সময়চিত্র-র্যাব: বিতর্ক ও কুতর্ক by আসিফ নজরুল
র্যাবের পক্ষ নিয়ে লেখার জন্য আমাকে প্রচুর সমালোচনা শুনতে হয়েছিল বিএনপির আমলে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার লেখার নাম ছিল র্যাব: পক্ষ-বিপক্ষ। পক্ষের কথাগুলোতে যাঁরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তাঁরা বিপক্ষের কথাগুলো লক্ষ করেননি। তখনই আমার আবারও মনে হয়েছিল যে বাংলাদেশের বহু মানুষ যুক্তি বা তর্ক বোঝেন না। আবেগসর্বস্ব এ ধরনের লোকজন স্পর্শকাতর ইস্যুতে কোনো ভিন্নমত শুনতেই নারাজ।
এর কিছুদিন পর আইন ও সালিশ কেন্দ্র র্যাবের বিরুদ্ধে প্রচারণামূলক একটি বই বের করে। নানা সাক্ষাৎকার, লেখা ও পরিসংখ্যানসমৃদ্ধ সেই বইতে র্যাবের পক্ষে (এবং কিছুটা বিপক্ষেও) বক্তব্য ছিল একমাত্র আমার। র্যাব সম্পর্কে আমার বক্তব্য আজও পরিবর্তিত হয়নি। এমনকি র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনের ঘটনাবলির পরও আমি মনে করি, কিছুটা সংস্কার সাপেক্ষে বাংলাদেশে আরও অনেক বছর র্যাবের প্রয়োজন রয়েছে। যে দেশে কুখ্যাত সন্ত্রাসীরা সর্বোচ্চ আদালত থেকে একাধিকবার জামিন পায়, যে দেশে দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ফরেনসিক সাপোর্ট, তদন্ত, প্রসিকিউশন ও বিচারব্যবস্থা রয়েছে এবং এ কারণে অর্থবান অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণ প্রায় দুঃসাধ্য, সে দেশে র্যাবের কিছু উপযোগিতা অবশ্যই রয়েছে। বিএনপির আমলে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর মানুষের বিজয়োল্লাস এমনকি স্কুলে যেমন খুশি তেমন সাজো অনুষ্ঠানে র্যাব সাজার হিড়িকের মধ্য দিয়ে এর জনপ্রিয়তাও টের পাওয়া গেছে।
তখন র্যাবের বহু সমালোচনা করার পরও তাই আমরা বর্তমান সরকারকে র্যাব অব্যাহত রাখতে দেখি, অব্যাহত রাখতে দেখি ক্রসফায়ারকেও। জঙ্গি দমন, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার এবং ফেরারি অপরাধীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে র্যাবের সাফল্য এই সরকারের কাছে র্যাবকে বরং অতিপ্রিয় একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে বলে মনে হচ্ছে।
র্যাবের আসল বিপদ এখানেই। আগে বলেছি, এখনো বলি, ‘জনপ্রিয়’ ক্রসফায়ার করে র্যাবের কেউ যদি স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার পেয়ে গেছে বলে মনে করে থাকে, তাহলে র্যাবের পতন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এসব পুরোনো কথা আবারও বলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে লিমনের ঘটনার পর।
বিএনপির আমলে কিছু ক্রসফায়ারের ঘটনার জন্য র্যাব তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। তবে লিমনের ঘটনার পর দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে র্যাব যেভাবে সমালোচিত হচ্ছে, তা নজিরবিহীন। আমার মনে হয় না, র্যাব বা র্যাবের চালিকাশক্তি হিসেবে সরকার এটি উপলব্ধি করতে পারছে।
২.
র্যাবের ক্রসফায়ারের বিবরণ সত্যি কি মিথ্যে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ তেমন মাথা ঘামায় না সব সময়। কিন্তু সব ক্রসফায়ারের পর এমন ঘটনা ঘটে না। ক্রসফায়ারে আহত বা নিহত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা থানায় অভিযোগ নেই—এসব সংবাদ পত্রিকায় এলে বহু মানুষ বরং র্যার্যাবের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
লিমনের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। এই নিরীহদর্শন কিশোরের অশ্রুসজল মুখ, তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার হূদয়বিদারক বিবরণ, চাঁদা তুলে তার এলাকাবাসী কর্তৃক চিকিৎসার প্রাথমিক খরচ জোগানো—সবই যেকোনো হূদয়বান মানুষকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তাকে দেখতে গিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। স্বয়ং র্যাবের মহাপরিচালক লিমনের ঘটনা প্রচারিত হওয়ার পর সে খারাপ বা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নয় বলে যে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি লিমনকে ঘটনার শিকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এত কিছুর পর কয়েক দিন আগে র্যাব হঠাৎ করে লিমন ও তার পুরো পরিবার সন্ত্রাসী বলে যে অভিযোগ করেছে, তা বহু মানুষকে হকচকিত করেছে। র্যাবের এই বক্তব্য সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের মনে আসতে পারে। আমার নিজের মনে যেসব প্রশ্ন এসেছে, সেগুলোই আগে বলি।
প্রথমত, লিমন দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করত—এই তথ্য কী করে সে সন্ত্রাসী এটি প্রমাণ করে? আমারই পরিচিত কিছু দরিদ্র মানুষের একাধিক মোবাইল রয়েছে, আমার জানামতে সেকেন্ডহ্যান্ড পুরোনো মডেলের মোবাইল মাত্র তিন-চার শ টাকায় কেনা সম্ভব। লিমনের পরিবারে একাধিক উপার্জনকারী সদস্য রয়েছেন। এসব যেকোনো কারণেই তার কাছে দুটি মোবাইল থাকা সম্ভব এবং এই তথ্য কোনোভাবেই সে সন্ত্রাসী—এটি প্রমাণ করে না। পত্রিকায় দেখলাম, র্র্যাব বলছে, তার পরিবারের কাছে রেজিস্ট্রেশনবিহীন ছয়-সাতটি মোবাইল রয়েছে। আমার প্রশ্ন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোবাইল তার পরিবারের সদস্যদেরই, এটি র্যাব বুঝল কীভাবে?
দ্বিতীয়ত, লিমনের সঙ্গে কুখ্যাত সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের টেলিফোনে কথা হয়েছে, এ ধরনের কললিস্ট র্যাবের কাছে রয়েছে বলা হচ্ছে। এটি যদি সত্যিও হয়, শুধু এ কারণেই কি লিমন অপরাধী হয়ে গেল? আমার মোবাইলে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত কিছু ব্যক্তির ফোন নম্বর রয়েছে। আমি কি তাতে শেয়ার মার্কেটের একজন অপরাধী হয়ে গেলাম? তার চেয়ে বড় কথা, এই কললিস্ট তো র্যাবের কাছে লিমনকে গুলি করার সময় ছিল না, এটি পরে তদন্তে পাওয়া গেছে বলা হচ্ছে। লিমনকে তাহলে কেন গুলি করা হলো?
তৃতীয়ত, লিমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা প্রথমেই র্যাবের কাছে কোনো এনকাউন্টার বা দুই পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা শুনিনি। এত দিন পর হঠাৎ করে এসব বললে কেন মানুষ তা বিশ্বাস করবে? এনকাউন্টার হলে র্যাবের কেউ কেন গুলিবিদ্ধ হয়নি? লিমনের হাত থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে—এ ধরনের কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ র্যাব প্রদান করতে পারেনি। লিমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিকে তার সঙ্গে সে সময়ে থাকা যে দুজন কিশোরের নাম বলেছে, তাদের র্যাব গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেনি। তার মানে কি এই নয় যে লিমন ও তার সঙ্গে থাকা দুজন অন্তত কোনো গোলাগুলি করেনি? লিমনকে তাহলে কেন গুলি করা হলো?
র্যাবকে বুঝতে হবে, সরকার বা র্যাবের তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মানুষের মনে এমনিতেই প্রশ্ন থাকে। র্যাব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের আরও কিছু লোক তদন্ত রিপোর্ট বের হওয়ার আগেই লিমনকে দোষারোপ করেছে, পুলিশ লিমনের মায়ের অভিযোগ গ্রহণে গড়িমসি দেখিয়েছে, তদন্তকালে লিমনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের এলাকায় আনা হয়েছে। এসব তথ্য মানুষ আগেই জেনেছে। এরপর প্রশ্নবিদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্যসহ র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে প্রচারিত তথ্য মানুষকে বরং আরও সন্দিহান করে তুলতে পারে।
৩.
র্যাবের সদস্যরা এই সমাজের মানুষ। র্র্যাব সব ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে শাস্তি প্রদান করলেই র্যাবে থাকা অপরাধীদের কালিমা র্যাব নামক প্রতিষ্ঠানটিকে স্পর্শ করবে না। লিমনের ক্ষেত্রে ইনফরমারের ভুল তথ্য, অপারেশনে থাকা র্যাব সদস্যের অপরিমিতিবোধ বা অন্য কোনো কারণে ঘটনাচক্রে লিমন গুলিবিদ্ধ হতে পারে। নিরস্ত্র লিমনকে ভুল করে গ্রেপ্তার করা হলে এ নিয়ে এত বিতর্ক হতো না। লিমনকে গুলি করা হয়েছে এবং সে চিরতরে পা হারিয়েছে। লিমন যদি র্যাবের ভাষায়, সাধারণ সন্ত্রাসীও হয়ে থাকে, লিমনের কারণে জীবন বিপন্ন না হলে তাকে র্যাব গুলি করতে পারে না। লিমনকে গুলি করে র্যাব সমালোচিত হয়েছে। র্যাব আরও বিতর্কিত হয়েছে পঙ্গু লিমনকে প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে এবং এর মাধ্যমে তাদের কার্যক্রমকে যুক্তিসংগত প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে।
র্যাবের পাশাপাশি লিমনের ঘটনায় সঠিক ভূমিকা রাখতে এ দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির আমলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এরা সরেজমিনে তদন্ত করে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ আমলে এ ধরনের কাজে তাদের উৎসাহে রাতারাতি ভাটা পড়ল কেন? তারা সরেজমিনে একটি নাগরিক তদন্ত সম্পন্ন করে রাখলে তা অন্তত লিমনের বাড়তি দুর্ভোগ কমাতে সাহায্য করতে পারত।
এ ক্ষেত্রে বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নিজেও। তিনি কান্নাভেজা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, আইনি লড়াইয়ে লিমনের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে লিমনের সংবাদটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিরোনাম করে তুলেছেন। তাঁর প্রাথমিক দৃঢ়তায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে লিমনের পরিবার র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো সাহস দেখিয়েছে। তিনি কি সত্যিই আছেন এখন বিপন্ন এই পরিবারটির পাশে? কী ধরনের আইনি সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষমতাই বা আছে কমিশনের? কমিশনের আইনি ক্ষমতা তদন্ত করার মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ। এত বড় একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত কেন কমিশন করছে না তাহলে? কমিশনের লোকবল না থাকলে তিনি নিজেই কেন আদালতে বিষয়টি যাওয়ার আগেই প্রাথমিক একটি তদন্তকাজ করলেন না? আমরা মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের চৌকস কথা বলার সামর্থ্য সম্পর্কে জেনেছি, কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনায় সরকারকে জবাবদিহিতে বাধ্য করার মতো কাজ কমিশন করতে পারে কি না, তার কোনো লক্ষণ আজও দেখতে পাইনি।
৪.
সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার কিছু মন্তব্য নিয়ে দু-একটি প্রশ্ন তুলছি। তিনি এত দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় কীভাবে তদন্তাধীন ও বিচারাধীন একটি বিষয় সম্পর্কে মন্তব্য করেন? কী করে তিনি দায়িত্বপূর্ণ সাংবাদিকতা করার কারণে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের বিরুদ্ধে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলেন? এ ধরনের অভিযোগ যে দুটি পত্রিকায় অনবরত করা হচ্ছে, সরকারের নিযুক্ত প্রেস কাউন্সিল ইতিমধ্যে তা সম্পূর্ণ অসাড় ও ভিত্তিহীন বলে রায় দিয়েছেন। কেন তাঁর কাছে প্রেস কাউন্সিলের রায়ের চেয়ে সে পত্রিকাগুলোর সূত্রহীন ঢালাও অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো? উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া অবিশ্বাস্য কোনো অভিযোগ তাঁর মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তি যখন করেন, তখন র্যাবের পক্ষে বলা তাঁর অন্যান্য বক্তব্যও অনেকাংশে অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে।
৫.
লিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে বিচারাধীন। আমরা আশা করব, এই মামলাটি যে গতিতে এবং যে প্রক্রিয়ায় চলমান থাকবে, লিমনকে গুলিবিদ্ধ করার জন্য দায়ী র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধেও একইভাবে মামলা চলতে থাকবে।
লিমনের ঘটনায় র্যাব ইতিমধ্যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে। আমরা আশা করব, এ বিষয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি কোনো পক্ষ থেকে যেন না করা হয়। আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে লিমনকে বরং সর্বোচ্চ সহযোগিতা ও সহমর্মিতা যেন প্রদর্শন করা হয়।
লিমন বাংলাদেশের কিশোর, আমাদেরই সন্তান বা ভাই। আমাদের বুঝতে হবে, রাষ্ট্রের কাঠিন্য এই অশ্রুসজল ছেলেটির প্রতিপক্ষ হতে পারে না!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তখন র্যাবের বহু সমালোচনা করার পরও তাই আমরা বর্তমান সরকারকে র্যাব অব্যাহত রাখতে দেখি, অব্যাহত রাখতে দেখি ক্রসফায়ারকেও। জঙ্গি দমন, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার এবং ফেরারি অপরাধীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে র্যাবের সাফল্য এই সরকারের কাছে র্যাবকে বরং অতিপ্রিয় একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে বলে মনে হচ্ছে।
র্যাবের আসল বিপদ এখানেই। আগে বলেছি, এখনো বলি, ‘জনপ্রিয়’ ক্রসফায়ার করে র্যাবের কেউ যদি স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার পেয়ে গেছে বলে মনে করে থাকে, তাহলে র্যাবের পতন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এসব পুরোনো কথা আবারও বলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে লিমনের ঘটনার পর।
বিএনপির আমলে কিছু ক্রসফায়ারের ঘটনার জন্য র্যাব তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। তবে লিমনের ঘটনার পর দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে র্যাব যেভাবে সমালোচিত হচ্ছে, তা নজিরবিহীন। আমার মনে হয় না, র্যাব বা র্যাবের চালিকাশক্তি হিসেবে সরকার এটি উপলব্ধি করতে পারছে।
২.
র্যাবের ক্রসফায়ারের বিবরণ সত্যি কি মিথ্যে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ তেমন মাথা ঘামায় না সব সময়। কিন্তু সব ক্রসফায়ারের পর এমন ঘটনা ঘটে না। ক্রসফায়ারে আহত বা নিহত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা থানায় অভিযোগ নেই—এসব সংবাদ পত্রিকায় এলে বহু মানুষ বরং র্যার্যাবের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
লিমনের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। এই নিরীহদর্শন কিশোরের অশ্রুসজল মুখ, তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার হূদয়বিদারক বিবরণ, চাঁদা তুলে তার এলাকাবাসী কর্তৃক চিকিৎসার প্রাথমিক খরচ জোগানো—সবই যেকোনো হূদয়বান মানুষকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তাকে দেখতে গিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। স্বয়ং র্যাবের মহাপরিচালক লিমনের ঘটনা প্রচারিত হওয়ার পর সে খারাপ বা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নয় বলে যে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি লিমনকে ঘটনার শিকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এত কিছুর পর কয়েক দিন আগে র্যাব হঠাৎ করে লিমন ও তার পুরো পরিবার সন্ত্রাসী বলে যে অভিযোগ করেছে, তা বহু মানুষকে হকচকিত করেছে। র্যাবের এই বক্তব্য সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের মনে আসতে পারে। আমার নিজের মনে যেসব প্রশ্ন এসেছে, সেগুলোই আগে বলি।
প্রথমত, লিমন দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করত—এই তথ্য কী করে সে সন্ত্রাসী এটি প্রমাণ করে? আমারই পরিচিত কিছু দরিদ্র মানুষের একাধিক মোবাইল রয়েছে, আমার জানামতে সেকেন্ডহ্যান্ড পুরোনো মডেলের মোবাইল মাত্র তিন-চার শ টাকায় কেনা সম্ভব। লিমনের পরিবারে একাধিক উপার্জনকারী সদস্য রয়েছেন। এসব যেকোনো কারণেই তার কাছে দুটি মোবাইল থাকা সম্ভব এবং এই তথ্য কোনোভাবেই সে সন্ত্রাসী—এটি প্রমাণ করে না। পত্রিকায় দেখলাম, র্র্যাব বলছে, তার পরিবারের কাছে রেজিস্ট্রেশনবিহীন ছয়-সাতটি মোবাইল রয়েছে। আমার প্রশ্ন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোবাইল তার পরিবারের সদস্যদেরই, এটি র্যাব বুঝল কীভাবে?
দ্বিতীয়ত, লিমনের সঙ্গে কুখ্যাত সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারের টেলিফোনে কথা হয়েছে, এ ধরনের কললিস্ট র্যাবের কাছে রয়েছে বলা হচ্ছে। এটি যদি সত্যিও হয়, শুধু এ কারণেই কি লিমন অপরাধী হয়ে গেল? আমার মোবাইলে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত কিছু ব্যক্তির ফোন নম্বর রয়েছে। আমি কি তাতে শেয়ার মার্কেটের একজন অপরাধী হয়ে গেলাম? তার চেয়ে বড় কথা, এই কললিস্ট তো র্যাবের কাছে লিমনকে গুলি করার সময় ছিল না, এটি পরে তদন্তে পাওয়া গেছে বলা হচ্ছে। লিমনকে তাহলে কেন গুলি করা হলো?
তৃতীয়ত, লিমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা প্রথমেই র্যাবের কাছে কোনো এনকাউন্টার বা দুই পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা শুনিনি। এত দিন পর হঠাৎ করে এসব বললে কেন মানুষ তা বিশ্বাস করবে? এনকাউন্টার হলে র্যাবের কেউ কেন গুলিবিদ্ধ হয়নি? লিমনের হাত থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে—এ ধরনের কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ র্যাব প্রদান করতে পারেনি। লিমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিকে তার সঙ্গে সে সময়ে থাকা যে দুজন কিশোরের নাম বলেছে, তাদের র্যাব গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেনি। তার মানে কি এই নয় যে লিমন ও তার সঙ্গে থাকা দুজন অন্তত কোনো গোলাগুলি করেনি? লিমনকে তাহলে কেন গুলি করা হলো?
র্যাবকে বুঝতে হবে, সরকার বা র্যাবের তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মানুষের মনে এমনিতেই প্রশ্ন থাকে। র্যাব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের আরও কিছু লোক তদন্ত রিপোর্ট বের হওয়ার আগেই লিমনকে দোষারোপ করেছে, পুলিশ লিমনের মায়ের অভিযোগ গ্রহণে গড়িমসি দেখিয়েছে, তদন্তকালে লিমনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের এলাকায় আনা হয়েছে। এসব তথ্য মানুষ আগেই জেনেছে। এরপর প্রশ্নবিদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্যসহ র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে প্রচারিত তথ্য মানুষকে বরং আরও সন্দিহান করে তুলতে পারে।
৩.
র্যাবের সদস্যরা এই সমাজের মানুষ। র্র্যাব সব ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে শাস্তি প্রদান করলেই র্যাবে থাকা অপরাধীদের কালিমা র্যাব নামক প্রতিষ্ঠানটিকে স্পর্শ করবে না। লিমনের ক্ষেত্রে ইনফরমারের ভুল তথ্য, অপারেশনে থাকা র্যাব সদস্যের অপরিমিতিবোধ বা অন্য কোনো কারণে ঘটনাচক্রে লিমন গুলিবিদ্ধ হতে পারে। নিরস্ত্র লিমনকে ভুল করে গ্রেপ্তার করা হলে এ নিয়ে এত বিতর্ক হতো না। লিমনকে গুলি করা হয়েছে এবং সে চিরতরে পা হারিয়েছে। লিমন যদি র্যাবের ভাষায়, সাধারণ সন্ত্রাসীও হয়ে থাকে, লিমনের কারণে জীবন বিপন্ন না হলে তাকে র্যাব গুলি করতে পারে না। লিমনকে গুলি করে র্যাব সমালোচিত হয়েছে। র্যাব আরও বিতর্কিত হয়েছে পঙ্গু লিমনকে প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে এবং এর মাধ্যমে তাদের কার্যক্রমকে যুক্তিসংগত প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে।
র্যাবের পাশাপাশি লিমনের ঘটনায় সঠিক ভূমিকা রাখতে এ দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির আমলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এরা সরেজমিনে তদন্ত করে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ আমলে এ ধরনের কাজে তাদের উৎসাহে রাতারাতি ভাটা পড়ল কেন? তারা সরেজমিনে একটি নাগরিক তদন্ত সম্পন্ন করে রাখলে তা অন্তত লিমনের বাড়তি দুর্ভোগ কমাতে সাহায্য করতে পারত।
এ ক্ষেত্রে বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নিজেও। তিনি কান্নাভেজা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, আইনি লড়াইয়ে লিমনের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে লিমনের সংবাদটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিরোনাম করে তুলেছেন। তাঁর প্রাথমিক দৃঢ়তায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে লিমনের পরিবার র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো সাহস দেখিয়েছে। তিনি কি সত্যিই আছেন এখন বিপন্ন এই পরিবারটির পাশে? কী ধরনের আইনি সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষমতাই বা আছে কমিশনের? কমিশনের আইনি ক্ষমতা তদন্ত করার মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ। এত বড় একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত কেন কমিশন করছে না তাহলে? কমিশনের লোকবল না থাকলে তিনি নিজেই কেন আদালতে বিষয়টি যাওয়ার আগেই প্রাথমিক একটি তদন্তকাজ করলেন না? আমরা মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের চৌকস কথা বলার সামর্থ্য সম্পর্কে জেনেছি, কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনায় সরকারকে জবাবদিহিতে বাধ্য করার মতো কাজ কমিশন করতে পারে কি না, তার কোনো লক্ষণ আজও দেখতে পাইনি।
৪.
সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার কিছু মন্তব্য নিয়ে দু-একটি প্রশ্ন তুলছি। তিনি এত দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় কীভাবে তদন্তাধীন ও বিচারাধীন একটি বিষয় সম্পর্কে মন্তব্য করেন? কী করে তিনি দায়িত্বপূর্ণ সাংবাদিকতা করার কারণে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের বিরুদ্ধে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলেন? এ ধরনের অভিযোগ যে দুটি পত্রিকায় অনবরত করা হচ্ছে, সরকারের নিযুক্ত প্রেস কাউন্সিল ইতিমধ্যে তা সম্পূর্ণ অসাড় ও ভিত্তিহীন বলে রায় দিয়েছেন। কেন তাঁর কাছে প্রেস কাউন্সিলের রায়ের চেয়ে সে পত্রিকাগুলোর সূত্রহীন ঢালাও অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো? উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া অবিশ্বাস্য কোনো অভিযোগ তাঁর মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তি যখন করেন, তখন র্যাবের পক্ষে বলা তাঁর অন্যান্য বক্তব্যও অনেকাংশে অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে।
৫.
লিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে বিচারাধীন। আমরা আশা করব, এই মামলাটি যে গতিতে এবং যে প্রক্রিয়ায় চলমান থাকবে, লিমনকে গুলিবিদ্ধ করার জন্য দায়ী র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধেও একইভাবে মামলা চলতে থাকবে।
লিমনের ঘটনায় র্যাব ইতিমধ্যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে। আমরা আশা করব, এ বিষয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি কোনো পক্ষ থেকে যেন না করা হয়। আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে লিমনকে বরং সর্বোচ্চ সহযোগিতা ও সহমর্মিতা যেন প্রদর্শন করা হয়।
লিমন বাংলাদেশের কিশোর, আমাদেরই সন্তান বা ভাই। আমাদের বুঝতে হবে, রাষ্ট্রের কাঠিন্য এই অশ্রুসজল ছেলেটির প্রতিপক্ষ হতে পারে না!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments