নির্মম নারকীয়তা by রফিকুল ইসলাম
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেতনার উন্মেষ কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' বা 'বাঙালি এথনিক ক্লিনজিং' শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। ওইদিন সকালবেলা একটি সামরিক হেলিকপ্টারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর
জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং মেজর জেনারেল ওমর রংপুর, রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট গিয়ে 'অপারেশন প্ল্যান' পাকিস্তানি কমান্ডারদের দিয়ে আসেন। ঢাকায় প্রধান টার্গেট ছিল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হাউস [পুরনো গণভবন] ত্যাগ করে যান বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে। তিনি গোপনে বিমানযোগে কলম্বো হয়ে করাচি যাত্রা করেন। এটাই ছিল তার শেষ ঢাকা সফর। 'অপারেশন সার্চলাইট' সম্পর্কে পাকিস্তানি পরিকল্পনার কথা জানা যায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে ইস্টার্ন কমান্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক লিখিত 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থ থেকে। আমরা তার গ্রন্থ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করছি_ 'মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ২৫ মার্চ রাজনৈতিক আলোচনার ফলাফল জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। সকাল প্রায় ১১টার সময় তার সবুজ টেলিফোন বেজে উঠল। লে. জেনারেল টিক্কা খান লাইনে ছিলেন। তিনি বললেন, 'খাদিম এটা আজ রাতে।' এ খবর খাদিমের মনে কোনো উন্মাদনার সৃষ্টি করল না, তিনি হাতুড়ির আঘাত পড়ার অপেক্ষায় ছিলেন। খাদিম তার অধীনস্থ মহলে আদেশটি বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিলেন। খবর যতই নিচের দিকে যাচ্ছিল, ততই উত্তেজনা বাড়ছিল। আমি দেখলাম, কয়েকজন জুনিয়র অফিসার কয়েকটি অতিরিক্ত রিকয়েললেস রাইফেল [ট্যাঙ্কবিধ্বংসী] ও অতিরিক্ত গোলাবারুদ সংগ্রহ এবং একটি ত্রুটিপূর্ণ মর্টার বদলানোর চেষ্টা করছে। কয়েকদিন আগে রংপুর থেকে আনা ২৯ নং ক্যাভালরির ৬টি এম-২৪ ট্যাঙ্কে রাতে ব্যবহারের জন্য জ্বালানি বোঝাই করা হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় ভীতি প্রদর্শনের জন্য ওই ট্যাঙ্কগুলো যথেষ্ট। ১৪শ' ডিভিশনের সদর দফতর থেকে ঢাকার বাইরে অবস্থিত সব গ্যারিসনে আক্রমণের সময় বা 'এইচ আওয়ার'-এর কথা জানিয়ে দেওয়া হয় একটি গোপন সংকেতের মাধ্যমে, যাতে সব গ্যারিসন একসঙ্গে অভিযান শুরু করতে পারে। 'এইচ আওয়ার' নির্ধারিত হয়েছিল ২৬০১০০ ঘণ্টা অর্থাৎ রাত ১টা, ২৬ মার্চ।
২৫ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর 'অপারেশন সার্চলাইট' বা 'জেনোসাইড বাংলাদেশ' অভিযান পরিকল্পনার যতটুকু সিদ্দিক সালিকের 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থে 'আইএসআই' বা পাকিস্তান 'ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্স'-এর দ্বারা অনুমোদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পিলখানা ইপিআর সদর দফতর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের পাকিস্তানি পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে মোটামুটি
একটা ধারণা পাওয়া যায়। পাকিস্তানি জেনোসাইড, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে 'ম্যাসাকার' নিয়ে বিশ্বের প্রচারমাধ্যমে যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা অবমোচনের জন্যই সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত তথ্যে ভরপুর মেজর সিদ্দিক সালিকের 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়েছিল। এই গ্রন্থ ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যা বা বাঙালি নিধনযজ্ঞের সাফাই গাওয়ার প্রয়াস। কিন্তু এই গ্রন্থের অর্ধসত্য বিবরণীতেও পাকিস্তানি অভিযানের ব্যাপকতা, নৃশংসতা এবং বর্বরতা গোপন থাকেনি। সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে বলেছেন, '৭১-এর ২৫ মার্চ রাতের অভিযানের ফলাফল পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার দেওয়া বিবরণী সংক্ষেপে বাংলায় উদ্ধৃত করছি :
ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পাকবাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা বিশাল গাছ বাহিনীর গতিরোধ করে। রাস্তার পাশের এলাকা পুরনো গাড়ি এবং স্টিমরোলার দিয়ে বন্ধ করা ছিল। ব্যারিকেডের শহরের দিক থেকে কয়েকশ' আওয়ামী লীগার 'জয় বাংলা' স্লোগান দিচ্ছিল। আমি জেনারেল টিক্কা খানের সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই উচ্চকিত স্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে রাইফেলের কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনলাম। একটু পর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গর্জন বাতাসে ভেসে এলো। তারপর গোলাবর্ষণ এবং স্লোগানের মিশ্র শব্দ শোনা গেল। মাঝে মাঝে এলএমজির গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ১৫ মিনিট পর শব্দ কমে এলো এবং স্লোগান মিলিয়ে গেল। সেনাবাহিনী শহরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অস্ত্রের জয় হলো। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অভিযান শুরু হয়ে যায়। এখন আর 'এইচ আওয়ার'-এর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। কারণ ইতিমধ্যেই নরকের দরজা খুলে গেছে।... মুজিব যখন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত আদমজী স্কুলে বন্দি অবস্থায়, তখন ঢাকা মহানগরী গৃহযুদ্ধের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। আমি টিক্কা খানের সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চার ঘণ্টা যাবত সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছি। সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল_ গোলাবর্ষণের ফলে আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা, একেক সময় আগুনের হল্কা এবং ধোঁয়া তারার দিকে সম্প্রসারিত আকাশের মেঘকে গ্রাস করে ফেলছিল।
২৬ মার্চ সকালে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান শেষ হওয়ার খবর জানায়। জেনারেল টিক্কা খান ভোর পাঁচটায় তার সোফা ছেড়ে অফিসে ঢোকেন এবং কিছুক্ষণ পর চশমা সাফ করতে করতে বেরিয়ে আসেন। সমগ্র অঞ্চল পর্যবেক্ষণের পর তিনি বলেন, 'না কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই।' বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি ওই কথা শুনতে পাই এবং চারদিকে তাকিয়ে আমি কেবল একটি নেড়ি কুত্তাকে লেজ গুটিয়ে শহরের দিকে চলে যেতে দেখি। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগে সেনাবাহিনী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল [বর্তমান রূপসী বাংলা] থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেল। প্লেনে ওঠার আগে তিনি গত রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তার 'এসকর্ট' ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বলেন, 'আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান বেঁচে গেছে।' করাচি বিমানবন্দরে পেঁৗছে তিনি তার ওই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। জুলফিকার আলি ভুট্টো যখন ওই মন্তব্য করেছিলেন, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলো জরিপ করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইকবাল হলে ২টি এবং জগন্নাথ হলে ৪টি রকেটের আঘাত লাগে, ঘরগুলো জ্বলে গেলেও অটুট ছিল, কয়েক ডজন আধপোড়া রাইফেল এবং কিছু কাগজপত্র তখনও জ্বলছিল। ক্ষতির পরিমাণ ছিল ভয়াবহ; কিন্তু জেনারেল টিক্কার সদর দফতরের বারান্দা থেকে যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছিলাম, ঠিক ততটা নয়। বিদেশি পত্রপত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হাজার খানেক লোককে হত্যর কথা লেখা হলেও অফিসাররা সেই সংখ্যা একশ'র কাছাকাছি নির্ধারণ করেছিল, তবে স্বীকার করা হয়েছিল ৪০ জনকে হত্যা করার কথা।
মেজর সিদ্দিক সালিকের সত্য, অর্ধসত্য ও অসত্যমিশ্রিত ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের উপর্যুক্ত বিবরণী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আগ্রাসনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তার সঙ্গে ২৫ থেকে ২৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রভৃতি এলাকা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালিদের বিবরণী মিলিয়ে দেখলে মেজর সিদ্দিক সালিকের প্রচারণার ফাঁকফোকর ও সাফাই ধরা পড়ে। প্রথমেই বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেন কর্তৃক টেপে ধারণকৃত অ্যাকশনরত পাকিস্তানি বাহিনীর ইউনিটগুলোর ওয়্যারলেস সংলাপ [দৈনিক বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২] :
"রেডিও খুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলাম। ৯০ মিটারে পেয়ে গেলাম যা খুঁজছিলাম। হানাদার বাহিনীর দলগুলোর একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা। ইতিমধ্যে রেডিওতে শুনেছি পাক কমান্ডারের গলা। জানাচ্ছে, 'দি বিগ ফিশ হ্যাজ বিন কট'।"
কার কথা বলেছে, তা বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। কিন্তু মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে, বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়েছেন। হঠাৎ কানে এলো আবার কন্ট্রোলের গলা_ 'দেয়ার ইজ নো কোশ্চেন অব টেকিং প্রিজনার। দে আর শুটিং অ্যাট ইউ, সো ওয়াইপ দেম অব।'
ধীরস্থির গলায় হুকুম দিচ্ছিল কমান্ডার_ এতটুকু উত্তেজনা ছিল না কণ্ঠস্বরে। পরে জেনেছিলাম, ওই গলা ছিল ব্রিগেডিয়ার আরবাব খানের। ওই গলায় তিনি আনন্দে বিভিন্ন টার্গেট দখলের খবর দিচ্ছিলেন। সবাইকে জানাচ্ছিলেন যে, দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই রাতেই ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে শহীদ মিনারের নিচের ঘরে। ওদের কথায় চার ছাত্র লুকিয়ে ছিল, তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে। একজন পালিয়ে গেছে। ... দেখলাম ভাঙা কাচ, দেয়ালে রক্ত। শনিবার রাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবশেষে শহীদ মিনার ধ্বংস করেছিল পাক বর্বররা। ২৫ মার্চের সেই কালরাত্র যখন শেষ হয়ে আসছিল, হুকুম এলো কন্ট্রোলের_ যেখানে যত মৃতদেহ আছে সব সরিয়ে ফেলতে হবে দিন শুরু হওয়ার আগে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। মৃতদেহ সরাতে ব্যবহার করা হয়েছিল 'বাঙালিদের'। যে হতভাগ্যদের ব্যবহার করা হয়েছিল ওই কাজে, শেষে তাদেরও হত্যা করেছিল ওই নরপশুরা। মৃতদেহের হিসাব রেখেছিল ২৬নং ইউনিট।
কন্ট্রোল জিজ্ঞেস করেছিল, ২৬নং ইউনিটকে রাজারবাগ পুলিশের মৃতদেহের সংখ্যা। উত্তর এসেছিল_ গোনা শেষ হয়নি। ২৬ মার্চ সারাদিন রেখে দেওয়া হয়েছে। রেডিওতে শুনেছি, কমান্ডার গিয়ে দেখবেন, ছাত্রনেতা কেউ আছেন কি-না সেটা দেখার পরই সরানো হবে। তা-ই হয়েছিল। ২৭ মার্চ সকালে দেখেছিলাম ইকবাল হলের পেছনের পুকুরপাড়ে সারি দিয়ে রাখা দশটি মৃতদেহ। ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখানোর জন্য ওখানে রাখা হয়েছিল কিছু মৃতদেহ। যাতে বাঙালিরা ভয় পায়, নতি স্বীকার করে। দেখেছিলাম জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে দেওয়া গণকবর। মাসখানেক পরে যখন দু-একজন বিদেশি সাংবাদিককে আসার অনুমতি দিয়েছিল পাক সরকার, তখন এক রাতে সেই গলিত দেহের অবশিষ্ট তুলে নিয়ে যায় পাকসেনারা।
বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেনের ধারণকৃত পাকিস্তানি বাহিনীর ওই ওয়্যারলেস সংলাপের চাইতেও তাৎপর্যপূর্ণ 'জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬ মার্চের সকালে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখেছি, আমার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় ধরে রেখেছি' শিরোনামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ডে মুদ্রিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের তদানীন্তন অধ্যাপক ড. নূরুলউল্লার বিশেষ সাক্ষাৎকারটি :
আপনি কি ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের ছবি নিজ হাতে তুলেছিলেন?
হ্যাঁ, ২৬ মার্চের সকালে জগন্নাথ হলের মাঠে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য ঘটেছিল, আমি তার ছবি আমার বাসার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় তুলেছিলাম।
ক্যামেরাটি কি আপনার নিজস্ব?
না, ওটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ভিডিও টেপ ক্যামেরা।
আপনি যে ক্যামেরা বসিয়েছিলেন, তা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল না?
এমনভাবে ক্যামেরা বসানো হয়েছিল যে, বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই।
ক্যামেরা চালু করেন কখন?
সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যবর্তী সময়ে। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম, জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে বাইরে আনা হচ্ছে এবং তাদের লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে। তখনই আমার সন্দেহ জাগে এবং আমি ক্যামেরা অন করি। আমাদের ক্যামেরাটির একটি বিশেষ গুণ এই যে, এতে মাইক্রোফোন দিয়ে একই সঙ্গে শব্দ তুলে রাখা যায়। তাই আমি টেপের সঙ্গে মাইক্রোফোন সংযোগ করে ক্যামেরা চালু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, ছেলেগুলোকে একধারছে গুলি করা হচ্ছে এবং একজন করে পড়ে যাচ্ছে। আবার কিছু সংখ্যক লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। ... আবার লাইন করে দাঁড় করানো হচ্ছে। আমি তখন আগের তোলা টেপটা মুছে ফেলে তার ওপর আবার ছবি তোলা শুরু করলাম। দ্বিতীয়বার লাইনে দেখলাম একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক রয়েছে। সে বসে পড়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছে। আমার মনে হচ্ছিল, সে তার দাড়ি দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল যে, সে মুসলমান। কিন্তু বর্বর পাকবাহিনী তার কোনো কথাই শুনতে চায়নি। তাকে গুলি করে মারা হলো। মাঠের অপরদিকে অর্থাৎ পূর্ব পাশে পাকবাহিনী একটা তাঁবু বানিয়ে ছাউনি করেছিল। সেখানে দেখছিলাম, ওরা চেয়ারে বসে বেশ কয়েকজন চা খাচ্ছে আর হাসি-তামাশা ও আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ছে। লোকগুলোকে হলের ভেতর থেকে কীভাবে আনা হচ্ছিল? যাদের আমার চোখের সামনে করা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে, তাদের দিয়ে প্রথমে হলের ভেতর থেকে মৃতদেহ বের করে আনা হচ্ছিল। মৃতদেহগুলো এনে সব এক জায়গায় জমা করা হচ্ছিল এবং এদের দিয়ে লেবারের কাজ করানোর পর আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হয়েছে, একটা করে পড়ে যাচ্ছে।
প্রফেসর নূরুলউল্লার ধারণকৃত জগন্নাথ হল গণহত্যার প্রামাণ্য তথ্যচিত্রটি স্বাধীনতার পর দেশে-বিদেশে বহুবার প্রদর্শিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের 'অপারেশন সার্চ লাইট' বা 'জেনোসাইড ঢাকা ইউনিভার্সিটি'র একমাত্র প্রামাণ্য দলিল, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও বর্বরতার পরিচয় উদ্ঘাটিতহয়।
এরপর দৈনিক আজাদ পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত 'স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম দুর্গ ইকবাল হল' প্রবন্ধ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ উদ্ধৃত করছি :
রাতে হানাদাররা হলের প্রতিটি ঘরে তালা ভেঙে লুটে নিয়ে গেছে, আর যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে নির্মমভাবে। এর ফাঁকে ফাঁকে দু-একজন বেঁচে গেছে নানা কৌশলে। ২৬ মার্চ ভোরে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়ছে, সেখানেই দেখা গেছে লাশ আর লাশ। স্বদেশের সোনার ছেলেদের গুলি খাওয়া লাশ।
জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় তিনটি [২৩, ২৪ ও ২৫নং] আবাসনে পাকিস্তানি সৈন্যরা সিঁড়িতে, ছাদে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক, আশ্রয়গ্রহণকারী বস্তিবাসী, প্রেসিডেন্ট হাউসে (পুরনো গণভবন) প্রহরারত নিরস্ত্রীকৃত ইপিআর জওয়ান, যারা ২৩নং বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের হত্যা করে। শিক্ষকদের বাড়ি ঘরে ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শিক্ষকদের হত্যা করবে, এমন ধারণা ছিল কল্পনারও অতীত। তাই জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার শিক্ষকরা কেউ ২৫ মার্চ রাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাননি।
নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় বসবাসরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। জহুরুল হক সংলগ্ন শিক্ষক-কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আর পুরনো রেল লাইনের ওপর গড়ে ওঠা বস্তি এলাকায় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চ সর্বাত্মক সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে যে গণহত্যা, অগি্নসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুণ্ঠন চালায় তা শুধু চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, চরম যুদ্ধাপরাধও বটে।
বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়_ কলাভবন সংলগ্ন শিখ গুরুদুয়ারা, শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত শিব মন্দির আর রমনা রেসকোর্স মাঠের দুটি পুরনো কালী মন্দির। স্মরণীয় যে, ২৬ মার্চ সকালে পাক সেনারা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড মোড়ের মসজিদে ফজরের নামাজের আজান দানরত মুয়াজ্জিনকে এবং গুরুদুয়ারা, শিব মন্দির ও কালী মন্দিরে ঢুকে পুরোহিতদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে সামরিক অভিযানে সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে। জগন্নাথ হলের সাবেক প্রভোস্ট ড. অজয় রায় এবং ড. রঙ্গলাল সেনের উদ্যোগে ড. রতন লাল চক্রবর্তী সংকলিত-সম্পাদিত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা : ১৯৭১ জগন্নাথ হল' গ্রন্থে অপারেশন সার্চলাইটে জগন্নাথ হলে কী ঘটেছিল, তার বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃতি :
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বিশেষভাবে জগন্নাথ হল ও তৎসনি্নহিত এলাকায় কী ঘটেছিল, তা একটু আলোচনা প্রয়োজন .... রাত বারোটার সময় ইউওটিসির দিকের দেয়াল ভেঙে পাক বাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে জগন্নাথ হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। এর পর জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে শুরু হয় নারকীয় কাণ্ড। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে। এমনকি টয়লেটে, বাথরুমে ও ছাদে রক্ষিত জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে যেখানেই পাওয়া যায় লোকের সন্ধান, সেখানে চলে নির্বিচারে গুলি ও হত্যা। পশ্চিমদিকের টিনশেড অর্থাৎ পশ্চিম ভবন, ক্যান্টিন ও ক্যান্টিন সংলগ্ন ছাত্রাবাসে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা পালিয়ে ছিল, কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসতেই তাদের ওপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ক্রমেই আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাসভবন। পাক বাহিনী মেরে ফেলে গোবিন্দ দেবকে এবং তার পালিত কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার, যেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান পুত্র ও আত্মীয়সহ নিহত হন। মারাত্মকভাবে আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাক মিলিটারি মধুসূদন দের [মধুদা] বাসা আক্রমণ করে হত্যা করে তার পুত্র, সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, স্ত্রী যোগমায়াকে, যিনি ছিলেন দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুলিতে মধুদাও মারাত্মকভাবে আহত হন। শিক্ষকদের মধ্যে প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহীদ হন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিৎবল্লী ও জনৈক রাজকুমারী দেবী তথ্য প্রকাশ করেন যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের লাশের পাশের সজনে গাছের নিচে খুব স্বল্প পরিসর গর্তে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন। জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তিন জন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪ জন ২৬ মার্চ শহীদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা-অজানা অনেক লোক। এদের খুব কম অংশই আমরা জানি। সবার পরিচিত মধুদা [মধুসূদন দে] জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন। মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ। দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে ও তার পুত্র মতিলাল দে পিতা-পুত্র পাশপাশি দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্যবিহীন। তখনকার উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি তিন বছরের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মানবাধিকার কমিশনের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সপরিবারে জেনেভা যান। জেনেভার একটি
পত্রিকায় ঢাকায় দু'জন ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে তিনি '৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন :
তোমরা নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম। [স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙ্গালী, আবদুল মতিন, রেডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন, লন্ডন, এপ্রিল, ১৯৮৯]। ১৯৭১ সালের ২৫ থেকে ২৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীলক্ষেত, ফুলার রোড, ঈশা খাঁ রোড, জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার, ঢাকা হল ও ফজলুল হক হল এলাকার আবাসিক এলাকাগুলো পরিত্যক্ত, ভুতুড়ে ও জনমানবহীন বিরানভূমিতে পরিণত হয়। ১৯২১ সাল থেকে গড়ে ওঠা রমনার মনোরম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার বা রক্তাক্ত করেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ক্যাম্পাস থেকে সব মানুষকে উচ্ছেদ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আকাশে তখন শুধু চিল, শকুন আর মাটিতে মাংস-লোলুপ কুকুর আর বিহারি-রাজাকারদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। হ
২৫ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর 'অপারেশন সার্চলাইট' বা 'জেনোসাইড বাংলাদেশ' অভিযান পরিকল্পনার যতটুকু সিদ্দিক সালিকের 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থে 'আইএসআই' বা পাকিস্তান 'ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্স'-এর দ্বারা অনুমোদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পিলখানা ইপিআর সদর দফতর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের পাকিস্তানি পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে মোটামুটি
একটা ধারণা পাওয়া যায়। পাকিস্তানি জেনোসাইড, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে 'ম্যাসাকার' নিয়ে বিশ্বের প্রচারমাধ্যমে যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা অবমোচনের জন্যই সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত তথ্যে ভরপুর মেজর সিদ্দিক সালিকের 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়েছিল। এই গ্রন্থ ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যা বা বাঙালি নিধনযজ্ঞের সাফাই গাওয়ার প্রয়াস। কিন্তু এই গ্রন্থের অর্ধসত্য বিবরণীতেও পাকিস্তানি অভিযানের ব্যাপকতা, নৃশংসতা এবং বর্বরতা গোপন থাকেনি। সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে বলেছেন, '৭১-এর ২৫ মার্চ রাতের অভিযানের ফলাফল পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার দেওয়া বিবরণী সংক্ষেপে বাংলায় উদ্ধৃত করছি :
ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পাকবাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা বিশাল গাছ বাহিনীর গতিরোধ করে। রাস্তার পাশের এলাকা পুরনো গাড়ি এবং স্টিমরোলার দিয়ে বন্ধ করা ছিল। ব্যারিকেডের শহরের দিক থেকে কয়েকশ' আওয়ামী লীগার 'জয় বাংলা' স্লোগান দিচ্ছিল। আমি জেনারেল টিক্কা খানের সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই উচ্চকিত স্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে রাইফেলের কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনলাম। একটু পর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গর্জন বাতাসে ভেসে এলো। তারপর গোলাবর্ষণ এবং স্লোগানের মিশ্র শব্দ শোনা গেল। মাঝে মাঝে এলএমজির গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ১৫ মিনিট পর শব্দ কমে এলো এবং স্লোগান মিলিয়ে গেল। সেনাবাহিনী শহরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অস্ত্রের জয় হলো। সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অভিযান শুরু হয়ে যায়। এখন আর 'এইচ আওয়ার'-এর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। কারণ ইতিমধ্যেই নরকের দরজা খুলে গেছে।... মুজিব যখন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত আদমজী স্কুলে বন্দি অবস্থায়, তখন ঢাকা মহানগরী গৃহযুদ্ধের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। আমি টিক্কা খানের সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চার ঘণ্টা যাবত সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছি। সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল_ গোলাবর্ষণের ফলে আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা, একেক সময় আগুনের হল্কা এবং ধোঁয়া তারার দিকে সম্প্রসারিত আকাশের মেঘকে গ্রাস করে ফেলছিল।
২৬ মার্চ সকালে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান শেষ হওয়ার খবর জানায়। জেনারেল টিক্কা খান ভোর পাঁচটায় তার সোফা ছেড়ে অফিসে ঢোকেন এবং কিছুক্ষণ পর চশমা সাফ করতে করতে বেরিয়ে আসেন। সমগ্র অঞ্চল পর্যবেক্ষণের পর তিনি বলেন, 'না কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই।' বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি ওই কথা শুনতে পাই এবং চারদিকে তাকিয়ে আমি কেবল একটি নেড়ি কুত্তাকে লেজ গুটিয়ে শহরের দিকে চলে যেতে দেখি। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগে সেনাবাহিনী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল [বর্তমান রূপসী বাংলা] থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেল। প্লেনে ওঠার আগে তিনি গত রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তার 'এসকর্ট' ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বলেন, 'আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান বেঁচে গেছে।' করাচি বিমানবন্দরে পেঁৗছে তিনি তার ওই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। জুলফিকার আলি ভুট্টো যখন ওই মন্তব্য করেছিলেন, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলো জরিপ করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইকবাল হলে ২টি এবং জগন্নাথ হলে ৪টি রকেটের আঘাত লাগে, ঘরগুলো জ্বলে গেলেও অটুট ছিল, কয়েক ডজন আধপোড়া রাইফেল এবং কিছু কাগজপত্র তখনও জ্বলছিল। ক্ষতির পরিমাণ ছিল ভয়াবহ; কিন্তু জেনারেল টিক্কার সদর দফতরের বারান্দা থেকে যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছিলাম, ঠিক ততটা নয়। বিদেশি পত্রপত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হাজার খানেক লোককে হত্যর কথা লেখা হলেও অফিসাররা সেই সংখ্যা একশ'র কাছাকাছি নির্ধারণ করেছিল, তবে স্বীকার করা হয়েছিল ৪০ জনকে হত্যা করার কথা।
মেজর সিদ্দিক সালিকের সত্য, অর্ধসত্য ও অসত্যমিশ্রিত ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের উপর্যুক্ত বিবরণী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আগ্রাসনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তার সঙ্গে ২৫ থেকে ২৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্রভৃতি এলাকা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালিদের বিবরণী মিলিয়ে দেখলে মেজর সিদ্দিক সালিকের প্রচারণার ফাঁকফোকর ও সাফাই ধরা পড়ে। প্রথমেই বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেন কর্তৃক টেপে ধারণকৃত অ্যাকশনরত পাকিস্তানি বাহিনীর ইউনিটগুলোর ওয়্যারলেস সংলাপ [দৈনিক বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২] :
"রেডিও খুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলাম। ৯০ মিটারে পেয়ে গেলাম যা খুঁজছিলাম। হানাদার বাহিনীর দলগুলোর একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা। ইতিমধ্যে রেডিওতে শুনেছি পাক কমান্ডারের গলা। জানাচ্ছে, 'দি বিগ ফিশ হ্যাজ বিন কট'।"
কার কথা বলেছে, তা বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। কিন্তু মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে, বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়েছেন। হঠাৎ কানে এলো আবার কন্ট্রোলের গলা_ 'দেয়ার ইজ নো কোশ্চেন অব টেকিং প্রিজনার। দে আর শুটিং অ্যাট ইউ, সো ওয়াইপ দেম অব।'
ধীরস্থির গলায় হুকুম দিচ্ছিল কমান্ডার_ এতটুকু উত্তেজনা ছিল না কণ্ঠস্বরে। পরে জেনেছিলাম, ওই গলা ছিল ব্রিগেডিয়ার আরবাব খানের। ওই গলায় তিনি আনন্দে বিভিন্ন টার্গেট দখলের খবর দিচ্ছিলেন। সবাইকে জানাচ্ছিলেন যে, দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই রাতেই ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে শহীদ মিনারের নিচের ঘরে। ওদের কথায় চার ছাত্র লুকিয়ে ছিল, তিন জনকে হত্যা করা হয়েছে। একজন পালিয়ে গেছে। ... দেখলাম ভাঙা কাচ, দেয়ালে রক্ত। শনিবার রাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবশেষে শহীদ মিনার ধ্বংস করেছিল পাক বর্বররা। ২৫ মার্চের সেই কালরাত্র যখন শেষ হয়ে আসছিল, হুকুম এলো কন্ট্রোলের_ যেখানে যত মৃতদেহ আছে সব সরিয়ে ফেলতে হবে দিন শুরু হওয়ার আগে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। মৃতদেহ সরাতে ব্যবহার করা হয়েছিল 'বাঙালিদের'। যে হতভাগ্যদের ব্যবহার করা হয়েছিল ওই কাজে, শেষে তাদেরও হত্যা করেছিল ওই নরপশুরা। মৃতদেহের হিসাব রেখেছিল ২৬নং ইউনিট।
কন্ট্রোল জিজ্ঞেস করেছিল, ২৬নং ইউনিটকে রাজারবাগ পুলিশের মৃতদেহের সংখ্যা। উত্তর এসেছিল_ গোনা শেষ হয়নি। ২৬ মার্চ সারাদিন রেখে দেওয়া হয়েছে। রেডিওতে শুনেছি, কমান্ডার গিয়ে দেখবেন, ছাত্রনেতা কেউ আছেন কি-না সেটা দেখার পরই সরানো হবে। তা-ই হয়েছিল। ২৭ মার্চ সকালে দেখেছিলাম ইকবাল হলের পেছনের পুকুরপাড়ে সারি দিয়ে রাখা দশটি মৃতদেহ। ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখানোর জন্য ওখানে রাখা হয়েছিল কিছু মৃতদেহ। যাতে বাঙালিরা ভয় পায়, নতি স্বীকার করে। দেখেছিলাম জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে দেওয়া গণকবর। মাসখানেক পরে যখন দু-একজন বিদেশি সাংবাদিককে আসার অনুমতি দিয়েছিল পাক সরকার, তখন এক রাতে সেই গলিত দেহের অবশিষ্ট তুলে নিয়ে যায় পাকসেনারা।
বিজ্ঞানী ড. মোজাম্মেল হোসেনের ধারণকৃত পাকিস্তানি বাহিনীর ওই ওয়্যারলেস সংলাপের চাইতেও তাৎপর্যপূর্ণ 'জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬ মার্চের সকালে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখেছি, আমার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় ধরে রেখেছি' শিরোনামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ডে মুদ্রিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের তদানীন্তন অধ্যাপক ড. নূরুলউল্লার বিশেষ সাক্ষাৎকারটি :
আপনি কি ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের ছবি নিজ হাতে তুলেছিলেন?
হ্যাঁ, ২৬ মার্চের সকালে জগন্নাথ হলের মাঠে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য ঘটেছিল, আমি তার ছবি আমার বাসার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় তুলেছিলাম।
ক্যামেরাটি কি আপনার নিজস্ব?
না, ওটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ভিডিও টেপ ক্যামেরা।
আপনি যে ক্যামেরা বসিয়েছিলেন, তা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল না?
এমনভাবে ক্যামেরা বসানো হয়েছিল যে, বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই।
ক্যামেরা চালু করেন কখন?
সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যবর্তী সময়ে। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম, জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে বাইরে আনা হচ্ছে এবং তাদের লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে। তখনই আমার সন্দেহ জাগে এবং আমি ক্যামেরা অন করি। আমাদের ক্যামেরাটির একটি বিশেষ গুণ এই যে, এতে মাইক্রোফোন দিয়ে একই সঙ্গে শব্দ তুলে রাখা যায়। তাই আমি টেপের সঙ্গে মাইক্রোফোন সংযোগ করে ক্যামেরা চালু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, ছেলেগুলোকে একধারছে গুলি করা হচ্ছে এবং একজন করে পড়ে যাচ্ছে। আবার কিছু সংখ্যক লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। ... আবার লাইন করে দাঁড় করানো হচ্ছে। আমি তখন আগের তোলা টেপটা মুছে ফেলে তার ওপর আবার ছবি তোলা শুরু করলাম। দ্বিতীয়বার লাইনে দেখলাম একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক রয়েছে। সে বসে পড়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছে। আমার মনে হচ্ছিল, সে তার দাড়ি দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল যে, সে মুসলমান। কিন্তু বর্বর পাকবাহিনী তার কোনো কথাই শুনতে চায়নি। তাকে গুলি করে মারা হলো। মাঠের অপরদিকে অর্থাৎ পূর্ব পাশে পাকবাহিনী একটা তাঁবু বানিয়ে ছাউনি করেছিল। সেখানে দেখছিলাম, ওরা চেয়ারে বসে বেশ কয়েকজন চা খাচ্ছে আর হাসি-তামাশা ও আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ছে। লোকগুলোকে হলের ভেতর থেকে কীভাবে আনা হচ্ছিল? যাদের আমার চোখের সামনে করা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে, তাদের দিয়ে প্রথমে হলের ভেতর থেকে মৃতদেহ বের করে আনা হচ্ছিল। মৃতদেহগুলো এনে সব এক জায়গায় জমা করা হচ্ছিল এবং এদের দিয়ে লেবারের কাজ করানোর পর আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হয়েছে, একটা করে পড়ে যাচ্ছে।
প্রফেসর নূরুলউল্লার ধারণকৃত জগন্নাথ হল গণহত্যার প্রামাণ্য তথ্যচিত্রটি স্বাধীনতার পর দেশে-বিদেশে বহুবার প্রদর্শিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের 'অপারেশন সার্চ লাইট' বা 'জেনোসাইড ঢাকা ইউনিভার্সিটি'র একমাত্র প্রামাণ্য দলিল, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও বর্বরতার পরিচয় উদ্ঘাটিতহয়।
এরপর দৈনিক আজাদ পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত 'স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম দুর্গ ইকবাল হল' প্রবন্ধ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ উদ্ধৃত করছি :
রাতে হানাদাররা হলের প্রতিটি ঘরে তালা ভেঙে লুটে নিয়ে গেছে, আর যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে নির্মমভাবে। এর ফাঁকে ফাঁকে দু-একজন বেঁচে গেছে নানা কৌশলে। ২৬ মার্চ ভোরে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়ছে, সেখানেই দেখা গেছে লাশ আর লাশ। স্বদেশের সোনার ছেলেদের গুলি খাওয়া লাশ।
জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় তিনটি [২৩, ২৪ ও ২৫নং] আবাসনে পাকিস্তানি সৈন্যরা সিঁড়িতে, ছাদে এবং ঘরে ঘরে ঢুকে শিক্ষক, আশ্রয়গ্রহণকারী বস্তিবাসী, প্রেসিডেন্ট হাউসে (পুরনো গণভবন) প্রহরারত নিরস্ত্রীকৃত ইপিআর জওয়ান, যারা ২৩নং বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের হত্যা করে। শিক্ষকদের বাড়ি ঘরে ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শিক্ষকদের হত্যা করবে, এমন ধারণা ছিল কল্পনারও অতীত। তাই জহুরুল হক হল সংলগ্ন নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার শিক্ষকরা কেউ ২৫ মার্চ রাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাননি।
নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় বসবাসরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। জহুরুল হক সংলগ্ন শিক্ষক-কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আর পুরনো রেল লাইনের ওপর গড়ে ওঠা বস্তি এলাকায় পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চ সর্বাত্মক সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে যে গণহত্যা, অগি্নসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুণ্ঠন চালায় তা শুধু চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, চরম যুদ্ধাপরাধও বটে।
বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়_ কলাভবন সংলগ্ন শিখ গুরুদুয়ারা, শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত শিব মন্দির আর রমনা রেসকোর্স মাঠের দুটি পুরনো কালী মন্দির। স্মরণীয় যে, ২৬ মার্চ সকালে পাক সেনারা সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড মোড়ের মসজিদে ফজরের নামাজের আজান দানরত মুয়াজ্জিনকে এবং গুরুদুয়ারা, শিব মন্দির ও কালী মন্দিরে ঢুকে পুরোহিতদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে সামরিক অভিযানে সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে। জগন্নাথ হলের সাবেক প্রভোস্ট ড. অজয় রায় এবং ড. রঙ্গলাল সেনের উদ্যোগে ড. রতন লাল চক্রবর্তী সংকলিত-সম্পাদিত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা : ১৯৭১ জগন্নাথ হল' গ্রন্থে অপারেশন সার্চলাইটে জগন্নাথ হলে কী ঘটেছিল, তার বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃতি :
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বিশেষভাবে জগন্নাথ হল ও তৎসনি্নহিত এলাকায় কী ঘটেছিল, তা একটু আলোচনা প্রয়োজন .... রাত বারোটার সময় ইউওটিসির দিকের দেয়াল ভেঙে পাক বাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে জগন্নাথ হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। এর পর জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে শুরু হয় নারকীয় কাণ্ড। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে। এমনকি টয়লেটে, বাথরুমে ও ছাদে রক্ষিত জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে যেখানেই পাওয়া যায় লোকের সন্ধান, সেখানে চলে নির্বিচারে গুলি ও হত্যা। পশ্চিমদিকের টিনশেড অর্থাৎ পশ্চিম ভবন, ক্যান্টিন ও ক্যান্টিন সংলগ্ন ছাত্রাবাসে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা পালিয়ে ছিল, কিন্তু সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসতেই তাদের ওপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ক্রমেই আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাসভবন। পাক বাহিনী মেরে ফেলে গোবিন্দ দেবকে এবং তার পালিত কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে আক্রান্ত হয় জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার, যেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান পুত্র ও আত্মীয়সহ নিহত হন। মারাত্মকভাবে আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাক মিলিটারি মধুসূদন দের [মধুদা] বাসা আক্রমণ করে হত্যা করে তার পুত্র, সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ, স্ত্রী যোগমায়াকে, যিনি ছিলেন দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুলিতে মধুদাও মারাত্মকভাবে আহত হন। শিক্ষকদের মধ্যে প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহীদ হন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিৎবল্লী ও জনৈক রাজকুমারী দেবী তথ্য প্রকাশ করেন যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের লাশের পাশের সজনে গাছের নিচে খুব স্বল্প পরিসর গর্তে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন। জগন্নাথ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তিন জন, ছাত্র ৩৪ জন ও কর্মচারী ৪ জন ২৬ মার্চ শহীদ হন। কিন্তু এছাড়া ছিল জানা-অজানা অনেক লোক। এদের খুব কম অংশই আমরা জানি। সবার পরিচিত মধুদা [মধুসূদন দে] জগন্নাথ হলের মাটিতে মিশে আছেন। মিশে আছেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ। দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে ও তার পুত্র মতিলাল দে পিতা-পুত্র পাশপাশি দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্যবিহীন। তখনকার উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি তিন বছরের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মানবাধিকার কমিশনের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সপরিবারে জেনেভা যান। জেনেভার একটি
পত্রিকায় ঢাকায় দু'জন ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে তিনি '৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন :
তোমরা নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম। [স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙ্গালী, আবদুল মতিন, রেডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন, লন্ডন, এপ্রিল, ১৯৮৯]। ১৯৭১ সালের ২৫ থেকে ২৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীলক্ষেত, ফুলার রোড, ঈশা খাঁ রোড, জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার, ঢাকা হল ও ফজলুল হক হল এলাকার আবাসিক এলাকাগুলো পরিত্যক্ত, ভুতুড়ে ও জনমানবহীন বিরানভূমিতে পরিণত হয়। ১৯২১ সাল থেকে গড়ে ওঠা রমনার মনোরম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শুধু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার বা রক্তাক্ত করেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ক্যাম্পাস থেকে সব মানুষকে উচ্ছেদ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আকাশে তখন শুধু চিল, শকুন আর মাটিতে মাংস-লোলুপ কুকুর আর বিহারি-রাজাকারদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। হ
No comments