বোবা বসন্তের চার দশক by শেখ রোকন
একাত্তরের মার্চে নিশ্চয়ই বাংলায় ছিল ঘোর বসন্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালির তখন ফুল-পাখি নিয়ে ভাববার সময় কই? কিংবা নিজেরাই এক একটি নতুন পাতা, গানের পাখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মোড়ে রোজ বিকেলে বেলি ফুলের মালা হাতে অপেক্ষমাণ তরুণকে আর দেখা যায় না।
তরুণীও ত্রস্ত পায়ে এসে রমনার সবুজে বসে ধীর লয়ে সন্ধ্যা কাটায় না। তারা দু'জনে তখন মিছিলে মিছিলে কণ্ঠ মেলায়, দৃপ্ত পায়ে হাঁটে। সে এক মুখর বসন্ত। কেবল কি একাত্তরের মার্চ? গোটা ষাটের দশকই যেন বাঙালির বসন্তকাল। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী এই বসন্তই স্তব্ধ করে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিশ্চুপ করে দিতে চেয়েছিল হাজারো কণ্ঠস্বরকে। মানুষ দখলদারদের রুখে দাঁড়িয়েছিল। স্লোগান পরিণত হয়েছিল শাস্ত্রে। প্রকৃত পাখিরাও কি সরব ছিল? নাকি অস্ত্রের ঝনঝনি আর গোলা-বারুদের ঝাঁঝে বসন্ত বোবা হয়ে গিয়েছিল?
সন্দেহ নেই, চার দশক আগে বাংলার বসন্ত আরও মনোরম ছিল। তখনও আমাদের মাটি ও জল বিবিধ দূষণের শিকার হয়নি। ন্যাড়া হতে শুরু করেনি পাহাড় ও বনভূমি। নদীগুলোও ছিল সত্যিকারে স্রোতস্বিনী_ তখনও উজানের পরিকল্পিত পানি প্রত্যাহার, ভাটিতে অপরিকল্পিত স্থাপনা, নির্বিচার দখল দৈত্যকায় হয়ে ওঠেনি। একাত্তরের মার্চ-এপ্রিলে পাকবাহিনীর নিবির্চার হত্যাযজ্ঞ বাংলার প্রকৃতিতে অপ্রাকৃতিক আগ্রাসনের কালো থাবা বসিয়েছিল। পরবর্তী নয় মাসে গাঙ্গেয় বদ্বীপে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নানা সময়ে নানা হিসাব-নিকাশ হয়েছে। প্রকৃতির ক্ষতি এখনও অজানা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে '৭৩-৭৪ সালে দেশজুড়ে যে গণডায়রিয়া-কলেরা দেখা দিয়েছিল, তার কারণ যে দূষিত পানি, কে না জানে! কিন্তু সেই দূষণের দায় কার, কেউ কি ভেবেছে? পরবর্তী কয়েক বসন্তে পাখি আগের মতো ডেকেছে কি-না, কে তার খোঁজ রেখেছে?
বস্তুত, পাখির ডাক তখনও আমাদের দেশে কবিতার বিষয়। মানুষের জীবনে ও যাপনে টুনটুনির সাবলীল কণ্ঠস্বরের অবদান তখনও অস্বীকৃত। অথচ বসন্তে পাখির ডাক নিয়ে আমেরিকায় তোলপাড় হয়েছে তারও এক দশক আগে থেকে।
বৈশ্বিক পরিবেশ আন্দোলনের বাইবেল বলে পরিচিত 'সাইলেন্স স্প্রিং' ততদিনে নতুন আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে মলাটবন্দি হওয়ার আগে ওই বছর জুন থেকে 'দ্য নিউ ইয়র্কার'-এ সিরিজ প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ হচ্ছিল এটি। তারও আগে, ১৯৫৮ থেকে চার গবেষণার পর র্যাশেল লুইস কারসোন দেখালেন কৃষি ও শিল্পে ব্যবহৃত কীটনাশক কীভাবে পরিবেশ, বিশেষ করে পাখির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তার আশঙ্কা ছিল, প্রকৃতিতে বিষ প্রয়োগ চলতে থাকলে পরবর্তী কয়েক বছর পর আমেরিকায় এমন বসন্ত আসবে, যখন গান গাওয়ার মতো পাখি অবশিষ্ট থাকবে না। তার আশঙ্কা ইউরোপ-আমেরিকার অনেককে স্পর্শ করেছিল। পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল পরিবেশ বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা। যুদ্ধের গোলা-বারুদে পানি ও ভূমি দূষণের বিরুদ্ধেও একই সময় গড়ে উঠতে থাকে বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন উদ্যোগ। সার্বিক পরিবেশ সুরক্ষায় বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হতে থাকে। ১৯৭২ সালের জুনে 'মানব পরিবেশ' নিয়ে স্টকহোমে সম্মেলনের ডাক দেয় খোদ জাতিসংঘ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধি দল সেখানে যোগ দিয়েছিল।
সেই পরিবেশ আন্দোলন গত চার দশকে ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় গ্রিন মুভমেন্ট এখন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিও। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে আঘাত প্রকৃতির ওপর নেমে এসেছিল; প্রতিবাদের ভাষা তার চেয়েও শক্তিশালী হয়েছে। আমরা তখন না হয় বুঝতে পারিনি। কিন্তু গত চার দশকে প্রকৃতির ওপর আঘাত মোকাবেলায় আমরা কতটা শক্তিশালী হয়েছি_ স্বাধীনতার চার দশক পূর্তিতে বাংলাদেশি পরিবেশবাদীরা সে হিসাব করতে বসতেই পারেন।
skrokon@gmail.com
সন্দেহ নেই, চার দশক আগে বাংলার বসন্ত আরও মনোরম ছিল। তখনও আমাদের মাটি ও জল বিবিধ দূষণের শিকার হয়নি। ন্যাড়া হতে শুরু করেনি পাহাড় ও বনভূমি। নদীগুলোও ছিল সত্যিকারে স্রোতস্বিনী_ তখনও উজানের পরিকল্পিত পানি প্রত্যাহার, ভাটিতে অপরিকল্পিত স্থাপনা, নির্বিচার দখল দৈত্যকায় হয়ে ওঠেনি। একাত্তরের মার্চ-এপ্রিলে পাকবাহিনীর নিবির্চার হত্যাযজ্ঞ বাংলার প্রকৃতিতে অপ্রাকৃতিক আগ্রাসনের কালো থাবা বসিয়েছিল। পরবর্তী নয় মাসে গাঙ্গেয় বদ্বীপে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নানা সময়ে নানা হিসাব-নিকাশ হয়েছে। প্রকৃতির ক্ষতি এখনও অজানা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে '৭৩-৭৪ সালে দেশজুড়ে যে গণডায়রিয়া-কলেরা দেখা দিয়েছিল, তার কারণ যে দূষিত পানি, কে না জানে! কিন্তু সেই দূষণের দায় কার, কেউ কি ভেবেছে? পরবর্তী কয়েক বসন্তে পাখি আগের মতো ডেকেছে কি-না, কে তার খোঁজ রেখেছে?
বস্তুত, পাখির ডাক তখনও আমাদের দেশে কবিতার বিষয়। মানুষের জীবনে ও যাপনে টুনটুনির সাবলীল কণ্ঠস্বরের অবদান তখনও অস্বীকৃত। অথচ বসন্তে পাখির ডাক নিয়ে আমেরিকায় তোলপাড় হয়েছে তারও এক দশক আগে থেকে।
বৈশ্বিক পরিবেশ আন্দোলনের বাইবেল বলে পরিচিত 'সাইলেন্স স্প্রিং' ততদিনে নতুন আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে মলাটবন্দি হওয়ার আগে ওই বছর জুন থেকে 'দ্য নিউ ইয়র্কার'-এ সিরিজ প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ হচ্ছিল এটি। তারও আগে, ১৯৫৮ থেকে চার গবেষণার পর র্যাশেল লুইস কারসোন দেখালেন কৃষি ও শিল্পে ব্যবহৃত কীটনাশক কীভাবে পরিবেশ, বিশেষ করে পাখির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তার আশঙ্কা ছিল, প্রকৃতিতে বিষ প্রয়োগ চলতে থাকলে পরবর্তী কয়েক বছর পর আমেরিকায় এমন বসন্ত আসবে, যখন গান গাওয়ার মতো পাখি অবশিষ্ট থাকবে না। তার আশঙ্কা ইউরোপ-আমেরিকার অনেককে স্পর্শ করেছিল। পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল পরিবেশ বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা। যুদ্ধের গোলা-বারুদে পানি ও ভূমি দূষণের বিরুদ্ধেও একই সময় গড়ে উঠতে থাকে বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন উদ্যোগ। সার্বিক পরিবেশ সুরক্ষায় বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হতে থাকে। ১৯৭২ সালের জুনে 'মানব পরিবেশ' নিয়ে স্টকহোমে সম্মেলনের ডাক দেয় খোদ জাতিসংঘ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধি দল সেখানে যোগ দিয়েছিল।
সেই পরিবেশ আন্দোলন গত চার দশকে ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় গ্রিন মুভমেন্ট এখন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিও। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে আঘাত প্রকৃতির ওপর নেমে এসেছিল; প্রতিবাদের ভাষা তার চেয়েও শক্তিশালী হয়েছে। আমরা তখন না হয় বুঝতে পারিনি। কিন্তু গত চার দশকে প্রকৃতির ওপর আঘাত মোকাবেলায় আমরা কতটা শক্তিশালী হয়েছি_ স্বাধীনতার চার দশক পূর্তিতে বাংলাদেশি পরিবেশবাদীরা সে হিসাব করতে বসতেই পারেন।
skrokon@gmail.com
No comments