ফিলিস্তিন-নাকবা: সব হারানোর দিন by রামজি বারুদ
মে মাসের ১৫ তারিখ ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যবিপর্যয়ের দিন—নাকবা দিবস। ১৯৪৭-৪৮ সালে তারা হারিয়েছিল তাদের সবকিছু। কোটি কোটি আরব, মুসলিম এবং অন্যান্য সমাজের সহানুভূতিশীল মানুষ এ দিবস এখনো অনুভব করে। তারা মনে রাখে এই কালো দিন, যেদিন ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করা হয়েছিল আর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ইসরায়েলি রাষ্ট্র।
আজ আমরা যখন নাকবা স্মরণ করি, তখন যা আমরা হারিয়েছি তার জন্য শোক করাই যথেষ্ট নয়; পাশাপাশি সেই ক্ষতির মাত্রা ও ধরনটাও বোঝা দরকার, অজস্র মানুষের কাছে এখনো তার কী অর্থ, বোঝা দরকার সেটাও।
ঔপনিবেশিক ব্রিটেনের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া শত শত ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরের ধ্বংসস্তূপের ওপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। এই সত্য কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। সে সময় একটি আন্তর্জাতিক ‘অনুমোদনের’ বলে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের ভারও ব্রিটেনের ওপর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
একটা পর্যায়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দুটি প্রধান ঔপনিবেশিক শক্তি। জনগণের জাতীয় মর্যাদার কোনো রকম পরোয়া না করেই তারা এই অঞ্চলকে তাদের স্বার্থমতো ভাগ করে। ১৯১৬ সালে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত সাইকস-পিকট নামে পরিচিত গোপন চুক্তিই এর বড় উদাহরণ। এ চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন, ফ্রান্স আর রাশিয়া অন্য দেশের ভাগ্য ঠিক করে দেয়। এর মাধ্যমে তারা ফিলিস্তিনকে মূলত একটি আন্তর্জাতিকায়িত অঞ্চলে পরিণত করে। অথচ আগের আন্তর্জাতিক সমঝোতা অনুসারে ফিলিস্তিনের হওয়ার কথা ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের দেশ।
১৯১৭ সালের নভেম্বরের কিছু পরে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক শীর্ষ ব্রিটিশ ইহুদিবাদীর কাছে একটি গোপন পত্র পাঠান। সেখানে তিনি ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে তখন তাঁরা কী ভেবেছিলেন? আমাদের তখন অভিহিত করা হতে থাকে ফিলিস্তিনের ‘অ-ইহুদি’ অধিবাসী হিসেবে। পরের তিন দশক ব্রিটিশরা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে সুরক্ষা দিয়ে যায়। গোড়া থেকেই ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে গণহারে ইহুদি অভিবাসনের নীতি সমর্থন করে যায়।
১৯৪৭ সালের শেষাশেষি ফিলিস্তিন অঞ্চলে বিরাট ভূমিকা নিতে থাকে জাতিসংঘ। স্থানীয় আরবরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ। বাকিরা ছিল নবাগত ইহুদি অভিবাসী। একেবারে প্রথমে ফিলিস্তিনি আরবরা ছিল জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ। পরে যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চলে, তাতে ব্রিটেনের ভূমিকা কোনোভাবেই ঢাকা যাবে না। অশুভ প্রক্রিয়ায় ক্রয় ও জবরদখলের ঘটনা ঘটলেও সরল সত্যটি বদলানো যাবে না, জমির মালিকানার বড় অংশই ছিল ফিলিস্তিনিদের।
ব্রিটেনের ইহুদি-সমর্থক নীতির জন্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘মিশ্রতা’ এলেও ভূমি মালিকানা মিশ্র ছিল না। অ্যাথনিং ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন (ফিলিস্তিনের জাতিগত শুদ্ধিকরণ) বইতে অ্যালান পেপে লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনের প্রায় সব আবাদি জমি ছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকারে, আর ইহুদি মালিকানায় ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু এ পরিসংখ্যানও কাউকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষার তাগাদা দেয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ—যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের বিপুল চাপের মুখে—১৮১ নম্বর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।’ এতে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র, একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র এবং অধিকৃত জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাখার কথা বলা হয়।
যেখানে ১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ প্রস্তাবে আরবরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের সিদ্ধান্তে তারা বিপর্যস্ত হলো। কেননা, এখানে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রকে সাড়ে পাঁচ হাজার বর্গমাইল ভূমি দেওয়ার কথা বলা হয়। বিপরীতে মাত্র সাড়ে চার হাজার বর্গমাইল বরাদ্দ হয় ফিলিস্তিনের জন্য—অথচ তারাই ছিল ফিলিস্তিনের ৯৪ দশমিক ২ শতাংশ ভূমির মালিক এবং জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ। ঘটনা হলো, প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের মাত্র ৬০০ বর্গমাইল এলাকা ছিল ইহুদিদের অধিকারে। এসব তথ্যের কোনোটাই জাতিসংঘের ৩৩ রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিন-বিভাগের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত করতে পারেনি।
জাতিসংঘের এ বঞ্চনামূলক বিভাজন সত্ত্বেও ইহুদিবাদী নেতারা চেয়েছিলেন আরও বেশি কিছু। তবু উৎসব করার মতো ঘটনা পেয়ে গেল তারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে অথবা তাদের সঙ্গে মিলে ইহুদিবাদী রূপরেখাকে বিরাট উদারতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে লেগে গেল।
ফিলিস্তিনি ও আরবরা ভেবেছিল, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বারবার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলে, সেহেতু তাদের চাপে পড়েই ব্রিটেনের কলঙ্কিত নীতি আরবদের পক্ষে ঘুরে যাবে। কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও চরম আঘাতে জেগে ওঠার মুহূর্ত। বিচার ও বিবেকের সব সম্ভাবনা এভাবে তিরোহিত হলো। ফিলিস্তিনিরা যখন আসন্ন যুদ্ধের অনিবার্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন ইহুদিবাদী নেতৃত্ব সমগ্র ফিলিস্তিনকেই অধিকার করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিল। সে সময় ইহুদিবাদীদের প্রধান যুদ্ধ-সংগঠন ছিল হাগানাহ, একে পরিচালিত করত জুইয়িশ এজেন্সি। এই এজেন্সি তখন থেকেই সরকার হিসেবে কাজ করা শুরু করে, আর হাগানাহ হয়ে ওঠে তার সামরিক বাহিনী। এর মধ্যে ১৯৪৬ সালে ইঙ্গ-মার্কিন কমিটি হিসাব করে দেখে, ইহুদিদের রয়েছে ৬২ হাজার সুপ্রশিক্ষিত যোদ্ধা। আরবদের প্রস্তুতি বিষয়ে তারা তখন কিছুই বলেনি।
জাতিসংঘের মাধ্যমে দেশভাগ পরিকল্পনা পাস হওয়ামাত্রই ফিলিস্তিনি নিধন ও বিতাড়ন শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে স্বদেশের ইহুদিবাদী বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি গণবিক্ষোভকে দাঙ্গা বলে আখ্যায়িত করে ইহুদিবাদীরা সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। এরই ধাক্কায় এক লপ্তে ৭৫ হাজার ফিলিস্তিনি দেশত্যাগ করে।
আরবদের সহযোগিতা এত বিলম্বে আসে যে ফিলিস্তিনিরা আরও মুষড়ে পড়ে। তারা হয়ে পড়ে সবচেয়ে অরক্ষিত জনগণ। আরও লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়। তারা হারায় তাদের সর্বস্ব, হয়ে পড়ে সব দিক থেকে বিপন্ন।
এ ঘটনার পরিণতিতে আর যা যা ঘটেছিল, তা খাটো করা যাবে না। হাজার হাজার মানুষের জীবন গেছে। মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে শত শত গ্রাম। ফিলিস্তিনিদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতির মধ্যে ধুঁকছে। তারা লড়াই করছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুর্দশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে।
নাকবা দিবস তাই কেবল স্মরণের বিষয় নয়। এটা এমন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ থেকে পৃথিবী বেরিয়ে আসতে পারে। আর কোনো কিছুই এর মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়।
প্যালেস্টাইন ক্রনিকল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
রামজি বারুদ: প্যালেস্টাইন ক্রনিকলের সম্পাদক ও লেখক।
ঔপনিবেশিক ব্রিটেনের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া শত শত ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরের ধ্বংসস্তূপের ওপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। এই সত্য কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। সে সময় একটি আন্তর্জাতিক ‘অনুমোদনের’ বলে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের ভারও ব্রিটেনের ওপর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
একটা পর্যায়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দুটি প্রধান ঔপনিবেশিক শক্তি। জনগণের জাতীয় মর্যাদার কোনো রকম পরোয়া না করেই তারা এই অঞ্চলকে তাদের স্বার্থমতো ভাগ করে। ১৯১৬ সালে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত সাইকস-পিকট নামে পরিচিত গোপন চুক্তিই এর বড় উদাহরণ। এ চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন, ফ্রান্স আর রাশিয়া অন্য দেশের ভাগ্য ঠিক করে দেয়। এর মাধ্যমে তারা ফিলিস্তিনকে মূলত একটি আন্তর্জাতিকায়িত অঞ্চলে পরিণত করে। অথচ আগের আন্তর্জাতিক সমঝোতা অনুসারে ফিলিস্তিনের হওয়ার কথা ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের দেশ।
১৯১৭ সালের নভেম্বরের কিছু পরে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক শীর্ষ ব্রিটিশ ইহুদিবাদীর কাছে একটি গোপন পত্র পাঠান। সেখানে তিনি ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে তখন তাঁরা কী ভেবেছিলেন? আমাদের তখন অভিহিত করা হতে থাকে ফিলিস্তিনের ‘অ-ইহুদি’ অধিবাসী হিসেবে। পরের তিন দশক ব্রিটিশরা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে সুরক্ষা দিয়ে যায়। গোড়া থেকেই ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে গণহারে ইহুদি অভিবাসনের নীতি সমর্থন করে যায়।
১৯৪৭ সালের শেষাশেষি ফিলিস্তিন অঞ্চলে বিরাট ভূমিকা নিতে থাকে জাতিসংঘ। স্থানীয় আরবরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ। বাকিরা ছিল নবাগত ইহুদি অভিবাসী। একেবারে প্রথমে ফিলিস্তিনি আরবরা ছিল জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ। পরে যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চলে, তাতে ব্রিটেনের ভূমিকা কোনোভাবেই ঢাকা যাবে না। অশুভ প্রক্রিয়ায় ক্রয় ও জবরদখলের ঘটনা ঘটলেও সরল সত্যটি বদলানো যাবে না, জমির মালিকানার বড় অংশই ছিল ফিলিস্তিনিদের।
ব্রিটেনের ইহুদি-সমর্থক নীতির জন্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘মিশ্রতা’ এলেও ভূমি মালিকানা মিশ্র ছিল না। অ্যাথনিং ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন (ফিলিস্তিনের জাতিগত শুদ্ধিকরণ) বইতে অ্যালান পেপে লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনের প্রায় সব আবাদি জমি ছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকারে, আর ইহুদি মালিকানায় ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু এ পরিসংখ্যানও কাউকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষার তাগাদা দেয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ—যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের বিপুল চাপের মুখে—১৮১ নম্বর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।’ এতে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র, একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র এবং অধিকৃত জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাখার কথা বলা হয়।
যেখানে ১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ প্রস্তাবে আরবরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের সিদ্ধান্তে তারা বিপর্যস্ত হলো। কেননা, এখানে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রকে সাড়ে পাঁচ হাজার বর্গমাইল ভূমি দেওয়ার কথা বলা হয়। বিপরীতে মাত্র সাড়ে চার হাজার বর্গমাইল বরাদ্দ হয় ফিলিস্তিনের জন্য—অথচ তারাই ছিল ফিলিস্তিনের ৯৪ দশমিক ২ শতাংশ ভূমির মালিক এবং জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগ। ঘটনা হলো, প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের মাত্র ৬০০ বর্গমাইল এলাকা ছিল ইহুদিদের অধিকারে। এসব তথ্যের কোনোটাই জাতিসংঘের ৩৩ রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিন-বিভাগের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত করতে পারেনি।
জাতিসংঘের এ বঞ্চনামূলক বিভাজন সত্ত্বেও ইহুদিবাদী নেতারা চেয়েছিলেন আরও বেশি কিছু। তবু উৎসব করার মতো ঘটনা পেয়ে গেল তারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে অথবা তাদের সঙ্গে মিলে ইহুদিবাদী রূপরেখাকে বিরাট উদারতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে লেগে গেল।
ফিলিস্তিনি ও আরবরা ভেবেছিল, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বারবার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলে, সেহেতু তাদের চাপে পড়েই ব্রিটেনের কলঙ্কিত নীতি আরবদের পক্ষে ঘুরে যাবে। কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও চরম আঘাতে জেগে ওঠার মুহূর্ত। বিচার ও বিবেকের সব সম্ভাবনা এভাবে তিরোহিত হলো। ফিলিস্তিনিরা যখন আসন্ন যুদ্ধের অনিবার্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন ইহুদিবাদী নেতৃত্ব সমগ্র ফিলিস্তিনকেই অধিকার করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিল। সে সময় ইহুদিবাদীদের প্রধান যুদ্ধ-সংগঠন ছিল হাগানাহ, একে পরিচালিত করত জুইয়িশ এজেন্সি। এই এজেন্সি তখন থেকেই সরকার হিসেবে কাজ করা শুরু করে, আর হাগানাহ হয়ে ওঠে তার সামরিক বাহিনী। এর মধ্যে ১৯৪৬ সালে ইঙ্গ-মার্কিন কমিটি হিসাব করে দেখে, ইহুদিদের রয়েছে ৬২ হাজার সুপ্রশিক্ষিত যোদ্ধা। আরবদের প্রস্তুতি বিষয়ে তারা তখন কিছুই বলেনি।
জাতিসংঘের মাধ্যমে দেশভাগ পরিকল্পনা পাস হওয়ামাত্রই ফিলিস্তিনি নিধন ও বিতাড়ন শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে স্বদেশের ইহুদিবাদী বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি গণবিক্ষোভকে দাঙ্গা বলে আখ্যায়িত করে ইহুদিবাদীরা সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। এরই ধাক্কায় এক লপ্তে ৭৫ হাজার ফিলিস্তিনি দেশত্যাগ করে।
আরবদের সহযোগিতা এত বিলম্বে আসে যে ফিলিস্তিনিরা আরও মুষড়ে পড়ে। তারা হয়ে পড়ে সবচেয়ে অরক্ষিত জনগণ। আরও লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়। তারা হারায় তাদের সর্বস্ব, হয়ে পড়ে সব দিক থেকে বিপন্ন।
এ ঘটনার পরিণতিতে আর যা যা ঘটেছিল, তা খাটো করা যাবে না। হাজার হাজার মানুষের জীবন গেছে। মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে শত শত গ্রাম। ফিলিস্তিনিদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতির মধ্যে ধুঁকছে। তারা লড়াই করছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুর্দশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে।
নাকবা দিবস তাই কেবল স্মরণের বিষয় নয়। এটা এমন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে, কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ থেকে পৃথিবী বেরিয়ে আসতে পারে। আর কোনো কিছুই এর মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়।
প্যালেস্টাইন ক্রনিকল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
রামজি বারুদ: প্যালেস্টাইন ক্রনিকলের সম্পাদক ও লেখক।
No comments