স্বাধীনতার ৪০ বছর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি by শহিদুল ইসলাম
এক. পাকিস্তানের ভাবাদর্শ দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতি একটি প্রবল শক্তিধর অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। সে লড়াইটা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই। কিন্তু সে লড়াইয়ের পেছনে প্রচ্ছন্ন ছিল স্বাধীনতা। পরবর্তী রাজনৈতিক সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে এই সত্যটাই সুপ্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, ১৯৬৬ সালের শেখ মুজিবের ৬ দফা ও ১৯৬৯ সালের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার মাধ্যমে এ সত্যটা ক্রমে প্রকাশিত হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির পেছনে সত্যটা ছিল- পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনে স্বায়ত্তশাসন নয়। স্বাধীনতার সে প্রচ্ছন্ন দাবি বাংলাদেশের মানুষের কণ্ঠে প্রথম স্লোগানে রূপান্তরিত হয় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। স্বাধীনতার জন্য সেদিন এ দেশের মানুষ নিজের জীবনকেও তুচ্ছ মনে করেছিল। পাকিস্তানি নিপীড়নের কোনো অস্ত্রই সেদিন মানুষকে রাজপথ থেকে সরাতে পারেনি। সারা দেশে মানুষ স্বাধীনতার জন্য হেলায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে দেয় এ দেশের মানুষ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। এরপর শুরু হয় স্বাধীনতার শেষ দৃশ্যের অভিনয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় জাতীয় সংসদের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পুরো মার্চ মাসটাই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক সরকারি কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ে। মানুষ প্রতিদিন সকালে উঠেই রেডিওতে শেখ মুজিবের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করত এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করত। শেখ মুজিব বললেন, 'ব্যাংক বন্ধ থাকবে।' ব্যাংক বন্ধ থাকল। এতে মানুষের অসুবিধা লক্ষ করে মুজিব বললেন, 'বেলা ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ব্যাংকে লেনদেন চলবে।' সে মতোই ব্যাংক চলেছিল। ১ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পর দেশের সব কর্তৃত্ব হারায় পাকিস্তান সরকার। দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব শেখ মুজিবের করতলগত হয়। সে অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার ২৫ মার্চ গভীর রাতে কাপুরুষের মতো ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। শুরু হয় পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হওয়ার শেষ পর্ব। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি খুনি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে এ দেশের মাটিতে পাকিস্তানের কবর রচনা হয়। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয়। এ ইতিহাস আজ আর কারো অজানা নয়। তারপর পার হয়ে গেছে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক। পার হয়েছে চারটি দশক অর্থাৎ ৪০টি বছর। তাই আজ মানুষ হিসাব করে স্বাধীনতার পর এই ৪০টি বছর তারা কী পেয়েছে আর কী পায়নি। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও ১৯৬৯-এর ১১ দফার কয়টি অর্জিত হয়েছে আর কয়টি হয়নি। সেসব দফা যদি এখানে উল্লেখ করা যেত তাহলে পাঠক বুঝতে পারতেন যে দেশবাসীর ঘরে স্বাধীনতার ফসল কতটা উঠেছে- আর কতটা ওঠেনি।
দুই. পাওয়া না পাওয়ার এই হিসাব মেলানোর সময় একটা সত্য, বৃহত্তম পাওয়ারটার কথা প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। তা হচ্ছে 'স্বাধীনতা'। ১৮৫৩ সালে মার্কস লিখেছিলেন 'স্বাধীনতা' অর্জন ছাড়া ভারতবর্ষ তার উন্নয়নের ফসল ঘরে তুলতে পারবে না। কথাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য। পাকিস্তান যতই উন্নতি করবে, পূর্ব পাকিস্তান ততই বেশি বৈষম্যের শিকার হবে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ পাচারের হার ততই দ্রুততর হবে। পাকিস্তানের শেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি সেই সত্যটিই নির্দেশ করে। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্তই ছিল 'স্বাধীনতা'। স্বাধীনতা না পেলে অন্য কিছুই অর্জিত হতো না। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলার রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের গর্জন। ফাইনালে মাত্র দু'রানে হারলেও রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা পাকিস্তানের ঘাম ঝরিয়ে দিয়েছে। সমগ্র বিশ্ব আজ বাংলাদেশের জয়গানে উচ্ছ্বসিত। এই উদাহরণটি সারা দেশের মানুষের কাছে যতটা চক্ষু উন্মোচনকারী উদাহরণ হবে, এই মুহূর্তে অন্য কোনো উদাহরণ তেমনটি হবে না। কেননা স্বাধীনতা না এলে, বাংলাদেশ যদি আজও পাকিস্তানের উপনিবেশই থাকত, তাহলে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে সাকিব-মাশরাফি-তামিমদের জায়গা হতো না। গত ৪০ বছরে আমরা অনেক কিছুই পাইনি, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই, তবুও যেটুকু পেয়েছি নানা প্রতিকূলতার প্রাচীর ধ্বংস করে এটুকুও পাওয়া যেত না স্বাধীনতা না এলে। আজ বিশ্বের ক্রিকেট বোদ্ধারা স্বীকার করছেন, 'ক্রিকেট বিশ্বে নতুন বিস্ময় বাংলাদেশ।' আজ পাকিস্তানিদের মুখে বাংলাদেশের প্রশান্তি। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে একটা প্রশ্ন, পাকিস্তান আমলে এ রকম প্রশান্তি শোনা যায়নি কেন? বরং শোনা যেত পাঁচ ফুট লম্বা বাঙালিরা ক্রিকেট, ফুটবল কিছুই খেলতে পারে না। ছোটখাটো সাকিব আজ বিশ্বের প্রধান অলরাউন্ডার। স্বাধীনতার পর খেলাধুলার জগতে বাংলাদেশের উত্থানটাই সর্বাগ্রগণ্য। খেলাধুলায় সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে। সব মানুষের চোখে পড়ছে।
তিন. পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। সত্যিকার অর্থেই সংস্কৃতি সেদিন পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে একটি ধারাল অস্ত্রে পরিণত হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। একুশ তাদের সে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়। বাংলা অক্ষরের পরিবর্তে আরবি হরফ প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান সরকার। এ দেশের মানুষ আরো জোরে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করে। সংস্কৃতি যে কত বড় হাতিয়ার, সেদিন বাঙালিরা তা প্রমাণ করেছিল। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিবিরুদ্ধ সব ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রাচীর ভেঙে পড়ে। মানুষ আশান্বিত হয়- এবার বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা আর রুদ্ধ করা যাবে না। স্বাধীনতার পরপরই তার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংস্কৃতির যে হাতিয়ার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেন এ দেশের সরকারি কর্মীরা। কিন্তু জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে আমাদের সংস্কৃতি ও তৎসংশ্লিষ্ট সব একটি সম্পদশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বহু আগেই সেখানে ভাটির টান লক্ষ করা গেছে। দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের জীবনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সে সংস্কৃতি এক ছোট্ট জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে জনগণ মার খেয়েছে। সংস্কৃতি আজ দেশের মাত্র ১ শতাংশ শাসক শ্রেণীর শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এভাবে শাসক শ্রেণী এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যক্তিকরণের মাধ্যমে শিক্ষাকে একটি মহামূল্যবান সামগ্রী করে তুলেছে, যা কেনার সামর্থ্য নেই এ দেশের ৯০-৯৫ শতাংশ মানুষের। তাই বেগতিক অসহায় মানুষ উপায়ন্তর না পেয়ে পশ্চাদপদ কিংবা পুরনো শিক্ষা গিলতে বাধ্য হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেছে। ৩৩টি পাবলিক ও ৫৯টি ব্যক্তি মালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে শিক্ষা নামক বস্তুটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকটিতে খোলাখুলিভাবে সনদপত্র বিক্রির অভিযোগ তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের চরম ব্যর্থতা, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে। রাজনীতিবিদদের রাজনীতির মান পড়ে গেছে।
চার. তবে এ দেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কতম অধ্যায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসনের পুনঃপ্রবর্তন। এই জঘন্যতম ঘটনা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং ১৫ বছরের সামরিক শাসন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে সব দিক থেকেই রুদ্ধ করে রাখে। ১৯৭২ সালের সংবিধানসম্মত একটি গণতান্ত্রিক, ইহজাগতিক (সেক্যুলার) রাষ্ট্রকে ক্রমান্বয়ে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে দুজন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক ব্যক্তি। ফলে একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয় মুছে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি পাকিস্তানি গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল, তারা সামরিক শাসনের আশ্রয়ে মাথা তুলতে সাহস পায় এবং নানাভাবে এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নতুন করে আক্রমণ শুরু করতে সাহসী হয়ে ওঠে। অগণতান্ত্রিক শাসন এ দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করে এবং রাজনীতিতে নতুন করে পাকিস্তানি যুগের প্রবর্তন করে। ছাত্র সমাজের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করা হয়। এরই ফল ভোগ করছি আমরা আজও।
পাঁচ. ১৯৯০ সালে আর এক গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। আবার সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসে। কিন্তু এ 'গণতন্ত্র' সামরিক শাসনের ১৫ বছরের ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। রাজনীতিকে করে তোলে অগণতান্ত্রিক এক দলবাজির 'গণতন্ত্র।' তবুও এরই মধ্যে 'ইনডেমনিটি' আইন অপসারণ করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করার সুযোগের সৃষ্টি করা হয় এবং সুষ্ঠুভাবে সে বিচার সম্পন্ন হয়ে রায় বাস্তবায়িত হয়। তার পরেও বোধ হয় বলা যায় যে এ দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হলো রাজনীতি। রাজনীতি ক্রমান্বয়ে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে 'এক গণতান্ত্রিক' মুখোশ পরেছে। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন কাউন্সিলের যারা সদস্যরা আজ ক্ষমতাহারা। গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে নির্বাচিত তৃণমূল নেতৃত্বের কোনো ক্ষমতা নেই, যা গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত। গণতন্ত্রও আজ রাজধানীর ইট-সুরকির মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েছে। গ্রামগঞ্জের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা রাজধানীর বিলাসবহুল বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করেন- দামি দামি গাড়িতে চড়তে ভালোবাসেন। রাজধানীর গণ্ডির মধ্যে রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার পেছনে আছে দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রীভূত অবস্থা। রাজধানীতে শক্তি-কেন্দ্রে রাজনীতি আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রাজধানী কেন্দ্রিক। আর্থিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক- সব কিছু রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে মানুষ আজ রাজধানীমুখী। গ্রামগঞ্জ থেকে বেকার মানুষ দুবেলা এক মুঠো ভাতের সন্ধানে প্রতিদিন রাজধানীর বস্তিগুলো ভরে তুলছে।
ছয়. স্বাধীনতা দেশের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির মুক্তিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা সবার জন্য শিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা আজ সম্পদশালীর দখলে চলে গেছে। স্বাধীনতা যে সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা ঢাকার কতিপয় গোষ্ঠীবদ্ধ সাংস্কৃতিক উদ্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা যে গণমুখী প্রশাসনিক ও আমলাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা আজও ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের গণবিরোধী দেয়ালের মধ্যেই রয়ে গেছে। রাজনীতি আজ একটি বিশাল লাভজনক পণ্য। তাই রাজনীতি আজ সবচেয়ে বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। জনস্বার্থবিরোধী অর্থনীতি এভাবে রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। কলুষিত করেছে শিক্ষা সংস্কৃতিকে- এমনকি মাতৃভাষা বাংলাকেও, যে ভাষার অস্ত্র দিয়ে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছিল। তাই এ কথা বললে ভুল বলা হবে না যে সব দোষের কেন্দ্র হলো কতিপয়ের হাতে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠা। সেই অবৈধ সম্পদ একটি গোলাপকে পণ্যে পরিণত করেছে একটি সংগীতকে পণ্যে পরিণত করেছে- প্রেম-ভালোবাসাও সে অবৈধ সম্পদের ছোবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। যে ফুলকে বাঁচাবে বলে এ দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিল, অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল, সেই ফুলটি আজ পুঁজির বাজারে বিকোচ্ছে প্রগতিশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাজাকার, যার সম্পদ আছে সেই-ই সেই ফুলটা কিনতে পারে। কে তাকে বাধা দেবে?
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
দুই. পাওয়া না পাওয়ার এই হিসাব মেলানোর সময় একটা সত্য, বৃহত্তম পাওয়ারটার কথা প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। তা হচ্ছে 'স্বাধীনতা'। ১৮৫৩ সালে মার্কস লিখেছিলেন 'স্বাধীনতা' অর্জন ছাড়া ভারতবর্ষ তার উন্নয়নের ফসল ঘরে তুলতে পারবে না। কথাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য। পাকিস্তান যতই উন্নতি করবে, পূর্ব পাকিস্তান ততই বেশি বৈষম্যের শিকার হবে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ পাচারের হার ততই দ্রুততর হবে। পাকিস্তানের শেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি সেই সত্যটিই নির্দেশ করে। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান শর্তই ছিল 'স্বাধীনতা'। স্বাধীনতা না পেলে অন্য কিছুই অর্জিত হতো না। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলার রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের গর্জন। ফাইনালে মাত্র দু'রানে হারলেও রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা পাকিস্তানের ঘাম ঝরিয়ে দিয়েছে। সমগ্র বিশ্ব আজ বাংলাদেশের জয়গানে উচ্ছ্বসিত। এই উদাহরণটি সারা দেশের মানুষের কাছে যতটা চক্ষু উন্মোচনকারী উদাহরণ হবে, এই মুহূর্তে অন্য কোনো উদাহরণ তেমনটি হবে না। কেননা স্বাধীনতা না এলে, বাংলাদেশ যদি আজও পাকিস্তানের উপনিবেশই থাকত, তাহলে পাকিস্তান ক্রিকেট দলে সাকিব-মাশরাফি-তামিমদের জায়গা হতো না। গত ৪০ বছরে আমরা অনেক কিছুই পাইনি, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই, তবুও যেটুকু পেয়েছি নানা প্রতিকূলতার প্রাচীর ধ্বংস করে এটুকুও পাওয়া যেত না স্বাধীনতা না এলে। আজ বিশ্বের ক্রিকেট বোদ্ধারা স্বীকার করছেন, 'ক্রিকেট বিশ্বে নতুন বিস্ময় বাংলাদেশ।' আজ পাকিস্তানিদের মুখে বাংলাদেশের প্রশান্তি। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে একটা প্রশ্ন, পাকিস্তান আমলে এ রকম প্রশান্তি শোনা যায়নি কেন? বরং শোনা যেত পাঁচ ফুট লম্বা বাঙালিরা ক্রিকেট, ফুটবল কিছুই খেলতে পারে না। ছোটখাটো সাকিব আজ বিশ্বের প্রধান অলরাউন্ডার। স্বাধীনতার পর খেলাধুলার জগতে বাংলাদেশের উত্থানটাই সর্বাগ্রগণ্য। খেলাধুলায় সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে। সব মানুষের চোখে পড়ছে।
তিন. পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। সত্যিকার অর্থেই সংস্কৃতি সেদিন পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে একটি ধারাল অস্ত্রে পরিণত হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। একুশ তাদের সে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়। বাংলা অক্ষরের পরিবর্তে আরবি হরফ প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান সরকার। এ দেশের মানুষ আরো জোরে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করে। সংস্কৃতি যে কত বড় হাতিয়ার, সেদিন বাঙালিরা তা প্রমাণ করেছিল। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিবিরুদ্ধ সব ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রাচীর ভেঙে পড়ে। মানুষ আশান্বিত হয়- এবার বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা আর রুদ্ধ করা যাবে না। স্বাধীনতার পরপরই তার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংস্কৃতির যে হাতিয়ার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেন এ দেশের সরকারি কর্মীরা। কিন্তু জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে আমাদের সংস্কৃতি ও তৎসংশ্লিষ্ট সব একটি সম্পদশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বহু আগেই সেখানে ভাটির টান লক্ষ করা গেছে। দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের জীবনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সে সংস্কৃতি এক ছোট্ট জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে জনগণ মার খেয়েছে। সংস্কৃতি আজ দেশের মাত্র ১ শতাংশ শাসক শ্রেণীর শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এভাবে শাসক শ্রেণী এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যক্তিকরণের মাধ্যমে শিক্ষাকে একটি মহামূল্যবান সামগ্রী করে তুলেছে, যা কেনার সামর্থ্য নেই এ দেশের ৯০-৯৫ শতাংশ মানুষের। তাই বেগতিক অসহায় মানুষ উপায়ন্তর না পেয়ে পশ্চাদপদ কিংবা পুরনো শিক্ষা গিলতে বাধ্য হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেছে। ৩৩টি পাবলিক ও ৫৯টি ব্যক্তি মালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে শিক্ষা নামক বস্তুটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকটিতে খোলাখুলিভাবে সনদপত্র বিক্রির অভিযোগ তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের চরম ব্যর্থতা, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে। রাজনীতিবিদদের রাজনীতির মান পড়ে গেছে।
চার. তবে এ দেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কতম অধ্যায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসনের পুনঃপ্রবর্তন। এই জঘন্যতম ঘটনা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং ১৫ বছরের সামরিক শাসন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে সব দিক থেকেই রুদ্ধ করে রাখে। ১৯৭২ সালের সংবিধানসম্মত একটি গণতান্ত্রিক, ইহজাগতিক (সেক্যুলার) রাষ্ট্রকে ক্রমান্বয়ে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে দুজন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক ব্যক্তি। ফলে একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয় মুছে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি পাকিস্তানি গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল, তারা সামরিক শাসনের আশ্রয়ে মাথা তুলতে সাহস পায় এবং নানাভাবে এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নতুন করে আক্রমণ শুরু করতে সাহসী হয়ে ওঠে। অগণতান্ত্রিক শাসন এ দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করে এবং রাজনীতিতে নতুন করে পাকিস্তানি যুগের প্রবর্তন করে। ছাত্র সমাজের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস করা হয়। এরই ফল ভোগ করছি আমরা আজও।
পাঁচ. ১৯৯০ সালে আর এক গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। আবার সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসে। কিন্তু এ 'গণতন্ত্র' সামরিক শাসনের ১৫ বছরের ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। রাজনীতিকে করে তোলে অগণতান্ত্রিক এক দলবাজির 'গণতন্ত্র।' তবুও এরই মধ্যে 'ইনডেমনিটি' আইন অপসারণ করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করার সুযোগের সৃষ্টি করা হয় এবং সুষ্ঠুভাবে সে বিচার সম্পন্ন হয়ে রায় বাস্তবায়িত হয়। তার পরেও বোধ হয় বলা যায় যে এ দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হলো রাজনীতি। রাজনীতি ক্রমান্বয়ে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে 'এক গণতান্ত্রিক' মুখোশ পরেছে। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন কাউন্সিলের যারা সদস্যরা আজ ক্ষমতাহারা। গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে নির্বাচিত তৃণমূল নেতৃত্বের কোনো ক্ষমতা নেই, যা গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত। গণতন্ত্রও আজ রাজধানীর ইট-সুরকির মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েছে। গ্রামগঞ্জের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা রাজধানীর বিলাসবহুল বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করেন- দামি দামি গাড়িতে চড়তে ভালোবাসেন। রাজধানীর গণ্ডির মধ্যে রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার পেছনে আছে দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রীভূত অবস্থা। রাজধানীতে শক্তি-কেন্দ্রে রাজনীতি আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রাজধানী কেন্দ্রিক। আর্থিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক- সব কিছু রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে মানুষ আজ রাজধানীমুখী। গ্রামগঞ্জ থেকে বেকার মানুষ দুবেলা এক মুঠো ভাতের সন্ধানে প্রতিদিন রাজধানীর বস্তিগুলো ভরে তুলছে।
ছয়. স্বাধীনতা দেশের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির মুক্তিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা সবার জন্য শিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা আজ সম্পদশালীর দখলে চলে গেছে। স্বাধীনতা যে সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা ঢাকার কতিপয় গোষ্ঠীবদ্ধ সাংস্কৃতিক উদ্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা যে গণমুখী প্রশাসনিক ও আমলাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা আজও ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের গণবিরোধী দেয়ালের মধ্যেই রয়ে গেছে। রাজনীতি আজ একটি বিশাল লাভজনক পণ্য। তাই রাজনীতি আজ সবচেয়ে বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। জনস্বার্থবিরোধী অর্থনীতি এভাবে রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। কলুষিত করেছে শিক্ষা সংস্কৃতিকে- এমনকি মাতৃভাষা বাংলাকেও, যে ভাষার অস্ত্র দিয়ে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছিল। তাই এ কথা বললে ভুল বলা হবে না যে সব দোষের কেন্দ্র হলো কতিপয়ের হাতে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠা। সেই অবৈধ সম্পদ একটি গোলাপকে পণ্যে পরিণত করেছে একটি সংগীতকে পণ্যে পরিণত করেছে- প্রেম-ভালোবাসাও সে অবৈধ সম্পদের ছোবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। যে ফুলকে বাঁচাবে বলে এ দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিল, অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল, সেই ফুলটি আজ পুঁজির বাজারে বিকোচ্ছে প্রগতিশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাজাকার, যার সম্পদ আছে সেই-ই সেই ফুলটা কিনতে পারে। কে তাকে বাধা দেবে?
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments