যুদ্ধের খোঁজে by শহিদুল্লাহ খান বাদল
১৯৭১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। সৌভাগ্যবশত ফেব্রুয়ারিতেই আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধু কিছু প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা ছিল বাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। সাংস্কৃতিক সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আর ছিলাম মহসিন হল ছাত্র সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক।
থাকতাম লালমাটিয়ায় ভাইয়ের বাসায়। মার্চ মাসেও আমি ঢাকায়। ৬ দফা, ১১ দফা, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ৬৯ সালে মোটামুটি এবং ৭০, ৭১ সালে প্রচণ্ডভাবে_ পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৭০ এবং ৭১-এর শুরুর দিকে তখন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আওতায় সব আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করছি আমরা।
যেহেতু বড় ভাইরা আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সে কারণে লালমাটিয়ায় আমরা যে বাসায় থাকতাম, সেখানে প্রায়-ই বাম রাজনীতিবিদদের বৈঠক বসত। গোপন বৈঠক করার জন্য বাড়িটি মোটামুটি নিরাপদ ছিল। সে সূত্র ধরে মেনন ভাইয়ের সুবাদে কিংবা নানাভাবে তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় ছিল।মার্চ মাসের শুরু থেকেই আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-মিটিংয়ে ঢাকার পরিবেশ উত্তপ্ত। নানা দিক থেকেই বিভিন্ন ধরনের সংবাদে আক্রমণের সন্দেহটা অনেকের মনেই দানা বাঁধতে থাকে। ১৬ কি ১৮ তারিখে আমরা কয়েকজন মিলে লালমাটিয়ার বাসায় বোমা বানাতে বসেছিলাম। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরিত হয়ে এক বন্ধু আহত হয় সেখানে। সে পায়ে আঘাত পায়। কিন্তু সমস্যা হলো বাসার পেছন দিকটাতেই মোহাম্মদপুরে বিহারিদের এলাকা। এ ঘটনায় আমাকে সেখান থেকে সরে আসতে হয়। ২০ মার্চের পর আমি আর ওই বাসায় থাকিনি।
ধানমণ্ডি ৫ নম্বরে বেলাল বাকী নামে এক বন্ধু থাকত। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার বাকী। আমি বেলাল বাকীর বাসায় গিয়ে উঠলাম। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হওয়ার কারণে বেলালের বাবাও চাচ্ছিলেন যে, আমরা সেখানে থাকি। এই বাড়িটির ঠিক পাশেই লেকের ওপারে ইপিআর [বর্তমান বিজিবি] গেট। ২৫ মার্চ রাতে আমি ওই বাসায়। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে রাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম কিছুক্ষণ পরপরই
আকাশ বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আলোকিত হয়ে উঠছে। চারপাশ থেকে মানুষের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। আমাদের আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না যে, ঘটনাটা কী ঘটছে। দৌড়ে ছাদে চলে গেলাম। দেখলাম বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বলছে। রেডিও, টেলিফোন সব বন্ধ। রাতটা এভাবেই কাটল। পরদিন প্রায় সারাদিন কারফিউ। রাস্তাঘাটে থমথমে অবস্থা। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ভাঙলে বাইরে বের হব। এমন সময় শুনলাম রাতের বেলায় যখন আর্মি ট্যাংক নিয়ে ৩২ নম্বরের দিকে এগোচ্ছিল, তখন ৭ নম্বর রোডের আমাদেরই এক বন্ধু খোকন নাকি পাখি মারার টু টু বোর রাইফেল নিয়ে গেছে শেখ মুজিবকে সেভ করতে। কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল। মিলিটারিদের হাতে খোকন মারা গেল। আসলে এ থেকেই বোঝা যায়, এ ধরনের আক্রমণের জন্য আমরা কতটা অপ্রস্তুত এবং অজ্ঞ ছিলাম। আসলে মিলিটারি জিনিসটা কী_ এ সম্পর্কে আমাদের ধারণাই ছিল না। যে কারণে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র আর ট্যাঙ্ক-কামানের সামনে খোকন পাখি মারা বন্দুক নিয়ে নেমে পড়েছিল। ৪ নম্বর রোডে আমাদের কিছু বন্ধু থাকত। আমরা ওই রোডে প্রায়ই আড্ডা দিতাম। ৪ নম্বর থেকে ওয়াসিফকে [ওয়াসিফ ইসলাম] নিয়ে ৫ নম্বর রোডে আরেক বন্ধুর বাসায় যাই। আমরা বাসা থেকে বেরোচ্ছি; হঠাৎ সেখানে তৌহিদ সামাদ, বদিউল আলমরা এসে হাজির। বদি এনএসএফ [জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন] করত। থাকত জিন্নাহ হলে। এই তো মাসখানেক আগে ৭১-এর শুরুর দিকে আমরা যখন এনএসএফের হাতে মার খেতে থাকলাম, তখন আমরা বাধ্য হয়ে ওদেরকে রুখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে গিয়ে শরীরচর্চা শুরু করি। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে একদিন বদি ও সালেক নামে একজন, মারবে বলে আমাকে তুলে নিতেও গিয়েছিল। সেই বদি ২৭ মার্চ সকালে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। স্বভাবতই আমার চোখেমুখে সন্দেহ। বদি বলছে_ ঐধর, ুড়ঁ মুঁং ধষষধিুং ঃধষশ ধনড়ঁঃ ধৎসং ৎবাড়ষঁঃরড়হ. হড় িষবঃ্থং মড় ধহফ ভরমযঃ। সে পুরোপুরি তৈরি হয়েই এসেছে। আমার চোখে অবিশ্বাস দেখে হুট করে কোথা থেকে একটা ব্লেড বের করে নিজের হাত আর আমার হাত কেটে দু'জনের রক্ত এক করে বলল, আজ থেকে আমাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক।
এরপর আমরা গেলাম ৪ নম্বরে। ওখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল মাসুদ ওমর। এ সময় আরেকটি ঘটনা ঘটল। আশফাক [শহীদ লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ; আতাউস সামাদের বড় ভাইয়ের ছেলে] আতাউস সামাদ ভাইয়ের গাড়িটা নিয়ে সোজা ৪ নম্বরে চলে এলো। আমরা টের পাচ্ছি, সবার ভেতরেই যুদ্ধের তাড়না। আমাদের আর কিছুই মাথায় নেই_ কী বাড়ি কী পরিবার! সিদ্ধান্ত হলো আমরা যুদ্ধের খোঁজে বেরুব। কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠে গেছে। আমাদের হাতে আছে বদির একটা মোটরসাইকেল। তাড়াতাড়ি আরেকটা জোগাড় করে আগে চারদিকের পরিবেশটা দেখার জন্য বের হলাম। আমি, মাসুদ, বদি আর আশফাক ধানমণ্ডি থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গেলাম। দেখি সূর্যসেন হলে জায়গায় জায়গায় বোমার আঘাত। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। মানুষজন তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় কাজ সারার জন্য এদিক-সেদিক যাচ্ছে। আমরা সেখান থেকে ঘুরে এসে লালমাটিয়ার দিকে গেলাম। লালমাটিয়ায় আমি যেখানে থাকতাম তার একটু সামনে খালেদ মোশাররফের শ্বশুরবাড়ি। পারিবারিক সূত্রে তাদের সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার। সেখানে গিয়ে দেখি বাসাবাড়ি সব তছনছ। কেউ নেই।
এরপর আমরা চলে এলাম তৌহিদের বাসায়। বদি চুপ করে বসে আছে। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বলল, এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না; কিছু একটা করতে হবে। এটা সহ্য করা যায় না। হঠাৎ বদি বলল_ শোনো, কেউ আমাদের বলে দেবে না। আমাদেরই করতে হবে। চলো, আমরা আমাদের মতো বেরিয়ে পড়ি। আমরা তৌহিদের বাসার কাউকেই কিছু বুঝতে দিলাম না। এমনকি তৌহিদকেও না। দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা যাচ্ছি যুদ্ধের খোঁজে। দুটি মোটরসাইকেলে তেজগাঁও হয়ে বাড্ডার সাতারকুল এলাকা দিয়ে আমরা যাব। আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির সুনীল দা বলেছিলেন, সিলেটের দিকে তাদের মুক্তাঞ্চল আছে। প্রাথমিকভাবে আমরা সেদিকেই রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে পড়েছে। কারও গন্তব্যের কোনো ঠিক নেই। আমাদের মোটরসাইকেলগুলো পরে কে বা কারা নিয়ে এসেছিল মনে নেই। আমরা মুড়াপাড়া দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে উঠলাম। বদি বলল, কিশোরগঞ্জে ওর মামার বাড়ি। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো বদির মামার বাড়িতে গিয়ে আমরা একটু গুছিয়ে তারপর সামনে এগোব। সবাই তো এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছি।
কিশোরগঞ্জে গিয়ে ঘটল সেই ঘটনা। যে যুদ্ধের খোঁজে এসেছি ঠিক তারই সন্ধান পেয়ে গেলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে যাচ্ছিল আখাউড়ার দিকে। মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এক ট্রেন বোঝাই সৈন্য পথে কিশোরগঞ্জে থেমে সার্কিট হাউসে উঠেছে। ইতিমধ্যে কিশোরগঞ্জে জানাজানি হয়ে গেছে এ ঘটনা। সিদ্ধান্ত নিলাম_ আমরা ওদের সঙ্গে যোগ দেব। ওরা যা দেয় তাই করব। আমরা সেখানে গেলাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। লোকজন আর্মি দেখে দারুণ উত্তেজিত। উত্তেজিত আমরাও। সৌভাগ্যবশত আমাদের মধ্যে বদি ছিল ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। বিদ্রোহী সেই আর্মি দলে, ক্যাডেট কলেজে বদির এক বছর কি দু'বছরের সিনিয়র তরুণ অফিসার হেলাল মুর্শেদের দেখা পেয়ে গেলাম। বদিকে দেখে অফিসার হেলাল বললেন_ তুমি এখানে কী করছ? আমরা বললাম, আমরা যুদ্ধ করব। অফিসার হেলাল বললেন, তোমরা কী যুদ্ধ করবে! না না। আমরা বললাম, ভাই, আমাদের একবারের জন্য কমান্ডারের কাছে নিয়ে চলেন। আমরা নিশ্চিত, তিনি আমাদের ফেরাবেন না। অবশেষে অফিসার হেলাল আমাদের নিয়ে গেলেন। ওখানে ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখা হলো মেজর সফিউল্লাহর সঙ্গে। তার পাশে আরও কয়েক জন ঊর্ধ্বতন সামরিক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে একজনকে আমি চিনতাম_ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নুরুজ্জামান। তিনিও আমাকে চিনতেন। এ সবই আমাদের জীবন ও যুদ্ধের কাকতালীয় ঘটনা। কর্নেল নুরুজ্জামান আমাদের দেখে আঁৎকে উঠে বললেন, তোমরা এখানে! তখন আমি বললাম, আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি। কর্নেল নুরুজ্জামান মেজর সফিউল্লাহকে বললেন, ঝযধভর, ও শহড় িঃযবংব নড়ুং. ঞযবু ধৎব মড়ড়ফ নড়ুং. ণড়ঁ পধহ ঃৎঁংঃ ঃযবস. তখন সফিউল্লাহ সাহেব বললেন, ওকে। তোমরা বসো; বল কী করতে পারি? তোমাদের কোনো ট্রেনিং আছে? আমরা বললাম, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউওটিসিতে [বিএনসিসি] হালকা ট্রেনিং করেছিলাম। তিনি অফিসার হেলালকে আমাদের কিছু অস্ত্র দেখাতে বললেন। আরও বললেন, ওদেরকে কিছু ফায়ারিং আর গ্রেনেড থ্রোইং শেখাও। আমরা তিন দিন আর্মিদের সঙ্গে সেখানে ছিলাম। তিন দিনের মাথায় মেজর সফিউল্লাহ আমাদের ৪টা থ্রি নট থ্রি, ৩০টা গ্রেনেড, কিছু অ্যামুনিশন আর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা ঢাকা ফিরে যাও। ছাত্রদের অর্গানাইজ করতে থাকো। সে সময়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে একটা ওয়াগনে করে খালেদ মোশাররফ এবং একজন অফিসার আসছিলেন এদিকে। মেজর সফিউল্লাহর সঙ্গে আগে থেকেই তাদের যোগাযোগ হচ্ছিল। মেজর সফিউল্লাহ বললেন, আমরা এখান থেকে তেলিয়াপাড়ার দিকে যাচ্ছি। তোমরা যোগাযোগ রেখো। দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চার তরুণ অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসছি_ উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা আর ক্রোধের মিশ্রিত একটা অনুভূতি। স্থানীয় মৌলভী সাহেব এসেছেন। আমাদের জন্য দোয়া করে দিচ্ছেন। দুইটা আড়াই মণি বস্তার মধ্যে অস্ত্রগুলো ভরে নিলাম আমরা। কিশোরগঞ্জ থেকে আমরা রওনা দিয়েছিলাম নৌকায় করে। পথে অনেকটা দূরত্ব লঞ্চে করে এসেছি।
খুব সম্ভবত ২ কি ৩ এপ্রিলে আমরা ঢাকায় এসে পেঁৗছলাম। আমরা ঢুকলাম গোপীবাগ দিয়ে। গোপীবাগের গলিটা থেকে বেরোলেই তিন-চারটা বাড়ির পরে আশফাকদের বাড়ি। আমাদের চারজনেরই পরনে লুঙ্গি। সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে দুইটা রিকশায় আমরা গোপীবাগের ওই গলিটা থেকে বের হব_ দেখি ইত্তেফাক অফিস পুরো ছাই। তার আশপাশে কয়েক সৈনিক হাঁটাহাঁটি করছে। কোনোমতে এই খানিকটা জায়গা পার হতে পারলেই আমরা গন্তব্যে পেঁৗছে যেতে পারি। ওই সময় রিকশাঅলা হঠাৎ বলল, স্যার লুঙ্গিডা নামাইয়া নেন। দেখলে তো আমগো মতো মনে অইবো না। বুঝলাম, ও ঠিক বুঝে গেছে। আমরা সেদিন এ জায়গাটুকু নির্বিঘ্নেই পার হতে পেরেছিলাম। আমরা প্রথমে চাচাকে বলিনি। এমন দুর্যোগের সময় এভাবে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আমরা আসায়। চাচা খুবই রাগ করেছিলেন। পরে চাচার পরামর্শে আমরা পালা করে রাত জেগে পাহারা দিয়েছি। রাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন সকালে তৌহিদকে ফোন দিলাম। কারফিউ উঠে গেলে ও আমাদের কথামতো গাড়ি আর লেপ-তোশক জোগাড় করে আশফাকের বাসায় নিয়ে আসল। রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে চেকিং চলছে। কিন্তু আমাদের মাথায় এ সবের কিছুই নেই। আমাদের একটাই ভাবনা_ যে করেই হোক যুদ্ধ করতে হবে। পারব কি পারব না_ এ চিন্তা উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এত বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর সপ্তাহ খানেকের মাথায় আমাদের কেউ এমন সাহস করতে পারে_ এমন ভাবাটাও বোধয় অস্বাভাবিক ছিল। গাড়িতে আমরা অস্ত্রগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নানা অলি-গলি করে ধানমণ্ডি ৪ নম্বরে ওয়াসিফদের বাসায় উঠলাম। ওদের বাসার একটা জাযগায় মাটি খুঁড়ে অস্ত্রগুলো রেখে দিলাম। আর এভাবে শেষ হলো আমাদের প্রথম মিশন। হ
লেখক :মুক্তিযোদ্ধা
যেহেতু বড় ভাইরা আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সে কারণে লালমাটিয়ায় আমরা যে বাসায় থাকতাম, সেখানে প্রায়-ই বাম রাজনীতিবিদদের বৈঠক বসত। গোপন বৈঠক করার জন্য বাড়িটি মোটামুটি নিরাপদ ছিল। সে সূত্র ধরে মেনন ভাইয়ের সুবাদে কিংবা নানাভাবে তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় ছিল।মার্চ মাসের শুরু থেকেই আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-মিটিংয়ে ঢাকার পরিবেশ উত্তপ্ত। নানা দিক থেকেই বিভিন্ন ধরনের সংবাদে আক্রমণের সন্দেহটা অনেকের মনেই দানা বাঁধতে থাকে। ১৬ কি ১৮ তারিখে আমরা কয়েকজন মিলে লালমাটিয়ার বাসায় বোমা বানাতে বসেছিলাম। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরিত হয়ে এক বন্ধু আহত হয় সেখানে। সে পায়ে আঘাত পায়। কিন্তু সমস্যা হলো বাসার পেছন দিকটাতেই মোহাম্মদপুরে বিহারিদের এলাকা। এ ঘটনায় আমাকে সেখান থেকে সরে আসতে হয়। ২০ মার্চের পর আমি আর ওই বাসায় থাকিনি।
ধানমণ্ডি ৫ নম্বরে বেলাল বাকী নামে এক বন্ধু থাকত। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার বাকী। আমি বেলাল বাকীর বাসায় গিয়ে উঠলাম। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হওয়ার কারণে বেলালের বাবাও চাচ্ছিলেন যে, আমরা সেখানে থাকি। এই বাড়িটির ঠিক পাশেই লেকের ওপারে ইপিআর [বর্তমান বিজিবি] গেট। ২৫ মার্চ রাতে আমি ওই বাসায়। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে রাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম কিছুক্ষণ পরপরই
আকাশ বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আলোকিত হয়ে উঠছে। চারপাশ থেকে মানুষের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। আমাদের আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না যে, ঘটনাটা কী ঘটছে। দৌড়ে ছাদে চলে গেলাম। দেখলাম বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বলছে। রেডিও, টেলিফোন সব বন্ধ। রাতটা এভাবেই কাটল। পরদিন প্রায় সারাদিন কারফিউ। রাস্তাঘাটে থমথমে অবস্থা। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ভাঙলে বাইরে বের হব। এমন সময় শুনলাম রাতের বেলায় যখন আর্মি ট্যাংক নিয়ে ৩২ নম্বরের দিকে এগোচ্ছিল, তখন ৭ নম্বর রোডের আমাদেরই এক বন্ধু খোকন নাকি পাখি মারার টু টু বোর রাইফেল নিয়ে গেছে শেখ মুজিবকে সেভ করতে। কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল। মিলিটারিদের হাতে খোকন মারা গেল। আসলে এ থেকেই বোঝা যায়, এ ধরনের আক্রমণের জন্য আমরা কতটা অপ্রস্তুত এবং অজ্ঞ ছিলাম। আসলে মিলিটারি জিনিসটা কী_ এ সম্পর্কে আমাদের ধারণাই ছিল না। যে কারণে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র আর ট্যাঙ্ক-কামানের সামনে খোকন পাখি মারা বন্দুক নিয়ে নেমে পড়েছিল। ৪ নম্বর রোডে আমাদের কিছু বন্ধু থাকত। আমরা ওই রোডে প্রায়ই আড্ডা দিতাম। ৪ নম্বর থেকে ওয়াসিফকে [ওয়াসিফ ইসলাম] নিয়ে ৫ নম্বর রোডে আরেক বন্ধুর বাসায় যাই। আমরা বাসা থেকে বেরোচ্ছি; হঠাৎ সেখানে তৌহিদ সামাদ, বদিউল আলমরা এসে হাজির। বদি এনএসএফ [জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন] করত। থাকত জিন্নাহ হলে। এই তো মাসখানেক আগে ৭১-এর শুরুর দিকে আমরা যখন এনএসএফের হাতে মার খেতে থাকলাম, তখন আমরা বাধ্য হয়ে ওদেরকে রুখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামে গিয়ে শরীরচর্চা শুরু করি। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে একদিন বদি ও সালেক নামে একজন, মারবে বলে আমাকে তুলে নিতেও গিয়েছিল। সেই বদি ২৭ মার্চ সকালে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। স্বভাবতই আমার চোখেমুখে সন্দেহ। বদি বলছে_ ঐধর, ুড়ঁ মুঁং ধষষধিুং ঃধষশ ধনড়ঁঃ ধৎসং ৎবাড়ষঁঃরড়হ. হড় িষবঃ্থং মড় ধহফ ভরমযঃ। সে পুরোপুরি তৈরি হয়েই এসেছে। আমার চোখে অবিশ্বাস দেখে হুট করে কোথা থেকে একটা ব্লেড বের করে নিজের হাত আর আমার হাত কেটে দু'জনের রক্ত এক করে বলল, আজ থেকে আমাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক।
এরপর আমরা গেলাম ৪ নম্বরে। ওখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল মাসুদ ওমর। এ সময় আরেকটি ঘটনা ঘটল। আশফাক [শহীদ লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ; আতাউস সামাদের বড় ভাইয়ের ছেলে] আতাউস সামাদ ভাইয়ের গাড়িটা নিয়ে সোজা ৪ নম্বরে চলে এলো। আমরা টের পাচ্ছি, সবার ভেতরেই যুদ্ধের তাড়না। আমাদের আর কিছুই মাথায় নেই_ কী বাড়ি কী পরিবার! সিদ্ধান্ত হলো আমরা যুদ্ধের খোঁজে বেরুব। কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠে গেছে। আমাদের হাতে আছে বদির একটা মোটরসাইকেল। তাড়াতাড়ি আরেকটা জোগাড় করে আগে চারদিকের পরিবেশটা দেখার জন্য বের হলাম। আমি, মাসুদ, বদি আর আশফাক ধানমণ্ডি থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গেলাম। দেখি সূর্যসেন হলে জায়গায় জায়গায় বোমার আঘাত। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। মানুষজন তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় কাজ সারার জন্য এদিক-সেদিক যাচ্ছে। আমরা সেখান থেকে ঘুরে এসে লালমাটিয়ার দিকে গেলাম। লালমাটিয়ায় আমি যেখানে থাকতাম তার একটু সামনে খালেদ মোশাররফের শ্বশুরবাড়ি। পারিবারিক সূত্রে তাদের সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার। সেখানে গিয়ে দেখি বাসাবাড়ি সব তছনছ। কেউ নেই।
এরপর আমরা চলে এলাম তৌহিদের বাসায়। বদি চুপ করে বসে আছে। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বলল, এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না; কিছু একটা করতে হবে। এটা সহ্য করা যায় না। হঠাৎ বদি বলল_ শোনো, কেউ আমাদের বলে দেবে না। আমাদেরই করতে হবে। চলো, আমরা আমাদের মতো বেরিয়ে পড়ি। আমরা তৌহিদের বাসার কাউকেই কিছু বুঝতে দিলাম না। এমনকি তৌহিদকেও না। দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা যাচ্ছি যুদ্ধের খোঁজে। দুটি মোটরসাইকেলে তেজগাঁও হয়ে বাড্ডার সাতারকুল এলাকা দিয়ে আমরা যাব। আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির সুনীল দা বলেছিলেন, সিলেটের দিকে তাদের মুক্তাঞ্চল আছে। প্রাথমিকভাবে আমরা সেদিকেই রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে পড়েছে। কারও গন্তব্যের কোনো ঠিক নেই। আমাদের মোটরসাইকেলগুলো পরে কে বা কারা নিয়ে এসেছিল মনে নেই। আমরা মুড়াপাড়া দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে উঠলাম। বদি বলল, কিশোরগঞ্জে ওর মামার বাড়ি। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো বদির মামার বাড়িতে গিয়ে আমরা একটু গুছিয়ে তারপর সামনে এগোব। সবাই তো এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছি।
কিশোরগঞ্জে গিয়ে ঘটল সেই ঘটনা। যে যুদ্ধের খোঁজে এসেছি ঠিক তারই সন্ধান পেয়ে গেলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে যাচ্ছিল আখাউড়ার দিকে। মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এক ট্রেন বোঝাই সৈন্য পথে কিশোরগঞ্জে থেমে সার্কিট হাউসে উঠেছে। ইতিমধ্যে কিশোরগঞ্জে জানাজানি হয়ে গেছে এ ঘটনা। সিদ্ধান্ত নিলাম_ আমরা ওদের সঙ্গে যোগ দেব। ওরা যা দেয় তাই করব। আমরা সেখানে গেলাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। লোকজন আর্মি দেখে দারুণ উত্তেজিত। উত্তেজিত আমরাও। সৌভাগ্যবশত আমাদের মধ্যে বদি ছিল ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। বিদ্রোহী সেই আর্মি দলে, ক্যাডেট কলেজে বদির এক বছর কি দু'বছরের সিনিয়র তরুণ অফিসার হেলাল মুর্শেদের দেখা পেয়ে গেলাম। বদিকে দেখে অফিসার হেলাল বললেন_ তুমি এখানে কী করছ? আমরা বললাম, আমরা যুদ্ধ করব। অফিসার হেলাল বললেন, তোমরা কী যুদ্ধ করবে! না না। আমরা বললাম, ভাই, আমাদের একবারের জন্য কমান্ডারের কাছে নিয়ে চলেন। আমরা নিশ্চিত, তিনি আমাদের ফেরাবেন না। অবশেষে অফিসার হেলাল আমাদের নিয়ে গেলেন। ওখানে ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখা হলো মেজর সফিউল্লাহর সঙ্গে। তার পাশে আরও কয়েক জন ঊর্ধ্বতন সামরিক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে একজনকে আমি চিনতাম_ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নুরুজ্জামান। তিনিও আমাকে চিনতেন। এ সবই আমাদের জীবন ও যুদ্ধের কাকতালীয় ঘটনা। কর্নেল নুরুজ্জামান আমাদের দেখে আঁৎকে উঠে বললেন, তোমরা এখানে! তখন আমি বললাম, আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি। কর্নেল নুরুজ্জামান মেজর সফিউল্লাহকে বললেন, ঝযধভর, ও শহড় িঃযবংব নড়ুং. ঞযবু ধৎব মড়ড়ফ নড়ুং. ণড়ঁ পধহ ঃৎঁংঃ ঃযবস. তখন সফিউল্লাহ সাহেব বললেন, ওকে। তোমরা বসো; বল কী করতে পারি? তোমাদের কোনো ট্রেনিং আছে? আমরা বললাম, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউওটিসিতে [বিএনসিসি] হালকা ট্রেনিং করেছিলাম। তিনি অফিসার হেলালকে আমাদের কিছু অস্ত্র দেখাতে বললেন। আরও বললেন, ওদেরকে কিছু ফায়ারিং আর গ্রেনেড থ্রোইং শেখাও। আমরা তিন দিন আর্মিদের সঙ্গে সেখানে ছিলাম। তিন দিনের মাথায় মেজর সফিউল্লাহ আমাদের ৪টা থ্রি নট থ্রি, ৩০টা গ্রেনেড, কিছু অ্যামুনিশন আর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা ঢাকা ফিরে যাও। ছাত্রদের অর্গানাইজ করতে থাকো। সে সময়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে একটা ওয়াগনে করে খালেদ মোশাররফ এবং একজন অফিসার আসছিলেন এদিকে। মেজর সফিউল্লাহর সঙ্গে আগে থেকেই তাদের যোগাযোগ হচ্ছিল। মেজর সফিউল্লাহ বললেন, আমরা এখান থেকে তেলিয়াপাড়ার দিকে যাচ্ছি। তোমরা যোগাযোগ রেখো। দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চার তরুণ অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসছি_ উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা আর ক্রোধের মিশ্রিত একটা অনুভূতি। স্থানীয় মৌলভী সাহেব এসেছেন। আমাদের জন্য দোয়া করে দিচ্ছেন। দুইটা আড়াই মণি বস্তার মধ্যে অস্ত্রগুলো ভরে নিলাম আমরা। কিশোরগঞ্জ থেকে আমরা রওনা দিয়েছিলাম নৌকায় করে। পথে অনেকটা দূরত্ব লঞ্চে করে এসেছি।
খুব সম্ভবত ২ কি ৩ এপ্রিলে আমরা ঢাকায় এসে পেঁৗছলাম। আমরা ঢুকলাম গোপীবাগ দিয়ে। গোপীবাগের গলিটা থেকে বেরোলেই তিন-চারটা বাড়ির পরে আশফাকদের বাড়ি। আমাদের চারজনেরই পরনে লুঙ্গি। সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে দুইটা রিকশায় আমরা গোপীবাগের ওই গলিটা থেকে বের হব_ দেখি ইত্তেফাক অফিস পুরো ছাই। তার আশপাশে কয়েক সৈনিক হাঁটাহাঁটি করছে। কোনোমতে এই খানিকটা জায়গা পার হতে পারলেই আমরা গন্তব্যে পেঁৗছে যেতে পারি। ওই সময় রিকশাঅলা হঠাৎ বলল, স্যার লুঙ্গিডা নামাইয়া নেন। দেখলে তো আমগো মতো মনে অইবো না। বুঝলাম, ও ঠিক বুঝে গেছে। আমরা সেদিন এ জায়গাটুকু নির্বিঘ্নেই পার হতে পেরেছিলাম। আমরা প্রথমে চাচাকে বলিনি। এমন দুর্যোগের সময় এভাবে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আমরা আসায়। চাচা খুবই রাগ করেছিলেন। পরে চাচার পরামর্শে আমরা পালা করে রাত জেগে পাহারা দিয়েছি। রাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন সকালে তৌহিদকে ফোন দিলাম। কারফিউ উঠে গেলে ও আমাদের কথামতো গাড়ি আর লেপ-তোশক জোগাড় করে আশফাকের বাসায় নিয়ে আসল। রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে চেকিং চলছে। কিন্তু আমাদের মাথায় এ সবের কিছুই নেই। আমাদের একটাই ভাবনা_ যে করেই হোক যুদ্ধ করতে হবে। পারব কি পারব না_ এ চিন্তা উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এত বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর সপ্তাহ খানেকের মাথায় আমাদের কেউ এমন সাহস করতে পারে_ এমন ভাবাটাও বোধয় অস্বাভাবিক ছিল। গাড়িতে আমরা অস্ত্রগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নানা অলি-গলি করে ধানমণ্ডি ৪ নম্বরে ওয়াসিফদের বাসায় উঠলাম। ওদের বাসার একটা জাযগায় মাটি খুঁড়ে অস্ত্রগুলো রেখে দিলাম। আর এভাবে শেষ হলো আমাদের প্রথম মিশন। হ
লেখক :মুক্তিযোদ্ধা
No comments