স্বাধীনতা দিবস-লক্ষ্যে স্থির থেকেই এগিয়ে যেতে হবে by মোহীত উল আলম
ঈশপের সবচেয়ে পরিচিত গল্পটির কথা বলছি: খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প। খরগোশ তার লক্ষ্যবস্তু জানত: তালগাছ। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর জন্য দৌড় সমাপ্ত করার বদলে সে এক প্রস্থ ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কারণ, তার প্রতিপক্ষ কচ্ছপ তো খুব ধীরগতির প্রাণী। কচ্ছপকে সে অবমূল্যায়ন করল, ফলে অতি আত্মবিশ্বাস থেকে সে বাজিটা হারল।
গল্পটির নৈতিক শিক্ষা এক জোড়া: ধীর কিন্তু অবিচলভাবে যারা পথ চলে তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষকে কখনো হেয় ভাবতে নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গল্পটি থেকে আরেকটি নৈতিক শিক্ষা আমরা পেতে পারি, আর সেটা হচ্ছে লক্ষ্য অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটিও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বর্তমানও। খরগোশ এ পথটি, অর্থাৎ বর্তমানকে অতিক্রমণের ব্যাপারে হেলাফেলা করেছিল। লক্ষ্যবস্তু তালগাছটি তার মাথায় ছিল, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর জন্য যে দীক্ষা, সেটি তার মধ্যে ছিল না।
বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পর থেকে আমাদের সবার স্বপ্ন হয়ে গেল সোনার বাংলা গঠন করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা বলতে সবার মুখে হাসি ফোটানোকে বুঝিয়েছিলেন। ‘সবার’ বলতে তিনি একান্তভাবে গরিব জনগোষ্ঠীকে বুঝেছিলেন। কিন্তু এ সোনার বাংলা বলতে রূপক অর্থে যদি আমরা ঈশপের তালগাছটি বুঝে থাকি, তাহলে আমরা সেখানে পৌঁছানোর জন্য খরগোশের পথ ধরতে পারি, কিংবা কচ্ছপের পথ। কিংবা তার চেয়ে ভালো হয় সে পথটি, যেটি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের এলাকাধীন পাহাড়গাত্রে ইটের অক্ষর দিয়ে লেখা আছে দেখা যায়: ফাস্ট অ্যান্ড স্টেডি—দ্রুত ও নিশ্চিত। ঈশপের গল্পের নীতিকথাটি ছিল: ধীর এবং নিশ্চিত।
যাহোক, আমার আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য, পথটি দ্রুত পার হব নাকি আস্তে পার হব, সেটি নয়। পথটি নিশ্চিত কি অনিশ্চিত, সেটিও নয়। আমার উদ্দেশ্য হলো, পথটির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা, যেটা খরগোশ মিঞা হিসেবে নেয়নি।
পথটি ত্রিমাত্রিক: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। এ তিনটি মাত্রাকে পারস্পরিক নির্ভরশীল সূচক হিসেবে আলোচনা করা যায়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাজনৈতিক পথটি সবচেয়ে এলোমেলো। সংসদ প্রায় একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে সামরিক শাসন ছিল প্রায় ১৭ বছর। প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘এ বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’ তাঁর প্রশ্নটির গুরুত্ব এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে হতাশার কারণ যদি বিশ্লেষণ করি, দেখব, খরগোশের মতো আমরা তালগাছ বা সোনার বাংলাকে মাথায় রেখেছি, কিন্তু তারই (খরগোশের) মতো পথপরিক্রমার ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করছি। কেমন করে? প্রথম কথা হলো, সংসদ যত অকার্যকরই হোক, সংসদে আইন পাস করা ছাড়া তো জাতীয়ভিত্তিক কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। যদি আজকে পদ্মা সেতু হয়, সেটিরও সিদ্ধান্ত সংসদের অনুমতি ছাড়া হবে না। যদি আজকে নারীশিক্ষা কলেজ পর্যন্ত অবৈতনিক করা হয়, সে সিদ্ধান্তও পাস হতে হবে সংসদে। কাজেই সংসদ সব কর্মকাণ্ডের উৎস ও রক্ষক। বাংলাদেশ ২৩ বছর কাল অতিক্রম করছে সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে এবং এ সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি করেনি, তা নয়। বাংলাদেশ এখন জলজাহাজ বানাচ্ছে, সামনে হয়তো উড়োজাহাজ বানাবে। যদিও একটি দেশের মূল উন্নয়নের সূচক হচ্ছে দারিদ্র্যের বিমোচন এবং সে পথ কিছুটা অতিক্রম করলেও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনো অনেক দেরি।
যাহোক, যদি তুলনা করা হয়, সামরিক শাসনের সময় বাংলাদেশের কী উন্নতি আর সংসদীয় গণতন্ত্রের সময় অর্জন কী হয়েছে, তাহলে দেখা যাবে যে সংসদীয় আমলের সময়কার উন্নতিই প্রভূত পরিমাণে বেশি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও এ তুলনাটা করা যেতে পারে। আমি বিশেষভাবে ভারত ও পাকিস্তানের কথা বলছি, কেননা দুই দেশের শাসনব্যবস্থার পার্থক্য এবং উন্নতির সূত্রগুলোর মধ্যে ব্যবধান সম্পর্কে আমরা অবহিত। পত্রিকায় একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখলাম, প্রতিরক্ষার দিক থেকে ভারতের অবস্থান চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সের পরে, অর্থাৎ পঞ্চম।
কাজেই চার্চিল যেমন হেঁয়ালিপূর্ণভাবে বলেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র অত্যন্ত নিকৃষ্ট জাতীয় কিছু, কিন্তু এটির চেয়ে ভালো কোনো শাসনব্যবস্থা নেই, ঠিক সে রকম আমাদেরও বুঝতে হবে, বর্তমানের সংসদীয় হালচাল যা-ই হোক না কেন, এটিই আমাদের জন্য ভরসা। শুধু আমাদের আশা করতে হবে যে একদিন এ সংসদ সুচারুভাবে কার্যকর হবে।
কাজেই সংসদীয় বর্তমান বেহাল অবস্থার দিকে চোখ বন্ধ করে রাখলে হবে না বা খরগোশের মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে হবে না, বরং কচ্ছপের মতো সজাগ থেকে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে এ কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। যখন আমরা সেটি করতে যাব, তখন বুঝতে হবে আমরা বর্তমানের পথপরিক্রমার পর্যায়টিকে আমলে নিচ্ছি। এ কঠিন পথটির প্রকৃতি বোঝার জন্যও একটি চিন্তা দরকার।
প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোকে বলা যায় সাপে-নেউলের সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান করছে। এখন বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কিন্তু যখন এ ইস্যুটি ছিল না, তখনো বিএনপি সংসদে যায়নি। অনুরূপভাবে বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগও নানা অজুহাতে সংসদ বর্জন করে চলেছিল। ফলে ইস্যুটি আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অনুরূপ কিছু নয়, ইস্যুটি আসলে আরও গভীরে প্রোথিত যে সংকটটাকে বলা যায় ‘পরিচিতি সংকট’।
সর্বজন জানেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিজাতিক তত্ত্ব নামক একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দর্শনের ভিত্তিতে। কিন্তু অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হতে থাকল যে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দর্শনের ভিত্তিতে চলতে পারে না। শোষণপ্রক্রিয়া একটি অর্থনৈতিক পরিকাঠোমোয় ঘটতে থাকে, যাকে রাজনৈতিক ফাঁকা বুলি বা রিটারিক হিসেবে পরিপুষ্ট করতে পারে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দর্শন, যেটি পাকিস্তানের প্রথম ২৩ বছরকালীন ঘটে যাচ্ছিল—কিন্তু যেটি অর্থনৈতিক শোষণপ্রক্রিয়ার মৌলিক সূত্রগুলোকে, যেমন বিনিয়োগ, উৎপাদন, লাভ—প্রভাবিত করতে পারে না। সোজা কথায় টাকার কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নেই, না ধর্মীয়, না জাতিগত, না গোত্রীয়, না রাজনৈতিক, অবশেষে না লৈঙ্গিক। ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না’, এ বাক্যটি লঘুচ্ছলে যতই না গৃহবধূকে পুঁজি নিয়োগে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করুক, ‘অঞ্চল’ শব্দটির অর্থ এলাকা হিসেবে এ কথাও দাঁড়ায় যে টাকা কোনো এলাকায় গণ্ডিবদ্ধ থাকবে, সে রকম জিনিস নয়।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের উত্তরণপর্ব বস্তুত সেই পথটি, যেটিকে বলতে পারি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘোর থেকে বের হয়ে অসাম্প্রদায়িক জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটি দেশের সৃষ্টি হওয়ার পথ। অর্থাৎ সোজা কথায়, আমাদের মুসলমান-বাঙালি, হিন্দু-বাঙালি থেকে বাঙালি-মুসলমান এবং বাঙালি-হিন্দুতে পরিণত হওয়া। এ পরিচিতি-সংকটের মুখোমুখি হলে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমে বাঙালি।’
আমরা যে জাতিগতভাবে প্রথমে বাঙালি এ কথাটা উপলব্ধি করলে কয়েকটা জিনিস সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যায়: এক. অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সংশ্লেষ রইল না। হিন্দু হিন্দুকে যেমন শোষণ করতে পারে, তেমনি মুসলমান মুসলমানকে শোষণ করতে পারে। কাজেই তখন অর্থনৈতিক সূত্রগুলোকে কেবল অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যে রেখে পরিচালনা করা সম্ভব। হয়তো সুদকে সুদ হিসেবে বিবেচনা না করে বিনিয়োগকৃত পুঁজির ওপর লাভ উপার্জন করার যে চিরাচরিত অর্থনৈতিক রীতি, সেটি অক্ষুণ্ন থাকবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রভাব যে ভৌগোলিকভাবে ক্রিয়াশীল নয়, সেটিও পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ ধর্ম মানব মনের ওপর প্রভাব ফেললেও ভূগোলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না। মৌলিকভাবে এটি জলবায়ু, ফসল, আহারাদি ও পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম যথাক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যত ছড়িয়েছে, ততই সেসব অঞ্চলের জলবায়ু ও নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা রাশিয়ায় গিয়ে প্রবল তুষারপাতকে মেনে নিয়ে ভারী ওভারকোট পরেছে, আর বাংলাদেশের মৌসুমি বারিধারার কবলে পড়ে মাথায় ডুলা পরে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে জমিতে ধান রুয়েছে। আমি এক বাঙালি মুসলমান কানাডার মতো শীতের দেশে গিয়ে গ্রীষ্মকালে রোজা (১৯৮২-৮৩) পড়লে সূর্যাস্ত-সূর্যডুবির ধারা মেনে সাড়ে ১৯ ঘণ্টা করে রোজা রেখেছিলাম। ধর্মীয় চারিত্র্যের এ ভৌগোলিক নমনীয়তা স্বীকার করা হয়নি বলে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান অচিরেই ভেঙে যায়। তৃতীয়ত হচ্ছে ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি যখন তৈরি হবে, তখন কয়েকটি সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারব যে ধর্ম একেকজনের একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং মেধা ও কর্মদক্ষতা কারও ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না বা থাকে না তার বেশবাসের মধ্যে। পর্দানশিন মহিলা যেমন উচ্চপদস্থ ব্যাংকার হতে পারেন, লম্বা শ্মশ্রুমণ্ডিত টুপিধারী ব্যক্তি যেমন ১ নম্বরের শৈল্যচিকিৎসক হতে পারেন, তেমনি আবার জিনস ও টি-শার্ট পরা ভদ্রলোকও উগ্রবাদী জঙ্গি হতে পারেন। আবার খুব উদারনৈতিক লোক এমন পোশাক পরিধান করতে পারেন যে তাঁকে উদার লোক বলে চিহ্নিত করা যাবে না। এ কথা স্বীকার করার অর্থ হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক সমাজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হচ্ছে ভীষণভাবে মিশ্রিত একটি দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক সমাজ। রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি হলেও জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি আর আমাদের বিকাশ হয়েছে প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের, প্রধানত সুফিবাদী, ইসলামিক ভাবধারায়। এ সংকরায়ণই আমাদের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। এবং একুশ শতাব্দীর বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক আচরণ পুরোমাত্রায় সংকরায়িত সংস্কৃতি।
এ সংকরায়ণ সাংস্কৃতিক পথটির চিহ্নিতকরণ এবং তার সঙ্গে অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য অসাম্প্রদায়িক বা নৈর্ব্যক্তিক সূত্রগুলোর সংশ্লেষ বা আত্তীকরণ এবং এ ভাবধারায় এগিয়ে যাওয়া, এটিই হচ্ছে সোনার বাংলা বা তালগাছ অভিমুখে যাওয়ার জন্য আমাদের কচ্ছপ নির্ধারিত পথ। এ পথটি চিনতে না পারলে সংসদীয় সংকট কাটতে আরও দীর্ঘ সময় নেবে।
মোহীত উল আলম, বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা এবং গল্পকার ও ঔপন্যাসিক।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গল্পটি থেকে আরেকটি নৈতিক শিক্ষা আমরা পেতে পারি, আর সেটা হচ্ছে লক্ষ্য অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটিও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বর্তমানও। খরগোশ এ পথটি, অর্থাৎ বর্তমানকে অতিক্রমণের ব্যাপারে হেলাফেলা করেছিল। লক্ষ্যবস্তু তালগাছটি তার মাথায় ছিল, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর জন্য যে দীক্ষা, সেটি তার মধ্যে ছিল না।
বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পর থেকে আমাদের সবার স্বপ্ন হয়ে গেল সোনার বাংলা গঠন করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা বলতে সবার মুখে হাসি ফোটানোকে বুঝিয়েছিলেন। ‘সবার’ বলতে তিনি একান্তভাবে গরিব জনগোষ্ঠীকে বুঝেছিলেন। কিন্তু এ সোনার বাংলা বলতে রূপক অর্থে যদি আমরা ঈশপের তালগাছটি বুঝে থাকি, তাহলে আমরা সেখানে পৌঁছানোর জন্য খরগোশের পথ ধরতে পারি, কিংবা কচ্ছপের পথ। কিংবা তার চেয়ে ভালো হয় সে পথটি, যেটি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের এলাকাধীন পাহাড়গাত্রে ইটের অক্ষর দিয়ে লেখা আছে দেখা যায়: ফাস্ট অ্যান্ড স্টেডি—দ্রুত ও নিশ্চিত। ঈশপের গল্পের নীতিকথাটি ছিল: ধীর এবং নিশ্চিত।
যাহোক, আমার আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য, পথটি দ্রুত পার হব নাকি আস্তে পার হব, সেটি নয়। পথটি নিশ্চিত কি অনিশ্চিত, সেটিও নয়। আমার উদ্দেশ্য হলো, পথটির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা, যেটা খরগোশ মিঞা হিসেবে নেয়নি।
পথটি ত্রিমাত্রিক: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। এ তিনটি মাত্রাকে পারস্পরিক নির্ভরশীল সূচক হিসেবে আলোচনা করা যায়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাজনৈতিক পথটি সবচেয়ে এলোমেলো। সংসদ প্রায় একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে সামরিক শাসন ছিল প্রায় ১৭ বছর। প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘এ বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’ তাঁর প্রশ্নটির গুরুত্ব এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে হতাশার কারণ যদি বিশ্লেষণ করি, দেখব, খরগোশের মতো আমরা তালগাছ বা সোনার বাংলাকে মাথায় রেখেছি, কিন্তু তারই (খরগোশের) মতো পথপরিক্রমার ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করছি। কেমন করে? প্রথম কথা হলো, সংসদ যত অকার্যকরই হোক, সংসদে আইন পাস করা ছাড়া তো জাতীয়ভিত্তিক কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। যদি আজকে পদ্মা সেতু হয়, সেটিরও সিদ্ধান্ত সংসদের অনুমতি ছাড়া হবে না। যদি আজকে নারীশিক্ষা কলেজ পর্যন্ত অবৈতনিক করা হয়, সে সিদ্ধান্তও পাস হতে হবে সংসদে। কাজেই সংসদ সব কর্মকাণ্ডের উৎস ও রক্ষক। বাংলাদেশ ২৩ বছর কাল অতিক্রম করছে সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে এবং এ সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি করেনি, তা নয়। বাংলাদেশ এখন জলজাহাজ বানাচ্ছে, সামনে হয়তো উড়োজাহাজ বানাবে। যদিও একটি দেশের মূল উন্নয়নের সূচক হচ্ছে দারিদ্র্যের বিমোচন এবং সে পথ কিছুটা অতিক্রম করলেও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনো অনেক দেরি।
যাহোক, যদি তুলনা করা হয়, সামরিক শাসনের সময় বাংলাদেশের কী উন্নতি আর সংসদীয় গণতন্ত্রের সময় অর্জন কী হয়েছে, তাহলে দেখা যাবে যে সংসদীয় আমলের সময়কার উন্নতিই প্রভূত পরিমাণে বেশি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও এ তুলনাটা করা যেতে পারে। আমি বিশেষভাবে ভারত ও পাকিস্তানের কথা বলছি, কেননা দুই দেশের শাসনব্যবস্থার পার্থক্য এবং উন্নতির সূত্রগুলোর মধ্যে ব্যবধান সম্পর্কে আমরা অবহিত। পত্রিকায় একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখলাম, প্রতিরক্ষার দিক থেকে ভারতের অবস্থান চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সের পরে, অর্থাৎ পঞ্চম।
কাজেই চার্চিল যেমন হেঁয়ালিপূর্ণভাবে বলেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র অত্যন্ত নিকৃষ্ট জাতীয় কিছু, কিন্তু এটির চেয়ে ভালো কোনো শাসনব্যবস্থা নেই, ঠিক সে রকম আমাদেরও বুঝতে হবে, বর্তমানের সংসদীয় হালচাল যা-ই হোক না কেন, এটিই আমাদের জন্য ভরসা। শুধু আমাদের আশা করতে হবে যে একদিন এ সংসদ সুচারুভাবে কার্যকর হবে।
কাজেই সংসদীয় বর্তমান বেহাল অবস্থার দিকে চোখ বন্ধ করে রাখলে হবে না বা খরগোশের মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে হবে না, বরং কচ্ছপের মতো সজাগ থেকে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে এ কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। যখন আমরা সেটি করতে যাব, তখন বুঝতে হবে আমরা বর্তমানের পথপরিক্রমার পর্যায়টিকে আমলে নিচ্ছি। এ কঠিন পথটির প্রকৃতি বোঝার জন্যও একটি চিন্তা দরকার।
প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোকে বলা যায় সাপে-নেউলের সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান করছে। এখন বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কিন্তু যখন এ ইস্যুটি ছিল না, তখনো বিএনপি সংসদে যায়নি। অনুরূপভাবে বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগও নানা অজুহাতে সংসদ বর্জন করে চলেছিল। ফলে ইস্যুটি আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অনুরূপ কিছু নয়, ইস্যুটি আসলে আরও গভীরে প্রোথিত যে সংকটটাকে বলা যায় ‘পরিচিতি সংকট’।
সর্বজন জানেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিজাতিক তত্ত্ব নামক একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দর্শনের ভিত্তিতে। কিন্তু অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের শোষণপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হতে থাকল যে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দর্শনের ভিত্তিতে চলতে পারে না। শোষণপ্রক্রিয়া একটি অর্থনৈতিক পরিকাঠোমোয় ঘটতে থাকে, যাকে রাজনৈতিক ফাঁকা বুলি বা রিটারিক হিসেবে পরিপুষ্ট করতে পারে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দর্শন, যেটি পাকিস্তানের প্রথম ২৩ বছরকালীন ঘটে যাচ্ছিল—কিন্তু যেটি অর্থনৈতিক শোষণপ্রক্রিয়ার মৌলিক সূত্রগুলোকে, যেমন বিনিয়োগ, উৎপাদন, লাভ—প্রভাবিত করতে পারে না। সোজা কথায় টাকার কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নেই, না ধর্মীয়, না জাতিগত, না গোত্রীয়, না রাজনৈতিক, অবশেষে না লৈঙ্গিক। ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না’, এ বাক্যটি লঘুচ্ছলে যতই না গৃহবধূকে পুঁজি নিয়োগে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করুক, ‘অঞ্চল’ শব্দটির অর্থ এলাকা হিসেবে এ কথাও দাঁড়ায় যে টাকা কোনো এলাকায় গণ্ডিবদ্ধ থাকবে, সে রকম জিনিস নয়।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের উত্তরণপর্ব বস্তুত সেই পথটি, যেটিকে বলতে পারি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘোর থেকে বের হয়ে অসাম্প্রদায়িক জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটি দেশের সৃষ্টি হওয়ার পথ। অর্থাৎ সোজা কথায়, আমাদের মুসলমান-বাঙালি, হিন্দু-বাঙালি থেকে বাঙালি-মুসলমান এবং বাঙালি-হিন্দুতে পরিণত হওয়া। এ পরিচিতি-সংকটের মুখোমুখি হলে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমে বাঙালি।’
আমরা যে জাতিগতভাবে প্রথমে বাঙালি এ কথাটা উপলব্ধি করলে কয়েকটা জিনিস সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যায়: এক. অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সংশ্লেষ রইল না। হিন্দু হিন্দুকে যেমন শোষণ করতে পারে, তেমনি মুসলমান মুসলমানকে শোষণ করতে পারে। কাজেই তখন অর্থনৈতিক সূত্রগুলোকে কেবল অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যে রেখে পরিচালনা করা সম্ভব। হয়তো সুদকে সুদ হিসেবে বিবেচনা না করে বিনিয়োগকৃত পুঁজির ওপর লাভ উপার্জন করার যে চিরাচরিত অর্থনৈতিক রীতি, সেটি অক্ষুণ্ন থাকবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রভাব যে ভৌগোলিকভাবে ক্রিয়াশীল নয়, সেটিও পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ ধর্ম মানব মনের ওপর প্রভাব ফেললেও ভূগোলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না। মৌলিকভাবে এটি জলবায়ু, ফসল, আহারাদি ও পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম যথাক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যত ছড়িয়েছে, ততই সেসব অঞ্চলের জলবায়ু ও নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা রাশিয়ায় গিয়ে প্রবল তুষারপাতকে মেনে নিয়ে ভারী ওভারকোট পরেছে, আর বাংলাদেশের মৌসুমি বারিধারার কবলে পড়ে মাথায় ডুলা পরে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে জমিতে ধান রুয়েছে। আমি এক বাঙালি মুসলমান কানাডার মতো শীতের দেশে গিয়ে গ্রীষ্মকালে রোজা (১৯৮২-৮৩) পড়লে সূর্যাস্ত-সূর্যডুবির ধারা মেনে সাড়ে ১৯ ঘণ্টা করে রোজা রেখেছিলাম। ধর্মীয় চারিত্র্যের এ ভৌগোলিক নমনীয়তা স্বীকার করা হয়নি বলে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান অচিরেই ভেঙে যায়। তৃতীয়ত হচ্ছে ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি যখন তৈরি হবে, তখন কয়েকটি সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারব যে ধর্ম একেকজনের একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং মেধা ও কর্মদক্ষতা কারও ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না বা থাকে না তার বেশবাসের মধ্যে। পর্দানশিন মহিলা যেমন উচ্চপদস্থ ব্যাংকার হতে পারেন, লম্বা শ্মশ্রুমণ্ডিত টুপিধারী ব্যক্তি যেমন ১ নম্বরের শৈল্যচিকিৎসক হতে পারেন, তেমনি আবার জিনস ও টি-শার্ট পরা ভদ্রলোকও উগ্রবাদী জঙ্গি হতে পারেন। আবার খুব উদারনৈতিক লোক এমন পোশাক পরিধান করতে পারেন যে তাঁকে উদার লোক বলে চিহ্নিত করা যাবে না। এ কথা স্বীকার করার অর্থ হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক সমাজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হচ্ছে ভীষণভাবে মিশ্রিত একটি দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক সমাজ। রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি হলেও জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি আর আমাদের বিকাশ হয়েছে প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের, প্রধানত সুফিবাদী, ইসলামিক ভাবধারায়। এ সংকরায়ণই আমাদের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। এবং একুশ শতাব্দীর বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক আচরণ পুরোমাত্রায় সংকরায়িত সংস্কৃতি।
এ সংকরায়ণ সাংস্কৃতিক পথটির চিহ্নিতকরণ এবং তার সঙ্গে অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য অসাম্প্রদায়িক বা নৈর্ব্যক্তিক সূত্রগুলোর সংশ্লেষ বা আত্তীকরণ এবং এ ভাবধারায় এগিয়ে যাওয়া, এটিই হচ্ছে সোনার বাংলা বা তালগাছ অভিমুখে যাওয়ার জন্য আমাদের কচ্ছপ নির্ধারিত পথ। এ পথটি চিনতে না পারলে সংসদীয় সংকট কাটতে আরও দীর্ঘ সময় নেবে।
মোহীত উল আলম, বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা এবং গল্পকার ও ঔপন্যাসিক।
No comments