বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহার্য সামগ্রী by জাহীদ রেজা নূর
একটু থমকে দাঁড়াই। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই ঘরটিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিস্মারক রয়েছে। ঘরটি ছোট, কিন্তু মনে হয়, এ যেন ইতিহাসের ব্যাপ্তি নিয়ে হাজির হয়েছে চোখের সামনে। ওই তো, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার ব্রিফকেসটি। মেটাফিজিক্যাল কবিদের কবিতা বিষয়ে একটি বই রয়েছে সঙ্গে।
এই তো সেই মানুষ, যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের সময় ‘প্রফেসর সাহাব কাহা হ্যায়’ বলে হাজির হয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। অফিসার তাঁকে নিয়ে যেতে চায় তাদের সঙ্গে। পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে এগিয়ে যান অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, কিন্তু বাড়ির পেছনে গিয়ে তাঁর ওপর পর পর দুটি গুলি করে তারা। পাঁচ দিন পর তিনি মারা যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্সে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি ১৯৪২ সালে। ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাই তাঁর আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। এ কারণেই ডান, হার্বার্ট, ভন, মার্ভেলদের নিয়ে লেখা বইটি নিশ্চয় তিনি পড়তেন আগ্রহ নিয়ে। জাতীয় জাদুঘরে আছে তাঁর সাদা ডায়ালের ঘড়ি, টাই। আর আছে ক্ল্যাসিকাল মিথস ইন দ্য প্লেইস অব সুইনবার্ন, ব্রিজেস, স্টার্জ মুর অ্যান্ড এলিয়ট। বইটি তাঁরই লেখা।
ওই তো, অদূরের ওই মানিব্যাগটি অধ্যাপক গিয়াসুদ্দীন আহমেদের। পাশে তাঁর চাদর আর পাঞ্জাবি। যে কটি ছবি দেখেছি, তাতে পাজামা-পাঞ্জাবি যে তাঁর প্রিয় পোশাক ছিল তা বোঝা যায়। এই মানিব্যাগ থেকে কি ১৪ ডিসেম্বরেও টাকা বের করেছিলেন তিনি? বাজারে পাঠিয়েছিলেন কাউকে? এখন আর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। জাতীয় জাদুঘরে আছে শহীদ গিয়াসুদ্দীন আহমেদের দাবার বোর্ড, ঘুঁটি, পাঞ্জাবি, ডায়েরি। দাবা খেলতে ভালোবাসতেন তিনি।
বিসিএসআইআরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আমিন উদ্দিনের কাঠের অ্যাশট্রে, কালো-সোনালি ফাউন্টেনপেন আর কাঁচি দেখতে পাচ্ছি। ১৪ ডিসেম্বর সকাল আটটায় যখন তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কি তিনি এই কলম দিয়ে কিছু লিখেছিলেন, কিংবা ব্যবহার করেছিলেন অ্যাশট্রেটি? তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। তাঁর ছেলে আয়ন কি এখনো অপেক্ষা করে বাবার?
শহীদ ডা. ফজলে রাব্বির গাড়িটি আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সেমিনার হলের সামনে। জাতীয় জাদুঘরে আছে তাঁর রক্তচাপ মাপার যন্ত্রটি, আছে চশমা, ডায়েরি, পাসপোর্ট। ১৫ ডিসেম্বর ডা. ফজলে রাব্বিকে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয় রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে।
অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের গলাবদ্ধ কোটের কাছে গিয়ে অকস্মাৎ চোখ চলে যায় পাশের কাচঘেরা টেবিলটির দিকে। মুসলিম বাজার আর জল্লাদখানা থেকে পাওয়া মানুষের হাড়, করোটি রয়েছে সেখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এই অধ্যাপককেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৪ ডিসেম্বর। ২২ দিন পর মিরপুর বধ্যভূমি থেকে তাঁর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
ডা. আলীম চৌধুরীর ডাক্তারি প্যাড আর প্রেসক্রিপশন এমনভাবে আছে, যা দেখে মনে হচ্ছে, কোনো কাজে অল্পক্ষণের জন্য তিনি বাইরে গেছেন। এখনই ফিরে রোগী দেখবেন আবার, দেবেন ব্যবস্থাপত্র।
এরপর দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের হাতের লেখা দেখে চমকে যাই। আমার বাবার হাতের লেখা! পাঁচ বছর বয়সে জীবনে শেষবারের মতো দেখেছি তাঁকে! নিউজপ্রিন্টের প্যাডে তিনি রাজনৈতিক ভাষ্যকার নামে যে লেখাগুলো লিখতেন, তারই দুটি পাতা সেখানে। ‘লুকোচুরির খেলা’ শিরোনামের এই লেখাটি আমাকে অনেক কিছু বলে। রাজনৈতিক ভাষ্যকার নামে একাত্তর সালে ঢাকাতে বসেই তিনি কৌশলে বাংলাদেশের পক্ষে একের পর এক প্রতিবেদন লিখেছেন। ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ লিখে তিনি পাকিস্তানপন্থীদের রুদ্ররোষের মুখে পড়েন। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র সংগ্রাম পত্রিকায় ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামের লেখায় স্পষ্টতই তাঁকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে এ রকমের একটি নিউজপ্রিন্টের কাগজেই তিনি ‘এতদিনে’ শিরোনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লেখেন, ১১ ডিসেম্বর সেটা প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। তাঁর তিনটি বই রয়েছে জাতীয় জাদুঘরে। অগ্নিপরীক্ষা, ইতিহাস কথা কও আর বীর ও বীরঙ্গনা।
৩০ আগস্ট পাকিস্তান বাহিনী বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় আলতাফ মাহমুদকে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন বাড়ির উঠোনে গর্ত খুঁড়ে। শত নির্যাতনেও তিনি কারও নাম বলেননি। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখানে রাখা আছে তাঁর শেভিং মেশিনটি। আর জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে তাঁর ডায়েরি। সেখানে পাশাপাশি দুটো পাতার প্রথম পাতায় লেখা, ‘তুম কেয়া জানো/ তুমহে কিউ চাহা/ কিউ দিলনে তুমহে/ আপনায়া সনম; অন্য পাতায় দেখেছো তুমি কীি (লেখার সময় তাঁর মনে হ্রস্ব-ই কার ও দীর্ঘ-ই কার নিয়ে দ্বিধা ছিল বলে দুটোই রেখেছেন লেখায়)/ নয়নেরো ছবিটি/ কার স্বপ্ন লয়ে/ ওগো মধুমিতা।’ নিচে লেখা—মিশর কুমারী। জাতীয় জাদুঘরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে দুজন স্কুলছাত্র আলতাফ মাহমুদের হাতের লেখা পড়ার চেষ্টা করছিল। তাঁদের বললাম, ‘কার লেখা পড়ছো, জানো?’
‘আলতাফ মাহমুদের।’
‘বলো তো, তাঁকে কীভাবে চেনা যায়?’
ওরা হাসল। আলতাফ মাহমুদের পরিচিতিটা পড়ল। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরকার দেখে ওদের চোখে অন্য রকম দ্যুতি দেখা গেল। আমি নিশ্চিত, ওরা বাড়ি গিয়ে বলবে, ‘জানো, আমরা একুশের গানের সুরকারের ডায়েরি দেখে এসেছি।’
ডা. আজহারুল হকের পিতলের অ্যাশট্রের পাশে আছে দুটি বই। জাতীয় জাদুঘরে দেখা গেল তাঁর সার্জারির যন্ত্রপাতি। ১৫ নভেম্বর তাঁকে এবং ডা. হুমায়ূন কবীরকে তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাড়ির সামনে আলবদরের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করে। ডা. আজহার বাড়ির সামনের তেঁতুলগাছের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলছিলেন। আলবদরের সদস্যরা তাঁর হাতে আঘাত করে। তারপর ডাক্তার দুজনকে নিয়ে চলে যায়। ১৬ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের সামনের কালভার্টের নিচে তাঁদের দুজনের লাশ পাওয়া যায়। ডা. আজহারের স্ত্রী সালমা হক তখন অন্তঃসত্ত্বা। একমাত্র পুত্রসন্তান নিশানকে তিনি দেখে যেতে পারেননি। আশরাফুল হক নিশান একদা লিখেছিল, ‘আমি সেই হতভাগ্য সন্তান, যার জন্ম হয়েছিল বাবার মৃত্যুর পর।’
সেলিনা পারভীনের সবুজ শাড়ি আর তাঁর সম্পাদিত শিলালিপি ম্যাগাজিনটি আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। জাতীয় জাদুঘরে আছে তাঁর ব্যবহূত শাল। ১৩ ডিসেম্বর ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রায়েরবাজার বধ্যভূমির একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। শহীদ সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ এসে বলেছিল, ‘মিতা (আমাদের দুজনের নামে মিল আছে), আমার মায়ের ছবিটা আমাকে দেবে?’ কেঁপে উঠেছিল মন। মাকে নয়, মায়ের ছবি নিয়েই তৃপ্ত হতে চাইছে সেলিনা পারভীনের একমাত্র সন্তান। সে গল্প করি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনে আসা স্কুল-ছাত্রীদের কাছে। তাদের বলি, ‘একটি আট বছরের শিশু হঠাৎ একদিন তাঁর মায়ের বদলে দেখল মায়ের লাশ, তোমরা কি বুঝতে পারো, কেমন অনুভূতি হতে পারে তার?’
ওরা কোনো কথা বলে না। কোনো কথা বলা যায় না বোধ হয়। এই স্মৃতির মুখোমুখি হওয়া সহজ নয়।
জাতীয় জাদুঘরে দর্শনার্থীর ভিড়। অনেকেই স্মারকগুলো দেখতে আসে। তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তাদের পাশাপাশি আমিও থাকি।
ওই তো শহীদ আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত-এর একটি কপি! আর আছে ডায়েরি। ডায়েরির পাতাগুলো থেকে চোখের সামনে স্পষ্ট হয় কয়েকটি বাক্য, ‘বারংবার গোরস্তান, কবর, মৃত্যু, ভাঙা জাহাজ, অবসাদ, নিখিল নাস্তি...মালার্মের ফিনের দিবাস্বপ্ন সুধীন্দ্রনাথের অর্কেস্ট্রা ফিনের মতো অর্কেস্ট্রার নায়কও মধ্যবয়সী।’ ১৪ ডিসেম্বর ঈশা খাঁ রোডের বাড়িতে আনোয়ার পাশাকে নাশতা দিলেন স্ত্রী মোহসিনা খাতুন। এ সময় তাঁদের বাড়ির সামনে একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আনোয়ার পাশাকে ধরে নিয়ে গেল ওরা। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় শহীদ আনোয়ার পাশার লাশ।
শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদের চশমা, টাইপরাইটার ও চশমার খাপ রয়েছে পাশাপাশি। বিবিসিতে কত সংবাদ তিনি পাঠিয়েছেন এই টাইপরাইটারে লিখে! কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটিতে কেমন লাগত তাঁকে? ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীবাজারের রোকনপুর এলাকায় ছিলেন তাঁরা। সদ্য বিদেশ থেকে শ্যালক এসেছে, তাই বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হয়েছে দুপুরবেলা। সবাই খেতে বসেছে। এমন সময় দরজায় করাঘাত। মুখে রুমাল বাঁধা একদল লোক এসে খাবার টেবিল থেকে ধরে নিয়ে গেল নিজামুদ্দীন আহমেদকে। বিবিসির সংবাদদাতা হিসেবে অবরুদ্ধ বাংলার অনেক খবর তিনি পাঠিয়েছিলেন।
ডা. আলীম চৌধুরী চোখের সার্জারির যন্ত্রপাতি দেখে কেউ কি এখন মনে করতে পারবে, লুকিয়ে কত মুক্তিযোদ্ধার শরীরে অস্ত্রোপচার করেছেন তিনি? ১৫ ডিসেম্বর ডা. আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। লুঙ্গি আর শার্ট ছিল তাঁর পরনে। তিনি কাপড় বদলাতে চাইলে ওরা বলেছিল, অন্য কাপড়ের দরকার নেই। কোথায় যেতে হবে? প্রশ্ন করায় ওরা বলেছিল, গেলেই জানতে পারবেন। একজন চিকিৎসক নিহত হলেন পাশবিক নির্যাতনের ফলে। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ১৮ ডিসেম্বর বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত আলীম চৌধুরীর লাশ পাওয়া গেল। সেই শরীর অস্ত্রোপচার করার অবস্থায় আর ছিল না।
অধ্যাপক আবুল খায়েরের সুদৃশ্য ক্যামেরাটিতে (Super Paxette) জং ধরেছে। এই ক্যামেরা দিয়েই একসময় অনেক ছবি তুলেছেন তিনি। একটি টাইও রয়েছে পাশে। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বাড়ি থেকেই নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন সকালে তিনি হাঁটতে বের হয়েছিলেন। সে সময় খাকি পোশাকধারী একদল মানুষ এসে প্রশ্ন করে, ‘ড. খায়ের কাহা রাহতা হে?’ সরল মানুষ আবুল খায়ের বলেন, আমিই ড. খায়ের। স্ত্রীর একটি শাল ছিল তাঁর গায়ে। সেই শাল দিয়েই চোখ বেঁধে ফেলেছিল নরপশুরা। হত্যাকাণ্ডের ২১ দিন পর মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় ডা. খায়েরের লাশ।
মোহাম্মদ মোর্তজা রচনাবলী, চশমা আর কলম আছে জাতীয় জাদুঘরে। ১৪ ডিসেম্বর সকালে তিনি শেভ করছিলেন ফুলার রোডের বাড়িতে। কাদা-লেপা একটি মাইক্রোবাস সকাল সাড়ে আটটায় তাঁর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। ড. মোর্তজার মেয়ে দ্যুতি অরণীর খেলার শাড়ি দিয়ে চোখ বেঁধে ড. মোর্তজাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি মিরপুরের বধ্যভূমিতে (এখন যেটা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ) তাঁর লাশ পাওয়া যায়।
শহীদ মুনীর চৌধুরীর অপটিমা টাইপরাইটারটি দেখা গেল এখানে। আর আছে নাটকের একটি খাতা। সেখানে লেখা আছে, ‘পাঁচটি দৃশ্য, কোনো দৃশ্য আরম্ভ হয়, যথা...’ অন্য পৃষ্ঠায়, ‘দূরে দূরে—আমার কারফ্যু নাটকের মতোই দৃশ্যগুলো। বিচ্ছিন্ন, যোগসূত্র মূলত অন্তরের।’ ভাষা আন্দোলনের পর লেখা কবর নাটকটি জেলখানায় বসেই লিখেছিলেন মুনীর চৌধুরী। জেলখানায়ই তার অভিনয় হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। সেন্ট্রাল রোডের বাড়ি থেকে ১৪ ডিসেম্বর তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। গোসল সেরেছেন তিনি। খাবার টেবিলে ডাক পড়েছে। এ সময় চার-পাঁচজন যুবক এল বাড়িতে। মুনীর চৌধুরী ‘আসছি, কারা যেন ডাকছে’ বলে বেরিয়ে গেলেন তাদের সঙ্গে। আর ফিরে আসেননি।
স্মৃতিস্মারকগুলো হূদয়ে বেদনা জাগায়। শহীদ কাজী শামসুল হকের দোয়াত-কলম, টুপি, শার্ট; শহীদ সায়ীদুল হাসানের পাঞ্জাবি, স্যুট, ডায়েরি, কলম, ড্রাইভিং লাইসেন্স; শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার ‘এ দেশ আমার’ শিরোনামে ছাপানো কবিতা; শহীদ অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাঁথা, টাই; শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছাইরঙা মাফলার, চেক লুঙ্গি, গলাবদ্ধ কোট; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শহীদ অধ্যাপক মুহম্মদ হবিবুর রহমানের বই কলেজ বীজগণিত, তাঁর হাতে লেখা ‘সরল রেখা ও সমতল’; শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নজমুল হকের কালো ফ্রেমের চমশা, ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সাংবাদিকতার ওপর ডিপ্লোমা; শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামাঙ্কিত প্যাডে লেখা চিঠি, ১৯৫৬ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছ থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার ছবিসহ আরও কত স্মারক যে আছে জাদুঘরে!
এক একটি স্মারকের দিকে তাকাই আর বিষণ্ন হই। আবার একধরনের সুখস্মৃতিও এসে ভর করে শরীরে। জানি, আমাদের এই স্বজনেরা ফিরে আসবেন না আর। বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁরা অজর-অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু এই স্মারকগুলোর কাছাকাছি হয়ে তাঁদের যেন ছুঁতে পারি। মন বলে, এই তো, তাঁরা আছেন আমাদের সঙ্গেই।
জাহীদ রেজা নূর: সাংবাদিক। শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান।ওই তো, অদূরের ওই মানিব্যাগটি অধ্যাপক গিয়াসুদ্দীন আহমেদের। পাশে তাঁর চাদর আর পাঞ্জাবি। যে কটি ছবি দেখেছি, তাতে পাজামা-পাঞ্জাবি যে তাঁর প্রিয় পোশাক ছিল তা বোঝা যায়। এই মানিব্যাগ থেকে কি ১৪ ডিসেম্বরেও টাকা বের করেছিলেন তিনি? বাজারে পাঠিয়েছিলেন কাউকে? এখন আর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। জাতীয় জাদুঘরে আছে শহীদ গিয়াসুদ্দীন আহমেদের দাবার বোর্ড, ঘুঁটি, পাঞ্জাবি, ডায়েরি। দাবা খেলতে ভালোবাসতেন তিনি।
বিসিএসআইআরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আমিন উদ্দিনের কাঠের অ্যাশট্রে, কালো-সোনালি ফাউন্টেনপেন আর কাঁচি দেখতে পাচ্ছি। ১৪ ডিসেম্বর সকাল আটটায় যখন তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কি তিনি এই কলম দিয়ে কিছু লিখেছিলেন, কিংবা ব্যবহার করেছিলেন অ্যাশট্রেটি? তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। তাঁর ছেলে আয়ন কি এখনো অপেক্ষা করে বাবার?
শহীদ ডা. ফজলে রাব্বির গাড়িটি আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সেমিনার হলের সামনে। জাতীয় জাদুঘরে আছে তাঁর রক্তচাপ মাপার যন্ত্রটি, আছে চশমা, ডায়েরি, পাসপোর্ট। ১৫ ডিসেম্বর ডা. ফজলে রাব্বিকে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয় রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে।
অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের গলাবদ্ধ কোটের কাছে গিয়ে অকস্মাৎ চোখ চলে যায় পাশের কাচঘেরা টেবিলটির দিকে। মুসলিম বাজার আর জল্লাদখানা থেকে পাওয়া মানুষের হাড়, করোটি রয়েছে সেখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এই অধ্যাপককেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৪ ডিসেম্বর। ২২ দিন পর মিরপুর বধ্যভূমি থেকে তাঁর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
ডা. আলীম চৌধুরীর ডাক্তারি প্যাড আর প্রেসক্রিপশন এমনভাবে আছে, যা দেখে মনে হচ্ছে, কোনো কাজে অল্পক্ষণের জন্য তিনি বাইরে গেছেন। এখনই ফিরে রোগী দেখবেন আবার, দেবেন ব্যবস্থাপত্র।
এরপর দৈনিক ইত্তেফাক-এর নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের হাতের লেখা দেখে চমকে যাই। আমার বাবার হাতের লেখা! পাঁচ বছর বয়সে জীবনে শেষবারের মতো দেখেছি তাঁকে! নিউজপ্রিন্টের প্যাডে তিনি রাজনৈতিক ভাষ্যকার নামে যে লেখাগুলো লিখতেন, তারই দুটি পাতা সেখানে। ‘লুকোচুরির খেলা’ শিরোনামের এই লেখাটি আমাকে অনেক কিছু বলে। রাজনৈতিক ভাষ্যকার নামে একাত্তর সালে ঢাকাতে বসেই তিনি কৌশলে বাংলাদেশের পক্ষে একের পর এক প্রতিবেদন লিখেছেন। ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ লিখে তিনি পাকিস্তানপন্থীদের রুদ্ররোষের মুখে পড়েন। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র সংগ্রাম পত্রিকায় ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামের লেখায় স্পষ্টতই তাঁকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে এ রকমের একটি নিউজপ্রিন্টের কাগজেই তিনি ‘এতদিনে’ শিরোনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লেখেন, ১১ ডিসেম্বর সেটা প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। তাঁর তিনটি বই রয়েছে জাতীয় জাদুঘরে। অগ্নিপরীক্ষা, ইতিহাস কথা কও আর বীর ও বীরঙ্গনা।
৩০ আগস্ট পাকিস্তান বাহিনী বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় আলতাফ মাহমুদকে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন বাড়ির উঠোনে গর্ত খুঁড়ে। শত নির্যাতনেও তিনি কারও নাম বলেননি। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখানে রাখা আছে তাঁর শেভিং মেশিনটি। আর জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে তাঁর ডায়েরি। সেখানে পাশাপাশি দুটো পাতার প্রথম পাতায় লেখা, ‘তুম কেয়া জানো/ তুমহে কিউ চাহা/ কিউ দিলনে তুমহে/ আপনায়া সনম; অন্য পাতায় দেখেছো তুমি কীি (লেখার সময় তাঁর মনে হ্রস্ব-ই কার ও দীর্ঘ-ই কার নিয়ে দ্বিধা ছিল বলে দুটোই রেখেছেন লেখায়)/ নয়নেরো ছবিটি/ কার স্বপ্ন লয়ে/ ওগো মধুমিতা।’ নিচে লেখা—মিশর কুমারী। জাতীয় জাদুঘরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে দুজন স্কুলছাত্র আলতাফ মাহমুদের হাতের লেখা পড়ার চেষ্টা করছিল। তাঁদের বললাম, ‘কার লেখা পড়ছো, জানো?’
‘আলতাফ মাহমুদের।’
‘বলো তো, তাঁকে কীভাবে চেনা যায়?’
ওরা হাসল। আলতাফ মাহমুদের পরিচিতিটা পড়ল। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরকার দেখে ওদের চোখে অন্য রকম দ্যুতি দেখা গেল। আমি নিশ্চিত, ওরা বাড়ি গিয়ে বলবে, ‘জানো, আমরা একুশের গানের সুরকারের ডায়েরি দেখে এসেছি।’
ডা. আজহারুল হকের পিতলের অ্যাশট্রের পাশে আছে দুটি বই। জাতীয় জাদুঘরে দেখা গেল তাঁর সার্জারির যন্ত্রপাতি। ১৫ নভেম্বর তাঁকে এবং ডা. হুমায়ূন কবীরকে তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাড়ির সামনে আলবদরের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করে। ডা. আজহার বাড়ির সামনের তেঁতুলগাছের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলছিলেন। আলবদরের সদস্যরা তাঁর হাতে আঘাত করে। তারপর ডাক্তার দুজনকে নিয়ে চলে যায়। ১৬ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের সামনের কালভার্টের নিচে তাঁদের দুজনের লাশ পাওয়া যায়। ডা. আজহারের স্ত্রী সালমা হক তখন অন্তঃসত্ত্বা। একমাত্র পুত্রসন্তান নিশানকে তিনি দেখে যেতে পারেননি। আশরাফুল হক নিশান একদা লিখেছিল, ‘আমি সেই হতভাগ্য সন্তান, যার জন্ম হয়েছিল বাবার মৃত্যুর পর।’
সেলিনা পারভীনের সবুজ শাড়ি আর তাঁর সম্পাদিত শিলালিপি ম্যাগাজিনটি আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। জাতীয় জাদুঘরে আছে তাঁর ব্যবহূত শাল। ১৩ ডিসেম্বর ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রায়েরবাজার বধ্যভূমির একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। শহীদ সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ এসে বলেছিল, ‘মিতা (আমাদের দুজনের নামে মিল আছে), আমার মায়ের ছবিটা আমাকে দেবে?’ কেঁপে উঠেছিল মন। মাকে নয়, মায়ের ছবি নিয়েই তৃপ্ত হতে চাইছে সেলিনা পারভীনের একমাত্র সন্তান। সে গল্প করি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনে আসা স্কুল-ছাত্রীদের কাছে। তাদের বলি, ‘একটি আট বছরের শিশু হঠাৎ একদিন তাঁর মায়ের বদলে দেখল মায়ের লাশ, তোমরা কি বুঝতে পারো, কেমন অনুভূতি হতে পারে তার?’
ওরা কোনো কথা বলে না। কোনো কথা বলা যায় না বোধ হয়। এই স্মৃতির মুখোমুখি হওয়া সহজ নয়।
জাতীয় জাদুঘরে দর্শনার্থীর ভিড়। অনেকেই স্মারকগুলো দেখতে আসে। তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তাদের পাশাপাশি আমিও থাকি।
ওই তো শহীদ আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত-এর একটি কপি! আর আছে ডায়েরি। ডায়েরির পাতাগুলো থেকে চোখের সামনে স্পষ্ট হয় কয়েকটি বাক্য, ‘বারংবার গোরস্তান, কবর, মৃত্যু, ভাঙা জাহাজ, অবসাদ, নিখিল নাস্তি...মালার্মের ফিনের দিবাস্বপ্ন সুধীন্দ্রনাথের অর্কেস্ট্রা ফিনের মতো অর্কেস্ট্রার নায়কও মধ্যবয়সী।’ ১৪ ডিসেম্বর ঈশা খাঁ রোডের বাড়িতে আনোয়ার পাশাকে নাশতা দিলেন স্ত্রী মোহসিনা খাতুন। এ সময় তাঁদের বাড়ির সামনে একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আনোয়ার পাশাকে ধরে নিয়ে গেল ওরা। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় শহীদ আনোয়ার পাশার লাশ।
শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদের চশমা, টাইপরাইটার ও চশমার খাপ রয়েছে পাশাপাশি। বিবিসিতে কত সংবাদ তিনি পাঠিয়েছেন এই টাইপরাইটারে লিখে! কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটিতে কেমন লাগত তাঁকে? ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীবাজারের রোকনপুর এলাকায় ছিলেন তাঁরা। সদ্য বিদেশ থেকে শ্যালক এসেছে, তাই বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হয়েছে দুপুরবেলা। সবাই খেতে বসেছে। এমন সময় দরজায় করাঘাত। মুখে রুমাল বাঁধা একদল লোক এসে খাবার টেবিল থেকে ধরে নিয়ে গেল নিজামুদ্দীন আহমেদকে। বিবিসির সংবাদদাতা হিসেবে অবরুদ্ধ বাংলার অনেক খবর তিনি পাঠিয়েছিলেন।
ডা. আলীম চৌধুরী চোখের সার্জারির যন্ত্রপাতি দেখে কেউ কি এখন মনে করতে পারবে, লুকিয়ে কত মুক্তিযোদ্ধার শরীরে অস্ত্রোপচার করেছেন তিনি? ১৫ ডিসেম্বর ডা. আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। লুঙ্গি আর শার্ট ছিল তাঁর পরনে। তিনি কাপড় বদলাতে চাইলে ওরা বলেছিল, অন্য কাপড়ের দরকার নেই। কোথায় যেতে হবে? প্রশ্ন করায় ওরা বলেছিল, গেলেই জানতে পারবেন। একজন চিকিৎসক নিহত হলেন পাশবিক নির্যাতনের ফলে। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ১৮ ডিসেম্বর বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত আলীম চৌধুরীর লাশ পাওয়া গেল। সেই শরীর অস্ত্রোপচার করার অবস্থায় আর ছিল না।
অধ্যাপক আবুল খায়েরের সুদৃশ্য ক্যামেরাটিতে (Super Paxette) জং ধরেছে। এই ক্যামেরা দিয়েই একসময় অনেক ছবি তুলেছেন তিনি। একটি টাইও রয়েছে পাশে। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বাড়ি থেকেই নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন সকালে তিনি হাঁটতে বের হয়েছিলেন। সে সময় খাকি পোশাকধারী একদল মানুষ এসে প্রশ্ন করে, ‘ড. খায়ের কাহা রাহতা হে?’ সরল মানুষ আবুল খায়ের বলেন, আমিই ড. খায়ের। স্ত্রীর একটি শাল ছিল তাঁর গায়ে। সেই শাল দিয়েই চোখ বেঁধে ফেলেছিল নরপশুরা। হত্যাকাণ্ডের ২১ দিন পর মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় ডা. খায়েরের লাশ।
মোহাম্মদ মোর্তজা রচনাবলী, চশমা আর কলম আছে জাতীয় জাদুঘরে। ১৪ ডিসেম্বর সকালে তিনি শেভ করছিলেন ফুলার রোডের বাড়িতে। কাদা-লেপা একটি মাইক্রোবাস সকাল সাড়ে আটটায় তাঁর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। ড. মোর্তজার মেয়ে দ্যুতি অরণীর খেলার শাড়ি দিয়ে চোখ বেঁধে ড. মোর্তজাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি মিরপুরের বধ্যভূমিতে (এখন যেটা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ) তাঁর লাশ পাওয়া যায়।
শহীদ মুনীর চৌধুরীর অপটিমা টাইপরাইটারটি দেখা গেল এখানে। আর আছে নাটকের একটি খাতা। সেখানে লেখা আছে, ‘পাঁচটি দৃশ্য, কোনো দৃশ্য আরম্ভ হয়, যথা...’ অন্য পৃষ্ঠায়, ‘দূরে দূরে—আমার কারফ্যু নাটকের মতোই দৃশ্যগুলো। বিচ্ছিন্ন, যোগসূত্র মূলত অন্তরের।’ ভাষা আন্দোলনের পর লেখা কবর নাটকটি জেলখানায় বসেই লিখেছিলেন মুনীর চৌধুরী। জেলখানায়ই তার অভিনয় হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। সেন্ট্রাল রোডের বাড়ি থেকে ১৪ ডিসেম্বর তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। গোসল সেরেছেন তিনি। খাবার টেবিলে ডাক পড়েছে। এ সময় চার-পাঁচজন যুবক এল বাড়িতে। মুনীর চৌধুরী ‘আসছি, কারা যেন ডাকছে’ বলে বেরিয়ে গেলেন তাদের সঙ্গে। আর ফিরে আসেননি।
স্মৃতিস্মারকগুলো হূদয়ে বেদনা জাগায়। শহীদ কাজী শামসুল হকের দোয়াত-কলম, টুপি, শার্ট; শহীদ সায়ীদুল হাসানের পাঞ্জাবি, স্যুট, ডায়েরি, কলম, ড্রাইভিং লাইসেন্স; শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার ‘এ দেশ আমার’ শিরোনামে ছাপানো কবিতা; শহীদ অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাঁথা, টাই; শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছাইরঙা মাফলার, চেক লুঙ্গি, গলাবদ্ধ কোট; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শহীদ অধ্যাপক মুহম্মদ হবিবুর রহমানের বই কলেজ বীজগণিত, তাঁর হাতে লেখা ‘সরল রেখা ও সমতল’; শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নজমুল হকের কালো ফ্রেমের চমশা, ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সাংবাদিকতার ওপর ডিপ্লোমা; শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামাঙ্কিত প্যাডে লেখা চিঠি, ১৯৫৬ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছ থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার ছবিসহ আরও কত স্মারক যে আছে জাদুঘরে!
এক একটি স্মারকের দিকে তাকাই আর বিষণ্ন হই। আবার একধরনের সুখস্মৃতিও এসে ভর করে শরীরে। জানি, আমাদের এই স্বজনেরা ফিরে আসবেন না আর। বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁরা অজর-অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু এই স্মারকগুলোর কাছাকাছি হয়ে তাঁদের যেন ছুঁতে পারি। মন বলে, এই তো, তাঁরা আছেন আমাদের সঙ্গেই।
No comments