স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র by আমীর-উল ইসলাম
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে বলতে গেলে পূর্বাপর কিছু ঘটনা না বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। যদিও এত বেশি বলার জায়গা এখানে নেই। যতটুকু একেবারেই না বললে নয়, সেখান থেকে শুরু করি। স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে ১১ এপ্রিল রাতে আগরতলা সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে।
সেখানে আওয়ামী লীগের সাংসদেরা ছাড়াও কর্নেল ওসমানী ছিলেন। যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লি, কলকাতাসহ দেশের ভেতরে-বাইরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়। সেখানে যুদ্ধের ব্যাপ্তি, প্রকৃতি, সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি আমি। তখনই আমরা সরকার গঠনের চিন্তাভাবনা করি। কারণ, ব্যক্তিপর্যায়ে আলোচনা হয় ব্যক্তির সঙ্গে। কোনো দেশের সঙ্গে কথা বলতে হলে দেশের প্রতিনিধি লাগে।
এর আগে অবশ্য ১০ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর প্রতি বক্তব্য দিয়েছেন, যা রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। প্রবাসী সরকারের করণীয় ও কর্মপরিকল্পনা ঠিক করলাম আমরা। প্রথমে অত্যাচারিত মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এই লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন সীমান্তপথে বাংলাদেশিদের সীমান্ত পার হয়ে নির্বিঘ্নে চলে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার জন্য আমরা দুটি প্রবেশপথ ঠিক করলাম। একটি আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লোকজন কলকাতা দিয়ে। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য ডাউকি, ময়মনসিংহের জন্য তুরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভূরুঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকির মতো ছোট ছোট কিছু প্রবেশপথ ঠিক করা হয়।
বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে সরকার গঠন করা জরুরি। যদিও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেডিওতে ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু তখনো মন্ত্রিপরিষদ আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেনি। তাই ১৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হয়। শপথের জন্য প্রথমে আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয় এবং ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে নতুন জায়গার কথা চিন্তা করতে থাকি। এ ব্যাপারে সবাই আলোচনা করে একমত হই যে যেখানেই অনুষ্ঠান করি না কেন, পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, বিএসএফের গোলক মজুমদার ও শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকে জানালাম না। কিছু কাজ দ্রুত সমাধা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাতক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল রেডিওতে প্রচারিত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বাংলা ও ইংরেজি করা হয়েছিল। ইংরেজি কপি বিদেশি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়েছিল। এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা।
আমি আর তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকি, সেই ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় লেখার কাজ করি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখতে হবে। হাতের কাছে নেই কোনো বই বা অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো কপি। আমেরিকার ইনডিপেনডেন্স বিল অনেক আগে পড়েছিলাম। চোখের সামনে ভাসছিল সেই অরিজিনাল কপি আর বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছু মনে নেই। অবশ্য বেশি কিছু মনে করার চেষ্টাও করলাম না। শুধু মাথায় রাখার চেষ্টা করলাম কী কী পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে এবং ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া চূড়ান্ত করে ফেললাম। প্রেসিডেন্ট যেহেতু অনুপস্থিত, স্বাধীনতার ঘোষণায় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া হলো।
চূড়ান্ত খসড়াটি তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালে তিনি পছন্দ করলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনো বড় আইনজীবীকে দেখিয়ে নিতে হবে। কারণ, আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ, ঘোষণাপত্রে কোনো রকমের আইনি ফাঁক থাকা চলবে না। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা ইতিমধ্যে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছেন। তাঁদের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, সুব্রত রায় চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে রহমত আলী নামে ঘোষণাপত্রের খসড়াটি তাঁকে দেখাতে নিয়ে গেলাম। তিনি ঘোষণাপত্রটি দেখে লাফিয়ে উঠলেন এবং বললেন, কোনো কোলন, সেমিকোলনও পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। এটা ছিল রায় চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। এরপর অবশ্য তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়। সময়ে-অসময়ে তাঁর কাছে ছুটে যেতাম। তিনিও ছোট ভাইয়ের মতো পরামর্শ, সাহায্য-সহযোগিতা করছেন।
শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে। প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের কাছে ওসমানীর গায়ের মাপের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। রাতের মধ্যে দর্জি ডেকে, কাপড় কিনে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। আমার আর আবদুল মান্নানের ওপর পড়ল শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার দায়িত্ব। প্রথম বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কলকাতা প্রেসক্লাবে মিলিত হই, সেটা ছিল ১৬ এপ্রিলের ঘটনা। প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য, তিলধারণের ঠাঁই নেই। ক্লাবের সভাপতি সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা অনুরোধ করলাম, আমাদের উপস্থিতির কথা আপাতত গোপন রাখতে হবে। এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পরদিন ভোরে ডাকা অনুষ্ঠানে হাজির হতে অনুরোধ জানাই।
বিএসএফ থেকে ১০০টি গাড়ি নেওয়া হলো। সাংবাদিকদের জন্য ৫০টি। অন্যগুলো আওয়ামী লীগের এমপি, এমএলএ ও নেতাদের জন্য। রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দিতে থাকলাম। কোথায় যাচ্ছেন তা জানতে না চাওয়ার জন্য বলা হলো। শুধু বলে দিলাম, সকালে আমরা একসঙ্গে হব। গাড়িচালকদের বলে দেওয়া হলো, তাঁরাই পৌঁছে দেবেন নির্দিষ্ট স্থানে। লোক জানাজানির ভয়ে এই ব্যবস্থা।
সারা রাত ঘুমাইনি, ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ওসমানী
গাড়িতে করে রওনা হয়ে যান। রুম থেকে ঘোষণাপত্রের কাগজপত্র নিয়ে আমি ও আবদুল মান্নান প্রেসক্লাবে গিয়ে দেখি, সেই কাকডাকা ভোরেও তিলধারণের ঠাঁই নেই। সাংবাদিকদের জানানো হলো, স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। তাঁদের নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। আম্রকাননে পৌঁছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এবং আগেই ঠিক করা ছিল, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ, ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন।
কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। একটি ছোট্ট মঞ্চে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আবদুল মান্নান। সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিচালনায় শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত আম্রকানন বা মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আম্রকাননের নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর।
অনুলিখন: ইমরান উজ-জামান
আমীর-উল ইসলাম: ব্যারিস্টার, রাজনীতিক
এর আগে অবশ্য ১০ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর প্রতি বক্তব্য দিয়েছেন, যা রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। প্রবাসী সরকারের করণীয় ও কর্মপরিকল্পনা ঠিক করলাম আমরা। প্রথমে অত্যাচারিত মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এই লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন সীমান্তপথে বাংলাদেশিদের সীমান্ত পার হয়ে নির্বিঘ্নে চলে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার জন্য আমরা দুটি প্রবেশপথ ঠিক করলাম। একটি আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লোকজন কলকাতা দিয়ে। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য ডাউকি, ময়মনসিংহের জন্য তুরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভূরুঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকির মতো ছোট ছোট কিছু প্রবেশপথ ঠিক করা হয়।
বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে সরকার গঠন করা জরুরি। যদিও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেডিওতে ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু তখনো মন্ত্রিপরিষদ আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেনি। তাই ১৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হয়। শপথের জন্য প্রথমে আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয় এবং ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে নতুন জায়গার কথা চিন্তা করতে থাকি। এ ব্যাপারে সবাই আলোচনা করে একমত হই যে যেখানেই অনুষ্ঠান করি না কেন, পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, বিএসএফের গোলক মজুমদার ও শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকে জানালাম না। কিছু কাজ দ্রুত সমাধা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাতক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল রেডিওতে প্রচারিত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বাংলা ও ইংরেজি করা হয়েছিল। ইংরেজি কপি বিদেশি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়েছিল। এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা।
আমি আর তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকি, সেই ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় লেখার কাজ করি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখতে হবে। হাতের কাছে নেই কোনো বই বা অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো কপি। আমেরিকার ইনডিপেনডেন্স বিল অনেক আগে পড়েছিলাম। চোখের সামনে ভাসছিল সেই অরিজিনাল কপি আর বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছু মনে নেই। অবশ্য বেশি কিছু মনে করার চেষ্টাও করলাম না। শুধু মাথায় রাখার চেষ্টা করলাম কী কী পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে এবং ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া চূড়ান্ত করে ফেললাম। প্রেসিডেন্ট যেহেতু অনুপস্থিত, স্বাধীনতার ঘোষণায় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া হলো।
চূড়ান্ত খসড়াটি তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালে তিনি পছন্দ করলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনো বড় আইনজীবীকে দেখিয়ে নিতে হবে। কারণ, আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ, ঘোষণাপত্রে কোনো রকমের আইনি ফাঁক থাকা চলবে না। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা ইতিমধ্যে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছেন। তাঁদের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, সুব্রত রায় চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে রহমত আলী নামে ঘোষণাপত্রের খসড়াটি তাঁকে দেখাতে নিয়ে গেলাম। তিনি ঘোষণাপত্রটি দেখে লাফিয়ে উঠলেন এবং বললেন, কোনো কোলন, সেমিকোলনও পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। এটা ছিল রায় চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। এরপর অবশ্য তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়। সময়ে-অসময়ে তাঁর কাছে ছুটে যেতাম। তিনিও ছোট ভাইয়ের মতো পরামর্শ, সাহায্য-সহযোগিতা করছেন।
শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে। প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের কাছে ওসমানীর গায়ের মাপের কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। রাতের মধ্যে দর্জি ডেকে, কাপড় কিনে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। আমার আর আবদুল মান্নানের ওপর পড়ল শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার দায়িত্ব। প্রথম বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কলকাতা প্রেসক্লাবে মিলিত হই, সেটা ছিল ১৬ এপ্রিলের ঘটনা। প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য, তিলধারণের ঠাঁই নেই। ক্লাবের সভাপতি সবার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা অনুরোধ করলাম, আমাদের উপস্থিতির কথা আপাতত গোপন রাখতে হবে। এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পরদিন ভোরে ডাকা অনুষ্ঠানে হাজির হতে অনুরোধ জানাই।
বিএসএফ থেকে ১০০টি গাড়ি নেওয়া হলো। সাংবাদিকদের জন্য ৫০টি। অন্যগুলো আওয়ামী লীগের এমপি, এমএলএ ও নেতাদের জন্য। রাত ১২টা থেকে নেতাদের গাড়িতে তুলে দিতে থাকলাম। কোথায় যাচ্ছেন তা জানতে না চাওয়ার জন্য বলা হলো। শুধু বলে দিলাম, সকালে আমরা একসঙ্গে হব। গাড়িচালকদের বলে দেওয়া হলো, তাঁরাই পৌঁছে দেবেন নির্দিষ্ট স্থানে। লোক জানাজানির ভয়ে এই ব্যবস্থা।
সারা রাত ঘুমাইনি, ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ওসমানী
গাড়িতে করে রওনা হয়ে যান। রুম থেকে ঘোষণাপত্রের কাগজপত্র নিয়ে আমি ও আবদুল মান্নান প্রেসক্লাবে গিয়ে দেখি, সেই কাকডাকা ভোরেও তিলধারণের ঠাঁই নেই। সাংবাদিকদের জানানো হলো, স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। তাঁদের নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। আম্রকাননে পৌঁছতে বেলা ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এবং আগেই ঠিক করা ছিল, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ, ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন।
কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। একটি ছোট্ট মঞ্চে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আবদুল মান্নান। সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিচালনায় শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত আম্রকানন বা মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আম্রকাননের নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর।
অনুলিখন: ইমরান উজ-জামান
আমীর-উল ইসলাম: ব্যারিস্টার, রাজনীতিক
No comments