বিজ্ঞাপন তেলেসমাতি -গণমাধ্যম by শাহদীন মালিক
আমাদের ইদানীংকালের ‘মুক্তবাজার’ অর্থনীতিতে বিজ্ঞাপন বাজারও ভীষণভাবে ‘মুক্ত’।
দেশের লক্ষ মানুষের মতো আমি পত্রিকা পড়ি, টিভি চ্যানেল দেখি, আর আজকাল মাঝেমধ্যে এফএম রেডিও শুনি। সব দেশেই মিডিয়ার প্রাণ-সঞ্জিবনী হলো বিজ্ঞাপন। এটাই স্বাভাবিক। দুনিয়ার সব দেশেই টেলিভিশন দেখতে হলে বিজ্ঞাপন দেখতে হবে, পত্রিকা পড়তে হলে বিজপনেও চোখ পড়বে।
বিজ্ঞাপন অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং আবশ্যকীয়। বাড়ি, গাড়ি, টেলিভিশন, প্লট কিনতে আমরা সবাই, যাকে বলে, বিজ্ঞাপনের দারস্থ হই। হতেই হবে। মুক্তবাজারের মুক্ত বিজ্ঞাপনের যৌক্তিকতা সহজ ও সরল। কোনো পণ্য ক্রয়ের আগে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে খরিদদার গুণগতমান, মূল্য ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে নিজের প্রয়োজন ও পকেটের স্বাস্থ্য অনুযায়ী সঠিক জিনিসটি বেছে নেবে।
উত্তম ব্যবস্থা। তবে ‘কিন্তু’ আছে। অনেক দেশে, বিশেষত উন্নত দেশে, বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করার সংস্থা থাকে—সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের। মনগড়া বিজ্ঞাপনে খদ্দের বা ক্রেতা যাতে প্রতারিত না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য।
অবশ্য ইদানীং আমাদের প্রেক্ষাপটে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটা পড়ে অনেক পাঠকের চোখে যদি মাননীয় বাণিজ্য মন্ত্রীর চেহারা ভেসে ওঠে, তাহলে দুষিব কেমনে? অবশ্য গত কয়েক দিন বাজার নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত মাননীয় মন্ত্রীর আশ্বাসবাণী টিভি চ্যানেলের খবরগুলোয় শুনতে না পেরে ভীষণ উত্কণ্ঠায় ছিলাম। বাজার নিয়ন্ত্রণের আর কোনো ব্যবস্থাই কি সরকার নিচ্ছে না। উত্কণ্ঠা দূর হলো যখন সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে জানলাম, মন্ত্রী মহোদয় দেশের বাইরে। দেশে ফিরে এসে নিশ্চয়ই ত্বরিতগতিতে এবং সব চ্যানেলের মাধ্যমে আমাদের আবার আশ্বস্ত করবেন।
বিজ্ঞাপনবাজার নিয়ন্ত্রণে কেউ আছে বলে জানা নেই। ১৯ অক্টোবরের প্রথম আলোর ১১ পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখলাম, বড় বড় ১৫টা বিজ্ঞাপন, তার প্রায় অর্ধেকই ইউকে ভিসাসংক্রান্ত—ভাবখানা বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানটির দুয়ারে পা রাখলেই ইউকের কলেজে ভর্তি, তারপর ভিসাসংক্রান্ত ঝুটঝামেলা আপনার হয়ে অতি আগ্রহে নিজ ঘাড়ে নিয়ে নেবে বিজ্ঞানদাতা প্রতিষ্ঠানটি। পুরো পত্রিকায় গোটাবিশেক এ ধরনের লোভনীয় ‘অফার’।
ছোটবেলার পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম—‘সদা সত্য কথা বলিবে’। সেটা ছিল সেকাল, এখন একাল। বিজ্ঞাপন দেখি চ্যানেলে, শুনি রেডিওতে—একটা পানীয় পান করলে সঙ্গে সঙ্গে সত্যি কথা, তা যতটাই বেফাস হোক না কেন, বলা শুরু হয়ে যাবে। বাচ্চাদের নৈতিকা শেখানোর বোধহয় আর দরকার নেই। একটা টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলেই বাচ্চারা সত্যি কথা বলে। এত প্রসাধনীতে চামড়া ফর্সা হওয়ার কথা এতকাল থেকে বলা হচ্ছে যে আমরা সবাই কেন এখনো ইউরোপ-আমেরিকার লোকজনের মতো সাদা চামড়ার হয়ে গেলাম না, তার সদুত্তর খুঁজতে হবে।
আর একটা কিনলে তিনটা ফ্রি পাবেন এমন জিনিসে তো বাজার সয়লাব। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ—আমার টেলিভিশনটা এখন ‘ঐতিহ্যবাহী’র পর্যায়ভুক্ত হতে চলেছে, বয়স তার ১৪ বছর। একটা ফ্ল্যাটও কেনা হয়ে ওঠেনি। তাই তক্কে তক্কে আছি—যখন বিজ্ঞাপন দেখব টেলিভিশন সেট কিনলে সঙ্গে পাবা ‘ফ্রি’ ফ্ল্যাট, সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়ব। টেলিভিশন কিনে ফ্ল্যাট পাব। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এমন মোক্ষম সুযোগ যদি আসে, মোটেই হাতছাড়া করব না। সেই আশায় প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন পড়ি, দেখি, শুনি।
শুধু ইউকে নয়, অন্যান্য দেশে যাওয়ার অতি সহজ-সস্তা পন্থার বিজ্ঞাপন এন্তার চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপিত অনেক দেশেই গিখেছি, তবে সবচেয়ে বেশিবার বোধহয় ইংল্যান্ডে—প্রথম ১৯৭৬ সালের জুলাই-আগস্টে, সপ্তাহ দুয়ের জন্য। ইদানীং টিভি চ্যানেলের খবরে রিপোর্ট দেখেছি, কীভাবে স্টুডেন্ট ভিসায় যাওয়া ছেলেরা প্রায় না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সাতসমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দেওয়ার আগে এই ছেলেদের আসল কথা বলার কেউ নেই। তাদের সম্ভবত একমাত্র সম্বল অর্থাত্ তথ্য ছিল বিজ্ঞাপন।
আর সব বাবা-মায়ের বোধহয় এখন উচিত হবে, বিজ্ঞাপিত টুথপেস্ট দিয়ে বাচ্চাদের দাঁতমাজা নিশ্চিত করা। তাতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে সত্য কথা বলার জন্য বিশেষ পানীয়টি পান করানো, ঠেসে খাওয়াবেন।
দু-একটা টিভি চ্যানেলে ‘খানকা শরিফ’ নাকি ‘মাজার শরিফ’-এর বিজ্ঞাপনও চোখে পড়েছে। ‘ওরস মোবারক’ তো কমন। আরও চোখে পড়ে ‘বার এট ল ডিগ্রি’ লাভ। যতদূর জানি ও বুঝি—ডিগ্রি দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। বার এই ল ডিগ্রিটা কোন বিশ্ববিদ্যালয় দেয় তার হদিস এখনো পাইনি। আর সেকেলে বলেই বোধহয় আইনটাকে পেশা হিসেবে জানি। আমাদের ওকালতিসংক্রান্ত আইনে বলা আছে যে এটা পেশা, ব্যবসা নয়। সে জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া নিষেধ। ধর্ম যেমন ব্যবসা হয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রেই, সেভাবেই হয়তো আমাদের পেশাটাও ব্যবসা হয়ে গেছে।
এক কথা, দু কথা থেকে অনেক কথা চলে আসে। বিচারকদের ভিজিটিং কার্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের লাল-সবুজ সিলটি থাকে। অনেকটা যার জন্য চুরি করি, সেই বলে ‘চোর’! অর্ধেক দশক ধরে আধা ডজন মামলা করলাম—নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মামলা, যেগুলোকে ভদ্র ভাষায় সবাই বলে ‘জনস্বার্থে মামলা’—নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথক করার জন্য। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই পৃথককরণ সাধিত হয়েছে। কিন্তু বিচারকেরা অন্তত অনেকেই নিজেদের সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া বোধহয় অন্য কোনো কিছু ভাবতে রাজি নয়। ভিজিটিং কার্ডে সরকারের সিল ছাড়াও বাসার নম্বর, মোবাইল নম্বর সবই পাওয়া যায় অনেকের। বিজ্ঞাপন ‘প্রলোভন’ হয়ে হয়ে যাচ্ছে। খেয়াল রাখার কেউ নেই।
২
গত এক সপ্তাহে বসুন্ধরার বিজ্ঞাপনের বন্যায় দেশ সয়লাব হওয়ার উপক্রম। প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশকদের যে এত পারদর্শিতা, তা এতকালে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বসুন্ধরার বিজ্ঞাপন থেকে ‘অবগত হইলাম’ (!) যে উনারা দেশের পোলট্রিসহ বৃহত্ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের চক্রান্তকারী; ওয়ান ইলেভেনের রূপকার; আর তার থেকে অনেক বড় পারদর্শিতা হলো, মাস পাঁচেক আগের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে যে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল, সেটার অগ্নিসংযোগকারী!
শুধু বিজ্ঞাপন নয়, আগুন লাগানোর অপরাধে অভিযুক্ত করে মামলাও নিয়ে গিয়েছিলেন আদালতে।
টাকা-পয়সা থাকলে সুযোগ-সুবিধা যে অনেক সেটা তো আজকাল শিশুরাও বোঝে। হাজার হলেও তারাও তো মুক্তবাজারের যুগে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছে। আর অর্থ-বৈভব যদি অঢেল হয়, তাহলে দেশের সব পত্রিকায়, চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ছাপানো যায়। প্রথম আলোকে শায়েস্তা করার এই ‘বিজ্ঞাপনী পন্থা’ এখন বসুন্ধরা গ্রুপ জোরেশোরে এস্তেমাল করছে।
আজকাল সরকারই আইনের তোয়াক্কা করে না, তাই বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আইন-নৈতিকতা মেনে চলবে—সে প্রত্যাশার গুড়ে বালি। বলা বাহুল্য বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আছে যারা আইন ও নিয়নকানুন মেনে চলে।
প্রথম আলোর বসুন্ধরাবিরোধী রিপোর্টে অসত্য থাকলে বসুন্ধরা প্রতিবাদ পাঠাতে পারত, প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারত। কোর্টেও যেতে পারত। অবশ্য এখন আমাকেও আগুনদাতা, ষড়যন্ত্রকারী বলে আগামীকাল আধা ডজন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপায় যে শাহদীন মালিক পাগল বা বিদেশি দালাল বা দেশের শত্রু, তাহলে আমার কি-ই বা করার আছে।
বসুন্ধরা বিজ্ঞাপনের অব্যবহারের নতুন একটা মাত্রা দেশের মিডিয়ায় যোগ করেছে।
অবশ্য সম্পূর্ণ নতুনই বলি কীভাবে। বিশেষত, বিটিভির খবরের তুলনায় অন্যান্য চ্যানেলে খবর দেখার মধ্যে অনেক সময় ধরে বিজ্ঞাপন। আর বিটিভির খবর তো পুরোটাই সরকারের বিজ্ঞাপন। অবশ্য কিছু চ্যানেল মনে হচ্ছে এখন সরকারেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। খবরের নামে কিছু টিভি চ্যানেলের মালিক তাদের স্ব স্ব চ্যানেলে অহরহ বিজ্ঞাপিত হচ্ছেন। বিটিভিতে খবর নামক বিজ্ঞাপনের জন্য যেমন সরকারের কোনো পয়সা খরচ হয় না, তেমনি মালিকেরা তাঁদের নিজেদের ঢাকঢোল পেটানোকে আজকাল মনে করা হয় ‘টিভি খবর’ বাহ্ বেশ!!
শাহদীন মালিক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
দেশের লক্ষ মানুষের মতো আমি পত্রিকা পড়ি, টিভি চ্যানেল দেখি, আর আজকাল মাঝেমধ্যে এফএম রেডিও শুনি। সব দেশেই মিডিয়ার প্রাণ-সঞ্জিবনী হলো বিজ্ঞাপন। এটাই স্বাভাবিক। দুনিয়ার সব দেশেই টেলিভিশন দেখতে হলে বিজ্ঞাপন দেখতে হবে, পত্রিকা পড়তে হলে বিজপনেও চোখ পড়বে।
বিজ্ঞাপন অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং আবশ্যকীয়। বাড়ি, গাড়ি, টেলিভিশন, প্লট কিনতে আমরা সবাই, যাকে বলে, বিজ্ঞাপনের দারস্থ হই। হতেই হবে। মুক্তবাজারের মুক্ত বিজ্ঞাপনের যৌক্তিকতা সহজ ও সরল। কোনো পণ্য ক্রয়ের আগে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে খরিদদার গুণগতমান, মূল্য ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করে নিজের প্রয়োজন ও পকেটের স্বাস্থ্য অনুযায়ী সঠিক জিনিসটি বেছে নেবে।
উত্তম ব্যবস্থা। তবে ‘কিন্তু’ আছে। অনেক দেশে, বিশেষত উন্নত দেশে, বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করার সংস্থা থাকে—সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের। মনগড়া বিজ্ঞাপনে খদ্দের বা ক্রেতা যাতে প্রতারিত না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য।
অবশ্য ইদানীং আমাদের প্রেক্ষাপটে ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটা পড়ে অনেক পাঠকের চোখে যদি মাননীয় বাণিজ্য মন্ত্রীর চেহারা ভেসে ওঠে, তাহলে দুষিব কেমনে? অবশ্য গত কয়েক দিন বাজার নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত মাননীয় মন্ত্রীর আশ্বাসবাণী টিভি চ্যানেলের খবরগুলোয় শুনতে না পেরে ভীষণ উত্কণ্ঠায় ছিলাম। বাজার নিয়ন্ত্রণের আর কোনো ব্যবস্থাই কি সরকার নিচ্ছে না। উত্কণ্ঠা দূর হলো যখন সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে জানলাম, মন্ত্রী মহোদয় দেশের বাইরে। দেশে ফিরে এসে নিশ্চয়ই ত্বরিতগতিতে এবং সব চ্যানেলের মাধ্যমে আমাদের আবার আশ্বস্ত করবেন।
বিজ্ঞাপনবাজার নিয়ন্ত্রণে কেউ আছে বলে জানা নেই। ১৯ অক্টোবরের প্রথম আলোর ১১ পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখলাম, বড় বড় ১৫টা বিজ্ঞাপন, তার প্রায় অর্ধেকই ইউকে ভিসাসংক্রান্ত—ভাবখানা বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানটির দুয়ারে পা রাখলেই ইউকের কলেজে ভর্তি, তারপর ভিসাসংক্রান্ত ঝুটঝামেলা আপনার হয়ে অতি আগ্রহে নিজ ঘাড়ে নিয়ে নেবে বিজ্ঞানদাতা প্রতিষ্ঠানটি। পুরো পত্রিকায় গোটাবিশেক এ ধরনের লোভনীয় ‘অফার’।
ছোটবেলার পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম—‘সদা সত্য কথা বলিবে’। সেটা ছিল সেকাল, এখন একাল। বিজ্ঞাপন দেখি চ্যানেলে, শুনি রেডিওতে—একটা পানীয় পান করলে সঙ্গে সঙ্গে সত্যি কথা, তা যতটাই বেফাস হোক না কেন, বলা শুরু হয়ে যাবে। বাচ্চাদের নৈতিকা শেখানোর বোধহয় আর দরকার নেই। একটা টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলেই বাচ্চারা সত্যি কথা বলে। এত প্রসাধনীতে চামড়া ফর্সা হওয়ার কথা এতকাল থেকে বলা হচ্ছে যে আমরা সবাই কেন এখনো ইউরোপ-আমেরিকার লোকজনের মতো সাদা চামড়ার হয়ে গেলাম না, তার সদুত্তর খুঁজতে হবে।
আর একটা কিনলে তিনটা ফ্রি পাবেন এমন জিনিসে তো বাজার সয়লাব। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ—আমার টেলিভিশনটা এখন ‘ঐতিহ্যবাহী’র পর্যায়ভুক্ত হতে চলেছে, বয়স তার ১৪ বছর। একটা ফ্ল্যাটও কেনা হয়ে ওঠেনি। তাই তক্কে তক্কে আছি—যখন বিজ্ঞাপন দেখব টেলিভিশন সেট কিনলে সঙ্গে পাবা ‘ফ্রি’ ফ্ল্যাট, সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়ব। টেলিভিশন কিনে ফ্ল্যাট পাব। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এমন মোক্ষম সুযোগ যদি আসে, মোটেই হাতছাড়া করব না। সেই আশায় প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন পড়ি, দেখি, শুনি।
শুধু ইউকে নয়, অন্যান্য দেশে যাওয়ার অতি সহজ-সস্তা পন্থার বিজ্ঞাপন এন্তার চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপিত অনেক দেশেই গিখেছি, তবে সবচেয়ে বেশিবার বোধহয় ইংল্যান্ডে—প্রথম ১৯৭৬ সালের জুলাই-আগস্টে, সপ্তাহ দুয়ের জন্য। ইদানীং টিভি চ্যানেলের খবরে রিপোর্ট দেখেছি, কীভাবে স্টুডেন্ট ভিসায় যাওয়া ছেলেরা প্রায় না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সাতসমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দেওয়ার আগে এই ছেলেদের আসল কথা বলার কেউ নেই। তাদের সম্ভবত একমাত্র সম্বল অর্থাত্ তথ্য ছিল বিজ্ঞাপন।
আর সব বাবা-মায়ের বোধহয় এখন উচিত হবে, বিজ্ঞাপিত টুথপেস্ট দিয়ে বাচ্চাদের দাঁতমাজা নিশ্চিত করা। তাতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে সত্য কথা বলার জন্য বিশেষ পানীয়টি পান করানো, ঠেসে খাওয়াবেন।
দু-একটা টিভি চ্যানেলে ‘খানকা শরিফ’ নাকি ‘মাজার শরিফ’-এর বিজ্ঞাপনও চোখে পড়েছে। ‘ওরস মোবারক’ তো কমন। আরও চোখে পড়ে ‘বার এট ল ডিগ্রি’ লাভ। যতদূর জানি ও বুঝি—ডিগ্রি দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। বার এই ল ডিগ্রিটা কোন বিশ্ববিদ্যালয় দেয় তার হদিস এখনো পাইনি। আর সেকেলে বলেই বোধহয় আইনটাকে পেশা হিসেবে জানি। আমাদের ওকালতিসংক্রান্ত আইনে বলা আছে যে এটা পেশা, ব্যবসা নয়। সে জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া নিষেধ। ধর্ম যেমন ব্যবসা হয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রেই, সেভাবেই হয়তো আমাদের পেশাটাও ব্যবসা হয়ে গেছে।
এক কথা, দু কথা থেকে অনেক কথা চলে আসে। বিচারকদের ভিজিটিং কার্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের লাল-সবুজ সিলটি থাকে। অনেকটা যার জন্য চুরি করি, সেই বলে ‘চোর’! অর্ধেক দশক ধরে আধা ডজন মামলা করলাম—নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মামলা, যেগুলোকে ভদ্র ভাষায় সবাই বলে ‘জনস্বার্থে মামলা’—নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথক করার জন্য। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই পৃথককরণ সাধিত হয়েছে। কিন্তু বিচারকেরা অন্তত অনেকেই নিজেদের সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া বোধহয় অন্য কোনো কিছু ভাবতে রাজি নয়। ভিজিটিং কার্ডে সরকারের সিল ছাড়াও বাসার নম্বর, মোবাইল নম্বর সবই পাওয়া যায় অনেকের। বিজ্ঞাপন ‘প্রলোভন’ হয়ে হয়ে যাচ্ছে। খেয়াল রাখার কেউ নেই।
২
গত এক সপ্তাহে বসুন্ধরার বিজ্ঞাপনের বন্যায় দেশ সয়লাব হওয়ার উপক্রম। প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশকদের যে এত পারদর্শিতা, তা এতকালে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বসুন্ধরার বিজ্ঞাপন থেকে ‘অবগত হইলাম’ (!) যে উনারা দেশের পোলট্রিসহ বৃহত্ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের চক্রান্তকারী; ওয়ান ইলেভেনের রূপকার; আর তার থেকে অনেক বড় পারদর্শিতা হলো, মাস পাঁচেক আগের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে যে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল, সেটার অগ্নিসংযোগকারী!
শুধু বিজ্ঞাপন নয়, আগুন লাগানোর অপরাধে অভিযুক্ত করে মামলাও নিয়ে গিয়েছিলেন আদালতে।
টাকা-পয়সা থাকলে সুযোগ-সুবিধা যে অনেক সেটা তো আজকাল শিশুরাও বোঝে। হাজার হলেও তারাও তো মুক্তবাজারের যুগে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছে। আর অর্থ-বৈভব যদি অঢেল হয়, তাহলে দেশের সব পত্রিকায়, চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ছাপানো যায়। প্রথম আলোকে শায়েস্তা করার এই ‘বিজ্ঞাপনী পন্থা’ এখন বসুন্ধরা গ্রুপ জোরেশোরে এস্তেমাল করছে।
আজকাল সরকারই আইনের তোয়াক্কা করে না, তাই বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আইন-নৈতিকতা মেনে চলবে—সে প্রত্যাশার গুড়ে বালি। বলা বাহুল্য বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আছে যারা আইন ও নিয়নকানুন মেনে চলে।
প্রথম আলোর বসুন্ধরাবিরোধী রিপোর্টে অসত্য থাকলে বসুন্ধরা প্রতিবাদ পাঠাতে পারত, প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারত। কোর্টেও যেতে পারত। অবশ্য এখন আমাকেও আগুনদাতা, ষড়যন্ত্রকারী বলে আগামীকাল আধা ডজন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপায় যে শাহদীন মালিক পাগল বা বিদেশি দালাল বা দেশের শত্রু, তাহলে আমার কি-ই বা করার আছে।
বসুন্ধরা বিজ্ঞাপনের অব্যবহারের নতুন একটা মাত্রা দেশের মিডিয়ায় যোগ করেছে।
অবশ্য সম্পূর্ণ নতুনই বলি কীভাবে। বিশেষত, বিটিভির খবরের তুলনায় অন্যান্য চ্যানেলে খবর দেখার মধ্যে অনেক সময় ধরে বিজ্ঞাপন। আর বিটিভির খবর তো পুরোটাই সরকারের বিজ্ঞাপন। অবশ্য কিছু চ্যানেল মনে হচ্ছে এখন সরকারেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। খবরের নামে কিছু টিভি চ্যানেলের মালিক তাদের স্ব স্ব চ্যানেলে অহরহ বিজ্ঞাপিত হচ্ছেন। বিটিভিতে খবর নামক বিজ্ঞাপনের জন্য যেমন সরকারের কোনো পয়সা খরচ হয় না, তেমনি মালিকেরা তাঁদের নিজেদের ঢাকঢোল পেটানোকে আজকাল মনে করা হয় ‘টিভি খবর’ বাহ্ বেশ!!
শাহদীন মালিক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
No comments