বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ by শওকত হোসেন বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ by শওকত হোসেন
বাংলাদেশ এগোচ্ছে। ১৯৭১ সালেই দেশের ‘সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে’ কেউ পারেনি। ৪০ বছর পর সেই মানুষ এখন ১৫ কোটি হয়ে গেছে। মানব উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। এগিয়েছে অর্থনীতিও। বাড়ছে প্রবৃদ্ধি, বেড়েছে মাথাপিছু আয়।
বাংলাদেশের মানুষ এখন গড়ে আগের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে, মেয়েরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশকে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হয়ে থাকতে হয়েছে। সেই বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে এখন লিখছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। বিশ্বে এখন ভারতের পরিচয় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে। আর বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি। এই দুই দেশ নিয়ে গত নভেম্বরে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘গত ২০ বছরে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় বেশি সম্পদশালী হয়েছে। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের মাথাপিছু আয় ১৯৯০ সালে ছিল ৬০ শতাংশ বেশি এবং ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯৮ শতাংশ বেশি। কিন্তু একই সময় বাংলাদেশ অনেকগুলো সামাজিক সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বেশির ভাগ সামাজিক সূচকেই বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে, যদিও দেশটির মাথাপিছু আয় ভারতের অর্ধেকেরও কম।’
বেড়েছে অর্থনীতির আকার: স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশের বেশি বাড়েনি। এর মধ্যে ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় পাঁচ শতাংশ হারে। এর পর থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে গেছে ছয় শতাংশ। সর্বশেষ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছিল চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সাত লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকার।
পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৪৭৬ ডলার, এখন ৭৫৫ ডলার। ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা, এখন তা ৫৩ হাজার ২৩৬ টাকা। ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) বাংলাদেশ এখন ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তালিকায় পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির হিসাবে বিশ্বের ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪২তম।
১৯৭২-৭৩ সময় সরকার রাজস্ব আয় করতে পেরেছিল মাত্র ২৮৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা আর রাজস্ব ব্যয় ছিল ২১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর এখন সরকারের রাজস্ব আয় এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫ টাকা এবং ব্যয় এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পরপর সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকার ’৭২-৭৩ সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হিসাবে ব্যয় করেছিল ৩১৪ কোটি টাকা, আর এবার ব্যয় হচ্ছে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সাহায্য নয়, বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশ: অধ্যাপক রেহমান সোবহান ১৯৮২ সালে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্যোগের মুখোমুখি। মনে হয়, সমাজ যেন আজ ঋণের টাকায় এবং ধার করা সময়ের ওপর বেঁচে আছে।...আমাদের দেশের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, আমদানি নীতিমালা, খাদ্যনীতি ইত্যাদি সবকিছুই ওয়াশিংটন, লন্ডন, বন, টোকিও ও রিয়াদের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং আমাদের সরকারকে বসে থাকতে হয় ওই রাজধানীগুলোর দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর।’
সত্তরের দশকে বাংলাদেশ ছিল পুরোপুরিই সাহায্যনির্ভর একটি দেশ। সাহায্যনির্ভরতা প্রকট হয় আশির দশকের পুরোটা সময়। সামরিক শাসন বাংলাদেশকে পরনির্ভর করতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের নেওয়া মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল জিডিপি প্রায় ছয় শতাংশ। এর বিপরীতে সে সময় রপ্তানি আয় ছিল জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশের সামান্য বেশি, প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স ছিল আরও কম, প্রায় দুই শতাংশ।
নব্বইয়ের দশকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করে। বাড়তে থাকে বাণিজ্যনির্ভরতা। নব্বইয়ের দশকে সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল, পরবর্তী দশকে এসে তা অনেকটাই সংহত হয়েছে। ফলে এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে হয়েছে ১৮ ও রেমিট্যান্স প্রায় নয় শতাংশ।
মানবসম্পদে বাংলাদেশ: অর্থনীতির চেয়েও বাংলাদেশ বেশি এগিয়েছে মানব উন্নয়নে। ইউএনডিপি মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করছে ১৯৯০ সাল থেকে। সে সময় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৫৫ বছর দুই মাস। এখন মানুষ বাঁচছে ৬৮ বছর নয় মাস।
১৯৯১ সালেও কম ওজন নিয়ে জন্ম নিত ৬৬ শতাংশ শিশু, সেই সংখ্যা এখন ৪৫। ’৯১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৪৬ জন, এখন তা কমে হয়েছে ৫০ জন। ’৯১ সালে প্রতি হাজারে ৯২ জন নবজাতক মারা যেত, এখন মারা যায় ৩৯ জন। আর ’৯০-এ প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল এক লাখে ৫৭৪ জন, এখন তা কমে হয়েছে ১৯৪ জন।
কেবল স্বাস্থ্যেই নয়, শিক্ষায়ও এগিয়েছে বাংলাদেশ। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০১৫ না হলেও ২০১৭ সালে সব কয়টি লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আশা বাংলাদেশের।
তবুও বৈষম্য: ৪১ বছর আগে স্বাধীনতার মাধ্যমে এ দেশের মানুষ তাদের জীবনের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিল। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল মারাত্মক বৈষম্যের শিকার। জীবন অবস্থার পরিবর্তনের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন ছিল, স্বাধীন না হলে তা পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। ফলে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল সব শ্রেণীর, সব পেশার মানুষদের। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সেই বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। আবার এগিয়ে যাওয়ার উল্টো চিত্রও আছে। বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েও যেন পিছিয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র থেকে এমনটিই অনেকে বলছেন। যদিও বৈষম্য থেকে রেহাই পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই বাংলাদেশের সৃষ্টি।
বৈষম্যের চিত্রটি এখন কী রকম? খানা আয় ও ব্যয় সমীক্ষা ২০১০ অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে সাড়ে আট শতাংশ। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৮০ শতাংশ মানুষ, আর ২০১০ সালে বাস করে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে দারিদ্র্য যে হারে কমেছে, বৈষম্য বেড়েছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে। দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচে থাকে যে পাঁচ শতাংশ মানুষ, মোট আয়ে তাদের অংশ মাত্র দশমিক ৭৮ শতাংশ। অথচ একই সময় সর্বোচ্চ ধনী পাঁচ শতাংশের আয় প্রায় ২৫ শতাংশ। ৪১ বছর ধরে বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতির চাপ। বিভিন্ন সময় মূল্যস্ফীতির চাপের কারণেই বাড়ছে আয়বৈষম্য। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ। ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির সুফল সবাইকে পৌঁছে দেওয়াটাই ৪১ বছর পরেও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশকে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হয়ে থাকতে হয়েছে। সেই বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে এখন লিখছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। বিশ্বে এখন ভারতের পরিচয় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে। আর বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি। এই দুই দেশ নিয়ে গত নভেম্বরে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘গত ২০ বছরে ভারত বাংলাদেশের তুলনায় বেশি সম্পদশালী হয়েছে। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের মাথাপিছু আয় ১৯৯০ সালে ছিল ৬০ শতাংশ বেশি এবং ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯৮ শতাংশ বেশি। কিন্তু একই সময় বাংলাদেশ অনেকগুলো সামাজিক সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বেশির ভাগ সামাজিক সূচকেই বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে, যদিও দেশটির মাথাপিছু আয় ভারতের অর্ধেকেরও কম।’
বেড়েছে অর্থনীতির আকার: স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশের বেশি বাড়েনি। এর মধ্যে ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় পাঁচ শতাংশ হারে। এর পর থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে গেছে ছয় শতাংশ। সর্বশেষ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছিল চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সাত লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকার।
পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৪৭৬ ডলার, এখন ৭৫৫ ডলার। ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা, এখন তা ৫৩ হাজার ২৩৬ টাকা। ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) বাংলাদেশ এখন ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তালিকায় পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির হিসাবে বিশ্বের ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪২তম।
১৯৭২-৭৩ সময় সরকার রাজস্ব আয় করতে পেরেছিল মাত্র ২৮৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা আর রাজস্ব ব্যয় ছিল ২১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর এখন সরকারের রাজস্ব আয় এক লাখ ১৮ হাজার ৩৮৫ টাকা এবং ব্যয় এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পরপর সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকার ’৭২-৭৩ সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হিসাবে ব্যয় করেছিল ৩১৪ কোটি টাকা, আর এবার ব্যয় হচ্ছে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সাহায্য নয়, বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশ: অধ্যাপক রেহমান সোবহান ১৯৮২ সালে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্যোগের মুখোমুখি। মনে হয়, সমাজ যেন আজ ঋণের টাকায় এবং ধার করা সময়ের ওপর বেঁচে আছে।...আমাদের দেশের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, আমদানি নীতিমালা, খাদ্যনীতি ইত্যাদি সবকিছুই ওয়াশিংটন, লন্ডন, বন, টোকিও ও রিয়াদের রাজনৈতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং আমাদের সরকারকে বসে থাকতে হয় ওই রাজধানীগুলোর দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর।’
সত্তরের দশকে বাংলাদেশ ছিল পুরোপুরিই সাহায্যনির্ভর একটি দেশ। সাহায্যনির্ভরতা প্রকট হয় আশির দশকের পুরোটা সময়। সামরিক শাসন বাংলাদেশকে পরনির্ভর করতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের নেওয়া মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল জিডিপি প্রায় ছয় শতাংশ। এর বিপরীতে সে সময় রপ্তানি আয় ছিল জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশের সামান্য বেশি, প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স ছিল আরও কম, প্রায় দুই শতাংশ।
নব্বইয়ের দশকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করে। বাড়তে থাকে বাণিজ্যনির্ভরতা। নব্বইয়ের দশকে সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর বাংলাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল, পরবর্তী দশকে এসে তা অনেকটাই সংহত হয়েছে। ফলে এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ, অন্যদিকে রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে হয়েছে ১৮ ও রেমিট্যান্স প্রায় নয় শতাংশ।
মানবসম্পদে বাংলাদেশ: অর্থনীতির চেয়েও বাংলাদেশ বেশি এগিয়েছে মানব উন্নয়নে। ইউএনডিপি মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করছে ১৯৯০ সাল থেকে। সে সময় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৫৫ বছর দুই মাস। এখন মানুষ বাঁচছে ৬৮ বছর নয় মাস।
১৯৯১ সালেও কম ওজন নিয়ে জন্ম নিত ৬৬ শতাংশ শিশু, সেই সংখ্যা এখন ৪৫। ’৯১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৪৬ জন, এখন তা কমে হয়েছে ৫০ জন। ’৯১ সালে প্রতি হাজারে ৯২ জন নবজাতক মারা যেত, এখন মারা যায় ৩৯ জন। আর ’৯০-এ প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল এক লাখে ৫৭৪ জন, এখন তা কমে হয়েছে ১৯৪ জন।
কেবল স্বাস্থ্যেই নয়, শিক্ষায়ও এগিয়েছে বাংলাদেশ। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০১৫ না হলেও ২০১৭ সালে সব কয়টি লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আশা বাংলাদেশের।
তবুও বৈষম্য: ৪১ বছর আগে স্বাধীনতার মাধ্যমে এ দেশের মানুষ তাদের জীবনের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিল। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল মারাত্মক বৈষম্যের শিকার। জীবন অবস্থার পরিবর্তনের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন ছিল, স্বাধীন না হলে তা পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। ফলে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল সব শ্রেণীর, সব পেশার মানুষদের। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সেই বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। আবার এগিয়ে যাওয়ার উল্টো চিত্রও আছে। বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েও যেন পিছিয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র থেকে এমনটিই অনেকে বলছেন। যদিও বৈষম্য থেকে রেহাই পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই বাংলাদেশের সৃষ্টি।
বৈষম্যের চিত্রটি এখন কী রকম? খানা আয় ও ব্যয় সমীক্ষা ২০১০ অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে সাড়ে আট শতাংশ। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৮০ শতাংশ মানুষ, আর ২০১০ সালে বাস করে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে দারিদ্র্য যে হারে কমেছে, বৈষম্য বেড়েছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে। দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচে থাকে যে পাঁচ শতাংশ মানুষ, মোট আয়ে তাদের অংশ মাত্র দশমিক ৭৮ শতাংশ। অথচ একই সময় সর্বোচ্চ ধনী পাঁচ শতাংশের আয় প্রায় ২৫ শতাংশ। ৪১ বছর ধরে বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতির চাপ। বিভিন্ন সময় মূল্যস্ফীতির চাপের কারণেই বাড়ছে আয়বৈষম্য। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ। ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির সুফল সবাইকে পৌঁছে দেওয়াটাই ৪১ বছর পরেও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
No comments