় গোলাগুলি। জগন্নাথ হল থেকে আগুনের ফুলকি দেখতে পাই। বাইরে কারফিউ চলছিল বিধায় বাবাকে নিয়ে হাসপাতালেও যেতে পারছিলাম না। এ সময় জগন্নাথ হল থেকে চার জন ছাত্র এসে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। ২৬ মার্চ দিন-রাত বাবাকে নিয়ে আমরা বাসাতেই থাকলাম। কোনো ওষুধপত্র কিংবা ডাক্তার নেই। এর মাঝে দিনের বেলা পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার এসেছিল মনিরুজ্জামান স্যারদের লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। ততক্ষণে তাদের বাসার লোকজন লাশগুলো তিন তলায় তাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। তারা আবার লাশগুলো টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে গেল জগন্নাথ হলে যে গণকবর খোঁড়া হয়েছিল সেখানে কবর দেওয়ার জন্য। আমরা ভয় পেয়েছিলাম_ এবার বাবাকে যদি এসে দেখে তাহলে তো আর রক্ষা নেই! আমরা তখন নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। সৈন্যরা বাইরে চার জনকে মেরেছে ভেবে ঐ বাসার চার জনকেই নিয়ে যায়। বাবার কথা তাদের আর খেয়াল ছিল না। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ভাঙার পর রাস্তার কিছু সাধারণ মানুষের দ্বারা বাবাকে উল্টো দিকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখনও বাবা সচেতন এবং জীবিত। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা জানান যে, 'ক্রিটিকাল ইনজুরি'র কারণে আর কিছুই করা সম্ভব নয়। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কোনো সিটে তুলতে পারিনি। কারণ এত আহত মানুষ ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল যে, কোনো আসনই ফাঁকা ছিল না। বাবাকে প্রথমে নিচে রাখা হয়। এর পর তার শিক্ষক পরিচয় পেয়ে তাকে আলাদা একটি বেডে স্থানান্তর করা হয়। আমি তখন কান্নাকাটি করছি মাকে বলছি, মা তুমি দেওয়াল টপকিয়ে নার্সদের হোস্টেলে যাও একজন নার্সকে নিয়ে এসো, বা স্বপ্ন দেখছি, ইস্, যদি একটা রেডক্রসের অ্যাম্বুুলেন্স পাওয়া যেত, তাহলে বাবাকে তাদের হাতেই তুলে দিতাম। বাবা সুচিকিৎসা পান, তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন_ তখন সেটাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা। দেখতে পাচ্ছিলাম চারদিক থেকে অসংখ্য লাশ নিয়ে আসা হচ্ছিল রিকশা ভর্তি করে। লাশের মিছিলে ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ ভারি হয়ে গিয়েছিল। আমরা বাবার সঙ্গে হাসপাতালেই অবস্থান করতে লাগলাম। এর মাঝে ২৮ তারিখে ডিনামাইট দিয়ে শহীদ মিনার উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ডিনামাইট ফাটার প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠেছিল মেডিকেল ভবন। হাসপাতালে আক্রমণ হবে_ এই আশঙ্কায় অনেক রোগীই হাসপাতাল ছেড়ে যেতে লাগল। ডাক্তাররাও জীবনের ভয়ে পালিয়ে
গেলেন। শুধু আমরা থেকে গেলাম। চিকিৎসার অভাবে বাবা মারা যান ৩০ মার্চ তারিখে। তার পরেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হয় বাবাকে ওভাবে রেখেই তখন আর্মি হাসপাতাল আক্রমণ করার ফলে তার মৃতদেহের সৎকার আমরা করতে পারিনি। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে মা গিয়েছিলেন মর্গে বাবার লাশ খোঁজ করতে। কিন্তু তিনি তার লাশ খুঁজে পাননি। পরে একজন থেকে শুনেছিলাম, বাবাকে মেডিকেল প্রাঙ্গণেই সমাহিত করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো ভিত্তি নেই। আমার মা বাসন্তী গুহঠাকুরতা হতোদ্যম হয়ে পড়লেন।
সব দিকেই বিপদ_ যুদ্ধ আর যুদ্ধ। খ্রিস্টান পরিচয় দিয়ে তিনি নিজে ভর্তি হলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আর আমাকে রাখলেন ফার্মগেটের একটি অরফানেজে। এর পর ঢাকা শহরেই আমরা নয় মাস ছিলাম। বিভিন্ন মানুষের বাসায়, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রূপ নিয়ে থাকতে হয়েছিল আমাদের। তখন হিন্দু ছেলেমেয়েদের ওপর এক ধরনের আক্রমণ চলছিল। আর্মিরা এসে রেজিস্টারে রোল চেক করত_ কে হিন্দু আর কে মুসলমান। তারপর বেছে বেছে নিয়ে যেত হিন্দুদের। অনেকেই আমাদের ভারতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত থেকেই গিয়েছি। মায়ের স্থির বিশ্বাস ছিল, আমরা যদি অন্যদের মতো ভারতে চলে যাই, তাহলে বাবার মৃত্যু প্রমাণিত হবে না। মা যখন পরে হাসপাতালে বাবার ডেথ সার্টিফিকেট নিতে যান, তখন দেখেন যে তাতে লেখা আছে_ 'ডেথ বাই নিউমোনিয়া'! মা যখন এ ব্যাপারে ডাক্তারদের প্রশ্ন করেন; ডাক্তাররা বলেন, 'সত্য কথাটা আমরা এখন বলতে পারব না। এখন আপনাকে এই ডেথ সার্টিফিকেটই নিতে হবে'। বাধ্য হয়ে সে যাত্রায় ভুল সার্টিফিকেটই নিতে হয়েছিল আমাদের। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নানা বেশে নানা পরিচয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। সময় গড়াতে লাগল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ জোরদার হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে দেশ স্বাধীনতার দিকে এগুতে লাগল। অজস্র জীবন, ত্যাগ আর স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে একটা সময় দেশ স্বাধীনও হলো। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষরা আর ফিরে এলো না। তারা জানতে পারল না_ তাদের জীবনের বিনিময়েই এই দেশ আজ স্বাধীন। স্বাধীনতার অজর্নকে রক্ষায় সবাইকে একাত্ম হয়ে কাজ করার সময় এসেছে বর্তমানে। হ
লেখক : গবেষক, উন্নয়নকর্মী
শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কন্যা
No comments