বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৫১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড, বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন এমন বিদেশির সংখ্যা কম নয়। তাঁদের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী নাম ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। যিনি মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সাহসী ভূমিকা রাখায় বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন।
ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড ১৯৭১ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন টঙ্গীর বাটা শু কোম্পানিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কিছুদিন পর ঔডারল্যান্ড সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের। বাটা শু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর সুবিধা ছিল বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ যাতায়াতের সুযোগ। পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে তিনি প্রথম সখ্য গড়ে তোলেন গুপ্তচরী কৌশলে। শুরু হয় তাঁর ঢাকা সেনানিবাসে যাওয়া-আসা।
ডব্লিউ এ এস ঔডারল্যান্ড পরে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন আরো কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বেসরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি একইভাবে সখ্য গড়েন। তাঁর সখ্য ও দোস্তি এতই সন্দেহাতীত হয়েছিল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে তিনি একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে গণ্য হন।
এ সুযোগে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সব ধরনের ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’ পেয়ে যান। কারফিউ চলাকালেও ঢাকা সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে চলাফেরার পাস জোগাড় করে ফেলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা ও পরিকল্পনা গোপনে পাঠাতে থাকেন ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে।
একই সঙ্গে টঙ্গীর বাটা শু কোম্পানির কারখানা প্রাঙ্গণে স্থাপন করেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপন ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর কারখানায় আশ্রয় নিয়ে আশপাশে গেরিলা অপারেশন করতে থাকেন। এর পাশাপাশি অস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসাসামগ্রী, আর্থিক সাহায্য প্রদানসহ নানাবিধ কাজ করেন; প্রশিক্ষণেও সহযোগিতা করেন।
মুক্তিযুদ্ধে এ এস ঔডারল্যান্ডের ভূমিকা ছিল বহুমুখী। ১৯৭১ সালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদেরই একজন হিসেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩১৭।
ডব্লিউ এ এস ঔডারল্যান্ডের স্বদেশ অস্ট্রেলিয়া। জন্ম নেদারল্যান্ডের (হল্যান্ড) আমস্টারড্যামে। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তাঁর হয়নি। ১৭ বছর বয়সে জীবিকার প্রয়োজনে বাটা শু কোম্পানিতে ছোট এক চাকরিতে যোগ দেন। কিছুদিন পর নাম দেন ‘ডাচ্ ন্যাশনাল সার্ভিস’-এ। বছর খানেক পর নেদারল্যান্ড জার্মানি কর্তৃক আক্রান্ত হয়। তখন ঔডারল্যান্ড নেদারল্যান্ডের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন এবং বন্দী হন। পরে যুদ্ধশিবির থেকে পালিয়ে যোগ দেন গোপন প্রতিরোধ আন্দোলনে। এ সময় তিনি গুপ্তচরের কাজ করেন। পরে আবার সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে জার্মানিদের বিরুদ্ধে অসমসাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জার্মানদের নৃশংসতা, বন্দিশিবিরে অবর্ণনীয় কষ্ট প্রভৃতি ঔডারল্যান্ডকে সাহসী, প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী করে। তাঁর এই মনোভাব মনের গভীরে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ৫৪ বছর বয়সে তিনি আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।
ডব্লিউ এ এস ঔডারল্যান্ড ১৯৭৮ সালে বাটা শু কোম্পানি থেকে অবসর নিয়ে ফিরে যান স্বদেশভূমি অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পুনরায় কিছুদিন চাকরি করেন। ২০০১ সালে তিনি ৮৪ বছর বয়সে মারা যান।
সূত্র: গাজীপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিলু কবীর। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
ডব্লিউ এ এস ঔডারল্যান্ড পরে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন আরো কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বেসরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি একইভাবে সখ্য গড়েন। তাঁর সখ্য ও দোস্তি এতই সন্দেহাতীত হয়েছিল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে তিনি একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে গণ্য হন।
এ সুযোগে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সব ধরনের ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’ পেয়ে যান। কারফিউ চলাকালেও ঢাকা সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে চলাফেরার পাস জোগাড় করে ফেলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা ও পরিকল্পনা গোপনে পাঠাতে থাকেন ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে।
একই সঙ্গে টঙ্গীর বাটা শু কোম্পানির কারখানা প্রাঙ্গণে স্থাপন করেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপন ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর কারখানায় আশ্রয় নিয়ে আশপাশে গেরিলা অপারেশন করতে থাকেন। এর পাশাপাশি অস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসাসামগ্রী, আর্থিক সাহায্য প্রদানসহ নানাবিধ কাজ করেন; প্রশিক্ষণেও সহযোগিতা করেন।
মুক্তিযুদ্ধে এ এস ঔডারল্যান্ডের ভূমিকা ছিল বহুমুখী। ১৯৭১ সালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদেরই একজন হিসেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩১৭।
ডব্লিউ এ এস ঔডারল্যান্ডের স্বদেশ অস্ট্রেলিয়া। জন্ম নেদারল্যান্ডের (হল্যান্ড) আমস্টারড্যামে। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তাঁর হয়নি। ১৭ বছর বয়সে জীবিকার প্রয়োজনে বাটা শু কোম্পানিতে ছোট এক চাকরিতে যোগ দেন। কিছুদিন পর নাম দেন ‘ডাচ্ ন্যাশনাল সার্ভিস’-এ। বছর খানেক পর নেদারল্যান্ড জার্মানি কর্তৃক আক্রান্ত হয়। তখন ঔডারল্যান্ড নেদারল্যান্ডের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন এবং বন্দী হন। পরে যুদ্ধশিবির থেকে পালিয়ে যোগ দেন গোপন প্রতিরোধ আন্দোলনে। এ সময় তিনি গুপ্তচরের কাজ করেন। পরে আবার সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে জার্মানিদের বিরুদ্ধে অসমসাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জার্মানদের নৃশংসতা, বন্দিশিবিরে অবর্ণনীয় কষ্ট প্রভৃতি ঔডারল্যান্ডকে সাহসী, প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী করে। তাঁর এই মনোভাব মনের গভীরে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ৫৪ বছর বয়সে তিনি আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।
ডব্লিউ এ এস ঔডারল্যান্ড ১৯৭৮ সালে বাটা শু কোম্পানি থেকে অবসর নিয়ে ফিরে যান স্বদেশভূমি অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পুনরায় কিছুদিন চাকরি করেন। ২০০১ সালে তিনি ৮৪ বছর বয়সে মারা যান।
সূত্র: গাজীপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিলু কবীর। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments