স্বাধীনতার চার দশক-নারী-পুরুষ সমতা: আজও সোনার হরিণ! by সালমা খান

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশকে যখন আমরা আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান করছি, তখন দেখতে হবে আমাদের সংগ্রামের মূল লক্ষ্য, একটি সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ও শ্রেণী-লিঙ্গ সামুদয়িক (inclusive) সামাজিক ব্যবস্থা স্থাপনে আমরা কতটা সফল হয়েছি। এই মূল্যায়নের একটি প্রধান সূচক লিঙ্গসমতা স্থাপনে আমাদের অবস্থান ও চ্যালেঞ্জ

মোকাবিলায় দায়বদ্ধতা পূরণ। কারণ, এ দেশে নারী জনসংখ্যার অর্ধেক এবং দরিদ্র শ্রেণীর তিন-চতুর্থাংশ। বাংলাদেশে লিঙ্গসমতা অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে আমাদের সংবিধানে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনে সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবে’ এবং ‘নারী-পুরুষভেদে... রাষ্ট্রবৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।’ লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। বিগত ৪০ বছরে নারীর জীবনে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিতকরণে এবং তা মোকাবিলার জন্য সরকার ও সুশীল সমাজের কী প্রচেষ্টা ছিল, তা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, আজ তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

২.
বিগত চার দশকে বাংলাদেশ নিজেকে বিশ্বদরবারে এক অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশ দেখিয়েছে, মাথাপিছু এত স্বল্প আয়ের বিপুল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত কিন্তু অতি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের একটি দেশ কীভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়! কীভাবে মানব উন্নয়ন সূচকে অধিকাংশ দক্ষিণ এশীয় দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়! আমাদের আরও অর্জন: পুরুষের তুলনায় নারীর গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, প্রজনন হার ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, নারীশিক্ষার অভাবনীয় অগ্রগতি এবং প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গসমতা অর্জন। আজ উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যা জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহ অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে। দুই দশক ধরে ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বমুখিতার মূল উৎস রপ্তানিমুখী মজুরি শ্রমবাজারে বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ—বিশেষ করে রপ্তানি পোশাক খাত মূলত নারীশ্রমনির্ভর। অভিবাসী নারীশ্রমিক আনুপাতিক হারে কম হলেও বিদেশে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠানোর হার পুরুষের তুলনায় নারীর ক্ষেত্রে প্রায় দ্বিগুণ। কৃষির সাফল্য আমাদের আর এক মাইলফলক। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের বিরাট ভূমিকা থাকলেও এখনো প্রস্তুতিপর্ব ও স্তরভিত্তিক কৃষিকার্য ব্যাপকভাবে নারীর কায়িকশ্রমনির্ভর। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশংসনীয় মানবিক উন্নয়ন সূচক, বৈদেশিক মুদ্রার আশাপ্রদ মজুত গড়ে তোলা ইত্যাদি সামাজিক রূপান্তরে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান করছে।

৩.
চার দশক ধরে নারীর উল্লেখযোগ্য অবদানের পরও নারী-পুরুষের সমতা অর্জন রয়ে গেছে এক সোনার হরিণ। পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও লিঙ্গসমতা স্থাপনে রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাব এর মূল কারণ। নারী তার তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের সোপান ধরে কর্মক্ষেত্রে বহুমুখিতা অর্জন এবং ন্যায্য দাবি আদায়ে কিছুটা তৎপর হতে পারলেও পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ‘মানুষ’ হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ আসন লাভে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু গৃহগণ্ডি থেকে বেরিয়ে বহিরাঙ্গনে মেয়েদের অধিক পদচারণা এবং শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলকভাবে নিজের অবস্থান সৃষ্টির প্রয়াসে প্রায়ই নারীকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। নারীর এই অভাবনীয় অবদানকে ঘিরে সুসংগঠিত নারী আন্দোলন বা সোশ্যাল মবিলাইজেশন দানা বেঁধে না ওঠায় নারী সমাজে তার অবস্থানগত পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার হতে পারেনি, পারেনি পরিবার ও সমাজের সঙ্গে নতুন শর্তে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে। উপরন্তু নারীর নবলব্ধ আত্মবিশ্বাস ও স্বনিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা তাকে প্রকাশ্য যৌন হয়রানি, ফতোয়া ও পারিবারিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত করেছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় তথ্যসূত্রে প্রকাশিত যে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের হার ক্রমবর্ধমান। ৪০ বছরে দেশের আর্থসামাজিক রূপান্তরে নারী দৃশ্যমান ভূমিকা রাখলেও উদারমনস্ক পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, আইনি সংস্কার, প্রশাসনিক সহায়ক নীতি ও কাঠামো হয়নি। বাস্তবতার নিরিখে মজুরি, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কাম্য হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিতে নারীর যৌনসত্তা ও জেন্ডার স্বরূপের পূর্ণ নিয়ন্ত্রক রয়ে গেছে পুরুষ। তাই বাংলাদেশে নারীর স্বাধীনতার চার দশক পেরোলেও নারীমুক্তি ঘটেনি।

৪.
আমাদের সংবিধান একটি নৈতিক ও প্রগতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার অঙ্গীকার বিবৃত করেছে। এ ছাড়া সরকার নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ নীতি প্রণয়ন, নারীর পশ্চাৎপদতা নিরসন করে সম-অংশীদারি প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু কোটাভিত্তিক বিধি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এগুলোর কাঠামোও বিদ্যমান। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগের মূল ফোকাস নির্দিষ্ট মেয়াদি প্রকল্পভিত্তিক হওয়ায় স্বল্পসংখ্যক নারী এর আওতাভুক্ত হয়েছে, বৃহত্তর নারীসমাজ রয়ে গেছে এসবের বাইরে।
এ সমস্যার মূল কারণ হলো, আমাদের উন্নয়ন দর্শন ও অগ্রাধিকার নির্ণয়ে কখনো নারীর প্রতি বৈষম্য-নিরসনকে ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে সংবিধান, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নীতি, বিধিমালা ও আইন প্রণয়ন, এমনকি আন্তর্জাতিক চুক্তির দায়বদ্ধতা—সর্বত্রই নারীর ক্ষমতার বিষয়টি তাত্ত্বিক পরিধিতে আবদ্ধ থেকেছে। লিঙ্গসমতা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

৫.
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথম করণীয় হলো প্রচলিত প্রথা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা এবং লিঙ্গবিভাজিত সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করার প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে এসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডে জাতীয় পর্যায়ে জেন্ডার-সমতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। মানবাধিকার ভোগ যেহেতু ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচার জন্য অপরিহার্য, তাই একে একটি অবিভাজ্য, অসমর্পণীয়, অহস্তান্তরযোগ্য এবং লিঙ্গনির্বিশেষে অভিন্ন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এই দর্শনের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৭৯ সালে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য নিরসন সনদ’ বা সিডও সনদ গৃহীত হয়। ১৯৮৪ সালে কিছু শর্ত সাপেক্ষে বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদ পরিগ্রহণ করলেও নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনের মৌলিক বিধিসংক্রান্ত ধারায় (ধারা ২, ধারা ১৬ আংশিক) সংরক্ষণ জারি করে, যা পরবর্তী সব সরকার অব্যাহত রেখেছে। এই সংরক্ষণের কারণে বাংলাদেশ সরকার নারীর প্রতি বৈষম্যের বেশ কিছু মৌলিক অন্তরায় নিরসনে দায়বদ্ধ নয়। উপরন্তু সিডওকে দেশের প্রচলিত আইনের সংযোজন হিসেবে গ্রহণ না করায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সিডও সনদ-পরিপন্থী কার্যক্রম বেআইনি বলে বিবেচিত হয় না।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে প্রায় ২৭ বছর আগে সিডও সনদ পরিগ্রহণ করলেও এ-যাবৎ কোনো সরকারই মৌলিক ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার, সিডওকে আইনি স্বীকৃতি এবং সনদ বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব প্রদান করেনি। মেয়াদি প্রতিবেদনে সিডও কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়াও উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

৬.
শুধু আইন ও প্রশাসনের মাধ্যমে কোনো সমাজ বা লিঙ্গ-অবস্থানের পরিবর্তন সম্ভব নয়; এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে অব্যাহত আন্দোলন। গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নৈতিক দাবি আদায়ে আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ উদাহরণ। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার দাবি থাকলেও নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হয়নি। নারীর সমতার আন্দোলনের ধারাটি কী ধরনের হওয়া উচিত, বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রায়নের সঙ্গে লিঙ্গ ও শ্রেণীবৈষম্যের কী রূপান্তর আবশ্যক, তা বাংলাদেশের সরব রাজনীতি ও মুখর বুদ্ধিজীবিতায় স্পষ্ট প্রকাশ পায়নি।
স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশকে একুশ শতকের উপযোগী একটি প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের নারীর অবদান ও সম্ভাবনার পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে এবং নারীর মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হিসেবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের জন্য অভিন্ন আইন, আইনের আশ্রয় এবং লিঙ্গ-সমতা স্থাপনের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার জন্য পরিবার, সরকার, সুশীল সমাজ ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, লিঙ্গ-সমতা কোনো দেশ বা সমাজের বিভিন্ন ইস্যু নয়, এটি যেকোনো প্রগতিশীল, উন্নত ও নৈতিক গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.