সময়ের প্রতিবিম্ব-পা খোয়ানো লিমনকে নিয়ে সরকারের বিড়ম্বনা by এবিএম মূসা
পা খোয়ানো লিমন এখন পত্রিকার পাতায় নিয়মিত সংবাদ। ব্যান্ডেজ পেঁচানো বিক্ষত হাঁটুর ছবি ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন। কে এই লিমন, কেমন তার পিতামাতা? লিমন হাসপাতালে ‘বন্দী’ ছিল, তারপর বরিশালের জেলে ইত্যাদি কারণে এই কৌতূহল মেটাতে সময়মতো তাকে দেখতে যাওয়া হয়নি।
দেখতে যাওয়ার সময় যখন হলো; একটি নয়, চার-চারটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। পুরো প্রকাশ পায়নি, র্যাবের মহাপরিচালক সংবাদ সম্মেলনে তদন্তে প্রাপ্ত সংক্ষিপ্ত ‘তথ্য’ জানিয়েছেন। যা হোক, লিমনের চেয়েও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছেটা প্রবলতর ছিল। কারণ আমি বুঝতে চেয়েছি, একাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার হিম্মত তাঁরা পেলেন কোথা থেকে। কীভাবে এমন অসীম সাহসী হয়ে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের ক্ষমতাধরদের তাঁরা বেকায়দায় ফেলতে পারলেন। পরিণতি না ভেবে নিঃশঙ্কচিত্তে আদালতে মামলাও করলেন।
অবাক করা ব্যাপার হলো, কিছু সত্যিকার সন্ত্রাসীকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আর কয়েকজন নিরপরাধীর জান নিয়ে সরকারের কোনো বাহিনী এমন বেকায়দায় পড়েনি, যেমনটি পড়েছে একটি ঠ্যাং নিয়ে। এমন তড়িঘড়ি করে এত তদন্তও করা হয়নি কোনো ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যার ঘটনার পর। আবার ‘তদন্ত’ শেষ না হতেই লিমন যে সন্ত্রাসী, অভূতপূর্ব ও নজিরবিহীন এমন বক্তব্য দিয়েছেন সরকারের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কথাটি এভাবেও বলা যায়, তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেয়েই তাঁরা আগাম মন্তব্য করেছেন। আবার উল্টোটিও হতে পারে, তাঁদের বক্তব্য যে সঠিক, তা বোঝানোর জন্যই তড়িঘড়ি করে চারটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্তও চলমান রয়েছে, যদিও সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, লিমন সন্ত্রাসী। এত সব কথার বিশ্লেষণ তদন্ত কমিটির সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে নেই, বিস্তারিত বর্ণনায় আছে কি না জানি না।
একটু নিকট অতীতে যাব। এক. র্যাব লিমনের গ্রামে একজন সন্ত্রাসী খুঁজতে অভিযানে গিয়েছিল। ইতিপূর্বে এমন অনেক অভিযান কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত হয়েছে। সেসব সত্যিকারের সন্ত্রাসবিরোধী ছিল কি না, তা নিয়ে একটু-আধটু সন্দেহ ছিল, পুরো সংশয় ছিল না। এ ধরনের প্রথম অভিযান বিএনপির আমলে ছিল অপারেশন ক্লিন হার্ট। ‘ক্লিনিং’ করতে ‘কিলিং’ করায় সেই সরকার দেশে-বিদেশে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছিল। সেসব কিলিংয়ের তদন্ত হয়নি, কেউ সাফাই বক্তব্য দেননি। সম্মেলন করে, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, সেনাবাহিনীকে ‘বিলুপ্ত’ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে—এমন অভিযোগ কেউ করেননি। বরং বিএনপি সরকার ক্ষমতা ত্যাগের আগে একটি দায়মুক্ত অধ্যাদেশ জারি করে সব হত্যাকাণ্ড বৈধ করে গেল। বর্তমান সরকার মনে হয় আগেই পাঁচটি তদন্ত দল মাঠে নামিয়ে দায় আগাম সারতে চেয়েছে, যেন পরে দায়মুক্তি বিধানের ঝামেলায় পড়তে না হয়।
যা হোক, তদন্ত-প্রক্রিয়া আর রিপোর্ট প্রকাশ পদ্ধতি নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে। তবে স্বীকার করতেই হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এই বাহিনী সদ্য গঠিত সরকারটিকে বিপর্যস্ত করার জন্য যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল, তাদের দমনে বেশ কিছু সফলতা পেয়েছিল। সেই ব্যবস্থা গ্রহণে র্যাব সদস্যদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সশস্ত্র কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ করতে হয়েছে। সেসব যুদ্ধে নিহতদের দু-চারজনের ‘সন্ত্রাসী’ পরিচয় নিয়ে সংশয় ছিল। তার পরও সামগ্রিকভাবে র্যাব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অবসান ঘটাতে না পারলেও সাময়িকভাবে অবদমিত করেছিল। সে কারণে তাদের কয়েকটি ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে একটু-আধটু সমালোচনার ঝড় বইলেও কালক্রমে সেসব থেমে গেছে। র্যাবকে বা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়তে হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে আবার কতিপয় অ্যাকশন বা ক্রসফায়ারে প্রকৃত সন্ত্রাসীর মৃত্যু হওয়ায় এলাকার সাধারণ মানুষ উল্লাস করেছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। সে কারণে নিরীহ ব্যক্তির মৃত্যুজনিত ক্ষোভও কালক্রমে চাপা পড়েছে। কিন্তু এবার মনে হয় ‘মিসফায়ার’ হওয়াতে দরিদ্র এক গ্রাম্য যুবক একটি পা খুইয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে র্যাবের অবস্থান টালমাটাল করে দিয়েছে পরবর্তী সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। আগের নির্বিচার হত্যা সামলানো গেলেও এবারের অকারণ নিষ্ঠুরতা অতিমাত্রায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ মেনে নিচ্ছে না।
তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে ভাবনার আগেই বুঝতে চেয়েছি, একজন বা একাধিক ‘র্যাব’ সদস্যের সামগ্রিক কর্তব্য পালনের ব্যতিক্রমী কোনো কর্মের দায় কেন সমগ্র বাহিনীর ওপর বর্তাবে। সাফাই গাইতে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কেন নিজেদের পাতে ঝোল টেনেছেন। বিশেষ একজন সদস্যের ইচ্ছাকৃত অথবা অসাবধানতায় অথবা র্যাব মহাপরিচালকের ভাষায়, ভুল-বোঝাবুঝিতে ‘ছোড়া’ গুলি র্যাব ও সরকারকে কেন ‘ব্যাক ফায়ার’ করছে। প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে, র্যাবের পক্ষ থেকে লিমন ‘ঘটনার শিকার’ বক্তব্যটি সাংবাদিকদের নোট বই অথবা টেপ থেকে মুছে যায়নি বলে জানি।
একটি তুলনা বাস্তবসম্মত হবে কি না জানি না। কতিপয় সেনাসদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। তাদের অপকর্মের দায় সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর কেউ চাপায়নি। পত্রিকার প্রতিবেদনে অথবা রাজনীতিবিদদের বিবৃতিতে প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হলেই ‘কতিপয় বিপথগামী’ সেনাসদস্যের অপকীর্তি বলে উল্লিখিত হয়েছে। তাদের বিচার হয়েছে, কয়েকজন দণ্ডিত হয়েছে। একইভাবে লিমনকে বিকলাঙ্গ করার ঘটনাটির জন্য, সেটি যেভাবেই হোক, সমগ্র র্যাব বাহিনীকে নয়; র্যাবের একজন সদস্যকেই দোষারোপ করেছে গণমাধ্যম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। তার পরও একজন সদস্যের কৃতকর্মের সাফাই গাইতে কেন লিমনের প্রতি সহমর্মীদের ‘র্যাব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রকারী’ বলা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়।
লিমনের পা হারানোর ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়ে শেষ না হতেই ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়ে গেল বা করা হলো। সেই ভিন্ন প্রবাহই পরবর্তী সময়ে বিশেষ মহলে আলোচিত হয়েছে। কোথায় লিমনের পায়ে গুলি, আর কোথায় দেশে জঙ্গিবাদ কিংবা সুদূর অতীতে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা। পা খোয়ানো লিমনকে যেসব পত্রিকা, তার সম্পাদক ও স্থানীয় প্রতিনিধি এবং আমরা যারা মানবিক কারণে তার প্রতি শুধু সহানুভূতি জানিয়েছি, তাদের সরকারের উপদেষ্টা রাতারাতি জঙ্গি বানিয়ে দিলেন। বস্তুত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নিষ্ঠা ও ধারা অনুসরণেই প্রথম আলো এত ফলোআপ অর্থাৎ খবরের পরের খবর ছেপেছে। বিলেতে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে লন্ডন টাইমস-এর সম্পাদক একাত্তরে আমার পরম শুভাকাঙ্ক্ষী হ্যারি ইভান্স এ ধরনের অনুসন্ধানী রিপোর্টের অনুসরণকে ‘ডগেডলি’ লেগে থাকা বলতেন। খবর ছাপলেই হলো না, ঘটনার শেষ দেখার জন্য প্রতিবেদককে ‘ডগেডলি’ মানে কুকুরের মতো খবরটিতে কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। প্রথম আলোর সম্পাদক আর স্থানীয় প্রতিনিধি সাংবাদিকতার এই চিরাচরিত রীতিটি অনুসরণ করে বিশেষ মহলের অপবাদের শিকার হয়েছেন।
দুঃখিত, প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছি। বর্তমান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, লিমনের পা বিচ্ছিন্নের ঘটনার তদন্ত চলাকালেই, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ফয়সালার আগেই, কেন সাফাই গেয়েছেন আমাদের সর্বমহলে সম্মানিত একজন উপদেষ্টা। এ নিয়ে অনেক পাঠক বিস্ময় প্রকাশ করে আমাকে টেলিফোন করেছেন। এ নিয়ে সেদিন প্রেসক্লাবে খাওয়ার ঘরে তুমুল আলোচনা চলছিল। সাংবাদিক জগতের প্রভাবশালী নেতা স্নেহভাজন ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন বিস্ময় প্রকাশ করলেন। একই সুরে বললেন, যিনি আড়াই বছর নিজের দায়িত্বের আওতার বাইরে আসেননি, রাজনৈতিক সরকারের কোনো ঝুট-ঝামেলায় নিজেকে জড়াননি বলে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন, তিনি কেন হঠাৎ করে আচম্বিতে লিমন-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন। সরকারকেও আলোচনা-সমালোচনায় পরোক্ষে সম্পৃক্ত করলেন?
এখন তদন্ত রিপোর্টের যতটুকু জানা গেছে তাতে দুর্ভাবনা হচ্ছে, আসল সন্ত্রাসীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও তাদের ‘সন্ত্রাসীর সহযোগী’ লিমনকে আর তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে গ্রেপ্তার করে ‘রিমান্ডে’ নেওয়া হবে কি না। তখন সরকার বনাম খঞ্জ লিমন ও তাঁর অসীম সাহসী পিতামাতার লড়াইয়ে হয়তো নতুন মাত্রা যোগ হবে। আবার এও ভাবছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টে কি আগের চারটি বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত হবে? তা না হলে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই যে বেকায়দায় পড়বেন।
খণ্ডিত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করার সময় মহাপরিচালক এবং তার তিন দিন আগে উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক কয়েকটি অজানা তথ্য জানিয়েছেন, যা র্যাবের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাব্যবস্থার প্রতি আমার আস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিপূর্বে উপদেষ্টা, পরে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন অপরাধে এ পর্যন্ত র্যাবের এক হাজার ১৪৭ ‘অপরাধী’কে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন ৬৭ জন আর কারাদণ্ড হয়েছে ১৬ জনের। সর্বোপরি, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে অভিযানে প্রাণ দিয়েছেন ৩৪ জন। এসব তথ্য এত দিন সাধারণ মানুষকে জ্ঞাত করা হলে র্যাব নিয়ে বিতর্ক মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছাত না। আবার এও ঠিক, লিমনকে খঞ্জ করা না হলে এই চমৎকার তথ্য আমরা জানতে পারতাম না। এখন স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা, বিলম্বিত হইচই আর তদন্তের ঝকমারি শুরুর আগেই কোনো সদস্য শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন কি না, বিভাগীয় তদন্ত করে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাবিধি অনুসরণে অপরাধ যাচাই করে ‘অপরাধী’কে ‘কারাদণ্ড বা শাস্তি কিংবা বরখাস্ত’ করা যেত না কি? তেমনটি করলে ‘অপারেশন লিমন’ নিয়ে চরম জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না, সরকারও এত বিড়ম্বনায় পড়ত না।
পা হারানো লিমন আর পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা, অস্ত্র পাচারের ঘটনার এত ধরনের তদন্ত হয়েছিল এক জমানায়। আরেক জমানায় এসে সব উল্টে গেল, সব তদন্তের পুনঃ তদন্ত হচ্ছে। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির গুলি চালনার পর মুসলিম লীগ সরকার গঠিত পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের জাস্টিস এলিসের তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছিল, ‘উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ সঠিক ছিল।’ তার পরও ৬০ বছর ধরে বাঙালি গাইছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ লিমনের ‘খোয়ানো পা’ ঘটনা নিয়ে তিনটি তদন্ত হয়েছে, চতুর্থটি চলছে। চূড়ান্ত ভাবনা, এসব তদন্ত নিয়ে বিভ্রান্তি অবসানকল্পে কোনো সুদূর বা নিকট ভবিষ্যতে পুনঃ তদন্ত হবে না তো?
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
অবাক করা ব্যাপার হলো, কিছু সত্যিকার সন্ত্রাসীকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আর কয়েকজন নিরপরাধীর জান নিয়ে সরকারের কোনো বাহিনী এমন বেকায়দায় পড়েনি, যেমনটি পড়েছে একটি ঠ্যাং নিয়ে। এমন তড়িঘড়ি করে এত তদন্তও করা হয়নি কোনো ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যার ঘটনার পর। আবার ‘তদন্ত’ শেষ না হতেই লিমন যে সন্ত্রাসী, অভূতপূর্ব ও নজিরবিহীন এমন বক্তব্য দিয়েছেন সরকারের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কথাটি এভাবেও বলা যায়, তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেয়েই তাঁরা আগাম মন্তব্য করেছেন। আবার উল্টোটিও হতে পারে, তাঁদের বক্তব্য যে সঠিক, তা বোঝানোর জন্যই তড়িঘড়ি করে চারটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্তও চলমান রয়েছে, যদিও সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, লিমন সন্ত্রাসী। এত সব কথার বিশ্লেষণ তদন্ত কমিটির সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে নেই, বিস্তারিত বর্ণনায় আছে কি না জানি না।
একটু নিকট অতীতে যাব। এক. র্যাব লিমনের গ্রামে একজন সন্ত্রাসী খুঁজতে অভিযানে গিয়েছিল। ইতিপূর্বে এমন অনেক অভিযান কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত হয়েছে। সেসব সত্যিকারের সন্ত্রাসবিরোধী ছিল কি না, তা নিয়ে একটু-আধটু সন্দেহ ছিল, পুরো সংশয় ছিল না। এ ধরনের প্রথম অভিযান বিএনপির আমলে ছিল অপারেশন ক্লিন হার্ট। ‘ক্লিনিং’ করতে ‘কিলিং’ করায় সেই সরকার দেশে-বিদেশে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছিল। সেসব কিলিংয়ের তদন্ত হয়নি, কেউ সাফাই বক্তব্য দেননি। সম্মেলন করে, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, সেনাবাহিনীকে ‘বিলুপ্ত’ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে—এমন অভিযোগ কেউ করেননি। বরং বিএনপি সরকার ক্ষমতা ত্যাগের আগে একটি দায়মুক্ত অধ্যাদেশ জারি করে সব হত্যাকাণ্ড বৈধ করে গেল। বর্তমান সরকার মনে হয় আগেই পাঁচটি তদন্ত দল মাঠে নামিয়ে দায় আগাম সারতে চেয়েছে, যেন পরে দায়মুক্তি বিধানের ঝামেলায় পড়তে না হয়।
যা হোক, তদন্ত-প্রক্রিয়া আর রিপোর্ট প্রকাশ পদ্ধতি নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে। তবে স্বীকার করতেই হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এই বাহিনী সদ্য গঠিত সরকারটিকে বিপর্যস্ত করার জন্য যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল, তাদের দমনে বেশ কিছু সফলতা পেয়েছিল। সেই ব্যবস্থা গ্রহণে র্যাব সদস্যদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সশস্ত্র কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ করতে হয়েছে। সেসব যুদ্ধে নিহতদের দু-চারজনের ‘সন্ত্রাসী’ পরিচয় নিয়ে সংশয় ছিল। তার পরও সামগ্রিকভাবে র্যাব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অবসান ঘটাতে না পারলেও সাময়িকভাবে অবদমিত করেছিল। সে কারণে তাদের কয়েকটি ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে একটু-আধটু সমালোচনার ঝড় বইলেও কালক্রমে সেসব থেমে গেছে। র্যাবকে বা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়তে হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে আবার কতিপয় অ্যাকশন বা ক্রসফায়ারে প্রকৃত সন্ত্রাসীর মৃত্যু হওয়ায় এলাকার সাধারণ মানুষ উল্লাস করেছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। সে কারণে নিরীহ ব্যক্তির মৃত্যুজনিত ক্ষোভও কালক্রমে চাপা পড়েছে। কিন্তু এবার মনে হয় ‘মিসফায়ার’ হওয়াতে দরিদ্র এক গ্রাম্য যুবক একটি পা খুইয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে র্যাবের অবস্থান টালমাটাল করে দিয়েছে পরবর্তী সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। আগের নির্বিচার হত্যা সামলানো গেলেও এবারের অকারণ নিষ্ঠুরতা অতিমাত্রায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ মেনে নিচ্ছে না।
তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে ভাবনার আগেই বুঝতে চেয়েছি, একজন বা একাধিক ‘র্যাব’ সদস্যের সামগ্রিক কর্তব্য পালনের ব্যতিক্রমী কোনো কর্মের দায় কেন সমগ্র বাহিনীর ওপর বর্তাবে। সাফাই গাইতে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কেন নিজেদের পাতে ঝোল টেনেছেন। বিশেষ একজন সদস্যের ইচ্ছাকৃত অথবা অসাবধানতায় অথবা র্যাব মহাপরিচালকের ভাষায়, ভুল-বোঝাবুঝিতে ‘ছোড়া’ গুলি র্যাব ও সরকারকে কেন ‘ব্যাক ফায়ার’ করছে। প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে, র্যাবের পক্ষ থেকে লিমন ‘ঘটনার শিকার’ বক্তব্যটি সাংবাদিকদের নোট বই অথবা টেপ থেকে মুছে যায়নি বলে জানি।
একটি তুলনা বাস্তবসম্মত হবে কি না জানি না। কতিপয় সেনাসদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। তাদের অপকর্মের দায় সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর কেউ চাপায়নি। পত্রিকার প্রতিবেদনে অথবা রাজনীতিবিদদের বিবৃতিতে প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হলেই ‘কতিপয় বিপথগামী’ সেনাসদস্যের অপকীর্তি বলে উল্লিখিত হয়েছে। তাদের বিচার হয়েছে, কয়েকজন দণ্ডিত হয়েছে। একইভাবে লিমনকে বিকলাঙ্গ করার ঘটনাটির জন্য, সেটি যেভাবেই হোক, সমগ্র র্যাব বাহিনীকে নয়; র্যাবের একজন সদস্যকেই দোষারোপ করেছে গণমাধ্যম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। তার পরও একজন সদস্যের কৃতকর্মের সাফাই গাইতে কেন লিমনের প্রতি সহমর্মীদের ‘র্যাব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্রকারী’ বলা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়।
লিমনের পা হারানোর ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়ে শেষ না হতেই ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়ে গেল বা করা হলো। সেই ভিন্ন প্রবাহই পরবর্তী সময়ে বিশেষ মহলে আলোচিত হয়েছে। কোথায় লিমনের পায়ে গুলি, আর কোথায় দেশে জঙ্গিবাদ কিংবা সুদূর অতীতে জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা। পা খোয়ানো লিমনকে যেসব পত্রিকা, তার সম্পাদক ও স্থানীয় প্রতিনিধি এবং আমরা যারা মানবিক কারণে তার প্রতি শুধু সহানুভূতি জানিয়েছি, তাদের সরকারের উপদেষ্টা রাতারাতি জঙ্গি বানিয়ে দিলেন। বস্তুত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নিষ্ঠা ও ধারা অনুসরণেই প্রথম আলো এত ফলোআপ অর্থাৎ খবরের পরের খবর ছেপেছে। বিলেতে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে লন্ডন টাইমস-এর সম্পাদক একাত্তরে আমার পরম শুভাকাঙ্ক্ষী হ্যারি ইভান্স এ ধরনের অনুসন্ধানী রিপোর্টের অনুসরণকে ‘ডগেডলি’ লেগে থাকা বলতেন। খবর ছাপলেই হলো না, ঘটনার শেষ দেখার জন্য প্রতিবেদককে ‘ডগেডলি’ মানে কুকুরের মতো খবরটিতে কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। প্রথম আলোর সম্পাদক আর স্থানীয় প্রতিনিধি সাংবাদিকতার এই চিরাচরিত রীতিটি অনুসরণ করে বিশেষ মহলের অপবাদের শিকার হয়েছেন।
দুঃখিত, প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছি। বর্তমান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, লিমনের পা বিচ্ছিন্নের ঘটনার তদন্ত চলাকালেই, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ফয়সালার আগেই, কেন সাফাই গেয়েছেন আমাদের সর্বমহলে সম্মানিত একজন উপদেষ্টা। এ নিয়ে অনেক পাঠক বিস্ময় প্রকাশ করে আমাকে টেলিফোন করেছেন। এ নিয়ে সেদিন প্রেসক্লাবে খাওয়ার ঘরে তুমুল আলোচনা চলছিল। সাংবাদিক জগতের প্রভাবশালী নেতা স্নেহভাজন ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন বিস্ময় প্রকাশ করলেন। একই সুরে বললেন, যিনি আড়াই বছর নিজের দায়িত্বের আওতার বাইরে আসেননি, রাজনৈতিক সরকারের কোনো ঝুট-ঝামেলায় নিজেকে জড়াননি বলে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন, তিনি কেন হঠাৎ করে আচম্বিতে লিমন-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন। সরকারকেও আলোচনা-সমালোচনায় পরোক্ষে সম্পৃক্ত করলেন?
এখন তদন্ত রিপোর্টের যতটুকু জানা গেছে তাতে দুর্ভাবনা হচ্ছে, আসল সন্ত্রাসীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও তাদের ‘সন্ত্রাসীর সহযোগী’ লিমনকে আর তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে গ্রেপ্তার করে ‘রিমান্ডে’ নেওয়া হবে কি না। তখন সরকার বনাম খঞ্জ লিমন ও তাঁর অসীম সাহসী পিতামাতার লড়াইয়ে হয়তো নতুন মাত্রা যোগ হবে। আবার এও ভাবছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টে কি আগের চারটি বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত হবে? তা না হলে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই যে বেকায়দায় পড়বেন।
খণ্ডিত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করার সময় মহাপরিচালক এবং তার তিন দিন আগে উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক কয়েকটি অজানা তথ্য জানিয়েছেন, যা র্যাবের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাব্যবস্থার প্রতি আমার আস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিপূর্বে উপদেষ্টা, পরে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন অপরাধে এ পর্যন্ত র্যাবের এক হাজার ১৪৭ ‘অপরাধী’কে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন ৬৭ জন আর কারাদণ্ড হয়েছে ১৬ জনের। সর্বোপরি, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে অভিযানে প্রাণ দিয়েছেন ৩৪ জন। এসব তথ্য এত দিন সাধারণ মানুষকে জ্ঞাত করা হলে র্যাব নিয়ে বিতর্ক মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছাত না। আবার এও ঠিক, লিমনকে খঞ্জ করা না হলে এই চমৎকার তথ্য আমরা জানতে পারতাম না। এখন স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা, বিলম্বিত হইচই আর তদন্তের ঝকমারি শুরুর আগেই কোনো সদস্য শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন কি না, বিভাগীয় তদন্ত করে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাবিধি অনুসরণে অপরাধ যাচাই করে ‘অপরাধী’কে ‘কারাদণ্ড বা শাস্তি কিংবা বরখাস্ত’ করা যেত না কি? তেমনটি করলে ‘অপারেশন লিমন’ নিয়ে চরম জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না, সরকারও এত বিড়ম্বনায় পড়ত না।
পা হারানো লিমন আর পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা, অস্ত্র পাচারের ঘটনার এত ধরনের তদন্ত হয়েছিল এক জমানায়। আরেক জমানায় এসে সব উল্টে গেল, সব তদন্তের পুনঃ তদন্ত হচ্ছে। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির গুলি চালনার পর মুসলিম লীগ সরকার গঠিত পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের জাস্টিস এলিসের তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছিল, ‘উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ সঠিক ছিল।’ তার পরও ৬০ বছর ধরে বাঙালি গাইছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ লিমনের ‘খোয়ানো পা’ ঘটনা নিয়ে তিনটি তদন্ত হয়েছে, চতুর্থটি চলছে। চূড়ান্ত ভাবনা, এসব তদন্ত নিয়ে বিভ্রান্তি অবসানকল্পে কোনো সুদূর বা নিকট ভবিষ্যতে পুনঃ তদন্ত হবে না তো?
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments